সাহিত্যের মান বিতর্ক
|| কাজী জহিরুল ইসলাম ||
সাহিত্যের মান নিয়ে কথা বলতে গেলে প্রায়শই একটি বিতর্ক অবধারিতভাবে উঠে আসে। সেটি হচ্ছে ‘সাহিত্যের মান কে বিচার করবে? মহাকালই বলে দেবে কোনটা ভালো সাহিত্য আর কোনটা ভালো সাহিত্য নয়।’ যারা এই বিতর্ক তোলেন তাদের অনেকেই ন্যুনতম মান সম্পর্কে অবহিত নন, অথবা জেনেও না জানার ভান করেন। ভান এজন্য করেন কারণ তাদের নিজেদের সাহিত্যের অবস্থান ন্যুনতম মানের নিচে। সেটি তারা জানেন এবং তা এড়িয়ে যাওয়ার জন্যই মহাকালকে অন্ধকার থেকে টেনে আনার চেষ্টা করেন। আমরা যে মহাকালের দোহাই দেই, সেই মহাকাল মহাশয় কেবলমাত্র মানোত্তীর্ণ সাহিত্যকেই তাঁর টেবিলের ওপর রেখে বিচার করবেন। কোন জায়গা থেকে কয়টা লাইন রাখবেন আর কোন অংশটা অন্ধকারে ছুঁড়ে ফেলবেন সেই বিচার তিনি করবেন শুধুমাত্র মানোত্তীর্ণ সাহিত্যের মধ্য থেকেই। ন্যুনতম মানের নিচে যেগুলোর অবস্থান সেগুলো বিবেচনার জন্য মহাকাল মহাশয়ের টেবিল অব্দিও পৌঁছুবে না। ন্যুনতম মান কি? এটা নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। একটি উদাহরণ দিই। মানের সঙ্গে কিন্তু কালের একটি সম্পর্ক আছে। একসময় মানুষ কাঁচা মাংস খেত, এরপর পুড়িয়ে, এরপর মশলা দিয়ে রান্না করে। ছাল-বাকলে রেখে খেত একসময়, এরপর পাতায়, খুব নিকট অতীতেও মানুষ কলাপাতায় খেয়েছে, কোনো কোনো সম্প্রদায় এখনো খায়। মাটির পাত্রে খাওয়ার প্রচলন তো এখন আবার স্বাস্থ্যসম্মত বলে ফিরে আসছে। কিন্তু এইকালে খাবার গ্রহনের জন্য ন্যুনতম একটি থালা লাগে। সেটি টিনের, মাটির, প্লাটিকের বা সিরামিকের যাই হোক না কেন। থালায় খাবার নিয়ে দাঁড়িয়ে, চেয়ারে বা মাটিতে বসে খেতে পারি কিন্তু খাবারটা যদি থালায় না দিয়ে টেবিলের ওপর ঢেলে দেওয়া হয় তাহলে কেমন হবে? এই যে খাওয়ার জন্য একটি থালা দরকার এটাই হচ্ছে ন্যুনতম মান। এবার কার মান কত উন্নত সেটা নির্ভর করছে কে কেমন থালায় খাবার পরিবেশন করছে তার ওপর। এখানে আপনি মহাকাল মহাশয়কে ডেকে হয়ত জিজ্ঞেস করতে পারেন কোন থালাটা স্বাস্থ্যসম্মত ছিল, এবং অনাগত কাল কোন থালাটাকে তার কালের মানুষের হাতে তুলে দেবে, সৌন্দর্যও বিবেচনায় আসতে পারে, আসতে পারে টেকসইয়ের ব্যাপারটিও।
আমরা যেমন পুঁথিগত বিদ্যা থেকে ‘মান, মান’ বলে চেঁচাই, যারা ‘মহাকাল মান ঠিক করবে’ বলেন, তারাও তো পুঁথিগত বিদ্যা থেকেই বা উদ্দেশ্যমূলকভাবে মহাকালের দোহাই দেন। সভ্যতা কোথায় যাবে তা অনুমান করার জন্য যেমন সভ্যতার ইতিহাস জানা দরকার, সাহিত্যের মান কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে এবং কখন কোথায় গিয়ে পৌঁছুতে পারে তা বোঝার জন্যও সাহিত্যের ধারাবাহিক ইতিহাস জানা দরকার। এই জানার মধ্য দিয়ে আমরা প্রত্যেকে নিজেই ঠিক করতে পারবো ‘মান’ জিনিসটা কী। তখন আর কারো বই পড়ে পুঁথিগত বিদ্যার জোরে তোতাপাখির মত ‘মান’ সম্পর্কিত কুতর্কে জড়িয়ে পক্ষ-বিপক্ষ নিতে হবে না। আর একটি জিনিস, সাহিত্যে সৎ হওয়া খুব দরকার। না জানা বা অল্প জানায় কোনো সমস্যা নেই, সমস্যা হল অসততায়। দুটি কারণে মানুষ অসততা করে, একটি হচ্ছে প্রাপ্তির প্রত্যাশা, অন্যটি হারানোর ভয়। প্রাণহানির আশঙ্কা থেকে কেউ যদি অসততা করে (বন্দুকের মুখে বাধ্য হয়ে কারো বিরুদ্ধে অনৈতিক কথা বলা বা লেখা বা কারো চাটুকারিতা করে লেখা) সেটিকে আমি ততটা দোষ দেই না। তেমন সাহসী লেখক বঙ্গদেশে কই, যিনি জান গেলেও অসত্য কথা লিখবেন না। অসততা মানকে বিভ্রান্ত করে। এই জায়গাটিতে অবশ্য মহাকাল মহাশয়কে অন্ধকার থেকে ডেকে আনতে পারেন, তিনি হয়ত এর একটি বিহিত করবেন।
পুঁথিগত বিদ্যা কোনো কাজের জিনিস নয়। মানুষকে বই পড়তে হয়, বই পড়ে গ্রন্থের জ্ঞান আত্মস্থ করে নিজের জ্ঞানকে শানিত করতে হয়। এটিই বই পড়ার মূল লক্ষ্য। গ্রন্থে বর্ণিত বাক্যের উদ্ধৃতি নেহায়েতই দরকার না হলে না দেওয়াই ভালো। বরং কথা বলুন আপনার নিজের বিবেচনা থেকে, পঠন-পাঠনের আলোকে অর্জিত জ্ঞান থেকে। আরো নির্দিষ্ট করে যদি বলি, আপনি বলুন আপনার নিজের কথা। অমুক জ্ঞানী লোকের কথা নয়।
একটি জনগোষ্ঠির সকল লেখক-সাহিত্যিক যদি সাহিত্যের ধারাবাহিক ইতিহাস জেনে স্বাধীনভাবে নিজের বিবেচনাপ্রসূত লেখালেখি করতে পারে, তখন হয়ত ন্যুনতম মানের যে একটি রেখা আছে তার ওপরে উঠে মান নিয়ে প্রকৃত বিতর্ক করা যাবে।
হলিসউড, নিউ ইয়র্ক। ৩০ জানুয়ারি ২০১৯
Comments
Post a Comment