Skip to main content

অসাধারণ এই শিল্পীর জীবনের গল্প বড় করুণ

 [এই সময়ের অত্যন্ত প্রতিভাবান শিল্পী সারফুদ্দিন আহমেদ। বাড়ি পশ্চিমবঙ্গে। আর্ট কলেজে খণ্ডকালীন শিক্ষকতা করেন, আর শুধু ছবি আঁকেন। নানান মাধ্যমে, নানান বিষয়ের ছবি। সারফুদ্দিন আহমেদের ছবি থেকে চোখ ফেরানো যায় না, আপনাতেই ওঁর নান্দনিক সৃষ্টিকর্মে দৃষ্টি আটকে যায়, কী জল রঙ, কী অ্যাক্রিলিক, কিংবা স্রেফ পেন্সিলের ড্রয়িং। এই গুণী শিল্পীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কবি কাজী জহিরুল ইসলাম। সাক্ষাৎকারটি এখানে উপস্থাপন করা হলো।]    

 

ভারত আমাকে চোখ দিয়েছে, বাংলাদেশ দিয়েছে দৃষ্টি

-   সারফুদ্দিন আহমেদ 

 


কাজী জহিরুল ইসলামঃ ব্যাক গ্রাউন্ডে তবলা বাজছে আপনি ছবি আঁকছেন কাচের ওপর।  এই যে বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে ছবি আঁকা, এই ছন্দটা ছবিতে কিভাবে ধরেন? আর কোনো শিল্পী ছবি আঁকার সময় যন্ত্রানুসঙ্গ ব্যবহার করেছেন?

 

সারফুদ্দিন আহমেদঃ কাঁচ নয়, এটি এক বিশেষ ধরনের কাপড়-নেট। এই নেটের উপরে বর্তমানে আমার এক্সপেরিমেন্ট চলছে। 

 

জহিরুলঃ ও, ফেইসবুকে যখন ছবিটি দেখি কাচের মতো লাগছিল।

সারফুদ্দিনঃ আমি বেশির ভাগ সময় গান শুনতে শুনতে ছবি আঁকি । শুরুতে গানের কথা এবং সুর কানে আসলেও পরে কেবল সুরটাই আমাকে ছবি আঁকার গভীরে ডুবিয়ে দেয়। কখনো কখনো গানের কথার সঙ্গে গলা মেলাই, ছবির বিষয়ের উপর ভিত্তি করে পছন্দের গান শুনি। আমার মনে হয় বেশির ভাগ শিল্পীই গান বা মিউজিক শুনতে শুনতে  ছবি আঁকেন। স্কুল লেভেলে আমি অঙ্ক করতে করতে গান শুনতাম। অঙ্ক আমার প্রিয় বিষয় ছিলো,খুব মজা পেতাম,এখন যেমন ছবি এঁকে মজা পাই। ঘোড়া আঁকার ক্ষেত্রে আমি তবলা কিংবা সরোদের সঙ্গে তবলা শুনি বিশেষ করে যখন দুহাতে ঘোড়া আঁকি । 

 

জহিরুলঃ এই ছন্দটা হয়ত ব্রাশিংযের তালটাকে ঠিক রাখে।

সারফুদ্দিনঃ একদম ঠিক। তবলার তালটাকে আমার ব্রাশিং এর সঙ্গে মিলিয়ে এক বিশেষ ছন্দে  রঙ বিন্যাসের চেষ্টা করি। তবে সব সময় তবলার তাল আর ব্রাশিং একই ছন্দে চলেনা। আমি ঘোড়া  আঁকার ক্ষেত্রে  ড্রইংকে প্রাধান্য দিই। তখন তবলার তাল আর ব্রাশিং এ নতুন কোনো ছন্দের সৃষ্টি হয়, অনেকটা পারফর্মিং আর্টের মত। 

আমার ইচ্ছে আছে এ ধরনের ছবির ক্ষেত্রে ছবি আঁকার শেষে সেই রেকর্ডের ভিত্তিতে ব্রাশিং এর ছন্দের সঙ্গে মিলিয়ে  নতুন করে তবলা এবং সারোদ মিক্সড সুর যুক্ত করা। আঁকতে আকঁতে উপলব্ধি করেছি গ্যাপ্পিং ঘোড়ার পায়ের খুরের শব্দের সঙ্গে খুব ভালো যায় তবলা এবং সরোদের যুগল।

জহিরুলঃ আপনি প্রকৃতির ছবি খুব আঁকেন, তবে সবচেয়ে বেশি আঁকেন ঘোড়া। ঘোড়ার প্রতি আপনার দুর্নিবার আকর্ষণ রয়েছে এবং আপনার হাতে ঘোড়ারা খুব জীবন্ত হয়ে ওঠে। ঘোড়ার প্রতি আপনি 'অবসেসড' বলাটা কি বেশি হয়ে যাবে? নিজের দূরন্ত ব্যক্তিত্ব কি ঘোড়ার মাধ্যমে প্রকাশ করতে চান?

সারফুদ্দিনঃ প্রকৃতি আমার ভীষণ প্রিয় বিষয়। প্রতিনিয়ত এই প্রকৃতি থেকেই শিখি। "নেচার ইজ দ্যা বেস্ট টিচার" এটা আমি হাড়ে হাড়ে অনুভব করি। ছবির বিষয় হিসাবে  নারী,  শিশু এবং মাঝে মধ্যে সমসাময়িক ঘটনাবলির ছবি আঁকি । হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন আমি ঘোড়া বেশি আঁকি এবং ঘোড়ার গতি ভীষণ ভাবে উপভোগ করি। তবে ঘোড়ার প্রতি  আমি অবসেসড কি না বলা মুশকিল । ছোট বেলায় দেখেছি আমাদের পাশের অঞ্চলে গাজীর মেলা  হতো, পৌষ সংক্রান্তির ঠিক পরে পরে। বাড়িতে বাড়িতে বিভিন্ন পিঠে, সকালে খেজুর রস,  নলেন গুড়ের মম সুগন্ধ। আহা!  গ্রামে তখন উৎসব উৎসব স্বর্গীয় পরিবেশ! বিশাল ফাঁকা মাঠ, মাঠের এক কোনে  তিন চারটে  ছোটো ছোটো সিমেন্টের ঢিপি লাল রঙের। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে এখানে মানত হিসাবে বাতাশা আর ছোটো ছোটো মাটির সাদা রঙের ঘোড়া নিয়ে এসে ঢিপিগুলোর চারপাশে রাখতো। সাদা ঘোড়ার গায়ে আলতা রঙের লাল নঁকসা থাকতো। দেখতে ঘোড়াগুলো সব প্রায় এক রকম আকর্ষণীয় । আমি কয়েকটা কিনে এনেছিলাম। পরে মাটি দিয়ে  নকল করে বাড়ির সবাইকে দেখাই। সবাই খুব প্রশংসা করেছিল। খুব আনন্দ পেয়েছিলাম। এই মেলার প্রধান আকর্ষণ ছিলো ঘোড়দৌড় । আমি ভীষণ উপভোগ করতাম । তিন দিনের কোনোদিন বাদ দিতাম না। এছাড়াও অনান্য কাছাকাছি কোথাও ঘোড়দৌড়  হলে যেতাম। ঘন্টা বাজিয়ে শুরু হতো দৌড়। মাঠের এ-প্রান্ত  থেকে ও-প্রান্ত  লোকে লোকারণ্য, সবার মুখে হাসিখুশি উৎসবের মেজাজ। ঘোড়াগুলো একপ্রান্ত থেকে পুরো মাঠ ঘুরে গন্তব্যে পৌঁছাতো, পিঠে থাকতো ৮/১০ বছরের কিশোর। সেই সময় ঘোড়ার টানটান গঠন, গতি আর গন্তব্যে পৌঁছানোর চেষ্টা আমাকে খুব আকর্ষণ করত। আর্ট কলেজের পাশেই ছিলো মাউন্টেন্ট পুলিশদের ঘোড়াশালা। ওখানে স্টাডি করতাম প্রচুর । বিক্ষিপ্ত ভাবে ঘোড়া আঁকলেও ঘোড়া নিয়ে ছবি আঁকার সাহস পাইনি কখনো। আমাদের সুনীল দাস আর ওপার বাংলায় সাহাবুদ্দিনের ঘোড়ার ছবি লাইব্রেরীতে এবং বিভিন্ন এক্সিবিশনে  দেখে খুব আকর্ষিত হতাম। ২০০০ সালে কলেজ পাশ করে ৮/৯ বছর ছবির কাছাকাছি থাকলেও ছবি ছিল আমার থেকে অনেক দুরে।  ২০১০ সালে ঠিক করলাম আর না, এবার ছবিকেই আমায় বস করতেই ২০১১/১২ সাল থেকে শুরু হলো নতুন উদ্যমে ও গতিতে ছবি আঁকা । একের পর এক ঘোড়া আঁকছি কিন্তু কিছুতেই মন ভরছে না। ঘোড়ার যে গতি তা খুঁজে পাচ্ছিনা আমার ছবিতে। পাশাপাশি ঘোড়া বিষয়ে পড়াশোনা করছি - আদিকাল থেকে ঘোড়ার গঠনগত পরিবর্তন, বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেমন মানব সভ্যতার উন্নয়নে, বিভিন্ন ধর্মে, সমাজের বিভিন্ন  কর্মকান্ডে,  ব্যাক্তিগত কিংবা রাজনীতিতে ঘোড়ার ব্যবহার । 



জহিরুলঃ আর ব্যক্তিত্বের সঙ্গে সামঞ্জস্যতা?

সারফুদ্দিনঃ ব্যক্তিত্ব ব্যাপারটা আমার কাছে মনে হয়, নির্দিষ্ট ব্যাক্তির যৌগিক অভিব্যক্তির প্রকাশ যা অন্যকে আলোকিত করে। এক্ষেত্রে পরিমিতি বোধটা খুবই  জরুরী এবং তা অধ্যাবসায় এর মাধ্যমে প্রকাশ পায় । চলনে, বলনে পোষাকেপ্রকাশে সততা এবং নিষ্ঠা পরিমিতি বোধ তৈরীর পিগমেন্ট । নিজেকে নিজেই বারবার হারিয়ে দেওয়া। ধারাবাহিক চর্চাতেই পরিমিতিবোধ শানিত হয়। ব্যাক্তি  নিজেই বলতে পারে না সে ব্যক্তিত্ববান ।

আমি এটুকু বলতে পারি আমার কাজটা আমি সততার সঙ্গে করি, নিষ্ঠার সঙ্গে করি,  ভালোবেসে করি এবং ভালো লাগে বলেই করি। 

আমার দুবছরের ভাগ্নি মুসকান আমাকে "টগবগ মামা" বলে। ৭০ বছরের গুণী শিল্পী, এখনও নিয়মিত বলিষ্ঠতার সাথে কাজ করে চলেছেন,  প্যারিস সহ দেশে-বিদেশে বিভিন্ন একক প্রদর্শনী এবং গ্রুপ প্রদর্শনী করছেন, শিল্পী সাহাবুদ্দিনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু দিলীপ দাস । তিনি আমাকে ঘোড়া আহমেদ বলে সম্বোধন করেন ।

জহিরুলঃ আমি তাহলে ভুল কিছু বলিনি। কবিতায় ঘোড়া বা অশ্ব পৌরুষ, কাম, শৌর্যবীর্যের প্রতীক হিসেবে আসে। আপনি ঘোড়া আঁকতে এতো পছন্দ করেন কেন তা কিছুটা বলেছেন। বিশেষ কোনো  অনুপ্রেরণা কাজ করে কি? ঘোরার প্রতি আপনার বিশেষ ভালোবাসাঢ় কারণেই আমরা ঘোড়ার গতির সঙ্গে একটু বেশি সময় থাকছি। 

সারফুদ্দিনঃ পছন্দ কেন করি বলতে গেলে  বলতে হয় ভালো লাগা থেকেই ঘোড়ার প্রতি আকর্ষণ বাড়তে থাকে ।  প্রথমে ঘোড়ার মূর্তি গড়েই ঘোড়ার প্রতি আকর্ষণের বহিঃপ্রকাশ শুরু।  আগের প্রশ্নের উত্তরে তা বলেছি। তখন প্রাইমারী স্কুলে পড়ি। আমাদের স্কুল ছাড়াও আশেপাশের  ক্লাব বা সংগঠনের সংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বিভিন্ন প্রতিযোগিতা হত। ছোটো ফুটবল টুর্নামেন্ট হত। আমি নিজের থেকেই প্রায় সমস্ত প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতাম কিন্তু কখনো কোনো প্রতিযোগিতায় কৃতকার্য হতে পারতাম না। খুব হীনমন্যতায় ভুগতাম। ছবি আঁকা ভালো লাগতো। একা একা আকঁতাম। সমস্ত না পাওয়ার  দুঃখ ভুলিয়ে দিত ছবি ।  আঁকার কোনো প্রতিযোগিতা মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবার আগে পর্যন্ত শুনিনি । পরে আর্ট নিয়ে পড়াশোনা করে আর্ট ব্যাপারটা জানতে থাকলাম । নিজের কাজ করতে করতে মনে হলো আমার ছবিতে আমি যা বলতে চাই সেখানে প্রয়োজন ঘোড়ার বলিষ্ঠ গঠন, ঘোড়ার শক্তি, ঘোড়ার গতি, গন্তব্যে পৌঁছানোর নিষ্ঠা এবং গুহা মানব থেকে পোস্ট-আধুনিক সময়ে মানব সভ্যতায় ঘোড়ার প্রচলন। আমার ছবির চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতেই ঘোড়া আঁকার তাগিদ বাড়তে থাকে এবং সেই তাগিদ থেকেই পাই অনুপ্রেরণা ।

 


জহিরুলঃ আপনি নানান মাধ্যমে ছবি আঁকেন, মাধ্যম বৈচিত্র কি একজন শিল্পীর অস্থিরতা থেকে আসে? বিষয়টি শৈল্পিক মগ্নতার সাথে কি সাংঘর্ষিক?

সারফুদ্দিনঃ ধন্যবাদ, আপনি আমার ছবি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে  দেখেন। আমার মনে হয় না এটা অস্থিরতা থেকে আসে। এ প্রসঙ্গে বলার আগে আমি একটু অন্য প্রসঙ্গে যাব। আমরা  প্রত্যেকেই  অবগত সাধারণ মানুষের কোনো কিছু দেখা আর সৃজনশীল মানুষের দেখার মধ্যে এক বিশেষ পার্থক্য আছে। সৃজনশীল মানুষ সেই দেখাকে নিজের অনুভূতির জারে জারিত করে পরে তার নির্যাস বিনা অনুমতিতে সাধার মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়। কেউ এঁকে, কেউ লিখে, গানে, নাচে, অভিনয়ে,  চলচ্চিত্রের ও অন্যান্য আরো বিভিন্ন মাধ্যমে। 

আমার ক্ষেত্রে আমি বলতে পারি আমাকে এখন চারুকলা চর্চার  সেই জায়গায় পৌঁছাতে  অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে। শিল্পকলাচর্চা তো লম্বা সফর, জীবনের শেষ  সেকেন্ড পর্যন্ত চলমান । অনেক কথা বলার থাকে যা কিনা  একই  মাধ্যমে বা এক নির্দিষ্ট  প্যাটার্নে প্রকাশ করা আমার দ্বারা  অসম্ভব । তাই হয়তো আমার দৌড়াদৌড়ি, আপনি যেটাকে ভেবেছেন অস্থিরতা । আসলে মাধ্যমটার চাইতে  আমি কি প্রকাশ করতে চাইছি আমার কাছে  সেটাই বড়।  কাদের জন্যে করছি, কেন করছি সেটা যত সহজ সরলভাবে বলা যাবে বা উপস্থাপন করা যাবে  তত সহজে সাধারণের কাছে পৌঁছানো সম্ভব হবে। এতে মগ্নতার সাথে কোনো সংঘর্ষ বা মননে কোনো ব্যাঘাত ঘটেনা বরং নির্দিষ্ট বিষয় প্রকাশে সহায়ক হয়।  চারুকলা চর্চার প্রাথমিক ব্যাকরণ, অঙ্কন শৈলীর দক্ষতা  এবং বিভিন্ন মাধ্যম সম্পর্কে পরিষ্কার ধাণা এবং অভিজ্ঞতা থাকলে নির্দিষ্ট বিষয় প্রকাশ সহজ হবে বলে আমার বিশ্বাস ।



জহিরুলঃ উপমহাদেশের কোন শিল্পী আপনার আদর্শ? তাঁর বা তাঁদের সম্পর্কে কিছু বলুন।

সারফুদ্দিনঃ আমার নির্দিষ্ট কোনো একজন আদর্শ শিল্পী নেই। অনেকেই আমার আর্দশ । বাংলাদেশের জয়নুল আবেদীনের ড্রয়িং, এস এম সুলতানের বলিষ্ঠ কম্পোজিশন, সাহাবুদ্দিনের ব্রাশিং এবং তার প্রত্যেকটা ছবির মধ্যেকার গতি থেকে আমি ভীষণভাবে অনুপ্রেরণা পাই শেখ আফজালের কম্পোজিশনে  ধরা-ছাড়ার ভারসাম্যে অপূর্ব নিয়ন্ত্রণ, সর্বোপরি ছবির মধ্যে এক মায়াময়তা সৃষ্টিতে আমি মুগ্ধ হই।  জামাল আহমেদের ছবির নদী, জল, বালুকাময় পাড়ে দুএকটা ফিগার, খুব অল্প কাজে অনেক বেশি এফেক্টস, পায়রাগুলো, নারী, ঘোড়া  ওঁর প্রত্যেকটা  কাজের মধ্যে  রঙের প্রয়োগ এবং স্বতঃস্ফুর্ততা আমাকে খুব টানে।  রনজিত দাসের কম্পজিশন, স্পেজ ডিভিশন, কালার ব্যলেন্স আমাকে মুগ্ধ করে।

নেপালের আর্টিস্ট শশি বিক্রম শাহের গতিবহুল ঘোড়ারা পুরো ক্যানভাস জুড়ে তোলপাড় করছে। কোনোটা মোটা কেশরের রাগান্বিত, কোনোটা ডানাওয়ালা পক্ষীরাজ - বলিষ্ঠ কম্পজিশনে আমার মন ভরে যায় ।

আমাদের দেশের হেমেন মজুমদারের প্রত্যেকটা ছবি, বিশেষ করে সিক্তবসনা ছবিগুলো, আহা অপূর্ব, অসাধারণ ।  গনেশ পাইনের কম্পজিশন এবং পুরো ছবি জুড়ে আলো-ছায়ার এক মায়াজাল আমাকে মুগ্ধ করে। তাঁর ছবি যখনই দেখি অনেকক্ষণ আটকে যাই। বিকাশ ভট্টাচার্যের ড্রয়িং, ছবির মধ্যে ধরা-ছাড়া এবং আলো আঁধারের খেলা সেই ছাত্রাবস্থা থেকে খুব টানে, মুগ্ধ হয়ে উপভোগ করি । সুনীল দাসের ঘোড়ায় আমি মুগ্ধ , আমাকে ভীষণভাবে অনুপ্রেরণা দেয়, বিশেষ করে আমার ঘোড়া আঁকার ক্ষেত্রে ।

জহিরুলঃ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না নিয়েও অনেকে বড় শিল্পী হয়েছেন, ভিঞ্চি, ভ্যান গো'র কথা বাদ দিলাম। এখন, এই আধুনিককালেও আমরা একজন মকবুল ফিদা হোসেনকে পেয়েছি। ভালো শিল্পী হওয়ার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কতটা অপরিহার্য?

সারফুদ্দিনঃ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় ধারাবাহিক প্রতিযোগিতামূলক সুন্দর  কাজের পরিবেশ থাকে যা শিক্ষার্থীকে ছবির ব্যাকরণ এবং করণ কৌশলে দক্ষ করে তোলে। ধারাবাহিক কাজ, কাজের সঙ্গে থাকা, লাইব্রেরি, বিভিন্ন ক্যাম্প, ওয়ার্কশপ  এবং  প্রদর্শনীতে ছবি দেখার এবং কাজ করার  সুযোগ তাকে করণকৌশল এবং অনুভূতি চর্চার সু-পরিবেশ দেয় যা শিল্পী হবার পথকে অনেকটা সহজ করে। ধারাবাহিক কাজই অনুভূতিকে শাণিত করে। 

আমার মনে হয় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার্থীর থেকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না নেওয়া শিল্পীদের সাহস অনেক বেশি । কার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার্থীদের ছবির ব্যাকরণ, করণকৌশল, ড্রয়িং-এ সুস্পষ্ট ধারণা থাকায় নতুন কোনো কিছু করতে গভীর ভাবনায় ফেলে দেয় । অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেওয়া শিল্পীরা সহজে তা করে ফেলার সহস রাখে। আমি  ফোক শিল্পীদের দেখেছি খুব সহজে সুন্দর একটা কম্পজিশন করে ফেলে। যদি ফোক শিল্পীরা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা পায় বা নেয় অত সহজে কম্পোজিশন করা অসম্ভব হবে বলে আমার ধারণা।  ফোক শিল্পীদের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে সরাসরি কাজের সুবাদে  সেটাই অনুধাবন করেছি । মোদ্দা কথা হলো ছবির বিষয়ে যথার্থ জ্ঞান, করণকৌশল, ড্রয়িং, দেখার চোখ এবং ব্যকরণ রপ্ত করে ধারাবাহিক চর্চা এবং কাজের পর কাজ করলেই  আকাঙ্ক্ষিত  জায়গার আশে-পাশে বিরাজ করা সম্ভব ।  তার জন্যে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়া কোনো এক বা একাধিক অভিজ্ঞ শিল্পীর থেকে বেসিক জ্ঞান নিয়ে রপ্ত করলেই হলো।



জহিরুলঃ আপনি নিজেও আর্টের শিক্ষক। আপনার শিক্ষকদের চেয়ে ব্যতিক্রম কি কি আপনি আপনার ছাত্রদের শেখান?

সারফুদ্দিনঃ শিক্ষার্থীরা প্রত্যেকে টগবগে যুবক। প্রত্যেকের অনুভূতি আলাদা, দেখার চোখ আলাদা, ভালো লাগা বা মন্দ লাগা আলাদা আলাদা । প্রথমে কাজ দিয়ে তাদেরকে বোঝার চেষ্টা করি কাজের প্রতি কার কতটা ভালোবাসা আছে, কতোটা আগ্রহ আছে। এখানে সুবিধা হলো প্রত্যেকে নিজের মতন করে ভালোবাসা এবং আগ্রহ নিয়ে এসেছে। যাদের আগ্রহ এবং কাজের প্রতি ভালোবাসা তুলনামুলক কম তাদেরকে আমি নরমাল ক্লাসের পর আলাদা সময় দি। তাদের কাজের পাশাপাশি নিজে কাজ করি। তাদেরকে স্টাডি করি কি করলে তারা আগ্রহী হবে এবং কাজের প্রতি ভালোবাসা বাড়বে সেই রাস্তা খুঁজি। 

জহিরুলঃ সেজন্যে থিউরির পাশাপাশি প্রচুর প্রাক্টিক্যাল কাজ করতে হয়। 

সারফুদ্দিনঃ স্বাভাবিক ভাবে আর্ট কলেজে থিওরির থেকে প্রাক্টিক্যাল অনেক বেশি।  আউটডোর ইনডোর দুজায়গাতে কাজ করতে হয় । একজন খুব ভালো ড্রয়িং করে একজন মোটামুটি অন্যজন হয়তো ঠিকমত পেন্সিল ধরতে পারে না । শিক্ষার্থীরা যে যেজায়গায় আছে তাকে সেই জায়গা থেকে তোলার চেষ্টা করি। কেউ যাতে হীনমন্যতায় না ভোগে সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখি। কাজ ছাড়াও মাঝে মাঝে নিজ উদ্যোগে এন্টারটেনমেন্টের ব্যবস্থা করি। কখনো সি বিচে বা কখনো কাছাকাছি কোথাও একসঙ্গে খেতে যাই। মোটকথা আমি শিক্ষার্থীদের সাথে মেশার চেষ্টা করি যাতে ওরা যে কোনো ধরণের কথা সহজে বলতে পারে।



জহিরুলঃ এগুলো করতে গিয়ে শিক্ষক হিসেবে একাই সব সিদ্ধান্ত নেন, নাকি সকলের অংশগ্রহণের একটা সুযোগ তৈরি করেন?

সারফুদ্দিনঃ অংশ্রগ্রহ্নের মধ্য দিয়েই সকলে মিলে সিদ্ধান্তগুলো নিই। মাঝে মাঝে মন্তব্য শুনি "ক্লাস ক্যয়সা লাগতা হায়" ?  উত্তর আসে  "স্যার আপ তো হিরো হায় " । একজন শিক্ষকের এর থেকে বড় পুরস্কার কি আছে আমার জানা নেই। একবার কলেজের এক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে যথা সময়ে আমি পুরস্কার নিতে স্টেজে পা দিতেই ছাত্র-ছাত্রীদের প্রচুর করতালি আর শিস দেওয়া  দেখে এঙ্কর বললেন " এনার আগে অনেকে পুরস্কার নিলেন তখন তো এত হাততালি দেখলাম না। এনার বেলা এতো  হাততালির রহস্য কি? আমরা যেটা করবো সেটা যদি সততার সাথে ভালোবেসে করি হয়তো অনেক শত্রু বাড়বে কিন্তু বেলা শেষে যা পাবো তা একেবারে আত্মার শান্তি।

জহিরুলঃ কিছুটা নিজের কথা বলুন, জন্ম এবং বেড়ে ওঠার কাল ও পরিবেশ, শিল্পী হয়ে ওঠার পেছনে পরিবার ও সমাজের ভূমিকা।

সারফুদ্দিনঃ পশ্চিমবঙ্গে তখন বন্যা। আমাাদের জেলাটা  উঁচু হওয়ায় ১৯৭৮-এর বন্যার প্রভাব তুলনামূলকভাবে ততটা ভয়ংকর ছিল না । নির্দিষ্ট তারিখ মায়ের মনে নেই। মায়ের বর্ণনায় যেটা মনে হল-  ভাদ্র মাসের ভরা বর্ষা জল থৈ থৈ। রাস্তায় হাঁটু জল, সমস্ত পুকুর একে অপরের সঙ্গে মিলে মিশে একাকার। মাছেদের অবাধ বিচরণ। মানুষজন খালি হাতে বা জালে সহজে বন্দি করছে মাছ, প্রচুর মাছ। আমার নানাজী বাড়ির কাউকে সেই  মাছ ধরতে দেয়নি গুনাহের ভয়ে। পাকা তাল পড়ার ধুপধাপ শব্দ। ছুটির দিন রবিবার সকাল ৮টায় ফাতেমা বিবি এবং আব্দুল খালেক এর তৃতীয় সন্তান হয়ে পৃথিবীতে আমার পা। রবিবার জন্ম বলে মা আমার নাম রবি রাখতে চেয়েছিলো কিন্তু ধোপে টেকেনি ।

ভারতবর্ষ, পশ্চিমবঙ্গ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার খাঁপুর গ্রামে জন্ম। স্কুল লেভেল কাটে গ্রামেই। পরে শহর কলকাতায় বাকি পড়াশোনা।  আমরা ছয় ভাই পাঁচ বোন পুরো ক্রিকেট দল আর কি, হা হা হা । মায়ের মুখে শোনা আমি যখন খুব ছোট্ট ছিলাম তখন কোন কারণে কাঁদলে একদলা মাটি বা আটা মাখিয়ে হাতে দিলে মহানন্দে সেই মাটি দিয়ে এটা সেটা বানাতে শুরু করতাম।

জহিরুলঃ শিল্পী হবার গুণটা বলা যায় জন্ম থেকেই ছিল।

 

সারফুদ্দিনঃ সিলেটে বা মাটিতে হিজিবিজি করে সবাইকে দেখাতাম। পড়াশোনার প্রতি মন ছিলো না। যারা গরু ছাগল নিয়ে মাঠে যেতো তাদের সঙ্গে চলে যেতাম স্কুল পালিয়ে। বাড়িতে প্রায় শুনতে হতো ভালো করে পড়াশোনা না করলে ওদের মত গরু চরাতে হবে সারা জীবন । মনে মনে ভাবতাম আমি তো পড়াশোনা করি না তাহলে আমাকে গরু চরাতে দেওয়া হয় না কেন। পরে বুঝলাম ওরা গরিব তাই ওরা গরু-ছাগল চরায়। 



জহিরুলঃ খুব স্কুল ফাঁকি দিতেন?

সারফুদ্দিনঃ প্রত্যেক দিন বইয়ের ব্যাগ নিয়ে স্কুলে যাবার জন্যে বেরোতাম কিন্তু স্কুলে না গিয়ে বই ভরা ব্যাগ কোনো নিরাপদ জায়গায় লুকিয়ে রেখে কোনো পুকুর পাড়ে কিংবা কোনো গাছের ডালে বসে থাকতাম। আর স্কুল ছুটি হলে ভালো ছেলের মতো বাড়ি ফিরতাম। স্কুলের বদ্ধ ঘর আমার ভালো লাগত না। এরকম প্রায় দিন করতাম। একদিন পড়লাম ধরা বড়দা জাকির আর মেজদা সারোয়ারের হাতে, বেদম পেটালো। মায়ের কাছে শুনেছি সারা শরীরে অনেক ছিলে-টিলে গেছিল। তারপরের দিন থেকে আর কখনো স্কুল কামাই হয়নি। যাবতীয় বইয়ের প্রথম পাতা থেকে শেষ পাতা পর্যন্ত মুখস্থ। প্রশ্ন যেখান থেকেই আসুক নিমেষেই উত্তর দিয়ে দিতাম। ক্লাস টু থেকে পড়াশোনার প্রতি গভীর মনযোগ  চলে আসলো। আমি ভালো ছেলের আওতায়, সেকেন্ড বয়। ক্লাসের মনিটর আমি। ক্লাস শেষে ডাক পড়ানো (ক্লাসের বাইরে মাঠে সবাই গোল হয়ে দাঁড়বে, একজন পড়া বলবে বাকি সবাই জোরে জোরে সেই পড়াটা একযোগে বলবে)। 

জহিরুলঃ ক্লাসের শেসে এভাবে পড়ানোর কৌশলটা বেশ। 

সারফুদ্দিনঃ প্রাইমারী স্কুলের প্রধান শিক্ষক আলি আকবর মহাশয় এই দায়িত্ব আমাকে দিয়ে ছিলেন। আমি তখন বন্ধুদের কাছে অন্যরকম । বইয়ের সাদা অংশে এবং বড়োদের খাতায় লুকিয়ে লুকিয়ে এটা সেটা ছবি এঁকে ভরে দিতাম। তার জন্যে প্রচুর বকা খেয়েছি। ক্লাস সেভেনে ব্যাঙের পৌস্টিক তন্ত্র পড়িয়ে বিজ্ঞান ক্লাস শেষে জাফর উল্লাহ মহাশয় চলে গেছেন। পড়ার রেশটা মাথায় ঘুরছে। আমি ভাবতে লাগলাম আদৌ কি ব্যাঙের পেটে অতো সব আছে না কি কেবল ছবি। বাড়িতে এসে বই থেকে ছবিটা হুবহু আঁকার চেষ্টা করলাম। মন ভরলো না। পরের দিন স্কুলে না গিয়ে একটা ব্যাঙ ধরে নিয়ে আড়ালে চলে গেলাম। তখন বর্ষাকাল ব্যাঙ খুব সহজে পাওয়া যেত। সেই জ্যান্ত ব্যাঙকে বইয়ের ছবির মত করে নরম মাটিতে শুইয়ে  দিলাম। বইটা খুলে পাশে রেখেছি। আশে-পাশে দেখে নিলাম কেউ আছে কি না। হাত কাঁপছে! যদি কেউ দেখে ফেলে কী যে করবে আমাকে খোদা মালুম। একটা একটা করে চার পায়ে চারটে খেজুর কাঁটা ফুটিয়ে মাটিতে আটকে দিলাম। ব্যাঙটা যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে । আমি অমানুষের মতো  নুতুন ব্লেড দিয়ে পুরো পেটটা চিরে ফেললাম। দেখে অবাক! দেখলাম বইয়ের ছবির সঙ্গে হুবহু একই । বিজ্ঞানের প্রতি ভালোবাসা, বিষয়টার প্রতি আগ্রহ বেড়ে গেলো। এখন ওই ঘটনা মনে করলেই খুব কষ্ট হয়, ব্যাঙটার প্রতি ওই অমানবিক আচরণের জন্যে।  ক্লাস সেভেন-এইট থেকে  হলে গিয়ে সিনেমা দেখার ঝোঁক বেড়ে গেলো। 

জহিরুলঃ এই জায়গাটিতে আপনার সঙ্গে আমার দারুণ মিল। আমি অবশ্য টু/থ্রিতে থাকতেই সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখতাম।

সারফুদ্দিনঃ অভিনয়ের প্রতি ভালোবাসা জমতে শুরু হতে না হতে কয়েকজন মিলে "দর্পণ" নামে এক নাটকের দল করলাম। পাঁচটা নাটক মঞ্চস্থ করেছি। আমার জন্যে কমেডিয়ান রোল বরাদ্দ ছিল। এলাকায় বেশ নাম, আমি তারিয়ে তারিয়ে  উপোভোগ করতাম। তখন ক্লাস নাইন। পাশাপাশি ছবি আঁকা ছিলো ছায়াসঙ্গী । পড়াশোনার অবনতি শুরু হলেও কখনো ফেল করিনি। আমার পড়াশোনা বা অন্যান্য কাজের জন্যে বাবার কোনো ইন্টারেস্ট ছিলো না। বাবা চাইতো তাঁর মতো দক্ষ দর্জি হই। দর্জির কাজটা আমাকে কখনো টানেনি। দক্ষ দর্জি হিসেবে বাবার খুব খ্যাতি ছিল। বাবা কলকাতা থেকে কাজ নিয়ে আসতো। বাড়িতে কারখানা ছিলো। অনেকেই কাজ করতো, চলতো রাত দিন করে। তখন বিদ্যুৎ ছিল না। হ্যাজাকের আলোতে রাতে কাজ চলতো। দশ বারোটা সেলাই মেশিন বিশ্রাম পেতো খুবই কম। সেই রেডি কাজ বাবা নিজে কখনো কলকাতায় দিয়ে আসতো কিংবা তারা গাড়ি নিয়ে কলকাতা থেকে আমাদের বাড়িতে আসতেন । আমার খুব গর্ব হতো বাবার জন্যে,বাবার কর্ম দক্ষতার জন্যে আমাদের বাড়িতে কোলকাতার লোক আসে । তখন কলকাতার লোক মানে আমার কাছে খুব দামি মানুষ। 

বাবা হাবে ভাবে প্রায় বুঝিয়ে দিতো আমি যেনো লেখাপড়া ছেড়ে দর্জির কাজে মন দি। কিন্তু  মা বলতো "আমি অন্ধ (নিরক্ষর) তোরা কেউ অন্ধ হোস না" । মায়ের কথাটা আমার জীবন যুদ্ধের মূলমন্ত্র। তখন ক্লাস নাইনে। আমি ঠিক করলাম লেখাপড়ার জন্যে বাবার থেকে একটা টাকা নেব না। সাইনবোর্ড লেখার দোকান করলাম। তখন সাইনবোর্ড শিল্পীরা আমার কাছে হিরো। ভাবতাম "ওঁদের মত বড় আর্ট হব "। আমার কাছে ছবি আঁকা মানে বড় সাইনবোর্ড শিল্পী হওয়া। তখন আর্ট আর আর্টিস্টের তফা বুঝতাম না। যেখানে যেখানে সাইনবোর্ড  লেখালিখি হতো সেখানে গিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকতাম আর মনে মনে মনের খাতায় নোট করতাম। বাড়িতে এসে সেগুলো প্রাক্টিক্যাল রপ্ত করতাম হ্যারিকেনের আলোতে রাত জেগে। মায়ের সায় পেতাম বলে রাত জেগে কাজ করার কোনো অসুবিধা হতো না।



জহিরুলঃ বেশ বর্ণাঢ্য এবং চ্যালেঞ্জিং। 

সারফুদ্দিনঃ হ্যাঁ। একটা সাইনবোর্ড দোকানের নাম ছিল কারুকলা ভবন। নামটা আমার খুব পছন্দ কিন্তু কারুকলা মানে কি তা জানতাম না। যাই হোক আমার দোকানের নাম তো একই দেওয়া যাবে না। নাম দিলাম চারুকলা ভবন। চারুকলা কি সেটাও জানিনা।  টুকটাক লেখালেখির কাজ আসতে শুরু হলো । হাতে টাকা আসা শুরু তবে তা খুবই  সামান্য। পাশাপাশি পড়াশোনা, নাটক এবং ছবি আঁকা চলতে থাকলো। আমাদের তখন ধান এবং বিভিন্ন সব্জি, আলু, পেয়াঁজ, কচু নিজেদের চাষ হতো। হালের দায়িত্বে ছিল বুড়ো আব্দুল। হালের গরু গাই দেখাশোনা করার জন্যে আব্দুল নামের এক দাদা ছিল। তার কাছে শিখেছিলাম, যে গরু গুঁতোয় তাকে কি করে বাগে আনতে হয়। আমাদের সাংসারের সারাক্ষণ যাবতীয় কাজের জন্যে খয়রন নামের এক খালা ছিল ।  এরম অবস্থা বাড়ির, আর আমি মাধ্যমিক পরীক্ষার পরে ছুটিতে জনমজুরের কাজে গেলাম । মাটি কাটা, কৃষি  কাজ - ৩০ টাকা রোজ। সকাল ৭টা থেকে দুপুর দুটো।  টাকা জমাতে শুরু করলাম। গ্রামে কাজ নেই কলকাতায় রাজমিস্ত্রির কাজে গেলাম নেজাম এবং নুরালমের সঙ্গে পাড়ার আজিজুল নামে এক দাদার আন্ডারে। বাবা যেহেতু চাননি পড়াশোনা করি তাই বাবার টাকা নেওয়া অসম্ভব তাতে যা করতে হয় করবো এরকম একটা প্রতিজ্ঞা ছিল

জহিরুলঃ কী সাংঘাতিক স্ট্রাগল, প্রত্যয়, আর কী বর্ণাঢ্য কৈশোর, আমি মুগ্ধ।

সারফুদ্দিনঃ সকাল ৯টা থেকে ৩টে পর্যন্ত  কাজ ৩০ টাকা আর রাত ৮টা পর্যন্ত করলে দুরোজ 60 টাকা।  ছবি আঁকার জেদ দিনের পর দিন প্রবল আকার নিচ্ছে। খুঁজি কোথায় গেলে ভালো আঁকা শিখতে পারবো। একদিন ট্রেনে করে কলকাতা যাবার পথে  জানালা দিয়ে একটা ছোট্ট সাইন দেখতে পেলাম। তাতে লেখা " অঙ্কন" এখানে যত্ন সহকারে অঙ্কন শেখানো হয় । আমি লাফিয়ে উঠলাম। পরের দিন আর কাজে গেলাম না। বন্ধু সাবিরকে নিয়ে গেলাম সেই  মল্লিকপুর স্টেশনে। ঠিকানায় যোগাযোগ করায় জানালো রোববার সকাল ৯টায় ক্লাস। মেজদা সারোয়ারকে সঙ্গে নিয়ে ভর্তি হলাম। আঁকার যাবতীয় সরঞ্জাম কিনতে যে পরিমান টাকা লাগবে তা আমার জমানো টাকায় হবে না। আমার একটা রেডিও ছিলো যেটা শুনতে  শুনতে অঙ্ক করতাম, সময় পেলেই শুনতাম। বাংলাদেশের গান বেশি ভালো লাগতো। ঢাকা খুলনা দুটো রেডিও সেন্টার ধরতো। তখন বাংলাদেশের প্রতি ভালোবাসা অনেক বেড়ে গেছিল। বিক্রি করে দিলাম সেই রেডিও। 

জহিরুলঃ আর্ট শেখার সরঞ্জাম কেনার জন্য প্রিয় রেডিও বিক্রি করে দেয়া, কৈশোরকালের অনেক বড় ত্যাগ এটা।

সারফুদ্দিনঃ আঁকার যাবতীয় সরঞ্জাম নিয়ে রোববার সকালে সেই কাঙ্ক্ষিত স্কুলে পৌঁছালাম। ক্লাসে ঢুকেই দেখি এযে স্বর্গ । এক সঙ্গে এতোজন ছবি আঁকতে আগে কখনো দেখিনি। আনন্দে মন ভরে গেলো । তারপর ওই অঙ্কন স্কুলের শিক্ষক শিল্পী স্বর্গীয় সর্বজিত সোম স্যারের থেকে জানলাম আঁকার স্কুলই শেষ নয়। আর্ট কলেজ আছে। ক্লাস ইলেভেনে এসে জানলাম আর্ট কলেজের নাম। আমাকে আর পায় কে! খুবই এক্সাইডেট । মহা উদ্যমে শুরু হলো আর্ট কলেজে ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি। মাঝে মাঝে কাজে যেতে হতো রাজমিস্ত্রি, রং মিস্ত্রির । রংচং কেনা স্কুলের বেতনের জন্যে।  ৬ মাস যেতে না যেতে ওই স্কুলে শিক্ষক হয়ে যাই। ওখান থেকে কিছু টাকা পেতে শুরু করি। ১৯৯৫ সালে আর্ট কলেজে ভর্তি  পরীক্ষায় অকৃতকার্য হই। 



জহিরুলঃ মন ভেঙে গেলে দমে যাননি নিশ্চয়ই।

সারফুদ্দিনঃ খুব কষ্ট হল। পরের বছর ইন্ডিয়ান আর্ট কলেজ এবং গভর্মেন্ট আর্ট কলেজ দুটোতেই চান্স পাই। আর্ট কলেজে পড়তে গেলে প্রচুর খরচা ইতিমধ্যে জেনে গেছি। আমি যদি কল্পলোকের আশ্রয় না নিয়ে ভাইভাতে সত্যি উত্তর দি আমি চান্স পাবো না । গভর্মেন্ট আর্ট কলেজের ভাইভার প্রত্যেকটা প্রশ্নের কল্পনিক উত্তর দিয়েছিলাম । প্রশ্ন ছিলো বাবা কি করে? স্মার্টলি বলে দিলাম ব্রেড কারখানা মানে রুটি বিস্কুটের কারখানার মালিক। কয় ভাই বোন? তিন ভাই বোন আমি ছোটা। দাদা সদ্য এম এ পাশ, দিদি ডাক্তারী পড়ছে। গ্রামে থাকো, পুকুর আছে? হ্যাঁ একটা নিজেদের বাকি তিনটে ভাগের। গভর্মেন্ট আর্ট কলেজের রেজাল্ট পাওয়ার আগে ইন্ডিয়ান আর্ট কলেজে নতুন ক্লাস শুরু। আমার স্বপ্ন বাস্তবায়নের সিঁড়িতে পা। মাস খানেক ক্লাস হতে না হতে গভর্মেন্ট আর্ট কলেজের রেজাল্ট।  লিস্টে ৩ নম্বরে আমার নাম। 

জহিরুল স্বপ্নের সিঁড়িতে পা, শুরু হলো নতুন যাত্রা।

সারফুদ্দিনঃ ভর্তি হলাম আমার স্বপ্নের আর্ট কলেজ গভর্মেন্ট কলেজ অফ আর্ট এন্ড ক্রাফট- । ভর্তির সময় দেড়শো টাকা কম পড়েছিল। বাবার কাছে চাইলাম। বাবা তখন গ্রামের অল্প কয়েকজন ধনীদের মধ্যে একজন। সচ্ছল সংসার। নিজের থেকে টাকা না দিয়ে আমার সামনে অন্য এক লোকের থেকে ধার নিয়ে আমাকে দিলো। সঙ্গে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিলো দেখ তোর জন্যে কতো খরচা করছি। টাকা হাতে নেয়ার সময়  খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। পরের সপ্তাহটা টানা রাজমিস্ত্রির কাজ করলাম। যার আন্ডারে কাজ করতাম তার থেকে কিছু টাকা অগ্রিম নিলাম। বাড়িতে ফিরে বাবাকে ৩০০ টাকা দিলাম আর বললাম সেদিন নিয়েছিলাম। আমার স্বপ্নের ক্লাস শুরু । এ যেন আনন্দের মহাসমুদ্র, যার প্রতীক্ষায় ছিলাম এতো বছর। বাড়িতে এসে আনন্দ শেয়ার করার চেষ্টা করি । কেউ বোঝে না, বোঝার চেষ্টাও করে না। কেবল মা না বুঝে খুশি প্রকাশ করত।

ধান কাটা এবং তোলার সময় একটু এক্সট্রা সময় দিতে হতো। আমার ভাগের কাজটা আমি করে কলেজে যেতাম। যাতে মাকে বাবা না বলতে পারে সারাদিন কোথায় ঢো ঢো করে "রাতে এসে গেলে (খায়) "। এই কথাটা শুনবো না বলে  ভোর ৪ টের সময় ঘুম থেকে উঠে মাঠে ধান কাটা বা বাঁধার কাজ থাকলে  করে ৭টায় বাড়ি ফিরতাম। ফ্রেশ হয়ে কলেজের জন্যে বেরিয়ে পড়তাম। মা টিফিন বক্সে করে ৬টা বড় বড় রুটি আর আলু ভাজা দিয়ে দিতো। দুপুরে এবং  সন্ধ্যায় খাবার জন্যে। ভিড় ট্রেনে পার্কসার্কাস স্টেশনে সাড়ে ৯টায় নামতাম। প্রায় পঞ্চাশ মিনিট পায়ে হেঁটে সাড়ে দশটায় কলেজে পৌঁছে যেতাম। সবার পায়ে দেখতাম দামি দামি জুতো, আমার হাওয়াই চটি। আমি টিফিন করতাম কোনো একটা আড়ালে গিয়ে । ওদের টিফিন বক্সে বিভিন্ন ধরনের খাবার আর আমার  বড়ো বড়ো রুটি শুকনো আলু ভাজা আর মায়ের অনেক আদর ভালোবাসা। কলেজ শেষে প্রায় এক ঘন্টা পায়ে হেঁটে শিয়ালদহ স্টেশন। এখানে ৯টা সাড়ে ৯টা লাই স্টাডি করে ১১টা সাড়ে ১১টায় বাড়ি পৌঁছাতাম।  সেকেন্ড ইয়ার থেকে একটু ফ্রি হলাম। টুকটক টিউশনি পেলাম,যাদবপুরে থাকার ব্যবস্থা হলো। 

কলেজে কাজের চাপ বাড়তে থাকে, শুরু হলো অনিয়ম। ফাইনাল ইয়ারে শেষ কাজে শেষ ব্রাশিং করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলি। অসভ্য যক্ষ্মা অনেক আগেই বুকে বাসা বেঁধেছে। স্টুডেন্ট হেলথ হোমের ফ্রি চিকিৎসা শুরু। দিনের পর দিন শুয়েই থাকতাম। মাঝে মাঝে এক ধরনের কষ্ট হতো। মনে হতো মাথার চুল টুল সব ছিঁড়ে ফেলি। অন্ধকার ভালো লাগতো। নিজেকে শুকনো খেজুর গাছ মনে হতো। শুয়ে শুয়ে আল্লাহ্কে বলতাম, আল্লাহ্ গো এতো কিছুর পরে আমি চলে যাবো পৃথিবী ছেড়ে । আমি কি কেবল হেরেই গেলাম। বিভি-এ রেজাল্ট বের হবার সময় এসে গেল । অনেকটা সুস্থতার দিকে আমি। নিজেকে খুঁজে পেতে লাগলাম। 



জহিরুলঃ অশ্রু ধরে রাখা কষ্ট হয়ে পড়ছে আমার। কিন্তু সব টানেলের শেষেই আলো থাকে।  

সারফুদ্দিনঃ প্রায় চার  মাস পর আবার ছবি আঁকা শুরু নতুন উদ্যমে । ছবির মোড় একদম ঘুরে গেল । ছবির ধর পাল্টে গেল।গতির ঘোড়া আঁকা শুরু। সব মিলিয়ে আমি নতুন। 

এর মধ্যে বন্ধু সঞ্জীবন জানালো " বাংলাদেশের এক পাবলিকেশন্সে চাকরির ইন্টারভিউ আছে তুই কি দিবি" ।ইন্টারভিউ দিলাম, ওরা ওই দিনেই বললেন "আপনি পাসপোর্ট রেডি করেন আমি গিয়ে এপোয়েন্টমেন্ট লেটার পাঠাবো"। এ আমার জন্যে এক বিশাল পাওনা। এ যেনো বিশাল হতাশা নিবারণের মোক্ষম ঔষাধি।

প্রায় তিন মাস লেগে গেল পাসপোর্ট পেতে। কেবল একটা লেটার আর দুটো কনট্যাক্ট নম্বর নিয়ে পাড়ি দিলাম আমার ছোটো বেলা থেকে ভালো লাগার দেশে, ভালোবাসার দেশে। যে দেশে শুধু বাংলা।  ঢাকার মালিবাগ বাস স্ট্যান্ডে তখন রাত্রি ১১টা। কারোকেই চিনি না।  ফোন বুথ থেকে কল করলাম। ওপার থেকে তার ড্রেস আর শরীরের বর্ণনা ভেসে আসলো। পুরো ব্যাপারটা অ্যাডভেঞ্চার মনে হচ্ছে। হ্যান্ডশেক করতে করতে বললেন আমি সাজিদ, আমাকেই অফিস থেকে পাঠিয়েছে আপনি নিশ্চয় সারফুদ্দিন । 

ঢাকায় দাঁড়িয়ে প্রথম যে বাংলাদেশির সঙ্গে পরিচয় হলো তিনি সাজিদ ভাই । কোলকাতায় ইন্টারভিউ নিয়েছিলেন পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্সে ডিরেক্টর কাওসার হাসান।  দীর্ঘ আট বছর চাকরি করেছি আর্ট ওয়ার্ক ইনচার্জ হিসাবে। পরিশেষে বলতেই হয় ইন্ডিয়া আমায় চোখ দিয়েছে আর দেখতে শিখিয়েছে বাংলাদেশ।

জহিরুলঃ একেবারে সিনেমার গল্পের মতো। 

সারফুদ্দিনঃ একদম। অনেক মজার ছিলো,  সিনেমার গল্পই মনে হত প্রত্যেকটা দিন। যা মন চায় তাই করতে পারছি, যেনো লাগাম ছাড়া বলিষ্ঠ ঘোড়া। কিন্তু গ্যালারিতে যখন এক্সিবিশান দেখতে যেতাম। আনমনা হয়ে পড়তাম। । কামালউদ্দিন ছিল খুব ভালো বন্ধু,ও বর্তমানে  চারুকলার লেকচারার। বেশ নাম করেছে। ও-ই নিয়ে যেত বিভিন্ন  প্রদর্শনীতে। বিভিন্ন  স্বনামধন্য আর্টিস্টদের স্টুডিওতে। শেখ আজাল স্যার, জামাল স্যারের কাজ সরাসরি দেখে মুগ্ধ হতাম। এতো মজার মাঝে মন খারাপ হতে শুরু হলো। কান্না আসতো যখন গ্যালারিতে ছবি দেখতাম। আমি তো কেবল ফর্মায়েশি ছবি আকঁছি। আমি তো দিন দিন ডিজিটাল হয়ে যাচ্ছি। আট বছরে একটাও মনের মতো, নিজের জন্যে ছবি  আকঁতে পারলাম না।  ২০১০ সালে এ চাকরি ছেড়ে কলকাতায় চলে আসি। বাড়িতে এবং পাড়ার সবাই ভাবলো নির্ঘাত পাগল হয়ে গেছি। এতো সুন্দর চাকরী কেউ ছাড়ে!

২০১১ তে ছবি আঁকতে বসি কিন্তু কিছুতেই ছবি হয় না । ছবি ভুল হলে রঙের প্যালেটে  clt+z খুঁজছি । ছবি থেকে উঠে আসার সময় clt+s খুঁজি । খুব অস্থির লাগছিল।  আদৌ কি আর ছবি ধরা দেবে না! বড় অভিমান করেছে ছবি। অভিমান ভাঙতে শুরু হলো ঘোড়া আঁকা দিয়ে, গতি বহুল ঘোড়া । ২০১২ থেকে ছবি হওয়ার ইঙ্গিত পেলাম,শান্ত হল মন।  শুরু হল অস্থিরতা থেকে  নিস্তার পাবার পালা। ঘোড়ার পাশাপাশি সমান তালে প্রকৃতি আর ময়না সিরিজ। ময়না হল ১০ বছরের জেলের মেয়ে, তাকে কেন্দ্র করে ময়না সিরিজ

বেশ ভালোই চলছিল । আসলো হাতছানি  আর এক লোভনীয় চাকরির, রাজধানী নিউ দিল্লি থেকে, ইলাস্ট্রেশনের কাজ, প্রচুর টাকা বেতন।  ভালোই লাগছিল মিউজিয়ামের বড়ো  বড়ো ইলাস্ট্রেশন পেন্সিলে হামজানামা স্টাইলে। তার মধ্যে একটা ছিল ১০ ১৯ ফুট। 

প্রচুর টাকায় বিলাসিতার খিদে মিটলেও মনের খিদে বাড়লো চরমে। ৮ মাসে হাঁপিয়ে উঠেছিলাম, ফিরে আসলাম চাকরী ছেড়ে বাড়িতে। এখন প্রকৃতি, নারী, শিশু, ঘোড়া নিয়ে বেশ আছি। এখন বাংলাদেশে যাই, নেপালে যাই,  আমার দেশের বিভিন্ন রাজ্যে যাই, অন্যান্য দেশ থেকে হাতছানি আসে, চাকরির জন্যে নয়, এক্সিবিশান, ওয়ার্কশপ, আর্ট ক্যাম্প কিংবা শিক্ষার্থীদের ডেমনেস্ট্রশন দেয়ার জন্যে।  

এটাই তো চেয়েছিলাম । পরিবার, সমাজ এবং প্রকৃতি থেকে ভালো মন্দ যা পাই সবটাই আমার শিল্পকলা চর্চায় রসদ জোগায় সারাক্ষণ। ভালো অনুভূতি শান্তি দেয়, সুনীতি দুর্নীতির উর্দ্ধে থাকতে শেখায় । পেছনের মন্দ অনুভূতিগুলো নিষ্ঠা, একাগ্রতা, কাজের প্রতি সততা আর গতি বাড়ায়।

 

জহিরুলঃ ধর্ম নিরপেক্ষতার প্রতি পুরো ভারতের না হলেও, পশ্চিমবঙ্গের শক্ত অঙ্গিকার আছে। একজন ধর্মীয় সংখ্যালঘু শিল্পী হিসেবে মর্যাদার বৈষম্য উপলব্ধি করেন?

সারফুদ্দিনঃ হ্যাঁ  তুলনামূলকভাবে পশ্চিমবঙ্গে এখনও বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষজনের মধ্যে সম্প্রতি বজায় আছে। তবে বেশি দিন থাকবে বলে মনে হয় না। তার গন্ধ একটু একটু প্রবাহিত হওয়া শুরু হয়েছে। নিজ জাতির মধ্যে বৈষম্য যতটা ক্ষতিকর তার চাইতে অনেক বেশি ক্ষতিকর ধর্ম-বৈষম্য। কিছু সংখ্যক মানুষ তাদের স্বার্থ চরিতার্থ করতে এর সৃষ্টি করে। আমরা প্রত্যেকেই অবগত এই বিভাজনের ইতিহাস সম্পর্কে।  যেদিন থেকে মানুষের মধ্যে লোভ চরম সীমায় পৌঁছায় এবং নিজেই সর্বেসর্বা প্রতিষ্ঠায় মত্ত  হয় সেদিন থেকে এই খেলার শুরু।  আমাদের দেশে দুটোই আছে, অর্থাৎ, উঁচু-জাত নিচু-জাত আর ধর্মের ভিত্তিতে সংখ্যালঘু, সংখ্যাগুরু যা কি না অতি ভয়ঙ্কর। যোগ্য ছাত্রছাত্রী যোগ্যতার ভিত্তিতে ভিন্ন ভিন্ন গুরুত্বপুর্ণ বিষয়ে পড়াশোনা করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত ,যোগ্য ব্যক্তি চাকরি থেকে বঞ্চিত  যা কিনা সুস্থ সমাজের জন্যে ভীষণ ক্ষতিকর। কলেজ জীবন থেকে টুকটাক এর উপলব্ধি হয়েছে, সেটা এখন অনেক বেশি, বুঝতে পারি আমাকে অন্য চোখে দেখছে। যে বা যারা ধর্মকে হাতিয়ার করে আমার ক্ষতি করার চেষ্টা করেছে তাদেরকে আমার অসংখ্য ধন্যবাদ। কারণ তারা প্রকৃতপক্ষে আমার কাজ করার গতিকে ত্বরান্বিত করেছে। সংখ্যালঘু হিসাবে সরকারী যে সুযোগ সুবিধা তা কখনো গ্রহণ করিনি। এই বিভাজনকে আমি ঘৃণা করি। এই ধর্মীয় বিভাজন রাজনৈতিক ব্যাবসার মুলধন ছাড়া আর কিছু না। ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য ঘুচলে এবং ধনী-দরিদ্রের ভিত্তিতে সংখ্যালঘু  সংখ্যাগুরু বিভাজন না হলে এবং সেই অনুপাতে সরকারি সুযোগ সুবিধা বন্টন হলে পৃথিবী শান্ত হতে বাধ্য ।



জহিরুলঃ পরিবারে কে কে আছেন? তারা আপনার শিল্পচর্চায় কতটা সহায়ক ভূমিকা রাখেন?

সারফুদ্দিনঃ আমাদের যৌথ পরিবারে  মা, ভাইয়েরা, ভাবীরা, ভাইপো, ভাইঝিরা আর তাদের ছেলে মেয়ে অর্থাৎ  নাতি এবং নাতনী।না, এখনো আমি ছবির আসল ব্যাপারটা বোঝাতে পারিনি আমার পরিবার এবং প্রতিবেশিদের। ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞা থাকার কারণে ওরা বোঝার চেষ্টাও করেনি। প্রথম দিকে ধর্মীয় কারণে মা একটু আপত্তি জানালেও পরে যখন  চাকরি পেলাম তখন থেকে সবাই ভালো চোখে দেখে। এখন  দেশ-বিদেশ থেকে  বিভিন্ন গুণীজনেরা আমার স্টুডিওতে আসেন, এতে করে পরিবারের সদস্যরাসহ এলাকার ছোট থেকে বড় সবাই খুশি হয়, আমি  উৎসাহিত হই।  তারপরেও মাঝে মাঝে শুনতে হয় ছবি আঁকা গুনাহর কাজ। যে ঘরে ছবি থাকে সে ঘরে রহমতের ফেরেশতা ঢোকে না , বিচারের দিনে সমস্ত প্রাণীর ছবিগুলোতে প্রাণ দিতে হবে ইত্যাদি । আরো আছে হঠাৎ  করে রাস্তায় কোনো শুভাকাঙ্ক্ষী  দাঁড়  করিয়ে প্রশ্নের পর প্রশ্ন   "কিরে চাকরিটা ছাড়লি কেন? বাংলাদেশে তো অনেক টাকার চাকরি করতিস। এখন আর আর্টিস্ট করিস? একদম কাজ করিস না নাকি রে? জমানো টাকা আর কতো খাবি? ওতো একদিন শেষ হয়ে যাবে " ইত্যাদি ইত্যাদি ।

এদের এতো প্রশ্নে মাঝে মাঝে আমি ভাবি, আমি কে? এদের কাছে আমি কি? আমি ভাগ্যবান আমাকে নিয়ে এরা কতো ভাবে। আশায়  আছি নিশ্চয়ই একদিন না একদিন এরা সুন্দর উত্তর পাবে!

জহিরুলঃ আমিও ওদের মতোই জিজ্ঞেস করি, এই মুহূর্তে ছবি আঁকা ছাড়া অর্থ উপার্জনের জন্য কি আপনাকে আর কিছু করতে হচ্ছে?

সারফুদ্দিনঃ ছবি আঁকার পাশাপাশি গেস্ট লেকচারার ধাউলি কলেজ অফ আর্ট এন্ড ক্রাফটস, উড়িশা, ইন্ডিয়া।  এছাড়া ইলাস্ট্রেশন, বুক কভার, গ্রাফিক্স ডিজাইন এবং কমিশন ওয়ার্ক। আর বর্তমানে ডিরেক্টর,  কুলো ক্রিয়েটিভ সোসাইটি।

Comments

  1. Sarfuddin is an immensly talented artist with a very clear and powerful inner sight. I know about his struggle but observed with awe that it could never become successful in wiping the confident smile from his face. He is always eager to know a subject more and has kin interests in holistic knowledge. Though he works in varied medium but I particularly like his water colours which are free flowing and transparent. His explicitly expressed ideology proves that petty politics or religion does not have any effect on him and that way he is definitely a superior human being. His overwhelming passion for art reflects his sincerity and honesty. I regard him as a fine artist and trust that his works would be appreciated by many.

    ReplyDelete
  2. Sarfuddin is an immensly talented artist with a very clear and powerful inner sight. I know about his struggle but observed with awe that it could never become successful in wiping the confident smile from his face. He is always eager to know a subject more and has kin interests in holistic knowledge. Though he works in varied medium but I particularly like his water colours which are free flowing and transparent. His explicitly expressed ideology proves that petty politics or religion does not have any effect on him and that way he is definitely a superior human being. His overwhelming passion for art reflects his sincerity and honesty. I regard him as a fine artist and trust that his works would be appreciated by many.

    ReplyDelete
  3. Sarfuddin is an immensly talented artist with a very clear and powerful inner sight. I know about his struggle but observed with awe that it could never become successful in wiping the confident smile from his face. He is always eager to know a subject more and has kin interests in holistic knowledge. Though he works in varied medium but I particularly like his water colours which are free flowing and transparent. His explicitly expressed ideology proves that petty politics or religion does not have any effect on him and that way he is definitely a superior human being. His overwhelming passion for art reflects his sincerity and honesty. I regard him as a fine artist and trust that his works would be appreciated by many.

    ReplyDelete
  4. Apart from being a great artist, Sarfuddin Da is a very calm person.

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

শিল্পী কাজী রকিবের সাক্ষাৎকার

নন-একাডেমিক শিল্পীরাই নতুন কিছু দেয় -    কাজী রকিব  [কাজী রকিব বাংলাদেশের একজন গুণী শিল্পী। রাজশাহী আর্ট কলেজের একজন প্রতিষ্ঠাতা-শিক্ষক। কলেজের প্রথম ক্লাসটি নেবার কৃতিত্বও তাঁর। নিরন্তর ছবি আঁকেন। নানান মাধ্যমে ,  নানান ভাবনার ছবি। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে সস্ত্রীক বসবাস। তার স্ত্রী মাসুদা কাজীও একজন গুণী শিল্পী। বৈচিত্রপ্রিয় এই শিল্পীর একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন কবি কাজী জহিরুল ইসলাম। ধারাবাহিকভাবে তা এখানে প্রকাশ করা হবে। আজ উপস্থাপন করা হলো প্রথম পর্ব।]   জহিরুলঃ  বেশিরভাগ শিল্পীই নিজের একটা স্টাইল তৈরি করেন ,  নিজস্বতা যাকে আমরা বলি। আবার কেউ কেউ একই ধরণের ছবি বারবার আঁকেন। আপনার কাজে বৈচিত্র খুব বেশি ,  এতে করে "টাইপড" অপবাদ থেকে আপনি মুক্ত কিন্তু নিজের একটি স্টাইল তৈরি করতে না পারা বা তৈরি হয়নি বলে কি আক্ষেপ হয় ,  নাকি এই যে ভার্সেটিলিটি এটাই আপনি বেশি উপভোগ করেন ?    রকিবঃ   আমি আসলে আলাদা করে ভাবিনি এই স্টাইল বিষয়ে। কারো মতো আঁকারও চেষ্টা করিনি তেমন ভাবে। অল্প বয়সে ,  আমার ১৯ / ২০ বছর বয়সে ,  সালভাদর দালির মতো আঁকতে চেষ্টা করেছিলাম কিছুদিন ।

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জুর সাক্ষাৎকার || পর্ব ৭

মতিউর রহমান চৌধুরীকে  র‍্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কারের জন্য নমিনেট করেছিলেন  আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু       [লেখক, সাংবাদিক, অনুবাদক আনোয়ার হোসেইন মঞ্জুর সাক্ষাৎকারের সপ্তম  পর্ব আজ প্রকাশ করা হলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কবি কাজী জহিরুল ইসলাম।]          জহিরুলঃ  আপনার সাংবাদিকতা জীবনের প্রায় পুরোটাই ব্যয় করেছেন জাতীয় সংসদ কভার করে। এই সংসদে আমাদের সংবিধানের অনেকগুলো সংশোধনী পাশ হয়েছে। আমাদের নেতারা সব সময় বলেন, ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড় কিন্তু প্রকৃত চিত্র হচ্ছে দেশের চেয়ে দলের স্বার্থ বড় হয়ে ওঠে এবং দলের চেয়ে ব্যক্তির/পরিবারের স্বার্থই বেশি গুরুত্ব পায়। প্রধান প্রধান সংশোধনীগুলোর আলোকে যদি বিশ্লেষণ করেন কতোটা জাতীয় স্বার্থে আর কতটা ব্যক্তি বা পরিবারের স্বার্থে এইসব সংশোধনীগুলো করা হয়েছে।    মঞ্জুঃ   আপনি ঠিকই বলেছেন, এযাবত বাংলাদেশে ১১টি জাতীয় সংসদ গঠিত হয়েছে এবং এর মধ্যে দ্বিতীয় সংসদ থেকে নবম সংসদ পর্যন্ত মোট আটটি সংসদের অধিবেশন কভার করা সুযোগ হয়েছে আমার। আমার সংসদ কভারের সময়ে আমাদের সংবিধানের ১০টি সংশোধনী অনুমোদিত হয়েছে এবং সংশোধনী প্রক্রিয়া কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। এখন পর্যন্ত স

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জুর সাক্ষাৎকার - তৃতীয় পর্ব

মঞ্জু আমার ওপর রাগ করেছে                                                           - আল মাহমুদ [লেখক, সাংবাদিক, অনুবাদক আনোয়ার হোসেইন মঞ্জুর সাক্ষাৎকারের  তৃতীয় পর্ব আজ প্রকাশ করা হলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কবি কাজী জহিরুল ইসলাম।]  সাক্ষাৎকার নেবার এক পর্যায়ে আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু  ও কাজী জহিরুল ইসলাম। ওয়ান্টাগ পার্ক, নিউ ইয়র্ক।  ছবি তুলেছেন ড. মাহবুব হাসান।   জহিরুলঃ  খুশবন্ত সিং তার সকল বই অনুবাদ করার লিখিত অনুমতি দিলেন আপনাকে এবং সেই অনুমতিপত্রটি তিনি নিজ হাতে আপনার সামনেই বাংলায় লিখে দিলেন। তিনি কিভাবে বাংলা শিখলেন তা কি জানতে পেরেছিলেন ?  মঞ্জুঃ    জ্বি ,  ঘটনাটি  ঘটে  ১৯৯২ সালের ডিসেম্বর মাসে ,  এ সম্পর্কে আমি আগের এক প্রশ্নে বলেছি। তারিখটি আমার স্মরণে নেই। তবে বাবরি মসজিদ ধ্বংস করার পর ,  ডিসেম্বরের শেষ দিকে। না ,  বাংলায় নয় ,  উনি ইংরেজিতে লিখেছেন। আমার কফি পানের সময়ের মধ্যেই লিখে দিয়েছেন। ১৯৮৪ থেকে মাঝে দীর্ঘ বিরতি দিয়ে আমাকে তিনটি বা চারটি চিঠি লিখেছেন। লিখেছেন বলতে আমার চিঠির উত্তর দিয়েছেন। প্রতিটি চিঠি ইংরেজিতেই লিখেছেন। প্রতিটি চিঠিতে আমাকে সম্বোধন করেছেন  “ আনোয়ার ভাই ,”  বলে।