Skip to main content

রাজনীতির ফায়দা নেয়ার কৌশল

 রাজনীতির রঙ

 || কাজী জহিরুল ইসলাম || 



ঊননব্বুই সালের শেষের দিকের কথা। তখন এরশাদ সরকার ক্ষমতায়। আমি তখনো কোনো চাকরি বাকরিতে যোগ দেই নাই। কবিতা লেখিআড্ডা মারিআর রাস্তায় রাস্তায় ঘুরি। বেশ কিছু সাহিত্য সংগঠনের সাথে তখন সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলাম। কবি জসীম উদদীন পরিষদঅনুপ্রাসউদীচীশতাব্দী এইসব। অনুপ্রাসের সহ-সভাপতি ছিলেন কবি জাহাঙ্গীর হাবীব উল্লাহ (তার নাম কেউ হাবিবুল্লাহ লেখলে খুব রেগে যেতেন।) গীতিকার অনিমেষ বড়ালও অনুপ্রাস করতেন। চলি পদ্মাপাড় কাব্যগ্রন্থের কবি শেখ সামসুল হক তখন ছিলেন দৈনিক নব-অভিযান পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক। তিনিও অনুপ্রাস করতেন। তার কারণে নব-অভিযানে আমি প্রচুর লিখেছি তখন। আমাদের দলনেতা ছিলেন খোশনূর আলমগীর (তখন এটাই তার নাম ছিল)। অনিমেষ বড়াল আমার চেয়ে বয়সে কিছু বড়। বাংলা সাহিত্যে এমএ পাস করে হন্যে হয়ে চাকরি খুঁজছেন। জাহাঙ্গীর হাবীব উল্লাহ তখন আনসার ভিডিপির পাক্ষিক মুখপত্র প্রতিরোধ পত্রিকার সম্পাদক। একদিন সামসু ভাই আমাকে আর অনিমেষ বড়ালকে ডেকে বলেনতোমরা জাহাঙ্গীর ভাইয়ের সাথে দেখা করো। তার ওখানে দুইটা পোস্ট খালি আছে। আমরা দেখা করতে গেলে জাহাঙ্গীর ভাই অনিমেষ বড়ালকে সাথে সাথেই চাকরি দিয়ে দেন। আমাকে দেন না। আমার অবশ্য আগ্রহও একটু কম ছিল। এরপরে একদিন প্রেসক্লাবে জাহাঙ্গীর ভাইয়ের সাথে দেখা হলে তিনি আমাকে অভিভাবকসুলভ ধমক দিয়ে বলেনলাফাঙ্গার মতো ঘুরে বেড়ালে হবেকাল সকালে আমার অফিসে আসবে। পরদিন তার অফিসে গেলে তিনি আমাকেও অনিমেষের পাশের টেবিলটিতে বসিয়ে দেন। আমার হাসফাস লাগে। একদিন শতাব্দীর পিকনিক। সবাই পিকনিকে গেছেজাহাঙ্গীর হাবীব উল্লাহ আমাকে ধমক দিয়ে বলেনএইটা অফিসকোনো ক্লাব না। নিজেকে খাঁচায় বন্দী পাখির মতো অসহায় লাগে। বুক ভেঙ্গে কান্না আসে। আমি বাথরুমে গিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে অনেকক্ষণ কাঁদি আর আনসারের জলে চোখ ধোয়ার চেষ্টা করি।

জাহাঙ্গীর ভাই একদিন ধমক দিয়ে বলেনএইখানে ভাই-টাই চলবে না। স্যার বলতে হবে। তখন উদাহরণ হিসেবে সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলালের ঘটনাটি আমাকে সবিস্তারে বলা হয়। জাহাঙ্গীর হাবীব উল্লাহর আগে প্রতিরোধের সম্পাদক ছিলেন আরেফীন বাদল। তাকে স্টাফরা সবাই বাদল ভাই ডাকতেন। সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল প্রতিরোধের একজন প্রুফ রিডার ছিলেন। বাদল ভাই চলে গেলে জাহাঙ্গীর ভাই সম্পাদক হন। জাহাঙ্গীর ভাইয়ের কড়া নির্দেশভাই-টাই চলবে নাফাজলামো না-কিএটা সরকারী অফিস। সরকারী অফিসের একটা ডেকোরাম আছে। অন্য সবাই মেনে নিলেও দুলাল কিছুতেই মানবেন না। তিনি কিছুতেই স্যার বলবেন না। এই দ্বন্দ্বের জের ধরে দুলাল অফিসে আসাই বন্ধ করে দেন। এরপর কোনো এক সময়ে তিনি চাকরি ছেড়ে দেন বা তাকে বহিস্কার করা হয়। তার শূন্য পদেই অনিমেষ বা আমি যোগ দেই। অনিমেষ আজো সেখানেই আছেনআমি পাঁচ মাসের মধ্যেই কেটে পড়ি। একটি জিনিস লক্ষ করেছি সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল প্রায়ই ফেইসবুকে স্ট্যাটাস দেন খালেদা জিয়া তার চাকরি খেয়েছে। আসলে দুলাল যখন প্রতিরোধ ছাড়েন তখন ক্ষমতায় ছিল এরশাদখালেদা জিয়া নয়। কেন তিনি খালেদা জিয়ার ওপর দোষ চাপানআওয়ামী লীগের কাছে যাওয়ার জন্যআর প্রতিরোধের প্রুফ রিডারের চাকরি থাকা বা না থাকার সাথে সরকার প্রধানের নাম জড়ানোটাও আমার কাছে হাস্যকর লাগে। সেটা এরশাদ বা খালেদা যে-ই হোক। তার চাকরি চলে গেছে বা তিনি নিজেই ছেড়েছেনযে কারণে তা তো একান্তই তার ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব জাহাঙ্গীর হাবীব উল্লাহর সাথে। স্যার বলা বা না বলা নিয়ে। এই অসন্তোষ জাহাঙ্গীর হাবীব উল্লাহর প্রতি আমারও ছিল। যদিও আমি সেখানে দীর্ঘদিন কাজ করার উদ্দেশ্য নিয়ে যাইনি তারপরেও পাঁচ মাসের মধ্যে ছেড়ে দেওয়ার এটাও একটা কারণ হতে পারে। তো ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বে চাকরি হারানোর ঘটনাকে রাজনীতির রঙ দিয়ে বারবার উপস্থাপন করাটা আমার কাছে অনৈতিক মনে হয়।

আমি অবশ্য আমার পাঁচমাসের প্রতিরোধ (অবরোধ)-বাসকালে সহকর্মীদের কাছে দুলাল-উপাখ্যান যা শুনেছি তাই বললাম। প্রকৃত সত্য যদি অন্য কিছু হয় তা সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল আমাদের জানাতে পারেন। ফেইসবুকে অনিমেষ বড়াল এবং আশরাফুল মান্নান ভাই আছেনতারাও চাইলে কোনো সংশোধনী দিতে পারেন।

 

হলিসউড, নিউইয়র্ক। ১৫ নভেম্বর, ২০১৯

Comments

Popular posts from this blog

শিল্পী কাজী রকিবের সাক্ষাৎকার

নন-একাডেমিক শিল্পীরাই নতুন কিছু দেয় -    কাজী রকিব  [কাজী রকিব বাংলাদেশের একজন গুণী শিল্পী। রাজশাহী আর্ট কলেজের একজন প্রতিষ্ঠাতা-শিক্ষক। কলেজের প্রথম ক্লাসটি নেবার কৃতিত্বও তাঁর। নিরন্তর ছবি আঁকেন। নানান মাধ্যমে ,  নানান ভাবনার ছবি। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে সস্ত্রীক বসবাস। তার স্ত্রী মাসুদা কাজীও একজন গুণী শিল্পী। বৈচিত্রপ্রিয় এই শিল্পীর একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন কবি কাজী জহিরুল ইসলাম। ধারাবাহিকভাবে তা এখানে প্রকাশ করা হবে। আজ উপস্থাপন করা হলো প্রথম পর্ব।]   জহিরুলঃ  বেশিরভাগ শিল্পীই নিজের একটা স্টাইল তৈরি করেন ,  নিজস্বতা যাকে আমরা বলি। আবার কেউ কেউ একই ধরণের ছবি বারবার আঁকেন। আপনার কাজে বৈচিত্র খুব বেশি ,  এতে করে "টাইপড" অপবাদ থেকে আপনি মুক্ত কিন্তু নিজের একটি স্টাইল তৈরি করতে না পারা বা তৈরি হয়নি বলে কি আক্ষেপ হয় ,  নাকি এই যে ভার্সেটিলিটি এটাই আপনি বেশি উপভোগ করেন ?    রকিবঃ   আমি আসলে আলাদা করে ভাবিনি এই স্টাইল বিষয়ে। কারো মতো আঁকারও চেষ্টা করিনি তেমন ভাবে। অল্প বয়সে ,  আমার ১৯ / ২০ বছর বয়সে ,  সালভাদর দালির মতো আঁকতে চেষ্টা করেছিলাম কিছুদিন ।

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জুর সাক্ষাৎকার || পর্ব ৭

মতিউর রহমান চৌধুরীকে  র‍্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কারের জন্য নমিনেট করেছিলেন  আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু       [লেখক, সাংবাদিক, অনুবাদক আনোয়ার হোসেইন মঞ্জুর সাক্ষাৎকারের সপ্তম  পর্ব আজ প্রকাশ করা হলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কবি কাজী জহিরুল ইসলাম।]          জহিরুলঃ  আপনার সাংবাদিকতা জীবনের প্রায় পুরোটাই ব্যয় করেছেন জাতীয় সংসদ কভার করে। এই সংসদে আমাদের সংবিধানের অনেকগুলো সংশোধনী পাশ হয়েছে। আমাদের নেতারা সব সময় বলেন, ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড় কিন্তু প্রকৃত চিত্র হচ্ছে দেশের চেয়ে দলের স্বার্থ বড় হয়ে ওঠে এবং দলের চেয়ে ব্যক্তির/পরিবারের স্বার্থই বেশি গুরুত্ব পায়। প্রধান প্রধান সংশোধনীগুলোর আলোকে যদি বিশ্লেষণ করেন কতোটা জাতীয় স্বার্থে আর কতটা ব্যক্তি বা পরিবারের স্বার্থে এইসব সংশোধনীগুলো করা হয়েছে।    মঞ্জুঃ   আপনি ঠিকই বলেছেন, এযাবত বাংলাদেশে ১১টি জাতীয় সংসদ গঠিত হয়েছে এবং এর মধ্যে দ্বিতীয় সংসদ থেকে নবম সংসদ পর্যন্ত মোট আটটি সংসদের অধিবেশন কভার করা সুযোগ হয়েছে আমার। আমার সংসদ কভারের সময়ে আমাদের সংবিধানের ১০টি সংশোধনী অনুমোদিত হয়েছে এবং সংশোধনী প্রক্রিয়া কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। এখন পর্যন্ত স

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জুর সাক্ষাৎকার - তৃতীয় পর্ব

মঞ্জু আমার ওপর রাগ করেছে                                                           - আল মাহমুদ [লেখক, সাংবাদিক, অনুবাদক আনোয়ার হোসেইন মঞ্জুর সাক্ষাৎকারের  তৃতীয় পর্ব আজ প্রকাশ করা হলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কবি কাজী জহিরুল ইসলাম।]  সাক্ষাৎকার নেবার এক পর্যায়ে আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু  ও কাজী জহিরুল ইসলাম। ওয়ান্টাগ পার্ক, নিউ ইয়র্ক।  ছবি তুলেছেন ড. মাহবুব হাসান।   জহিরুলঃ  খুশবন্ত সিং তার সকল বই অনুবাদ করার লিখিত অনুমতি দিলেন আপনাকে এবং সেই অনুমতিপত্রটি তিনি নিজ হাতে আপনার সামনেই বাংলায় লিখে দিলেন। তিনি কিভাবে বাংলা শিখলেন তা কি জানতে পেরেছিলেন ?  মঞ্জুঃ    জ্বি ,  ঘটনাটি  ঘটে  ১৯৯২ সালের ডিসেম্বর মাসে ,  এ সম্পর্কে আমি আগের এক প্রশ্নে বলেছি। তারিখটি আমার স্মরণে নেই। তবে বাবরি মসজিদ ধ্বংস করার পর ,  ডিসেম্বরের শেষ দিকে। না ,  বাংলায় নয় ,  উনি ইংরেজিতে লিখেছেন। আমার কফি পানের সময়ের মধ্যেই লিখে দিয়েছেন। ১৯৮৪ থেকে মাঝে দীর্ঘ বিরতি দিয়ে আমাকে তিনটি বা চারটি চিঠি লিখেছেন। লিখেছেন বলতে আমার চিঠির উত্তর দিয়েছেন। প্রতিটি চিঠি ইংরেজিতেই লিখেছেন। প্রতিটি চিঠিতে আমাকে সম্বোধন করেছেন  “ আনোয়ার ভাই ,”  বলে।