মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে না পারা আমার সারাজীবনের দু:খ - কাজী রকিব
[কাজী রকিব বাংলাদেশের একজন গুণী শিল্পী। রাজশাহী আর্ট কলেজের প্রতিষ্ঠাতা-শিক্ষক। কলেজের প্রথম ক্লাসটি নেবার কৃতিত্বও তার। নিরন্তর ছবি আঁকেন। নানান মাধ্যমে, নানান ভাবনার ছবি। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে সস্ত্রীক বসবাস। তার স্ত্রী মাসুদা কাজীও একজন গুণী শিল্পী। বৈচিত্রপ্রিয় এই শিল্পীর একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন কবি কাজী জহিরুল ইসলাম। ধারাবাহিকভাবে তা এখানে প্রকাশ করা হবে। আজ উপস্থাপন করা হলো তৃতীয় পর্ব।]
পর্ব -৩
জহিরুলঃ আর্ট কলেজে যাদের পেয়েছিলেন, তারা এখন কে কোথায় আছে? শিল্পী হিসেবে কে কতখানি নাম করেছেন? তখন যাকে বা যাদেরকে খুব প্রমিজিং মনে হয়েছিল পরবর্তি জীবনে কি সেই প্রতিভার প্রতিফলন দেখতে পেয়েছেন?
রকিবঃ আমি যখন ঢাকা আর্টকলেজে ভর্তি হই তখন শিক্ষার্থীদের মধ্যে জ্বলজ্বল করছেন পেইন্টার্স গ্রুপের সদস্যরা। আর যারা কিছু বছর আগে পাশ করে চলে গিয়েছিলেন তাদের মধ্যে শহীদ কবির ও শাহতাব হোসেন আমাদের অনেককেই মুগ্ধ করেছিলেন। শহীদ কবির পরবর্তিতে আমাদের শিক্ষক হয়েছিলেন। তিনি এখন দিকপাল। শাহতাব ভাইকে জীবনানন্দ মনে হতো। ময়মনসিংহে থাকতেন। অল্পবয়সে গিয়ে প্রয়াত হন।
পেইন্টার্স গ্রুপের প্রত্যেকেই প্রতিষ্ঠিত। পেইন্টার্স গ্রুপের বাইরে চোখ ছিলো আমাদের শাহাবুদ্দিন, মোমিনুল রেজা, আসেম আনসারীর দিকে। শাহাবুদ্দিনকে নিয়ে বলার কিছু নাই। আসেম আনসারী চাকুরী জীবনে গিয়ে তেমন ছবি আঁকেন নাই। মোনিনুল রেজা এক প্রকার চোখের আড়ালেই চলে গেলেন।
ফরিদা জামান, সাধনা ইসলাম, নাইমা হক ও শামীম সিকদার জলরংয়ের প্রদর্শনী করে আলোচিত হন। পরবর্তিতে শামীম সিকদারের ভাস্কর্য তেমন ভালো হয়নি, নাইমা হকের এবস্ট্রাকশন অন্যমাত্রা পায়। ফরিদা জামান প্রতিষ্ঠা পান, সাধনা ইসলাম(কবির) খুব ভালো বাটিক মাধ্যমে ছবি আঁকতেন। দীর্ঘ বিরতির পর কামাল কবির আবার কাজ করছেন। আর ছিল রঞ্জিৎ দাস, মাহবুব আকন্দ। মাহবুব আকন্দ পেইন্টিং ছেড়ে ডিজিটাল গ্রাফিক্সে মন দেন। মাহবুব আকন্দ ডিজিটাল গ্রাফিক্সে অন্যমাত্রা আনেন। রঞ্জিৎ দাস প্রতিষ্ঠিত শিল্পী । আমাদে ঢাকা পেইন্টার্সের দশ জনের মধ্যে দীপা হক অকাল প্রয়াত প্রতিষ্ঠিত শিল্পী, আমি এবং তরুণ ঘোষ ব্যাতিত আর কেউ সেভাবে কাজ করে নাই। জামাল আহমেদ , নাসরিন বেগম ও রোকেয়া সুলতানা প্রতিষ্ঠা পান। আমাদের পরে সময় গ্রুপের ঢালী মামুন, নিসার হোসেন প্রতিষ্ঠা পান। এরাই আমার ছাত্রজীবনের আগে-পরের শিল্পী। পরবর্তিকালের আরো বেশ কিছু শিল্পী প্রতিষ্ঠা পান, যাদের আমি ছাত্রজীবনে পাইনি।
জহিরুলঃ ১৯৭১ সালে আপনার বয়স ১৬/১৭ বছর। এই বয়সের ছেলেরা অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। আপনি কেন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করেননি? কোথায় ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময়?
রকিবঃ ১৯৭১ সালে আমার বয়স ১৬ বছর। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে না পারা আমার সারাজীবনের দু:খ। ৯ এপ্রিল আমাদের পরিবার ফরিদপুর শহর থেকে মাদারীপুর হয়ে গ্রামের বাড়ি পালিয়ে যাই। এর পরদিন পাকসেনারা ফরিদপুর শহরের দখল নেয় ও হত্যাযজ্ঞ চালায়। প্রথম দিকে গ্রামে এসে একটা বেড়ানোর আনন্দে থাকি, ঢাকা চট্টগ্রাম থেকে দলে দলে লোকজন গ্রামে ফিরে, একটা উৎসব উৎসব ভাব। কিন্তু সপরিবারে আমার আপা চট্টগ্রামে, তাদের কোন সংবাদ পাই না। তখন মোবাইল ফোনের যুগ না। মা কাঁদেন। আব্বা, বড়দা, মেজদা এদিক ওদিক গিয়ে চট্টগ্রাম থেকে আগতদের কাছ থেকে খোঁজ নিতে চেষ্টা করেন। রেডিও বা লোকমুখে চট্টগ্রামের প্রতিরোধের কিছু কিছু খবর পাই। বাড়িতে দুশ্চিন্তার ছায়া। গ্রামের বাড়িতে নিরাপদে থাকার আনন্দ শেষ। তিন চারদিন পর তাদের ফিরে আসার সংবাদ পাই। ছোট ছোট ছেলেমেয়ে নিয়ে কিছুটা বাসে, কিছুদুর রিক্সা আর বাকিটা পায়ে হেঁটে ফেনী, চাঁদপুর হয়ে নৌকায় নদী পাড়ি দিয়, চর পেরিয়ে হেঁটে বাড়ি আসেন। খুব ক্লান্ত ও অসুস্থ হয়ে পরে সবাই। তবুও বেঁচে ফিরে আসাটা আমাদের স্বস্তি দেয়। হৈচৈ আনন্দ আর গ্রামের কিছু মুরুব্বিদের সাথে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিপক্ষে তর্ক-বিতর্ক করে দিন কাটছিল। মুরুব্বিদের অনেকেই পাকিস্তান আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিলেন। কেউ কেউ কলকাতা রায়টের সাক্ষী। তারা পাকিস্তান ভাঙ্গা মেনে নিতে পারছিলেন না।
এদিকে শহরের মানুষ তাদের মূল্যবান অলংকার ও অর্থ সাথে নিয়ে আসছে বলে বিভিন্ন বাড়িতে ডাকাতি শুরু হয়। আমরা কিশোর-যুবকের দল তৈরি করে গ্রুপে গ্রুপে ভাগ হয়ে সারারাত হেঁটে হেঁটে পাহারা দেই। মে মাসের মাঝামাঝি ছোট একটি মুক্তিযোদ্ধার দল গ্রামে আসে। ওরা অস্ত্র সজ্জিত। আমরা ভরসা পাই। কারণ থানার পুলিশে আস্থা ছিল না, থানায় পাকিস্তানি পতাকা ওড়ে। আমাদের গ্রামে থানাও ছিল না। গোসাইরহাট ও ভেদরগঞ্জ থানায় কিছু পাকিস্তানি সেনাও আসে। ছোট দলের মুক্তিযোদ্ধারা স্থানীয় তরুণদের নিয়ে ডাকাতদের প্রতিহত করে। গ্রামের মানুষ স্বস্তি পায়।
জুনের শুরুতে বিভিন্ন বাড়ি থেকে এক এক করে যুবকেরা হারিয়ে যেতে থাকে। কেউ কেউ গোপনে চিঠি লিখে যায় পরিবারের কাছে, তারা মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিংয়ে যাচ্ছে। অনেকেই সেটা করে না বাঁধা পাবে বলে।
ট্রেনিং হচ্ছে ভারতীয় সীমান্তে, পুবে না পশ্চিমে যাওয়া কম ঝুঁকির তারও কোন স্পস্ট ধারণা নাই। প্রায় প্রতিদিন এ-বাড়ির ও-বাড়ির ছেলেরা হারিয়ে যাচ্ছে। বাড়ির বয়স্করা চিন্তায় থাকে। এরা সবাই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষ, তবুও নিজ ছেলেদের যুদ্ধে যাওয়াতে ভয়-মায়া কাজ করে। সেনাবাহিনীতে যাওয়া আর মুক্তিবাহিনীতে যাওয়া এক কথা না। সেনাবাহিনীতে নিরাপদে ক্যান্টনমেন্টে যাওয়া, আর মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং সেন্টারে পৌঁছানোই বিপদ্দজনক। পথে পাকবাহিনির টহলদারিতে আটকে গিয়ে কিছু ছেলের ফিরে আসাতে ভয়টা বেশি। কেউ কেউ পথেই মারা গেছে এমন সংবাদও আসে। আব্বা রাতে প্রায়ই ঘুমান না। বাথরুমের জন্য রাতে বাইরে গেলেও জিজ্ঞাসা করেন। চাচাজী মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা না করলেও সাফল্যের ভরসা পান না। সন্দেহ প্রকাশ করেন। আব্বা সন্দেহ করেন না কিন্তু মনে করেন দীর্ঘদিন বা কয়েক বছর এ-যুদ্ধ চলবে। দিনের বেলা আব্বা আমাকে ভিয়েতনাম যুদ্ধের কথা বলেন। তখনো ভিয়েতনামে যুদ্ধ চলছে। আকারে ইঙ্গিতে বোঝান সবাই একসাথে যুদ্ধে যাওয়ার দরকার নাই। খেপে খেপে যাওয়াই ভালো। আমি যে যেতে চাই তা মাকে বলেছিলাম। আমার মামাতো ভাই আন্টুদা আর আমরা কয়েকজনের একটা দল পালিয়ে যেতে চাই। একরাতে কথামতো আমি আর দাদা বেরুতে পারলাম না আব্বার পাহারার জন্য। আন্টুদা বিশ্বাস হারালেন। কয়েক দিন তিনি আমাদের সাথে যোগাযোগ করলেন না। একদিন শুনি তিনি পালিয়ে গেছেন। বড় মামা চিন্তিত মুখে আব্বা আর মার সাথে আলাপ করলেন।
ইতোমধ্যে প্রায় থানা পাকবাহিনীর দখলে, গ্রামে গ্রামে পাকিস্তানের পক্ষে শান্তি কমিটি ও রাজাকার তৈরী হচ্ছিল। আপার শ্বশুরবাড়িপাকসেনারা পুড়িয়ে দিল। অই বাড়ির নয়জন মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিল। আপারা আমাদের বাড়িতে চলে এলেন। তার এক দেবর মতি ভাইস্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপের কমান্ডার। তিনি তার একজন সহযোদ্ধাকে নিয়ে নৌকায় করে মাঝে মাঝে দুপুরে আমাদের বাড়ি আসেন, গোসল-খাওয়া করে কিছু সময় বিশ্রাম নিয়ে আবার চলে যান। আব্বা আর দুলাভাই তার সাথে কিছু সময় গল্প করেন, যুদ্ধের খোঁজখবর নেন। একদিন মতিভাই আমাকে বলেন, মাঝে মাঝে যেনো আমি তাদের নানা কাজে সাহায্য করি। এই মূহুর্তে আমার ওপারে যাওয়ার দরকার নাই, তাদের স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক দরকার। পরে সুবিধা মতো সময়ে তিনিই ওপারে পাঠানোর ব্যাবস্থা করবেন। আব্বা সায় দেন, শুধু বলেন রাতে বাড়িতেই ঘুমাতে হবে।
ফ্রান্সে একটা সাবমেরিন থেকে ছয়জন বঙালি পালিয়ে গিয়েছিলেন। বিভিন্ন দেশ ঘুরে তারা প্রবাসী সরকারের কাছে পৌঁছান। বাংলদেশের প্রবাসী সরকার তাদের দেশের বিভিন্ন জায়গায় নৌ-কমান্ডো হিসাবে পাঠায়। তার একজন ছিলেন সৈয়দ মোশাররফ হোসেন। তিনি আমার এক রকম মামা হতেন। নানুবাড়ির পাশেই তার বাড়ি। মোশাররফ মামা গ্রামে ফিরলেন। চাঁদপুর, বরিশালের কিছু অংশের নৌ-কমান্ডোর দায়িত্ব নিয়ে আসলেন। আমি তার সাথে দেখা করি। তিনি কোথাও গেলে আমাকে সঙ্গী হিসাবে নিতেন।
জহিরুলঃ তো সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে না পারলেও মুক্তিযোদ্ধাদের স্বেচ্ছাসেবক হয়েছিলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের নানান কাজে সহযোগিতা করেছেন। কি ধরণের সহযোগিতা করেছেন? সুনির্দিষ্ট দুয়েকটি ঘটনার কথা বলুন।
রকিবঃ আসলে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা বললে যেটা বোঝায় সেটাও না। আমি মাঝে মাঝে তাদের সাথে সময় কাটিয়েছি, সঙ্গ দিয়েছি। টেলিফোন ব্যাবস্থা ছিলো না বলে কখনো কখনো দূরের কোনো ক্যম্পে সংবাদ পৌঁছে দিয়েছি। প্রতিদিন যে হতো তা না। আমার সম্পর্কিত মামা মীর মোশাররফ মামা ছিলেন নৌ-কমান্ডের এলাকা প্রধান, তার সঙ্গে প্রচুর হেঁটেছি গ্রাম থেকে গ্রামে। আমাদের এলাকায়, বর্তমান শরিয়তপুর জেলায়, খুব বেশি যুদ্ধ-বিগ্রহ হয় নাই। পালং ও ভেদরগঞ্জ থানা দখল, ডামুড্যার যুদ্ধ ও হাটবারে হত্যাকান্ড, মনোহর বাজারে হত্যাকান্ড এগুলিই। এছাড়া প্রায় সম্পুর্ণ যুদ্ধকালীন সময়টা মুক্ত এলাকাই ছিল বলা যায়। পালং থানা ও ভেদরগঞ্জ থানা দখলের মধ্যেই মুক্ত এলাকা হয়ে যায়। যদিও গোসাইরহাট থানার নিয়ন্ত্রণ পাকিদের হাতেই ছিলো। বরিশাল যাওয়ার নদীপথে থানার অবস্থান থাকায় পাকিদের বড়ঘাটি হিসাবে এর নিয়ন্ত্রণ শক্তভাবেই পাকিরা দখলে রেখেছিলো দীর্ঘদিন।
জহিরুলঃ শেষ পর্যন্ত কি আপনার নিজের পরিবারের কেউ সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন? যদি নিয়ে থাকেন, তাদের কারনে পাক-বাহিনী বা তাদের বাঙালি-দোসরদের দ্বারা আপনার পরিবার ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে কি?
রকিবঃ আমাদের পরিবারের কেউ যুদ্ধে যায় নাই। বড় মামার ছোট ছেলে সৈয়দ আবুল বাসার আন্টুদা যুদ্ধে গিয়েছিলেন, তিনি আমার বছর তিনেকের বড়। আপার দেবরদের বেশ কয়েকজন যুদ্ধে যান, তার মধ্যে মতি কোতওয়াল এলাকার কমান্ডার হিসাবে ছিলেন। পালং থানা অপারেশনের পর তাদের বাড়ির অনেকগুলি ঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়। বেশ বড় বাড়ি তাদের পালংয়ে। আমাদের গ্রাম থেকে বেশ দূরে তাদের গ্রাম। আমাদের এলাকায়, পালংয়েই, পাকিস্তান সমর্থনকারী কিছু মানুষ শান্তিকমিটি গঠন করে। থানায় শান্তিকমিটির এক সভা করার সময় মুক্তিযোদ্ধারা হামলা করে একজন কমিটি নেতাকে হত্যা করে, বেশ কয়েকজন আহত হয়। এছাড়া রাজাকার বাহিনীতে এই একাকার লোকদের তেমন অংশগ্রহণ ছিলো না। আসলে শুরু থেকেই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষেরা সংগঠিত ছিলো। কিছু কিছু মানুষ পাকপ্রেমী থাকলেও বিশেষ সুবিধা করতে পারে নাই।
Comments
Post a Comment