Skip to main content

শিল্পের আগাছা

 শিল্প-সাহিত্যে গণতান্ত্রিক আগাছা

|| কাজী জহিরুল ইসলাম ||    


অন্য দেশের
অন্যভাষার কথা তেমন জানি নাতবে বাংলা ভাষার শিল্প-সাহিত্যকে কেন্দ্র করেকী ঢাকায়কী কোলকাতায়কী দেশের বাইরে বাঙালি অধ্যুষিত পরবাসেসর্বকালেই একদল টাউট গড়ে উঠেছেএখনও তাদের সরব উপস্থিতি রয়েছে। শিল্প একটি নীরব মাধ্যমউপলব্ধিরবোধের গভীরে ধারণ করার বিষয়। এর সরাসরি প্রভাব সমাজে দেখা না গেলেও সুদূরপ্রসারী প্রভাব খুব ব্যাপক। ইংরেজ কবি পিবি শেলির ভাষায়, কবিরা পৃথিবীর অস্বীকৃত আইন প্রণেতা। কিন্তু শিল্প-সাহিত্যের টাউটগণ এই নীরব বিষয়টিকে সর্বকালেই সরব রাখেনতারাই শিল্প-সাহিত্যের মাঠ গরম করে রাখেন সব সময়। এই গরম রাখাকে তো ইতিবাচকভাবেই দেখতে হবেনাকিযদি তারা শিল্প-সাহিত্যের মাঠ গরম না রাখতেন তাহলে অনেক কম মানুষ এর সঙ্গে জড়িত হতঅনেক কম মানুষ এর পৃষ্ঠপোষকতা করতএবং আমরা অনেক প্রতিভাকেই হয়ত পেতাম না! তো যারা এই মহৎ কাজটি করছেন তাদের জন্য টাউট এর মত একটি নেতিবাচক বিশেষণ কেন তৈরী হলো

যারা লিখতে পারেন না বা লিখেন নাগাইতে পারেন না বা গান করেন নাআঁকতে পারেন না বা আঁকেন নাঅর্থাৎ সৃজনশীল বা মননশীল শিল্পের চর্চায় অভ্যস্ত নন অথচ শিল্প-সাহিত্যের মঞ্চ দখল করে রাখেনকাকে মঞ্চে তোলা হবেকাকে তোলা হবে নাএইসব বিষয় নিয়ন্ত্রণ করেন তারাই কালক্রমে শিল্প-সাহিত্যের টাউট হিসেবে বিবেচিত হতে থাকেন। কথা হচ্ছে যারা প্রকৃত শিল্পের সাধক তারা তো কোনো মঞ্চ তৈরী করতে এগিয়ে আসনে না,অথচ অশিল্পীরা এ-কাজটি করলে এবং এর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিলে শিল্পীরা তা মেনে নিতে পারেন না। এটা কী শিল্পীদের অনুদার মানসিকতা নয়

অনেকে এই দোষও দিয়ে বেড়ান এইসব টাউটদের জন্য শিল্প-সাহিত্যে প্রচুর আগাছা উৎপাদিত হয়। সেইসব আগাছার ভিড়ে ভালো সাহিত্য কোণঠাসা হয়ে পড়ে এবং আগাছার পরিমাণ খুব বেড়ে গেলে ভালো সাহিত্যকে আর শনাক্তই করা যায় না। অভিযোগটি অমূলক নয়তবে এর একটি প্রতিযুক্তিও আছে। যদি কবিতার কথাই ধরিভেবে দেখুন তো কে বা কারা কবিতার বই কেনেহ্যাঁএকথা ঠিক যে কবিতার বই কোনো কালেকোনো দেশেই খুব বেশি বিক্রি হতো নাএখনো হয় না। খোঁজ-খবর নিয়ে দেখেছি ইওরোপেও ১০০ কপি কবিতার বই বিক্রি হওয়া নাকি একটি বিরল ঘটনা এবং দৈবাৎ বিক্রি হয়ে গেলে সেই কবিকে নিয়ে হৈ চৈ পড়ে যায়। তিনি হয়ে যান বেস্ট সেলার। সেই তুলনায় দেখুন আমাদের দেশে শুধু একুশের বইমেলায়ই মাঝারি পাল্লার একেকজন কবির (শুনেছি) ২/৩ শ কপি বই বিক্রি হয়ে যায়। তো কারা কেনেন এই ২/৩ শ কপিসেই যে আগাছাযাদের আমরা মোটেও মর্যাদা দিচ্ছি নাতারাই কিন্তু এর মূল ক্রেতা। অবশ্য আমার সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করেছেন ঢাকার দুয়েকজন বিখ্যাত প্রকাশক। তাদের মতে ২/৩ শ কবিতার বই কারোরই বিক্রি হয় না। কেউ কেউ নিজেই বেশ কিছু কপি কিনে নিয়ে বন্ধুদের বিলি করেন আবার ক্ষমতাবান কবিরা তাদের অফিসের কর্মচারীদের টাকা দিয়ে বইমেলায় পাঠিয়ে দেন তার বইটি কেনার জন্যে।

তবে বিভিন্ন জায়গায় যেসব গণকবিতা পাঠের অনুষ্ঠান হয়একশ/দেড়শ কবি কবিতা পড়েনসেখানে কী ওই এক-দেড়শ কবি ছাড়া আর কেউ কবিতা শুনতে আসেনএকথা ঠিক যে সেখানেও হাতে গোনা ২/৩ জনই কবিঅন্যরা আগাছাকিন্তু ওই আগাছারা ছাড়া আর কেউ তো কবিতা শুনতে আসেন না। তারা না হয় নিজেদের অখাদ্যই খাওয়াতে এসেছেনএসেছেন তো। নাহলে কে শুনতো আপনার কবিতা হে কবিআপনার কবিতা শুনে হাততালি দেবার জন্যও তো কিছু লোক দরকার। এইসব আগাছাদের যারা লালন-পালন করেন সেই টাউটদের ওপর আপনার এতো রাগ কেন?  ভিড়ের বিজয় কী আপনি মেনে নেবেন না?  আপনার তো দেখি গণতন্ত্র-জ্ঞানই নেই।

ছেলেবেলায় আমি কীভাবে গণতন্ত্র শিখেছি বলি। অষ্টম শ্রেণীর অঙ্ক পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি ফিরছি। আমরা বারোজন একসাথে। ফিরতে ফিরতে একটি অঙ্কের ফলাফল নিয়ে কথা হচ্ছিল। দেখলাম শুধু আমার উত্তরই ভুল হয়েছেগণতান্ত্রিক উপায়ে বাকি এগারজনের উত্তর সঠিক। কারণওদের সকলের উত্তর মিলে গেছে। আমি চিৎকার করে বলতে চাইলামআমারটিই সঠিক তোমরা সবাই ভুল করেছ কিন্তু কে শোনে সংখ্যালঘুর কথাগণতন্ত্রের কাছে হেরে গেলাম। কিছুদিন পর যখন পরীক্ষার খাতা পাইসকলেই আমার মুখের দিকে অসহায়ের মতো তাকিয়ে আছে। কারণ শুধু আমার উত্তরই সঠিক হয়েছিল।

Comments

  1. আমাদের অঙ্কের রেজাল্টা নিকট ভবিষ্যতে পাবার সম্ভাবনা দেখছিনা। সুতরাং...

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

শিল্পী কাজী রকিবের সাক্ষাৎকার

নন-একাডেমিক শিল্পীরাই নতুন কিছু দেয় -    কাজী রকিব  [কাজী রকিব বাংলাদেশের একজন গুণী শিল্পী। রাজশাহী আর্ট কলেজের একজন প্রতিষ্ঠাতা-শিক্ষক। কলেজের প্রথম ক্লাসটি নেবার কৃতিত্বও তাঁর। নিরন্তর ছবি আঁকেন। নানান মাধ্যমে ,  নানান ভাবনার ছবি। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে সস্ত্রীক বসবাস। তার স্ত্রী মাসুদা কাজীও একজন গুণী শিল্পী। বৈচিত্রপ্রিয় এই শিল্পীর একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন কবি কাজী জহিরুল ইসলাম। ধারাবাহিকভাবে তা এখানে প্রকাশ করা হবে। আজ উপস্থাপন করা হলো প্রথম পর্ব।]   জহিরুলঃ  বেশিরভাগ শিল্পীই নিজের একটা স্টাইল তৈরি করেন ,  নিজস্বতা যাকে আমরা বলি। আবার কেউ কেউ একই ধরণের ছবি বারবার আঁকেন। আপনার কাজে বৈচিত্র খুব বেশি ,  এতে করে "টাইপড" অপবাদ থেকে আপনি মুক্ত কিন্তু নিজের একটি স্টাইল তৈরি করতে না পারা বা তৈরি হয়নি বলে কি আক্ষেপ হয় ,  নাকি এই যে ভার্সেটিলিটি এটাই আপনি বেশি উপভোগ করেন ?    রকিবঃ   আমি আসলে আলাদা করে ভাবিনি এই স্টাইল বিষয়ে। কারো মতো আঁকারও চেষ্টা করিনি তেমন ভাবে। অল্প বয়সে ,  আমার ১৯ / ২০ বছর বয়সে ,  সালভাদর দালির মতো আঁকতে চেষ্টা করেছিলাম কিছুদিন ।

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জুর সাক্ষাৎকার || পর্ব ৭

মতিউর রহমান চৌধুরীকে  র‍্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কারের জন্য নমিনেট করেছিলেন  আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু       [লেখক, সাংবাদিক, অনুবাদক আনোয়ার হোসেইন মঞ্জুর সাক্ষাৎকারের সপ্তম  পর্ব আজ প্রকাশ করা হলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কবি কাজী জহিরুল ইসলাম।]          জহিরুলঃ  আপনার সাংবাদিকতা জীবনের প্রায় পুরোটাই ব্যয় করেছেন জাতীয় সংসদ কভার করে। এই সংসদে আমাদের সংবিধানের অনেকগুলো সংশোধনী পাশ হয়েছে। আমাদের নেতারা সব সময় বলেন, ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড় কিন্তু প্রকৃত চিত্র হচ্ছে দেশের চেয়ে দলের স্বার্থ বড় হয়ে ওঠে এবং দলের চেয়ে ব্যক্তির/পরিবারের স্বার্থই বেশি গুরুত্ব পায়। প্রধান প্রধান সংশোধনীগুলোর আলোকে যদি বিশ্লেষণ করেন কতোটা জাতীয় স্বার্থে আর কতটা ব্যক্তি বা পরিবারের স্বার্থে এইসব সংশোধনীগুলো করা হয়েছে।    মঞ্জুঃ   আপনি ঠিকই বলেছেন, এযাবত বাংলাদেশে ১১টি জাতীয় সংসদ গঠিত হয়েছে এবং এর মধ্যে দ্বিতীয় সংসদ থেকে নবম সংসদ পর্যন্ত মোট আটটি সংসদের অধিবেশন কভার করা সুযোগ হয়েছে আমার। আমার সংসদ কভারের সময়ে আমাদের সংবিধানের ১০টি সংশোধনী অনুমোদিত হয়েছে এবং সংশোধনী প্রক্রিয়া কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। এখন পর্যন্ত স

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জুর সাক্ষাৎকার - তৃতীয় পর্ব

মঞ্জু আমার ওপর রাগ করেছে                                                           - আল মাহমুদ [লেখক, সাংবাদিক, অনুবাদক আনোয়ার হোসেইন মঞ্জুর সাক্ষাৎকারের  তৃতীয় পর্ব আজ প্রকাশ করা হলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কবি কাজী জহিরুল ইসলাম।]  সাক্ষাৎকার নেবার এক পর্যায়ে আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু  ও কাজী জহিরুল ইসলাম। ওয়ান্টাগ পার্ক, নিউ ইয়র্ক।  ছবি তুলেছেন ড. মাহবুব হাসান।   জহিরুলঃ  খুশবন্ত সিং তার সকল বই অনুবাদ করার লিখিত অনুমতি দিলেন আপনাকে এবং সেই অনুমতিপত্রটি তিনি নিজ হাতে আপনার সামনেই বাংলায় লিখে দিলেন। তিনি কিভাবে বাংলা শিখলেন তা কি জানতে পেরেছিলেন ?  মঞ্জুঃ    জ্বি ,  ঘটনাটি  ঘটে  ১৯৯২ সালের ডিসেম্বর মাসে ,  এ সম্পর্কে আমি আগের এক প্রশ্নে বলেছি। তারিখটি আমার স্মরণে নেই। তবে বাবরি মসজিদ ধ্বংস করার পর ,  ডিসেম্বরের শেষ দিকে। না ,  বাংলায় নয় ,  উনি ইংরেজিতে লিখেছেন। আমার কফি পানের সময়ের মধ্যেই লিখে দিয়েছেন। ১৯৮৪ থেকে মাঝে দীর্ঘ বিরতি দিয়ে আমাকে তিনটি বা চারটি চিঠি লিখেছেন। লিখেছেন বলতে আমার চিঠির উত্তর দিয়েছেন। প্রতিটি চিঠি ইংরেজিতেই লিখেছেন। প্রতিটি চিঠিতে আমাকে সম্বোধন করেছেন  “ আনোয়ার ভাই ,”  বলে।