Skip to main content

শিল্প কী?

 আমার শিল্পভাবনা

|| কাজী জহিরুল ইসলাম || 



যখন থেকে, জেনে বা না জেনে, লেখালেখির সঙ্গে জড়িয়েছি, তখন থেকেই এই বিতর্কের সঙ্গেও জড়িয়ে গেছি, শিল্পের জন্য শিল্প না-কী জীবনের জন্য শিল্প। এই বিতর্কের অবসান ঘটাতে হলে শিল্প কী তা উপলব্ধি করা দরকার। আমি খুব সতর্কতার সাথে উপলব্ধি শব্দটি ব্যবহার করছি, জানা দরকার বলছি না। আমি সাধারণত বিখ্যাত মানুষের উদ্ধৃতি দিয়ে কোনো ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই না। প্রবন্ধ লেখার প্রচলিত ধারা হচ্ছে তথ্য-উপাত্ত এবং বিখ্যাতদের সংজ্ঞার আলোকে কোনো ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করা। আমি এই ধারা থেকে বের হয়েই কিছু লিখতে চাই। আমি শুধু লিখতে চাই আমার উপলব্ধির কথা। এবং এ-ও বলি, আমার উপলব্ধির যেটুকু আপনার ভালো লাগে সেটুকুই আপনি নেবেন, আমি কোনো সংজ্ঞা তৈরী করতে চাই না যা অন্যদের গ্রহন করতে হবে। তবে আমি সকল বিখ্যাত মানুষের কথাই জানতে চাই, পড়তে চাই। তারা কী লিখেছেন, বলেছেন তা জানার আগ্রহ আমার রয়েছে। আরো সুস্পস্ট করে যদি বলি, আমি সকলকেই গ্রহণ করতে চাই, কিন্তু দেবার সময় শুধু আমারটাই দেব, আমার মত করে। 

মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক (সৃজনশীল এবং মননশীল) ক্ষমতা যদি একটি বোতাম টিপে বন্ধ করে দেয়া যায় তাহলে থাকবে শারীরীক ক্ষমতা। বুদ্ধিহীন মানুষ একটি অবলা পশুর মত। তার শরীর যদি সুস্থ থাকে সে দুটি কাজ অবশ্যই করবে। খাদ্য গ্রহন করবে এবং যৌনকর্ম করবে। যেহেতু সে ভালো-মন্দ বোঝে না, কখনো সে না বুঝেই ধ্বংস করবে আবার কখনো না বুঝেই সৃষ্টি করবে। কারণ এই প্রবৃত্তিগুলো তার মধ্যে প্রাকৃতিকভাবেই তৈরী হবে। যে রিপুগুলোকে আমরা শিক্ষা এবং মানবিক বোধ দিয়ে দমন করি সেগুলো সে করবে না, তার জেদ, রাগ, ঘৃণা এইসব থাকবে, ভালোবাসাও থাকবে। কারো বা কোনো গোষ্ঠীর এই স্বাভাবিক প্রবৃত্তিজাত কর্মকাণ্ড যদি কেউ একজন দেখেন এবং তা যিনি বা যারা দেখেননি তাদেরকে জানান, লিখে, এঁকে, চিহ্ন দিয়ে, বা যে কোনো মাধ্যম ব্যবহার করে, তাকেই শিল্প বলে জেনে এসেছি। যিনি এই জানানোর কাজটি করেন তিনিই শিল্পী। শিল্পী শুধু তার চর্মচক্ষু দিয়েই দেখেন না তার সকল ইন্দ্রিয় দিয়ে দেখেন, অনুভব করেন এবং অন্যকে জানান এমন একটি মাধ্যম ব্যবহার করে যে মাধ্যমে তিনি দক্ষ এবং স্বচ্ছন্দ। শিল্পের সঙ্গে যখন সামাজিক প্রতিশ্রুতি যুক্ত হয়, যেটিকে আমরা জীবনের জন্য শিল্প বলি, তখন শিল্পীর প্রকাশভঙ্গীটি স্বতস্ফূর্ত থাকে না, এর সঙ্গে প্রয়োজনীয়, কল্যাণকর অনুষঙ্গ যুক্ত হয়। তখনই আমরা বলি শিল্প মার খেয়ে গেছে। যে কারণে আর্ট ফিল্মে এতো আনকাট যৌনতা এবং দূর্ভিক্ষ দেখা যায়। পেটের ক্ষুধা আর যৌনক্ষুধাই মানুষের সবচেয়ে মৌলিক চাহিদা বা ইচ্ছা।

আমি যা দেখি তার সঙ্গে মানবিক বোধ যুক্ত করে অন্যের কাছে কমিউনিকেট করাকে শিল্প বলা যাচ্ছে না। কারণ শিল্পের সঙ্গে শুদ্ধতার একটি ব্যাপার আছে। মানবকল্যাণ সেই শুদ্ধতাকে বিনষ্ট করে। তাহলে যা দেখি হুবহু তা-ই উপস্থাপন করবো? এটাই কি শিল্প? শিল্প সম্পর্কে আমার এই মুহূর্তের ভাবনাটি বলি। শিল্পীর একটি তৃতীয় চোখ আছে। সেই চোখ সবকিছু ধারণ করে না, কোনো কোনো দৃশ্য ধারণ করে। সেই ধারণকৃত দৃশ্য অন্যের দেখা দৃশ্য থেকে আলাদা। এই যে শিল্পীর তৃতীয় নয়ন কিছু একটা ধারণ করল সেই দৃশ্যটি সাতপাঁচ না ভেবে, কার উপকার হবে, কার অপকার হবে, কার পক্ষে গেল, কার পক্ষে গেল না এতো সব না ভেবে হুবহু উপস্থাপন করাই হচ্ছে শিল্প। শিল্পীর তৃতীয় নয়ন কি করে? কোনো কিছু দেখার পরে তার ভাবনার জগতে নানান রকম ইমেজ তৈরী করে। সেই ইমেজ খুব আজগুবিও হতে পারে। সেই চিন্তাগুলো, সেই ইমেজগুলো, সম্পাদনা না করে হুবহু উপস্থাপন করাই শিল্প। অর্থাৎ শিল্পীর চর্মচক্ষু যা দেখল তা নয় দেখার পরে শিল্পী যা ভাবল (তৃতীয় নয়নে যা ধরা পড়ল) তার শুদ্ধতাই শিল্প। সেই ভাবনাকে কোনো মতবাদ, ধর্ম, নিয়ম, কল্যাণ-অকল্যাণের ছাঁচে ফেলে নির্মাণ করা যাবে না। শিল্পে শিল্পীর বোধের শুদ্ধতা নিশ্চিত হবে, এটিই আমার শিল্পভাবনা। 

 

হলিসউড, নিউ ইয়র্ক। ৩ জুন ২০১৯

Comments

Popular posts from this blog

অসাধারণ এই শিল্পীর জীবনের গল্প বড় করুণ

  [এই সময়ের অত্যন্ত প্রতিভাবান শিল্পী সারফুদ্দিন আহমেদ। বাড়ি পশ্চিমবঙ্গে। আর্ট কলেজে খণ্ডকালীন শিক্ষকতা করেন ,  আর শুধু ছবি আঁকেন। নানান মাধ্যমে ,  নানান বিষয়ের ছবি। সারফুদ্দিন আহমেদের ছবি থেকে চোখ ফেরানো যায় না ,  আপনাতেই ওঁর নান্দনিক সৃষ্টিকর্মে দৃষ্টি আটকে যায় ,  কী জল রঙ ,  কী অ্যাক্রিলিক ,  কিংবা স্রেফ পেন্সিলের ড্রয়িং। এই গুণী শিল্পীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কবি কাজী জহিরুল ইসলাম। সাক্ষাৎকারটি এখানে উপস্থাপন করা হলো।]       ভারত আমাকে চোখ দিয়েছে ,  বাংলাদেশ দিয়েছে দৃষ্টি -     সারফুদ্দিন আহমেদ     কাজী জহিরুল ইসলামঃ  ব্যাক গ্রাউন্ডে তবলা বাজছে আপনি ছবি আঁকছেন কাচের ওপর।    এই যে বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে ছবি আঁকা, এই ছন্দটা ছবিতে কিভাবে ধরেন? আর কোনো শিল্পী ছবি  আঁ কার সময় যন্ত্রানুসঙ্গ ব্যবহার করেছেন?   সারফুদ্দিন আহমেদঃ   কাঁচ নয়,   এটি এক বিশেষ ধরনের কাপড়-নেট। এই নেটের উপরে বর্তমানে আমার এক্সপেরিমেন্ট চলছে।    জহিরুলঃ ও ,  ফেইসবুকে যখন ছবিটি দেখি কাচের মতো ...

কাজী জহিরুল ইসলামের কবিতা || আবুল কাইয়ুম

কাজী জহিরুল ইসলামের কবিতা: জাতীয়-বৈশ্বিক মেলবন্ধন   || আবুল কাইয়ুম ||    কবি যদি হন বিশ্বপরিব্রাজক ,  তবে তিনি তো কবিতায় আঁকবেন তাঁর দেখা দুনিয়ার ছবি। বৃহত্ত্বকে আশ্লেষ করার পরিণামে স্বাভাবিকভাবে তাঁর মধ্যে জন্ম নেবে মানবিক মহত্ত্ববোধ ,  তা যে কাব্যাদর্শের লাঠিতে ভর করেই হোক। আশির দশক থেকে ক্রমবিকশিত কবি কাজী জহিরুল ইসলামের ক্ষেত্রেও একথা সত্যি । পর্যাপ্ত বিশ্বভ্রমণের অভিজ্ঞতায় আলোকিত হয়েছেন বলেই তিনি যে কোনো সঙ্কীর্ণতার উর্ধ্বে থেকে নিজেকে উদারনৈতিক মানবিক চৈতন্যে সংগঠিত করতে পেরেছেন ,  বিশ্বমানবতা ও বিশ্বশান্তির মন্ত্রে উজ্জীবিত রেখেছেন। তাঁর ব্যক্তিত্বে জড়ো হয়েছে বৃহত্তর সমষ্টিচেতনা ,  তাঁর প্রেম ও প্রার্থনা মানব কল্যাণের আশ্রয়ে গড়ে উঠেছে। তার লেখনীতে নানা দেশের মানুষের জীবন ,  সংস্কৃতি ,  প্রেম ,  ত্যাগ ও সংগ্রামের চালচিত্র কীভাবে উঠে এসেছে তা তাঁর কবিতার সংস্পর্শে না এলে বোঝা যাবে না। তাঁর  ‘ এল সালভাদর ’  শীর্ষক কবিতার কথাই ধরা যাক। এই অত্যুজ্জ্বল কবিতার মাত্র কয়টি বিস্ময়কর পংক্তিই শুধু এখানে তুলে ধরছি-    হণ্ডু...

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জুর সাক্ষাৎকার || পর্ব ৭

মতিউর রহমান চৌধুরীকে  র‍্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কারের জন্য নমিনেট করেছিলেন  আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু       [লেখক, সাংবাদিক, অনুবাদক আনোয়ার হোসেইন মঞ্জুর সাক্ষাৎকারের সপ্তম  পর্ব আজ প্রকাশ করা হলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কবি কাজী জহিরুল ইসলাম।]          জহিরুলঃ  আপনার সাংবাদিকতা জীবনের প্রায় পুরোটাই ব্যয় করেছেন জাতীয় সংসদ কভার করে। এই সংসদে আমাদের সংবিধানের অনেকগুলো সংশোধনী পাশ হয়েছে। আমাদের নেতারা সব সময় বলেন, ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড় কিন্তু প্রকৃত চিত্র হচ্ছে দেশের চেয়ে দলের স্বার্থ বড় হয়ে ওঠে এবং দলের চেয়ে ব্যক্তির/পরিবারের স্বার্থই বেশি গুরুত্ব পায়। প্রধান প্রধান সংশোধনীগুলোর আলোকে যদি বিশ্লেষণ করেন কতোটা জাতীয় স্বার্থে আর কতটা ব্যক্তি বা পরিবারের স্বার্থে এইসব সংশোধনীগুলো করা হয়েছে।    মঞ্জুঃ   আপনি ঠিকই বলেছেন, এযাবত বাংলাদেশে ১১টি জাতীয় সংসদ গঠিত হয়েছে এবং এর মধ্যে দ্বিতীয় সংসদ থেকে নবম সংসদ পর্যন্ত মোট আটটি সংসদের অধিবেশন কভার করা সুযোগ হয়েছে আমার। আমার সংসদ কভারের সময়ে আমাদের সংবিধানের ১০টি সংশোধনী অনুমো...