শিল্প-সাহিত্যে গণতান্ত্রিক আগাছা
|| কাজী জহিরুল ইসলাম ||
যারা লিখতে পারেন না বা লিখেন না, গাইতে পারেন না বা গান করেন না, আঁকতে পারেন না বা আঁকেন না, অর্থাৎ সৃজনশীল বা মননশীল শিল্পের চর্চায় অভ্যস্ত নন অথচ শিল্প-সাহিত্যের মঞ্চ দখল করে রাখেন, কাকে মঞ্চে তোলা হবে, কাকে তোলা হবে না, এইসব বিষয় নিয়ন্ত্রণ করেন তারাই কালক্রমে শিল্প-সাহিত্যের টাউট হিসেবে বিবেচিত হতে থাকেন। কথা হচ্ছে যারা প্রকৃত শিল্পের সাধক তারা তো কোনো মঞ্চ তৈরী করতে এগিয়ে আসনে না,অথচ অশিল্পীরা এ-কাজটি করলে এবং এর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিলে শিল্পীরা তা মেনে নিতে পারেন না। এটা কী শিল্পীদের অনুদার মানসিকতা নয়?
অনেকে এই দোষও দিয়ে বেড়ান এইসব টাউটদের জন্য শিল্প-সাহিত্যে প্রচুর আগাছা উৎপাদিত হয়। সেইসব আগাছার ভিড়ে ভালো সাহিত্য কোণঠাসা হয়ে পড়ে এবং আগাছার পরিমাণ খুব বেড়ে গেলে ভালো সাহিত্যকে আর শনাক্তই করা যায় না। অভিযোগটি অমূলক নয়, তবে এর একটি প্রতিযুক্তিও আছে। যদি কবিতার কথাই ধরি, ভেবে দেখুন তো কে বা কারা কবিতার বই কেনে? হ্যাঁ, একথা ঠিক যে কবিতার বই কোনো কালে, কোনো দেশেই খুব বেশি বিক্রি হতো না, এখনো হয় না। খোঁজ-খবর নিয়ে দেখেছি ইওরোপেও ১০০ কপি কবিতার বই বিক্রি হওয়া নাকি একটি বিরল ঘটনা এবং দৈবাৎ বিক্রি হয়ে গেলে সেই কবিকে নিয়ে হৈ চৈ পড়ে যায়। তিনি হয়ে যান বেস্ট সেলার। সেই তুলনায় দেখুন আমাদের দেশে শুধু একুশের বইমেলায়ই মাঝারি পাল্লার একেকজন কবির (শুনেছি) ২/৩ শ কপি বই বিক্রি হয়ে যায়। তো কারা কেনেন এই ২/৩ শ কপি? সেই যে আগাছা, যাদের আমরা মোটেও মর্যাদা দিচ্ছি না, তারাই কিন্তু এর মূল ক্রেতা। অবশ্য আমার সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করেছেন ঢাকার দু’য়েকজন বিখ্যাত প্রকাশক। তাদের মতে ২/৩ শ কবিতার বই কারোরই বিক্রি হয় না। কেউ কেউ নিজেই বেশ কিছু কপি কিনে নিয়ে বন্ধুদের বিলি করেন আবার ক্ষমতাবান কবিরা তাদের অফিসের কর্মচারীদের টাকা দিয়ে বইমেলায় পাঠিয়ে দেন তার বইটি কেনার জন্যে।
তবে বিভিন্ন জায়গায় যেসব গণকবিতা পাঠের অনুষ্ঠান হয়, একশ/দেড়শ কবি কবিতা পড়েন, সেখানে কী ওই এক-দেড়শ কবি ছাড়া আর কেউ কবিতা শুনতে আসেন? একথা ঠিক যে সেখানেও হাতে গোনা ২/৩ জনই কবি, অন্যরা আগাছা, কিন্তু ওই আগাছারা ছাড়া আর কেউ তো কবিতা শুনতে আসেন না। তারা না হয় নিজেদের অখাদ্যই খাওয়াতে এসেছেন, এসেছেন তো। নাহলে কে শুনতো আপনার কবিতা হে কবি? আপনার কবিতা শুনে হাততালি দেবার জন্যও তো কিছু লোক দরকার। এইসব আগাছাদের যারা লালন-পালন করেন সেই টাউটদের ওপর আপনার এতো রাগ কেন? ভিড়ের বিজয় কী আপনি মেনে নেবেন না? আপনার তো দেখি গণতন্ত্র-জ্ঞানই নেই।
ছেলেবেলায় আমি কীভাবে গণতন্ত্র শিখেছি বলি। অষ্টম শ্রেণীর অঙ্ক পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি ফিরছি। আমরা বারোজন একসাথে। ফিরতে ফিরতে একটি অঙ্কের ফলাফল নিয়ে কথা হচ্ছিল। দেখলাম শুধু আমার উত্তরই ভুল হয়েছে, গণতান্ত্রিক উপায়ে বাকি এগারজনের উত্তর সঠিক। কারণ, ওদের সকলের উত্তর মিলে গেছে। আমি চিৎকার করে বলতে চাইলাম, আমারটিই সঠিক তোমরা সবাই ভুল করেছ কিন্তু কে শোনে সংখ্যালঘুর কথা, গণতন্ত্রের কাছে হেরে গেলাম। কিছুদিন পর যখন পরীক্ষার খাতা পাই, সকলেই আমার মুখের দিকে অসহায়ের মতো তাকিয়ে আছে। কারণ শুধু আমার উত্তরই সঠিক হয়েছিল।
আমাদের অঙ্কের রেজাল্টা নিকট ভবিষ্যতে পাবার সম্ভাবনা দেখছিনা। সুতরাং...
ReplyDelete