Skip to main content

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জুর সাক্ষাৎকার || পর্ব ৭

মতিউর রহমান চৌধুরীকে 

র‍্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কারের জন্য নমিনেট করেছিলেন 

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু  

 


 [লেখক, সাংবাদিক, অনুবাদক আনোয়ার হোসেইন মঞ্জুর সাক্ষাৎকারের সপ্তম পর্ব আজ প্রকাশ করা হলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কবি কাজী জহিরুল ইসলাম।]    

 

জহিরুলঃ আপনার সাংবাদিকতা জীবনের প্রায় পুরোটাই ব্যয় করেছেন জাতীয় সংসদ কভার করে। এই সংসদে আমাদের সংবিধানের অনেকগুলো সংশোধনী পাশ হয়েছে। আমাদের নেতারা সব সময় বলেন, ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড় কিন্তু প্রকৃত চিত্র হচ্ছে দেশের চেয়ে দলের স্বার্থ বড় হয়ে ওঠে এবং দলের চেয়ে ব্যক্তির/পরিবারের স্বার্থই বেশি গুরুত্ব পায়। প্রধান প্রধান সংশোধনীগুলোর আলোকে যদি বিশ্লেষণ করেন কতোটা জাতীয় স্বার্থে আর কতটা ব্যক্তি বা পরিবারের স্বার্থে এইসব সংশোধনীগুলো করা হয়েছে। 

 

মঞ্জুঃ আপনি ঠিকই বলেছেন, এযাবত বাংলাদেশে ১১টি জাতীয় সংসদ গঠিত হয়েছে এবং এর মধ্যে দ্বিতীয় সংসদ থেকে নবম সংসদ পর্যন্ত মোট আটটি সংসদের অধিবেশন কভার করা সুযোগ হয়েছে আমার। আমার সংসদ কভারের সময়ে আমাদের সংবিধানের ১০টি সংশোধনী অনুমোদিত হয়েছে এবং সংশোধনী প্রক্রিয়া কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। এখন পর্যন্ত সংবিধানের ১৭টি সংশোধনী হয়েছে। যে কোনো দেশে সংবিধান হচ্ছে সর্বোচ্চ আইন, সেজন্য সংবিধান প্রণয়নে চূড়ান্ত সতর্কতা অবলম্বন করা হয়। কারণ সংবিধান প্রণয়ন যেমন কঠিন, সংশোধন আনাও তেমন জটিল। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র হওয়ার কারণে এবং কিছুটা রাজনৈতিক সচেতনতার কারণে আমার মনে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে যে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নে অনুরূপ সতর্কতা অবলম্বন করা হয়েছিল কিনা। বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন প্রক্রিয়ার শুরু থেকে লক্ষ্য করলে আপনি এক ধরনের অস্থিরতা দেখতে পাবেন, যা আমাদের জাতীয় বৈশিষ্টের অংশ। ১৯৭১ সালের ১০ই এপ্রিল অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার স্বাধীনতা যে ঘোষণাপত্র অনুমোদন করে সেখানে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের বিধান রাখা হয়েছিল। ১৯৭২ সালের সংবিধানে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থার বিধান রাখা হয়। চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে আবার রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়, পুনরায় সংসদীয় পদ্ধতি ফিরিয়ে আনা হয় ১৯৯১ সালে সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে।

বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের পর গণপরিষদ আদেশ জারি করা হয় সংবিধান প্রণয়নের জন্য এবং গণপরিষদের সদস্য হিসেবে গন্য করা হয় পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়নের জন্য ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য হিসেবে নির্বাচিত তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯জন সদস্য এবং প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত ৩০০ জন সদস্যকে। মৃত্যুজনিত এবং কিছু সদস্য ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের পক্ষে ভূমিকা নেয়ার কারণে তাদেরকে বাদ দিয়ে মোট ৪০৪ জনকে নিয়ে গণপরিষদ গঠন করা হয়। উপমহাদেশের যে কোনো দেশের চেয়ে বাংলাদেশের গণপরিষদের সদস্য সংখ্যা ছিল সবচেয়ে বেশি। ভারতে সংবিধান প্রণয়নের জন্য গণপরিষদের সদস্য সংখ্যা প্রথমে ৩৮৯ জন থাকলেমুসলিম সদস্যরা সদস্যপদ প্রত্যাহার করায় ২৯৯ জন সদস্য নিয়ে ভারতীয় গণপরিষদ পুণর্গঠিত হয়। পাকিস্তান (পূর্ব পাকিস্তানসহ) গণপরিষদের সদস্য সংখ্যা ছিল ৭৯ জন। ভারতের সংবিধান প্রণয়নে সময় লেগেছি ২বছর ১১ মাস ১৮ দিন। পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রণয়ন করতে সময় লেগেছিল ৯ বছরের বেশি, এবং সেটিও বাতিল করা হয়। পাকিস্তান একটি সংবিধান পেয়েছে দেশ স্বাধীন হওয়ার ২৬ বছর পর; এজন্য তারা তিনটি গণপরিষদ গঠন করেছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার রে ১৯৭৩ সালে পাকিস্তান সংবিধান প্রণয়ন করতে সক্ষম হয়। এর আগে দেশটি চলেছে গোঁজামিল দিয়ে অথবা বলা যেতে পারে ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন, ১৯৫৮ সালে বাতিল করা সংবিধান এবং ১৯৬২ সালে আইয়ুব খানের নির্বাহী আদেশে তৈরি সংবিধান দ্বারা।  সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নে সময় লেগেছিল মাত্র ৬ মাস ২৪ দিন, রীতিমতো একটি রেকর্ড। বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নে ভূমিকা রাখার ব্যাপারে ভারতীয় দাবীও রয়েছে। আমি যখন দিল্লিতে আইন ও সংসদ বিষয়ক ফেলোশিপ করছিলাম তখন আমার রিসার্চ পেপারের জন্য গাইড ছিলেন ভারতের বিশিষ্ট সংবিধান বিশেষজ্ঞ এবং ইন্ডিয়ান ল’ ইন্সটিটিউটের ওই সময়ের ডাইরেক্টর পি, এম বকশী। ‘দ্য কন্সটিটিউশন অফ ইণ্ডিয়া’ নামে তার একটি বিখ্যাত আইন গ্রন্থও রয়েছে। আমাদের ইন্সটিটিউটে প্রথম দিন বক্তৃতা করতে এসে পরিচয় পর্বে বাংলাদেশের দু’জন ফেলোর (আমি ও জাতীয় সংসদের ওই সময়ের প্রটোকল অফিসার রুহুল আমিন) পরিচয় জানার পর বলেন যে তারা শুধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনেই সহযোগিতা করেননি, বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নে ভূমিকা রাখতে পেরেও গর্বিত। তিনি জনৈক মি: সরকারের কথা বলেছিলেন, যিনি বাংলাদেশের সংবিধান ড্রাফটিং কমিটিকে সার্বক্ষণিক সহায়তা দিয়েছেন বলে উল্লেখ করেন। মি: সরকারের পুরো নাম আমার মনে নেই। 

বাংলাদেশের গণপরিষদের গঠন নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। প্রথমত: জাতীয় পরিষদে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য নির্বাচিত ১৬৯ জন সদস্য ইয়াহিয়া খানের জারি করা লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্কের অধীনে ১২০ দিনের মধ্যে কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে পাকিস্তানের সংবিধান তৈরি করার উদ্দেশ্যে নির্বাচিত হয়েছিলেন। দ্বিতীয়ত পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের জন্য নির্বাচিত সদস্যদের সংবিধান প্রণয়নে কোনো ভূমিকা থাকার কারণ ছিল না। জনগণ তো তাদেরকে এই ম্যান্ডেট দেয়নি। ১৯৭২ সালে গণপরিষদ আদেশ জারি করে দুটি ভিন্ন উদ্দেশে নির্বাচিত দুটি ভিন্ন পরিষদের সদস্যদের গণপরিষদ হিসেবে সদ্য স্বাধীন দেশের সংবিধান প্রণয়নের বৈধতা নিয়ে রাজনৈতিক মহলসহ সকল মহলে একাডেমিক বিতর্ক তখনও ছিল, এখনও রয়েছে। আমার মনে আছে, আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেত্রী আমেনা বেগম, যিনি একসময় আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্বও পালন করেছেন, আমার সাথে এক সাক্ষাৎকারে এই বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। অবশ্য তখন তিনি আওয়ামী লীগে ছিলেন না। জনগণ তাদের প্রতিনিধি নির্বাচনের সময় যে আশাই পোষণ করে থাকুন না কেন নির্বাচিত হয়ে যাওয়ার পর প্রতিনিধিরা জনগণের নামে তাদের ব্যক্তিগত ও দলীয় স্বার্থ চরিতার্থ করা ছাড়া আর কিছুই করেন না। আমাদের মত অনগ্রসর দেশে সবসময় তা-ই ঘটে।


   

আপনি সংবিধানের প্রধান প্রধান সংশোধনীর ওপর আলোকপাত করতে বলেছেন। আগেই উল্লেখ করেছি যে সংবিধান সংশোধন করা বেশ জটিল এবং যখন সংশোধন করা হয় তখন জরুরী প্রয়োজনেই করা হয়, তা দেশের প্রয়োজনে হোক, ব্যক্তি বা দলের প্রয়োজনেই হোক। যখনই কোনো রাজনৈতিক দল সংসদে সংবিধান সংশোধনীর জন্য প্রয়োজনীয় দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় তখন সেই সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুযোগ নিয়ে সংবিধানে প্রয়োজনীয় ছুরি-কাঁচি চালায়, যা কখনো কখনো জাতির জন্য দুর্ভাগ্য ডেকে আনে। আওয়ামী লীগ সংবিধান তৈরি করেছিল, সেই সংবিধানের অধীনে ১৯৭৩ সালে জাতীয় সংসদের প্রথম নির্বাচনে সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে ২৯৩ আসনে জয়ী হয়ে যে সংসদ গঠন করে, সেই সংসদ আড়াই বছরে চার বার সংবিধান সংশোধন করেছে, যা এযাবত বাংলাদেশের যে কোন সংসদের পাস করা সংশোধনীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি। যাহোক, পাকিস্তানের শাসনামলে বাংলাদেশের জনগণ যেহেতু বিভিন্ন নিবর্তনমূলক আইনের কারণে নিপীড়িত হয়েছে, এদেশের উল্লেখযোগ্য প্রায় সকল বিরোধী দলীয় রাজনীতিক পাকিস্তান আমলের অধিকাংশ সময়ে কারাগারে কাটিয়েছেন সেজন্য সম্ভবত দমননীতিমূলক কোনোকিছু আরোপ না করার সদুদ্দেশেই মূল সংবিধানে জরুরী অবস্থার বিধান রাখা হয়নি। কিন্তু স্বাধীনতার পর সরকারের পক্ষে দেশ সামাল দেয়া কঠিন হয়ে পড়েছিল, নাশকতা চলছিল সর্বত্র, এমনকি রক্ষী বাহিনীর মতো শক্তিশালী বিশেষ বাহিনীর কথিত ‘ক্রসফায়ার,’ বা ‘এনকাউন্টার’ এ বিরোধী দলের বহু নেতাকর্মীদের হত্যা ও গুম করেও পরিস্থিতি সামাল দেয়া সম্ভব হচ্ছিল না। আওয়ামী লীগ ও তাদের সরকারের বিরুদ্ধে জনমত ক্রমেই প্রবল হচ্ছিল। এ পরিস্থিতিতে ১৯৭৩ সালের ২২ সেপ্টেম্বর জরুরি অবস্থা ঘোষণার বিধান সংযোজন করা হয় এবং ২০০৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে মোট পাঁচবার জরুরী অবস্থা জারি করা হয়েছে। শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন সরকার ১৯৭৪ সালের ২৮শে ডিসেম্বর জরুরী অবস্থা ঘোষণা করে এবং দেশের সর্বত্র সেনাবাহিনী এবং অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ছড়িয়ে দিয়ে জনগণের ওপর চরম নির্যাতন চালায়, যা আমি নিজেও আমার এলাকায় প্রত্যক্ষ করেছি। সংবিধানের তৃতীয় সংশোধনী আনা হয় ১৯৭৪ সালের ২৮ নভেম্বর, যার উদ্দেশ ছিল ভারত ও বাংলাদেশের ভূমি বিনিময় এবং এ সংশোধনীর পর বাংলাদেশ বেরুবাড়ি নামে একটি এলাকা ভারতকে দিয়ে দেয়। বিনিময়ে ভারতীয় ভূখন্ডের মধ্যে অবস্থিত দহগ্রাম ও আঙ্গরপোতা ছিটমহলে যাতায়াতের জন্য করিডোর সমস্যা সমাধান না করায় তখন বেশ প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ ঘটেছিল।  

বাংলাদেশের সাংবিধানিক ইতিহাসে বিপর্যয়কর ঘটনা ঘটানো হয় ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংবিধানে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে, যখন সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থার পরিবর্তন করে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা চালু করা হয়। যে আওয়ামী লীগ জন্মলগ্ন থেকে সংসদীয় গণতন্ত্রের কথা বলে জনগণকে প্রলুব্ধ করেছে, তাদের দ্বারা রাষ্ট্রপতি শাসিত পদ্ধতি প্রবর্তন সকলকে বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ করে। শুধু তাই নয় এ সংশোধনীতে বহুদলীয় ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে একদলীয় শাসন ব্যবস্থার বিধান করা হয়, সংসদকে ক্ষমতাহীন করা; মৌলিক অধিকার বাতিল করা; বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে খর্ব করা এবং চারটি দৈনিক সংবাদপত্র চালু রেখে সকল সংবাদপত্রের প্রকাশনা বাতিল করা হয়। সংবিধানের খোলনলচে এভাবে বদলে ফেলায় বিদেশি সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা এটিকে বর্ণনা করেছেন “সাংবিধানিক ক্যু” হিসেবে। চতুর্থ সংশোধনী যে দেশকে অশুভ পরিণতির দিকে নিয়ে গিয়েছিল তা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। আরো মজার ব্যাপার হলো এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ একটি সংবিধান সংশোধনী বিল সংসদে পাস হয় মাত্র ১৩ মিনিট সময়ে এবং যেদিন সংসদ এ বিল পাস করে সেদিনই প্রেসিডেন্ট এটিতে স্বাক্ষর করেন।

পঞ্চম সংশোধনী ছিল আমার সংসদ রিপোর্টিং শুরু করার পর প্রথম সংশোধনী। ১৯৭৯ সালের ৬ এপ্রিল আনীত এই  সংশোধনী  আসলে সংবিধানের কোনো বিধান সংশোধন করেনি। ১৯৭৫ এর ১৫ অগাস্ট সামরিক শাসন জারির পর থেকে ১৯৭৯ এর ৬ এপ্রিল পর্যন্ত সামরিক শাসনামলের সব আদেশ, ঘোষণা ও দণ্ডাদেশ বৈধ বলে অনুমোদন করা হয়। ষষ্ঠ সংশোধনী আনা হয় ১৯৮১ সালের ৮ জুলাই এবং এর মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী ভাইস প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে তার পদে বহাল থেকে প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার বিধান নিশ্চিত করা হয় এই সংশোধনীর মাধ্যমে। সপ্তম সংশোধনী আনা হয় ১৯৮৬ সালের ১১ নভেম্বর এবং এর মধ্য দিয়ে ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ থেকে ১৯৮৬ সালের ১০ নভেম্বর পর্যন্ত দেশে সামরিক শাসনামলে জারি করা সব আদেশ, আইন ও দণ্ডকে বৈধতা দেয়া হয়। এছাড়া এ সংশোধনীতে বিচারপতিদের অবসরের বয়সসীমা ৬২ থেকে ৬৫ বছরে উন্নীত করা হয়। ১৯৮৮ সালের ৯ জুন পাসকৃত সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে ইসলাম ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ঘোষণা করা হয়; ঢাকার বাইরে হাই কোর্ট বিভাগের ৬টি স্থায়ী বেঞ্চ স্থাপন করা হয়, জাতীয়তা হিসেবে ‘বাংলাদেশী এবং ঢাকার ইংরেজি বানান পরিবর্তন করা হয়। নবম সংশোধনী আনা হয় ১৯৮৯ সালের ১১ জুলাই, যার মধ্য দিয়ে প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে যতবার খুশি নির্বাচন করার বিধান পরিবর্তন করা হয়। 

১৯৯০ সালের ১২ জুন পাস করা দশম সংশোধনীতে সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনের সংখ্যা ১৫ থেকে ৩০ এ বৃদ্ধি করা হয়। একাদশ সংশোধনী পাস করা হয় ১৯৯১ সালের ৬ আগস্ট প্রেসিডেন্ট এরশাদের পতনের পর বিচারপতি মো. সাহাবুদ্দিনের দায়িত্ব গ্রহণ নিয়ে; যে সংশোধনীর মাধ্যমে প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োগদানকে বৈধ ঘোষণা, নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর ভাইস প্রেসিডেন্ট পুনরায় প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্বগ্রহণ করতে পারবেন এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার কর্মকাল বিচারপতি হিসেবে গণ্য হবে বলে বিধান সংবিধানে সন্নিবেশিত হয়। এ সংশোধনীতেও স্পষ্ট যে বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদের একগুয়েমির কারণে তাঁকে ভাইস প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন শেষে পুনরায় প্রধান বিচারপতি পদে ফিরিয়ে আনার সুযোগ সৃষ্টি ও তার অনুপস্থিতকালীন সময়কেও বিচারপতি হিসেবে তার কার্যকাল হিসেবে গন্য করার জন্য এ সংশোধনী আনা হয়েছিল। একজন প্রধান বিচারপতি যদি ব্যক্তিগত স্বার্থে রাষ্ট্রকে পণবন্দী বানিয়ে ফেলেন সেখানে আপনি কার কাছে কি আশা করতে পারেন? 

দেশের সাংবিধানিক বিকাশের ক্ষেত্রে দ্বাদশ সংশোধনী একটি গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী। ১৯৭৫ সালে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে যে সংসদীয় গণতন্ত্রকে হত্যা করা হয়েছিল দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তা পুনর্বহাল করা হয় এবং এ সংশোধনীও পাস করা হয় ১৯৯১ সালের ৬ আগস্ট। এর মাধ্যমে প্রেসিডেন্টকে রাষ্ট্রের সাংবিধানিক প্রধান রেখে প্রধানমন্ত্রীকে নির্বাহী প্রধান করা হয়, যেখানে মন্ত্রী পরিষদের নেতৃত্বে থাকবেন প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রীরা তাদের কাজের জবাবদিহিতার জন্য দায়ী থাকবেন জাতীয় সংসদের কাছে। এ সংশোধনীতে ভাইস প্রেসিডেন্টের পদ বিলুপ্ত করা হয় এবং বিধান করা হয় যে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন জাতীয় সংসদের সদস্যদের দ্বারা। অদৃষ্টের পরিহাস বলতে হয় যে, আজন্ম গণতন্ত্রের প্রবক্তা, দেশের স্বাধীনতার মূল নায়ক শেখ মুজিবুর রহমান চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে যে সংসদীয় গণতন্ত্রকে কবরস্থ করেছিলেন, সেই গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনে একজন সামরিক শাসকের নেতৃত্বে গঠিত দল বিএনপি। এর চেয়ে পরিহাসের বিষয় আর কী হতে পারে! 

ত্রয়োদশ সংশোধনী পাস করা হয় ১৯৯৬ সালের ২৬ মার্চ এবং এর মাধ্যমে সংবিধানে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু করার বিধান সংযুক্ত হয়। এক্ষেত্রেও আপনি একটি বৈপরীত্য লক্ষ্য করতে পারবেন। দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয় বলে আওয়ামী লীগ আন্দোলন করেছিল, সেই তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ ২০১১ সালের ২৫ জুন পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলোপ করে। পঞ্চদশ সংশোধনীতে আরেকটি পরিবর্তন আনা হয়েছে, তা হলো সংসদে সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংখ্যা ৪৫ থেকে ৫০ এ উন্নীত করা হয়। চতুর্দশ সংশোধনী আনা হয় ২০০৪ সালের ১৬ মে এবং এ সংশোধনীর মাধ্যমে সংরক্ষিত মহিলা আসন ৩০ থেকে ৪৫ করা হয় সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অবসরের বয়সসীমা ৬৫ থেকে ৬৭ বছর করা হয়। এই সংশোধনী আনার পেছনে বিএনপি’র অসদুদ্দেশ্য ছিল। তারা চেয়েছিলেন প্রধান বিচারপতি কেএম হাসান পরবর্তী তত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হবেন। তাঁর অবসর নেয়ার কথা ২০০৪ সালে। বিচারপতিদের বয়স ৬৭ বছর করা হলে তিনি বিএনপি সরকারের মেয়াদ শেষ হলে সেই দায়িত্ব লাভ করবেন এবং পরবর্তী নির্বাচনে তারা সুবিধাজনক অবস্থায় থাকবে। বিচারপতি কেএম হাসান বিএনপির সুবিধাভোগী ছিলেন। দু’জন সিনিয়র বিচারপতিকে ডিঙিয়ে তাকে প্রধান বিচারপতি করা হয়েছিল। তিনি বিএনপির প্রতিষ্ঠাতাদের একজন, বিএনপি সরকার তাকে রাষ্ট্রদূত নিয়োগ করেছিল;  এমনকি তিনি একটি নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়ন পর্যন্ত চেয়েছিলেন। অতএব স্বাভাবিক কারণেই এই সংশোধনীর ব্যাপারে প্রশ্ন উঠে এবং আওয়ামী লীগের নেতত্বাধীন মহাজোট প্রবল আপত্তি উত্থাপন করে। শেষ পর্যন্ত তিনি তত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হবেন না বলে ঘোষণা দিয়ে বিএনপির আশার গুড়ে বালি ছুঁড়ে দেন। আমার সংসদ রিপোর্টিংয়ের সময়ে আমি চতুর্দশ সংশোধনী পর্যন্ত প্রক্রিয়াগুলো কাছে থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি। পরবর্তী তিনটি সংশোধনীর মধ্যে পঞ্চদশ সংশোধনী প্রসঙ্গ আমি চতুর্দশ সংশোধনীর সূত্রে উল্লেখ করেছি। ষোড়শ সংশোধনী আনা হয় ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর এবং এ সংশোধনীতে উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের ওপর ন্যস্ত করা হয়। ২০১৮ সালের ৮ জুলাই সংবিধানের সপ্তদশ সংশোধনী পাস করা হয়েছে সংসদের ৫০টি সংরক্ষিত নারী আসন আরও ২৫ বছরের জন্য শুধুমাত্র নারী সদস্যদের জন্য সংরক্ষিত রাখার জন্য। নারীদের এই সংরক্ষিত আসন ব্যবস্থা ১৯৭২ সালের সংবিধানেই রাখা হয়েছিল এবং তখন দশ বছরের জন্য আসন সংখ্যা ছিল ১৫টি। সংবিধান প্রণেতারা আশা করেছিলেন যে দশ বছরের মধ্যে নারীদের আরও বিকাশ ঘটবে ও সামর্থ বৃদ্ধি পাবে। দশ বছর পর নারীরাও পুরুষের মতো নির্বাচনে সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হবেন। যদিও অনেক নারী সরাসরি নির্বাচন করে সংসদে আসছেন, কিন্তু জনসংখ্যায় নারীর অনুপাতের চেয়ে তা নগন্য। নারীরা কাঙ্খিত অগ্রগতি সাধন করতে না পারায় এ-যাবত সংবিধানে শুধু সংরক্ষিত নারী আসন সংক্রান্ত ৫টি সংশোধনী আনা হয়েছে, কোনোটায় সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়েছে, কোনোটায় সংরক্ষণের মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়েছে।

সংক্ষিপ্ত আকারে হলেও কো সংশোধনী ব্যক্তি স্বার্থে এবং কোটি দলীয় স্বার্থে আনা হয়েছে আশা করি তা বুঝতে সমস্যা হবে না। 

 

জহিরুলঃ আপনি কমরেড মনি সিংয়ের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন, কেমন দেখেছেন এতো বড় একজন কমরেডকে? 

 

মঞ্জুঃ কমরেড মনি সিংকে নিয়ে আমার আগ্রহ ছিল শৈশব থেকেই। সবসময় শুনতাম যে তিনি কারাগারে আছেন, অথবা আণ্ডারগ্রাউণ্ডে আছেন। তখন জানতাম না যে আণ্ডারগ্রাউণ্ড বলতে কী বোঝায়। আহম্মক ভাবতে পারে মনে করে কারো কাছে জানতেও চেষ্টা করিনি যে আণ্ডার গ্রাউণ্ডে থাকা মানে কী।  আমাদের এলাকায়ও একজন বিখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা ছিলেন রবি নিয়োগী। তার ছেলে কাজল নিয়োগী স্কুলে আমার সহপাঠি ছিল। ওদের বাড়িতে প্রায়ই যেতাম, যা আমি আগেও এক প্রশ্নের উত্তরে বলেছি। রবি নিয়োগী ব্রিটিশ আমলে কালাপানি বা দ্বীপান্তরের দণ্ড পেয়ে আন্দামানে ছিলেন। স্কুলের একেবারে শেষের দিকে রবি নিয়োগীকে প্রথম দেখি। আগে না দেখার কারণ তিনিও সবসময় কারাগারেই থাকতেন। কাজলদের বাড়িতেই সম্ভবত মনি সিং এর নাম শুনি। প্রথম তাকে দেখি ১৯৭৩ বা ৭৪ সালে। তখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কমিউনিষ্ট পার্টির বড় কোনো সম্মেলন হয়েছিল এবং কাজল নিয়োগীর সাথে দেখতে গিয়েছিলাম। বক্তৃতাও শুনেছিলাম। আমি তার কণ্ঠে জ্বালাময়ী বক্তব্য শুনবো বলে আশা করেছিলাম, কিন্তু তিনি শান্ত, কিন্তু দৃঢ় কণ্ঠে কথা বললেন। অবাক হয়েছিলাম, এমন শান্ত একজন মানুষ এতো জনপ্রিয়তা অর্জন করলেন কীভাবে। বাংলাদেশের কমিউনিস্টরা তাকে দেবতাতূল্য শ্রদ্ধা করেন। আমি তার জীবনী জানার চেষ্টা করি। আমাদের বৃহত্তর ময়মনসিংহেরই মানুষ। নেত্রকোনায়। মায়ের দিক থেকে তিনি সুসং দুর্গাপুরের বড় জমিদার পরিবারের সন্তান। ব্রিটিশ আমলে তিনি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সাথে জড়িত হয়েছিলেন এবং তার নেতৃত্বের বিকাশ ঘটে বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার নেত্রকোনা ও শেরপুর এলাকার বিভিন্ন স্থানে টঙ্ক প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। টঙ্ক মানে জমিদারদের দ্বারা তাদের অধীনস্থ চাষীদের উৎপাদিত ফসলের ওপর খাজনা আদায়, যার পরিমাণ প্রচলিত খাজনার কয়েক গুনেরও বেশি, যা চাষীদের পক্ষে বহন করা সম্ভব ছিলো না। তার টঙ্ক বিরোধী আন্দোলনের কারণে মামাদের সাথেও তার বিরোধ সৃষ্টি হয়েছিল। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ১৯৫০ সালে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের ফলে এই নির্মম প্রথার বিলুপ্তি ঘটে। ব্রিটিশ আমলেই তিনি ত্রিশের দশকে কলকাতায় কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন এবং পরে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক হন। পাকিস্তান আমলের অধিকাংশ সময় তাকে কারাগারে বা আত্মগোপনে থাকতে হয়েছে। ১৯৭১ সালেও তিনি রাজশাহী কারাগারে ছিলেন। তখন বিভিন্ন কারাগার ভাঙার পর্যায়ে রাজশাহী কারাগারও ভাঙা হয় এবং তিনি কারাগার থেকে ভারতে চলে যান। ১৯৭৩ সালে তিনি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি নির্বাচিত হন। স্বাধীনতা রেও প্রেসিডেন্ট জিয়ার সময়ে তাকে কারাগারে থাকতে হয়েছে। পাকিস্তান আমলে কমিউনিস্ট নেতাদের ওপর যেহেতু ‘হুলিয়া’ বা গ্রেফতারি পরোয়ানা ঝুলেই থাকতো সেজন্য অধিকাংশ কমিউনিস্ট নেতা ছদ্মনাম ধারণ করতেন। মনি সিংয়ের নাম ছিল কমরেড আজাদ। 



সাংবাদিকতা শুরু করার পর পর তার আরও বক্তৃতা শোনার সুযোগ হয়। সেই একই রকম অতি সাধারণ মানুষের আলাপচারিতার মতো বক্তব্য। লোকজন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শোনে। ১৯৮৩ সালে আমি যখন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রধানদের ধারাবাহিক সাক্ষাৎকার গ্রহণ করছিলাম, মনি সিং সেই তালিকায় ছিলেন। আমি তখন শান্তিবাগে থাকতাম। মনি সিংও শান্তিবাগে থাকতেন। অনেক সময় তাকে রিকশায় বাসায় ফিরতে বা বাসা থেকে বের হয়ে রিকশায় উঠতে দেখেছি। তার সাক্ষাৎকার নেয়ার জন্য সিপিবি’র পল্টনের অফিসে গেলে তাকে ব্যস্ত পাই। আমি অপেক্ষা করি। ব্যস্ততা শেষ হলে আমাকে ডেকে পাঠান। আমি তাকে আমার উদ্দেশ্যের কথা বলি। কিন্তু সেদিন তিনি সময় দিতে পারেন না, দু’দিন পর সময় দিতে চান। তাকে বলি যে আমি তার বাসার কাছেই থাকি, সময় দিলে আমি বাসায় আসতে পারি। তিনি আগ্রহে সাড়া দেন, আমাকে পরদিন সকাল ১০টায় যেতে বলেন। যতদূর মনে পড়ে শান্তিবাগে তিনি তার ছেলের ভাড়া বাসায় থাকতেন। যথাসময়ে আমি তার বাসায় গিয়ে হাজির হই। বাসা মানে একতলা টিনের বাড়ি, ইটের দেয়াল। বেল বাজানোর পর তিনি নিজেই দরজা খুলে দেন। পরনে ধুতি ও গায়ে গেঞ্জি। আমাকে বসতে বলে তিনি ভেতরে গিয়ে একটি লম্বা সাদা কুর্তা পরে আসেন। বাইরেও সম্ভবত তাকে কখনো প্যান্ট বা ধুতি পরা অবস্থায় দেখিনি। সাদা পাজামা ও লম্বা কুর্তা পরনে থাকতো।  সারাক্ষণ মুখে স্মিত হাসি। বলেন, আপনাকে ভালোভাবে আপ্যায়নও করতে পারবো না। আমিও বিনয়ের সাথে কথা বলি যে আমি শুধু তার জীবন ও আন্দোলন সম্পর্কে জানতে চাই। রুশ বিপ্লবের প্রায় সাত দশক কেটে গেলেও বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদের ব্যাপারে নেতিবাচক মনোভাবের মধ্যে তার দলের পক্ষে কীভাবে শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন প্রতিষ্ঠা সম্ভব, সে সম্পর্কে তার বক্তব্য জানতে চাই। তিনি বলেন, মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ আমাদের আদর্শ। ক্ষমতা অর্জনের সঙ্কীর্ণতার মধ্যে আমাদের সংগ্রাম সীমাবদ্ধ নয়। মেহনতি মানুষের মুক্তির মধ্য দিয়ে মুক্ত মানবের মুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করাই আমাদের কাজ। আমাদের পার্টি শ্রমিকের পার্টি, গরিবের পার্টি, ইনসাফের পার্টি। আমরা মানুষের মাঝে থাকবো। তিনি চীনের মাওবাদকে বামপন্থার বিচ্যুতি বলে উল্লেখ করেন এবং পার্টিতে বিভেদের বিরুদ্ধে সবসময় দৃঢ় অবস্থানের কথা বলেন। 

কথার এক পর্যায়ে তিনি থামেন এবং ভেতরে গিয়ে একটি ট্রেতে চা ও বিস্কুট নিয়ে আসেন। আমি নিজেকে ক্ষুদ্র বিবেচনা করতে শুরু করি। আমি কমিউনিজমের পক্ষের লোক নই। কিন্তু তার নেতৃত্ব ও বিনয়ের প্রতি আমি শ্রদ্ধাশীল থাকবো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার শিক্ষক ছিলেন অধ্যাপক সরদার ফজলুল করিম। তিনিও কমিউনিস্ট ছিলেন। তার রাজনৈতিক জীবনের ১১ বছর কারাগারে কেটেছে। কারাগারে থাকাকালে যুক্তফ্রন্টের মনোনয়নে ১৯৫৪ সালে তিনি পাকিস্তানের দ্বিতীয় গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। তখন তার বয়স ত্রিশ বছর। তিনি আমাদেরকে রাজনৈতিক দর্শন পড়াতেন। এতো জ্ঞানী, পড়াশোনায় এতো গভীরতা, এবং এতো সরলভাবে বোঝাতেন যে দর্শনের কঠিন বিষয়গুলো গল্প হয়ে ওঠতো। ছোটখাট আকৃতির এই মহান শিক্ষক এতো বিনয়ী ছিলেন যে, সালাম দিলে তিনি হেসে মাথা প্রায় বুক পর্যন্ত ঝুঁকিয়ে সালামের উত্তর দিতেন, তখন নিজেকে ক্ষুদ্র মনে হতো। আমার বন্ধুর পিতা কমরেড রবি নিয়োগীও ঠিক এমন বিনয়ী ছিলেন। তিনি অনেক সময় সাইকেলে চলাফেরা করতেন। খুব সাধারণ মানুষও যদি তাকে আদাব জানাতো, তিনি পাল্টা আদাব দিয়ে সাইকেল থেকে নেমে তার সাথে কথা বলতেন। মানুষের কাছে তাদের রাজনৈতিক আদর্শ গ্রহণযোগ্য হয়নি, কিন্তু তারা ব্যক্তিগত সততা, বিনয়, মানুষের প্রতি নি:স্বার্থ ভালোবাসার কারণে মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছিলেন। মনি সিং এর সাধনা ছিল মানুষ এবং এক ঘন্টার সাক্ষাৎকারে তিনি একবারও রাজনীতির কথা বলেননি। কে কী ভুল করেছে তাদের সমালোচনা করেননি। মানবতাবাদের কথা বলেছেন। মানুষের জন্য তার ও তার দলের ভালোবাসা ও মানবপ্রেমকেই বিপ্লবের কেন্দ্রবিন্দু বলেছেন। তিনি রাজনীতিবিদের মতো কথা বলেননি। শিক্ষকের মতো কথা বলেছেন। এমন শিক্ষক আমাদের জন্য খুবই প্রয়োজন। আমি মুগ্ধতা নিয়ে ফিরে আসি। 

 

জহিরুলঃ আপনি পৃথিবীর অনেক দেশ ও শহর ভ্রমণ করেছেন, প্রায়শই বলেন, যদি আবারও কোনো দেশ বা শহর ভ্রমণের সুযোগ আসে পছন্দের তালিকায় প্রথমেই থাকবে দিল্লি। দিল্লির প্রতি এই প্রেম কেন?

 

মঞ্জুঃ দিল্লিকে সবসময় আমার আপন মনে হয়েছে বলে আমি বার বার দিল্লিতে ফিরে গেছি। দিল্লিকে কখনো ভিন্ন একটি দেশের রাজধানী বলে মনে হয়নি। এখনো দিল্লিতে যেতে চাই। দিল্লির উজিরপুরায় যেখানে ছিলাম সেখানে অল্পদিনেই সেখানকার লোকজন আপন হয়ে গিয়েছিল। আমি এবং আমার সঙ্গে অপর যে বাংলাদেশী ফেলো ছিলেন জাতীয় সংসদের প্রটোকল অফিসার রুহুল আমিন, আমরা এক শিখ ভদ্রলোক মনোহর লাল দং এর বাড়ির তিনতলার একটা রুম ভাড়া নিয়েছিলাম। সাতচল্লিশে দেশ ভাগের পর পাকিস্তান থেকে যখন আসেন তখন তার বয়স ছিল চার বছর। যখন আমার সাথে দেখা তখন তিন ছেলে, দুই মেয়ের পিতা। শিখদের মতো তার দীর্ঘ দাড়ি ও মাথায় পাগড়ি ছিল না, কিন্তু হাতে কঙ্গন পরা ছিল। আমরা ভাড়াটের মত ছিলাম না। তার পরিবারের সদস্যের মতো ছিলাম। তার বাসায় ভালো কিছু রান্না হলে ছেলে বা মেয়েদের দিয়ে পাঠাতেন, কখনো নিজেই নিয়ে আসতেন। আমরা যেহেতু সাময়িক বাসিন্দা, আমাদের গ্যাস সিলিণ্ডারের বরাদ্দ পাওয়া সম্ভব ছিল না। কেরোসিনের স্টোভে রান্না করতাম। কেরোসিনকে হিন্দি ও উর্দুতে বলা হয় ‘মিট্টি কা তেল।’ যখন যেখান থেকে সুবিধা হতো মিট্টি কা তেল কিনতাম। একদিন এক বয়স্কা মহিলার দোকান থেকে মিট্টি কা তেল কিনেছি, যে দোকানে প্রথমবার গিয়েছিলাম। বিশ রুপির নোট দেয়ার পর তিনি অবশিষ্ট ফেরত দিয়েছেন। দুই তিন সপ্তাহ সেই দোকানে যাইনি। একদিন একটা দিয়াশলাই কিনতে গেলাম, মহিলা দাম না নিয়ে আমাকে উল্টো বেশ কয়েকটি টাকা দিচ্ছেন। আমি কারণ জানতে চাইলে তিনি বললেন, বেশ ক’দিন আগে তুমি মিট্টি কা তেল নিয়ে গেছিলে, আমি ভুলে বেশি টাকা রেখেছিলাম। দোকানে যারা আসে তাদেরকে তোমার হুলিয়া বর্ণনা করে জানতে চেয়েছি, কেউ বলতে পারেনি। তিনি দু:খ প্রকাশ করলেন এবং বার বার ক্ষমা চাইলেন। আমি একজন দরিদ্র দোকানি মহিলার এই সততায় কুণ্ঠিত বোধ করেছি। এরপর ইচ্ছা অনিচ্ছায় তার দোকানে গিয়ে তাকে নমস্কার জানিয়ে এসেছি। দিল্লি থেকে চলে আসার আগেও তার কাছ থেকে বিদায় নিয়েছি। আমাদের বাড়ির সামনের বাড়ির এক মেয়ের বিয়ে হয়েছে আমরা থাকতেই। তারা আমাদেরকে বিয়েতে দাওয়াত করেছেন। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর যদিও দিল্লিতে তেমন আঁচ পড়েনি, তবুও তারা আমাদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। পরদেশে এমন সহানভূতির ছোাঁয়া শুধু সেই মহল্লায় নয়, প্রায় সর্বত্র পেয়েছি। এসব ছাড়াও দিল্লির মোগল ঐতিহ্যের কারণে দিল্লিকে হৃদয়ের কাছাকাছি মনে হয়। ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের পর শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের নির্বাসনের মধ্য দিয়ে মোগল রাজবংশ নিশ্চিহ্ন হওয়া থেকে ১৯৯২ সালে দিল্লিতে আমার অবস্থানের মধ্যে সময়ের ব্যবধান ১৩৫ বছর। সময়ের সাথে দিল্লিতে এতো পরিবর্তন সত্বেও দিল্লি মোগল দিল্লিই ছিল। মোগল ঐতিহ্যের প্রতি আমার ভালোবাসার কারণেই দিল্লির প্রতি ভালোবাসা অনুভব করি।     

 

জহিরুলঃ পড়াশোনার জন্য দিল্লি, বার্লিন, ক্যালিফোর্নিয়ায় গেছেন। পৃথিবীর দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয় স্ট্যানফোর্ডে পড়াশোনা করেছেন। প্রাচ্যের অক্সফোর্ডের সাথে স্ট্যানফোর্ডের পার্থক্যগুলো কিছু তুলে ধরুন। শিক্ষাদান পদ্ধতি, কারিকুলাম, গবেষণা পদ্ধতি, শিক্ষকদের যোগ্যতা, সততা এবং আন্তরিকতা, শিক্ষার্থীদের ডাইভার্সিটি ইত্যাদির আলোকে বিশ্লেষণ করুন, যা থেকে আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো কিছু শিখতে পারে। 

 

মঞ্জুঃ কোনো দেশে বেড়ানোর জন্য যাওয়ার চেয়ে পড়াশোনা করতে গেলেই সেই দেশ, মানুষ, সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি ও অর্থনীতি সম্পর্কে ভালোভাবে জানা সম্ভব হয় বলে আমি বিশ্বাস করি। অন্যান্য স্থানে শিক্ষা লাভের জন্য যে সময়ের জন্য গেছি, তার চেয়ে স্ট্যানফোর্ডে কাটানোর সময় তুলনামূলকভাবে দীর্ঘ ছিল। আমার সাথে আমার পরিবারও ছিল, সে কারণে পরিবার বিচ্ছিন্ন অবস্থায় যে মানসিক টানাপোড়েন থাকে, আমার তা ছিল না। আমার সতীর্থ দু’একজন ছাড়া সবার পরিবারই ছিল সেখানে। এসব পরিবার ছাড়াও আমাদের প্রোগ্রামের শিক্ষকদের পরিবারের সাথে আমরা একাত্ম ছিলাম। ঘন ঘন পারিবারিক অনুষ্ঠান হতো। বিশ্ববিদ্যালয়কে শুধু পড়াশোনার স্থান বলে মনে হয়নি, নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ একটি সমাজ বলে মনে হয়েছে। আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলে অহঙ্কার করি। যারা এ অভিধা দিয়েছেন, তারা নিশ্চয়ই এর পেছনে কোনো কারণ খুঁজে পেয়েছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়, যা ব্রিটিশ যুগের পূর্ব-বাংলার ওই সময়ের মুসলিম নেতৃবৃন্দের প্রচেষ্টা ও সংগ্রামের পর প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়েছে। কলকাতার বাবুরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘মক্কা বিশ্ববিদ্যালয়’ বলে হাসিঠাট্টাও করেছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়টি শেষ পর্যন্ত ভালোভাবে টিকে গেছে, দেশের সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে এই বিশ্ববিদ্যালয় গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেছে এবং সব মিলিয়ে এখনো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দেশে বিদেশে বাংলাদেশের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থানেই রয়েছে। আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই তখন দেশে আরো কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় থাকলেও অনেক সময় ভাবি যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় না থাকলে আমি কী উচ্চ শিক্ষার সুযোগ পেতাম। আমার মনে হয় না যে, আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাদ দিয়ে চট্টগ্রাম বা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে যেতাম। স্ট্যানফোর্ডের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে তুলনা করলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে হেয় করা হবে, যা আমি করতে চাই না। সম্প্রতি একটি প্রতিষ্ঠান বিশ্বের ৯০টি দেশের ১৫০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাংকিং করেছে, সেখানে স্ট্যানফোর্ডের অবস্থান দ্বিতীয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান  ১০০১ এ। স্ট্যানফোর্ড যে অর্থ ব্যয় করতে পারে, যতোজন শিক্ষক নিয়োগ করতে পারে, ছাত্রদের যে সুযোগ দিতে পারে তা শুধু বাংলাদেশ নয়, তৃতীয় বিশ্বের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে সম্ভব নয়। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপের দেশগুলো শিক্ষক অনুসন্ধানের জন্য সার্চ কমিটি গঠ করে, কোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোন সেরা শিক্ষককে কত বেতনে, কী কী সুযোগ সুবিধা দিয়ে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে আনতে পারবে সেজন্য প্রতিযোগিতা করে। আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ করা হয় রাজনৈতিক বিচারে। যারা শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান তারা যে দলের সুপারিশে নিয়োগ লাভ করেন, সেই দলের প্রতি অনুগত থাকেন। অতএব কারিকুলাম যাই হোক, তারা তা অনুসরণ করে পাঠদান করেন না। মাসের পর মাস ক্লাস নেন না। শিক্ষকের সাথে ছাত্রের সম্পর্ক কেমন তার উপর নির্ভর করে ছাত্রের ভালো গ্রেড পাওয়া। তারা পছন্দের খারাপ ছাত্র-ছাত্রীকে ভালো গ্রেড দেন, অপছন্দের ছাত্র-ছাত্রীদের মন্দ গ্রেড দিয়ে জীবন ধ্বংস করে দেন।  এ ধরনের প্রবণতার কারণে শিক্ষার মান, শিক্ষকের মান কমেছে। আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণার কাজ নেই বললেই চলে। গবেষণা খাতে অর্থ বরাদ্দ এতো কম থাকে যা দিয়ে কোনো গবেষণা চলে না। পাশ্চাত্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মাধ্যমে সকল ক্ষেত্রের বিভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠান গবেষণার কাজ পরিচালনা করতে অর্থ বরাদ্দ দেয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মাধ্যমে শিক্ষকরা সরাসরি এই অর্থ গবেষণার কাজে ব্যয় করেন ছাত্রদের নিয়োগ করার মাধ্যমে। বাংলাদেশেও এ ধরনের গবেষণার কিছু কাজ হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে এক শ্রেনির শিক্ষকের নিজস্ব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। আমাদের শিক্ষকরা নিজেদের লাভ খোঁজেন আগে। আমাদের শিক্ষকরা যে যোগ্যতার বিচারে পিছিয়ে আছেন তা বলবো না, তারা সে যোগ্যতাকে সততার সাথে জাতীয় স্বার্থে কাজে লাগান না। অতএব পার্থক্য মানসিকতার। স্ট্যানফোর্ডে যারা আমার শিক্ষক ছিলেন তারা বলতেন উইকএণ্ডসেও যদি প্রয়োজন পড়ে তাহলে যাতে আমি ফোন করি, তা পড়াশোনার প্রয়োজনে হোক বা ব্যক্তিগত প্রয়োজনে হোক। আমাদের দেশের ছাত্রশিক্ষকরাও উন্নত দেশের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়াশোনা করেন। অনেকে দেশে ফিরে শিক্ষকতায় নিয়োজিত হন, কিন্তু কিতাবি শিক্ষার বাইরে যা শিখেন তা চর্চা করেন না অথবা করার মতো পরিবেশ পান না। এজন্য শুধু বিশ্ববিদ্যালয় বা সংশ্লিষ্ট শিক্ষকরাই দায়ী নন, দেশের সার্বিক রাজনৈতিক সংস্কৃতিও দায়ী। 

 

জহিরুলঃ যখন বার্লিনে পড়তে যান, ১৯৮৩ সালে, দুই জার্মানি ছিল ভিন্ন দুটি দেশ, একটি সমাজতান্ত্রিক, অন্যটি ধনতান্ত্রিক। বার্লিন তখন বিভক্ত ছিল বার্লিন প্রাচীর দ্বারা। সেই সময়ে আপনার দেখা বার্লিন তথা দুই জার্মানি, এমন কি, টু সাম এক্সটেন্ট ইউরোপের, একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক চিত্র তুলে ধরুন। 

 

মঞ্জুঃ জি, আমি বার্লিনে গেছি ১৯৮৩ সালে। তখন বার্লিন ছিল বিভক্ত নগরী এবং পশ্চিম বার্লিন সম্পূর্ণ প্রাচীরবেষ্টিত ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এক জার্মানি, ১৯৪৫ সালে পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানি নামে দুটি পৃথক দেশে পরিণত হয়। পূর্ব জার্মানির রাজধানী ছিল পূর্ব বার্লিন এবং পশ্চিম জার্মানি রাজধানী ছিল বন। আমি পশ্চিম বার্লিনের ইন্টারন্যাশনাল ইন্সটিটিউট ফর জার্নালিজম এ তিন মাসের একটি ডিপ্লোমা প্রোগ্রামে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। ১৯৮৩ সালের জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। পশ্চিম বার্লিনে পশ্চিম জার্মানির মুদ্রা চালু থাকলেও এই নগরী পশ্চিম জার্মানির অংশ ছিল না। বলা হতো ফোর পাওয়ার স্ট্যাটাস। চারটি দেশের পতাকা ওড়তো পশ্চিম বার্লিনে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ফ্রান্স।  মিত্র বাহিনীর বার্লিনমুখী অভিযানে যে দেশের বাহিনী যেখানে আগে পৌছেছে সেখানেই অবস্থান নিয়ে ছিল ১৯৯০ সালে বার্লিন প্রাচীর ভেঙে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত। সোভিয়েত বাহিনী নগরীর বেশির ভাগ এলাকা দখল করেছিল, যা পূর্ব বালিন। তবে পশ্চিম বার্লিনেও তাদের কিছু কিছু পকেট ছিল, বিশেষ করে দুটি ওয়ার মেমোরিয়াল। একটির প্রহরায় নিয়োজিত থাকতো সোভিয়েত সৈন্যরা। পশ্চিম বার্লিনে অন্য তিনটি রাষ্ট্র যেখানে দখল কায়েম করে রেখেছিল সেদিকে যাওয়ায় কোনো বাধা ছিল না, কিন্তু ইংরেজি ও জার্মান ভাষায় সাইনবোর্ডে লেখা থাকতো, “ইউ আর ক্রসিং ইউএস সেক্টর”, “ইউ আর ক্রসিং ব্রিটিশ সেক্টর” বা “ইউ আর ক্রসিং ফ্রেঞ্চ সেক্টর।” তিন দেশের ইউনিফর্ম পরিহিত সৈন্যরা নগরীতে ঘুরতো। বিদেশিরা পূর্ব বার্লিন থেকে পশ্চিম বার্লিন এবং পশ্চিম বার্লিন থেকে পূর্ব বার্লিনে ২৪ ঘন্টার জন্য আসতে পারতো চেক পয়েন্ট চার্লি নামে একটি গেট দিয়ে। পশ্চিম বার্লিনে যে সাবওয়ে চলতো তার কয়েকটি লাইন পূর্ব বার্লিনের নিচ দিয়ে ছিল। কয়েকটি স্টেশনে ট্রেন থামতো। সেদিক দিয়ে ওপরে ওঠে পূর্ব বার্লিন ঘুরে আসার সুযোগ ছিল বিদেশিদের। স্টেনে দু’একটি গিফট শপও ছিল। গিফট কিনতো কেউ কেউ। সস্তায় সিগারেট কিনতো অনেকে। পূর্ব বার্লিনে যেহেতু সবকিছু সাবসিডাইজড ছিল সেজন্য কম দামে পাওয়া যেত সিগারেটসহ অনেক কিছু। ওই স্টেশনগুলো পার হলে অনেক সময় পশ্চিম বার্লিনের কাষ্টমস পুলিশ যাত্রীদের তল্লাশী করতো এবং সিগারেট পেলে ট্যাক্স আদায় করতো। আমার অবস্থানকালে আমি একদিন গাইডেড ট্যুরে পূর্ব বার্লিন গিয়েছিলাম। চেকপয়েন্ট চার্লিতে গাড়ি তল্লাশী করা হলেও যাত্রীদের তল্লাশী করা হয়নি। আমরা একটি বিশ্ববিদ্যালয়, একটি যাদুঘর, একটি পার্ক ও পূর্ব বার্লিনের ডাউনটাউন ঘুরে একটি রেষ্টুরেন্টে যাই। খাবারের দাম পশ্চিম বার্লিনের দামের অর্ধেকের কম। বার্লিনের বাইরে পশ্চিম জার্মানি বেশ কিছু শহর ও উল্লেখযোগ্য স্থান পরিদর্শনের জন্য দুই সপ্তাহের ট্যুর প্রোগ্রাম ছিল। এসময় আমাদেরকে রাজধানী বন এ বিভিন্ন সরকারী দফতরে নিয়ে যাওয়া হয়। সর্বত্র তারা বন’কে প্রভিশনাল ক্যাপিট্যাল বা অস্থায়ী রাজধানী হিসেবে বর্ণনা করেছেন। প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন, জার্মানি আবারও এক হবে এবং রাজধানী আবারও হবে বার্লিন, যা আমি চলে আসার সাত বছর পর সত্যে পরিণত হয়েছে। ইউরোপের অন্যান্য দেশের রাজনীতি ও সামাজিক চিত্র সম্পর্কে ওই সময়ে খুব একটা স্বচ্ছ ধারণা হয়নি। তবে জার্মানিতে একটি বিষয় লক্ষ্য করেছি যে জার্মান প্রবাসী তুর্কিদের নিজ দেশে পাঠিয়ে দেয়ার জন্য তারা উৎসাহিত করার চেষ্টা করছে বিভিন্ন প্রনোদনা ঘোষণা করার মাধ্যমে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তুর্কি শ্রমিকরাই যুদ্ধ বিধ্বস্ত পশ্চিম জার্মানিকে পুনরায় গড়ে তুলেছে এবং কোনো কোনো সিটিতে ১৯৮৩ সালে তুর্কি নাগরিকের সংখ্যা ৩০ শতাংশ বলেও শুনেছি। তাদেরকে জার্মান নাগরিকত্ব দেয়া হয়নি। এ সময় পশ্চিম বার্লিনে একটি ঘটনা ঘটে। কামাল আলতুন নামে এক তুর্কির কোনো অপরাধের বিচারে তাকে তুরস্কে ডিপোর্ট করার রায় দেয়ার পর তিনি আদালত ভবনের ছয় তলার এজলাস কক্ষের জানালা দিয়ে লাফ দেন এবং তার মৃত্যু ঘটে। এ ঘটনার পর তুর্কিদের দেশে পাঠানোর প্রচারণা কিছুটা কমে এসেছিল। 

 

জহিরুলঃ স্টানফোর্ডে পড়ার সময় শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন কন্ডোলিজা রাইসকে। পরবর্তিতে তিনি বুশ প্রশাসনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পান এবং তার সময়ের পররাষ্ট্রনীতি বিশ্বব্যাপী ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়, বিশেষ করে ইরাক যুদ্ধ, নাইন-এলেভেন ইস্যুকে যেভাবে হ্যান্ডেল করা হয় ইত্যাদি ক্ষেত্রে। আপনার শিক্ষক কন্ডিকে আপনি কেমন দেখেছেন? কতটা ঘনিষ্ঠ হতে পেরেছিলেন তার সাথে? 

 

মঞ্জুঃ যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় ও প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নারী সেক্রেটারী অফ ষ্টেট ছিলেন কন্ডোলিজা রাইস। তিনি প্রেসিডেন্ট বুশ জুনিয়রের প্রশাসনে ২০০৫ থেকে ২০০৯ সালের জানুয়ারী পর্যন্ত সেক্রেটারী অফ ষ্টেট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। প্রায় ৩৩ বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রে এসে সাংবাদিক ছাড়া অন্যান্য পেশার যাদের সাথে কিছু বেশি সময়ের জন্য সম্পর্ক টিকে ছিল তাদের একজন প্রফেসর কন্ডোলিজা রাইস। ষ্ট্যানফোর্ডে আমার ফেলোশিপের মেয়াদে পলিটিক্যাল সায়েন্স ডিপার্টমেন্টে তার একটি কোর্স নিয়েছিলাম, ‘মিলিটারি ইন পলিটিকস’। ক্যালিফোর্নিয়ার উত্তরাঞ্চলে আবহাওয়া নাতিশীতোষ্ণ হলেও শীতের সকালগুলো বেশ ঠাণ্ডা। আমি জ্যাকেট গায়ে দিয়ে ক্লাসে গেছি। বহু ছাত্রছাত্রী সর্টস পরে এসেছে। ডেস্কের ওপর পা তুলে আয়েশ করে বসেছে। ছেলেমেয়ে জড়াজড়ি করে চুমু খাচ্ছে। কেউ স্যাণ্ডউইচে কামড় দিতে দিতে ক্লাসে ঢুকেছে। কারো হাতে কফির গ্লাস। কণ্ডোলিজা রাইস ক্লাসে এলেন, কেউ উঠে দাঁড়ালো না। ডেস্কের ওপর পা তুলে যারা বসেছিল তারা পা পর্যন্ত নামালো না, বরং যা করছিল তাই করতে থাকলো। কণ্ডি সামনের দিকের একজনকে ডাকলেন লেকচার ডেস্ক ঠিক করে দিতে। যখন তার মনে হলো সবাই তার উপস্থিতি জেনে গেছে, তখন ডেস্কে চাপড় দিয়ে শুরু করলেন, “গুড মর্নিং এভরিবডি, লেটস গেট স্টার্টেড। সঙ্গে আনা কোর্স আউটলাইনের কপিগুলো একজনকে দিলেন পাস অন করার জন্য। কোয়ার্টারের প্রথম ক্লাস। তিনি শৈশব থেকে তার পরিচয় দিয়ে কোর্স সংক্রান্ত প্রয়োজনেযখন যার প্রয়োজন যোগাযোগ করার জন্য তার ফোন নম্বর, অ্যাপার্টমেন্টের ঠিকানা বলে দিলেন।  একহারা গড়নের কৃষ্ণাঙ্গ অবিবাহিতা মহিলা, আমার সমবয়সী হবেন। যখন লেকচার শুরু করলেন তখন মনে হলো আমি কি একজন শিক্ষকের লেকচার শুনছি না, মার্কিন সেক্রেটারি অফ ষ্টেটের পররাষ্ট্র বিষয়ক ঘোষণা শুনছি। পঞ্চাশ মিনিটের ক্লাস যেন মুহূর্তে শেষ হয়ে গেল। প্রতি সপ্তাহে তার একটি ক্লাসে শ’খানেক নিয়মিত ছাত্রছাত্রীর সাথে উপস্থিত হই আমরা পাঁচ সাংবাদিক। আমি ছাড়া টেক্সাসের অষ্টিন-আমেরিকান নিউজের জন সি হেনরি (পরবর্তীতে এসোসিয়েটেড প্রেন এর ওয়াশিংটন ব্যুরোর নিউজ এডিটর), ফরচুন ম্যাগাজিনের ষ্টুয়ার্ট গেনেস (বর্তমানে ষ্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির রয়টার্স ডিজিটাল ভিশনের ডাইরেক্টর), অষ্ট্রেলিয়ার দি এইজের ষ্টিভ হ্যারিস (সর্বশেষ মেলবোর্নের দ্য হেরাল্ডের প্রধান সম্পাদক ছিলেন) এবং তুরস্কের সাবাহ নিউজের এরগুন বাবাহান (পরবর্তীতে সাবাহ ডেইলির সম্পাদক হন) ছিলেন



পরবর্তী তিনটি মাস সপ্তাহে তার চারটি ক্লাসে উপস্থি হয়েছি। গ্রুপ স্টাডির পর রিপোর্ট জমা দিয়েছি। আমাদের লাউঞ্জে বক্তব্য দিতে এসেছেন। তার বক্তব্যে ঘুরে ফিরে এসেছে ভিয়েতনাম প্রসঙ্গ। তিনি বলেছেন, আমেরিকান সিভিল ওয়ারের অভিজ্ঞতা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে বহি:শত্রুর আক্রমণের একমাত্র অভিজ্ঞতা ১৯৪১ সালে পার্ল হারবারে জাপানি  বিমান হামলা। ফলে যুক্তরাষ্ট্রকে তার মূল ভূখণ্ডে কখনো যুদ্ধ দেখতে হয়নি। বিদেশে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটিগুলো থেকে যে যুদ্ধ পরিচালনা করা হয়েছে তা মূলত প্রক্সি ওয়ার এবং এসব যুদ্ধে জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয় রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে, ভিয়েতনামেও তাই ঘটেছিল। তিনি ভিয়েতনামে যুক্তরাষ্ট্রের পরাজয়ের কথা স্বীকার করেননি। তার মতে ভিয়েতনামে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক পরাজয় ঘটেছিল ওয়াশিংটনে। ভিয়েতনাম পরিস্থিতি সামলাতে রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যর্থতাকে দায়ী করে বলেন, দেশে যুদ্ধ বিরোধী বিক্ষোভ সাফল্যের সঙ্গে দমন করা হলে ভিয়েতনাম কখনোই আমেরিকার দু:স্বপ্নে পরিণত হতো না। দেখতে দেখতে এক কোয়ার্টার কেটে গেল। এর মধ্যে আমরা কন্ডোলিজা রাইসের সাথে কিছুটা ঘনিষ্ট হয়েছি। সেকেন্ড কোয়ার্টারেও তার একটা কোর্স নেব ঠিক করেছি। কিন্তু প্রফেসর রাইস কোর্সটি ক্যান্সেল করে দিয়েছেন। ষ্ট্যানফোর্ড ডেইলিতে খবর বের হলো, কন্ডোলিজা রাইস বুশ (সিনিয়র) প্রশাসনে জয়েন করতে যাচ্ছেন। সে কারণে কোর্স ক্যান্সেল করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছুটি নেবেন।

আমাদের প্রোগ্রামের যে পাঁচজন সাংবাদিক কন্ডোলিজা রাইসের ক্লাসে এটেন্ড করেছি, তারা দশ পনের ডলার করে চাঁদা দিয়ে তাকে ফ্যাকাল্টি ক্লাবে লাঞ্চে ইনভাইট করলাম তার সাথে নিবিড়ভাবে আলাপ করার জন্য যে প্রকাশিত খবর সঠিক কিনা। এ সম্পর্কে তাকে প্রশ্ন করলে তিনি জানালেন যে, বুশ এডমিনিষ্ট্র্রেশন থেকে তাকে অফার দেয়া হয়েছে। কিন্তু এতো কম বয়সে তিনি সরাসরি মিনিষ্ট্রিতে যোগ দিতে চান না। তবে ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলে কাজ করার সুযোগ এলে তিনি বিবেচনা করবেন। তার মতে, ‘ওটাই আমার কাজের জন্য ভাইটাল প্লেস্’। যাহোক, কয়েকদিন পরই ষ্ট্যানফোর্ড ডেইলিতে আবার সংবাদ প্রকাশিত হলো, প্রফেসর কন্ডোলিজা রাইস ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলে ডেপুটি ডাইরেক্টর হিসেবে যোগ দিয়েছেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম নারী ন্যাশনাল সিকিউরিটি এডভাইজার প্রেসিডেন্ট বুশ জুনিয়রের প্রশাসনে ২০০১-২০০৪ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। এর আগে রিগ্যান প্রশাসনে যুক্তরাষ্ট্রের সোভিয়েত নীতি নির্ধারণে তার বড় ভূমিকা ছিল। ইউএস আর্মির জয়েন্ট চিফ অফ স্টাফের সোভিয়েত এডভাইজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৯৩ সালে প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবে তিনি স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদ প্রভোষ্টের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বর্তমানে তিনি স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে অবস্থিত হার্বার্ট হুভার ইন্সটিটিউটের ডাইরেক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

শৈশব থেকে তিনি তার মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন সর্বত্র। শিক্ষক বাবা-মা’র একমাত্র সন্তান কণ্ডোলিজা রাইস তিন বছর বয়সে পিয়ানো শিখতে শুরু করেন এবং তা পা পিয়ানোর পা-দানি স্পর্শ করার মতো উচ্চতা সম্পন্ন হওয়ার আগেই বাখ ও বেটোফেন বাজাতে শিখেন। তিনি স্কেটিং রপ্ত করেন, ফ্রেঞ্চ ও স্পেনিশ ভাষা আয়ত্ব করেন। এগার বছর বয়সে এইটথ গ্রেডে ভর্তি হন এবং পনেরো বছর বয়সে হাইস্কুল শেষ করেন। ডেনভার ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি করেন। স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে যোগ দেন ১৯৮১ সালে। 

তিনি সেক্রেটারী অফ স্টেট হওয়ার পর আমি ও আমা স্ত্রী ২০০৭ সালের জুন মাসে যুক্তরাষ্ট্রে বেড়াতে আসি। ওয়াশিংটনে আমার ষ্ট্যানফোর্ডের সতীর্থ এসোসিয়েটেড প্রেসের নিউজ এডিটর জন হেনরির বাড়িতে থাকি। তিনি আমাকে বলেন যে আমি কণ্ডোলিজা রাইসের সাথে দেখা করতে চাই কিনা। তাৎক্ষণিক দেখা করা সম্ভব কিনা জানতে চাইলে বলেন, অন্তত দু’দিন লাগবে। তবে দেখা দিতে অস্বীকার করবেন না। কিন্তু আমার পক্ষে দু’দিন ওয়াশিংটনে থাকা সম্ভব ছিল না, নিউইয়র্কে নির্ধারিত কিছু কাজ থাকায়। 

 

জহিরুলঃ সাংবাদিকতা বিষয়ে পড়তেই ফেলোশিপ নিয়ে পৃথিবীর বড় বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়তে গেছেন, পৃথিবীর বহু নামকরা সাংবাদিককে সতীর্থ হিসেবে পেয়েছে, আপনার একজন সহপাঠি হাঙ্গেরিয়ান-আমেরিকান রিচার্ড হারশিলার এর সঙ্গে আমার বুদাপেস্টে দেখা হয়। এক দুপুর তার সঙ্গে আড্ডা দেবারও সুযোগ পাই। সেইসব বিখ্যাত গণমাধ্যম ব্যক্তিদের সম্পর্কে কিছু বলুন। 

 

মঞ্জুঃ ১৯৮৮ সালে প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্রে এসে বিখ্যাত কিছু ব্যক্তিত্ত্বের সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ ঘটেছিল। কিছু লোকের সাথে চকিতেপরিচয়, আনুষ্ঠানিক সাক্ষাৎ হয়েছে, এরপর আর কখনো কোনো কারণেই তাদের সাথে যোগাযোগ ঘটেনি। এই তালিকার মধ্যে মধ্যে ছিলেন সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী জর্জ শুলজ, ওয়াশিংটন পোস্টের খ্যাতনামা কলামিস্ট ডেভিড ব্রোডার, রয়টার্সের ট্রাস্টি ও অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির কুইন এলিজাবেথ ইন্সটিটিউটের পরিচালক নেভিল ম্যাক্সওয়েল, রয়টার্স ফান্ডেশনের পরিচালক ডেভিড চিপ এবং আরো কয়েকজন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি। সাক্ষাতের আগেই শেষোক্ত দু’জনের সাথে চিঠিপত্রে যোগাযোগ ছিল। নেভিল ম্যাক্সওয়েল লন্ডনের দি টাইমসের প্রতিনিধি হিসেবে ষাটের দশকের উল্লেখযোগ্য সময় দিল্লিতে নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৬২ সালে ভারত ও চীনের মধ্যে যে যুদ্ধ সংঘটিত হয় নেভিল ম্যাক্সওয়েল তার উপর একটি গ্রন্থ রচনা করেন, যেটির নাম “ইন্ডিয়া’স চায়না ওয়ার”। গ্রন্থটিতে চীনের মতো একটি দেশের সাথে কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়া ভারতের মূর্খতা ছিল বলে সমালোচনা করা হয় এবং এতে ভারত সরকারের যুদ্ধ সংক্রান্ত গোপন দলিলের যেসব উদ্ধৃতি দেয়া হয় তা সরকারকে বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে ফেলে। কারণ যুদ্ধে অপমানজনক পরাজয়ের কারণে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী কৃষ্ণ মেনন পদত্যাগ করেন, তদানীন্তন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল কারিয়াপ্পা পদত্যাগ পত্র পেশ করলেও প্রধানমন্ত্রী নেহরুর অনুরোধে তা প্রত্যাহার করে নেন। 

ভারতের অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট অনুযায়ী সরকারী গোপন দলিলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ছাড়া কারো স্পর্শ পড়ার সুযোগ না থাকলেও কি করে একজন বিদেশি সাংবাদিকের হাতে সেসব দলিল পৌঁছুলো তা প্রচন্ড আলোড়ন সৃষ্টি করে। মেজর জেনারেল বিএম কাউল, যাকে ম্যাক্সওয়েল তার গ্রন্থে সামরিক প্রস্তুতিহীনতার জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী করেছেন, তিনি তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ খণ্ডানোর সুযোগ পান সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণের পর একটি গ্রন্থ রচনা করে। গ্রন্থটির নাম “দি আনটোল্ড স্টোরি”। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তার যুক্তি ও ব্যাখ্যা নীতি নির্ধারকদের কাছে গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয়নি। নেভিল ম্যাক্সওয়েল বাংলাদেশের অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তির সাথেও ঘনিষ্ট ছিলেন এবং আমাকে লিখা এক পত্রে তিনি তার বন্ধু অর্থনীতিবিদ ড. রেহমান সোবহানের সাথে সাক্ষাৎ করতে বলেন। কিন্তু আমি তার সাথে সাক্ষাৎ করিনি। কারণ, এই মহাপণ্ডিত অর্থনীতিবিদ, যিনি ভালোভাবে বাংলা ভাষাও বলতে পারেন না, বাংলার মানুষের সাথে যার সম্পর্ক অতি ক্ষীণ, ১৯৬৬ সালে যখন তার বয়স ত্রিশ বছরও পেরোয়নি, সেই অপরিণত বয়সে তিনি এবং তার কিছু সহযোগী আওয়ামী লীগকে ৬ দফা উপহার দিয়ে বলেন যে, দফাগুলো আদায় করতে পারলেই দেশ “সোনার বাংলা” হয়ে যাবে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ৬ দফা বাস্তবায়নে আর বাঁধা ছিল না, কিন্তু দেশ সোনার বাংলায় পরিণত হওয়া দূরে থাক, দারিদ্র আরো বিস্তার লাভ করায় ভূমিহীনের সংখ্যা আরো বেড়েছে। অতএব ৬ দফার অন্যতম এই তাত্ত্বিককে আমি পছন্দ করতে পারিনি। কথাটি আমি ম্যাক্সওয়েলকে বলেছিলাম তিনি যখন ১৯৮৯ সালের মে মাসে লন্ডন থেকে স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে এসেছিলেন নাইট ফেলোশিপ প্রোগ্রামের বার্ষিক ডিনারে যোগ দিতে। তার গ্রন্থ এবং জেনারেল বিএম কাউলের গ্রন্থ নিয়ে আমাদের আলোচনার সুযোগ হয় এবং তিনি আমাকে অক্সফোর্ডের প্রোগ্রামে আমন্ত্রণ জানান। কিন্তু অক্সফোর্ডের প্রোগ্রামের তহবিলদাতাও যেহেতু রয়টার্স, অতএব সেখানে আমার যাওয়া হয়নি।  

ডেভিড চিপ দীর্ঘদিন রয়টার্সের রিপোর্টার ছিলেন এবং ভারত বিভাগের উপর অনেক রিপোর্ট করেছেন। পরবতীতে তিনি এডিটোরিয়াল বিভাগে যোগ দেন। আমি রয়টার্সের ফেলো নির্বাচিত হলে ১৯৮৮ সালের জুলাই মাসে তিনি আমাকে অভিনন্দন জানিয়ে একটি চিঠি লিখেন রয়টার্স ফাউন্ডেশনের পরিচালক হিসেবে এবং তাতে ঢাকা ও বগুড়া সফর সম্পর্কে তার অভিজ্ঞতার বিবরণ দেন। পাকিস্তান স্বাধীন হবার কয়েক বছর পর ১৯৫৩ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তানে গিয়েছিলেন পাকিস্তানের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী বগুড়ার মোহাম্মদ আলীর আমন্ত্রণে। প্রধানমন্ত্রী তাকে বগুড়ার কি একটি ‘সুইট’ (সম্ভবত বগুড়ার দই) নিজ হাতে তুলে দিয়েছিলেন, তা তার স্মরণে আছে। তবে তার সফরকালের ‘Dacca’  সিটি কেন ‘Dhaka’ হলো তা তিনি মেনে নিতে পারেননি। এক বছর পর যখন ক্যালিফোর্নিয়ায় তার সাথে সাক্ষাৎ হলো তখনো তিনি প্রসঙ্গটি উল্লেখ করেছিলেন।  

ষ্ট্যানফোর্ডে সাংবাদিকতা বিভাগে জন এস নাইট ফেলোশিপ প্রোগামের সূচনা হয়েছিল রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রফেসর জন লাইলের হাতে। আমি যখন প্রোগ্রামে যোগ দেই তখন তিনি এমিরেটাস প্রফেসর এবং প্রোগ্রামের সঙ্গে তিনি ও তার স্ত্রী দু’জনই নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। যারা প্রোগ্রামে আসতেন তাদেরকে সন্তানতূল্য ভালোবাসা দিতেন দু’জনই এবং কার কী প্রয়োজন তা সরবরাহ করতেন। তাদের সান্নিধ্য আমাকে আপ্লুত করেছে। পরিচালক হিসেবে পেয়েছিলাম ১৯৭৫ ও ১৯৭৯ সালে সাংবাদিকতায় পুলিৎজার পুরস্কার বিজয়ী জেমস ভি রিসারকে। স্ট্যানফোর্ডে আমাদের প্রোগ্রামের ম্যানেজিং ডাইরেক্টর হ্যারি এন প্রেস স্যান ফ্রান্সিসকো ক্রনিকলে কাজ করার সময় স্ট্যানফোর্ডের জার্নালিজম ডিপার্টমেন্টে যোগ দেন এবং ১৯৮৯ সালে অবসর নেয়ার সময় পর্যন্ত দুই যুগ এই প্রোগ্রামের সাথে যুক্ত ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও বিশ্বের এমন কোনো স্থান নেই যেখানে তার পরিচিত সাংবাদিক ছিল না ২০১১ সালে পুলিৎজার পুরস্কারপ্রাপ্তদের তালিকাকে সমৃদ্ধ করেছে আমাদের আরেক ফেলো ডেনভার পোষ্টের এডিটোরিয়াল কার্টুনিষ্ট মাইকেল কিফি। টেক্সাসের জন হেনরি এসোসিয়েটেড প্রেস এর ওয়াশিংটন ব্যুরোতে নিউজ এডিটরের দায়িত্ব পালন করেছেন। বারবারা আয়ারল্যাণ্ড নিউইয়র্ক টাইমসের ট্রাভেল এণ্ড ফ্যাশন সেকশনের এডিটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করে অবসরে গেছেন।  এই সব বিশিষ্ট ব্যক্তির সাথে একসাথে কাটাবার সুযোগ পেয়েছি এবং এখনো যে তাদের অনেকে আমার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেন তা ভেবে আনন্দিত হই। দীর্ঘ তিন দশক অতিক্রান্ত হলেও মনে হয়, এই তো সেদিনের ব্যাপার। ২০১৩ সালে আমি ও আমার স্ত্রী স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পুনর্মিলনীতে যোগ দিতে গিয়ে সাবেক ডাইরেক্টর জেমস রিসার ও তার স্ত্রী স্যান্ডিকে ছাড়া আমার পাঁচজন সতীর্থকে পাই। দীর্ঘ ব্যবধানেও কারো মাঝে আন্তরিকতার ঘাটতি ছিল না।  

আপনার সাথে আমার সতীর্থ হাঙ্গেরিয়ান সাংবাদিক রিচার্ড হারশিলারে সাথে সাক্ষাৎ হওয়ার ঘটনা আমার জন্য আনন্দদায়ক। রিচার্ড আমার সবচেয়ে বয়োজ্যষ্ঠ সতীর্থ। বাণিজ্যিক ব্যাংকে তাঁর কর্মজীবন শুরু হলেও সাংবাদিকতা শুরু করেন ১৯৬৯ সালে একটি দৈনিক সংবাদপত্রে যোগদানের মধ্য দিয়ে। তিনি যখন স্ট্যানফোর্ডে আসেন তখন বুদাপেস্ট থেকে প্রকাশিত ‘হেতি ভিলাগগাজ দাসাগ’ (ওয়ার্ল্ড ইকনমিক উইকলি) নামে একটি ম্যাগাজিনের সম্পাদক ছিলেন। ১৯৭৯ থেকে তিনি ম্যাগাজিনটির সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করছিলেন। অত্যন্ত রসিক এবং সজ্জন লোক। তার সাথে আমার সম্পর্ক শুরু থেকেই আন্তরিকতাপূর্ণ ছিল। আমি যেহেতু গাড়ি চালাই না সেজন্য রিচার্ড বলতেন শপিং এর প্রয়োজন হলে জানিও আমার ওয়াইফ নিয়ে যাবে। তিনিও গাড়ি চালাতেন না। যেহেতু আমরা দু’জনই ক্যাম্পাসের হাউজিং এ ছিলাম, তার স্ত্রী কেনাকাটার জন্য বের হলে আমার অ্যাপার্টমেন্টের সামনে এসে হর্ন বাজাতেন, আমি অথবা আমার স্ত্রী তার সাথে যেতাম। পুরো সময়টাই এভাবে কাটে। সর্বশেষ তিনি এইচভিজি অনলাইন নিউজ পোর্টালের চিফ এডিটর ছিলেন। গত বছর অবসর নিয়েছেন। গতবছর (২০১৯) মার্চ মাসে তার হার্ট সার্জারি হয়েছে। তার স্ত্রী কাটালিনা, যিনি আমাদের কেনাকাটায় রাইড দিতেন ১০ বছর আগে তার সাথে ছাড়াছাড়ি হয়েছে। কাটালিনা এবং তার মেয়ে পেট্টা যুক্তরাষ্ট্রেই অবস্থান করছেন। 

 

জহিরুলঃ একসঙ্গে ভ্রমণ করলে, এক ছাদের নিচে রাত কাটালে পরস্পরকে চেনা যায়, জানা যায় অনেক বেশি। আপনি বাংলাদেশের অনেক বিখ্যাত মানুষের সাথে দেশে-বিদেশে ভ্রমণ করেছেন, যেমন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্ণর আতিউর রহমান, কবি সৈয়দ শামসুল হক প্রমূখ। মানুষ হিসেবে কেমন দেখেছেন সেইসব বিখ্যাত মানুষকে?

 

মঞ্জুঃ আপনি ঠিকই বলেছেন, কোনো মানুষের সাথে নিবিড়ভাবে মিশলেই তার সম্পর্কে সঠিক ধারণা করা সম্ভব হয়। শুধু ভ্রমণ বা একত্রে রাত কাটানো নয় ছাত্রজীবনে সহপাঠি ও শিক্ষক, কর্মজীবনে সহকর্মীদের চেনা যায় ঘনিষ্টভাবে মেলামেশা  ও চলাফেরার মধ্য দিয়েই। দেশে ও বিদেশে খ্যাত ও অখ্যাত অনেক ব্যক্তির সাথে ঘনিষ্টভাবে মেশার এবং এক ছাদের নিচে, কখনো বা একই কক্ষে রাত্রিযাপনের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে তাদের সম্পর্কে সাধারণভাবে জানার চেয়েও বেশি জানতে পেরেছি। আমার বিদেশে অবস্থানকালীন দুটি ঘটনার কথা বলি। ১৯৮৮ সালের সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রে আসার পর আমার থাকার স্থায়ী জায়গা ঠিক হওয়ার আগে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছাত্রাবাস উইলবার হলে আমাকে দিন দশেক থাকতে হয়েছিল। আমার সাথে একই রুমে ছিল আমার সতীর্থ নাইজিরিয়ার ওলাতুনজি লার্ডনার। তিনদিন পর সে তার বরাদ্দকৃত জায়গায় চলে গেলে রুমে এলো সামান নামে শ্রীলঙ্কার এক ছেলে। আমেরিকার অন্য এক ইউনিভার্সিটিতে আণ্ডারগ্র্যাড শেষ করে স্ট্যানফোর্ডে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে গ্রাজুয়েট কোর্স করতে এসেছে। ভাবলাম ভালোই হলো, কাছাকাছি দেশের ছেলে। বছর চারেক যাবত সে আমেরিকায়। আচার আচরণে আমেরিকান প্রভাব সুস্পষ্ট। একদিন সে গোসল করে রুমে ফিরেই কোমরে প্যাচানো টাওয়েল খুলে আমার সামনেই ন্যাংটা হয়ে সর্বাঙ্গে ক্রিম মাখতে লাগলো। বয়সে অন্তত বছর দশেক বড় হওয়ায় উপমহাদেশীয় রীতি অনুযায়ী ওর কাছে যে সমীহ আমার প্রাপ্য ছিল সে এভাবেই তা শোধ করলো। এটা ওভারলুক করলেই হয়তো আমার গ্লানিবোধ হতো না। এর আগে বার্লিনে থাকাকালে এ ধরনের বিষয়গুলোকে আমল দেইনি। গ্রুপের মধ্যে আমার সবচেয়ে ঘনিষ্ট ছিল ঘানা স্কুল অফ জার্নালিজমের শিক্ষক কুজো অ্যান্টনি বাতসি। আমার বয়সী। একই ফ্লোরের দুই প্রান্তে আমাদের রুম। ঘুমানোর সময়টুকু ছাড়া আমরা দু’জন একসাথেই কাটাতাম। বাতসি গোসল করে এসে আমার সামনেই উদোম হয়ে শরীর মুছতো। কী একটা তেল মেখে মিশমিশে কালো রঙ আরও চিকচিকে করে তুলতো। আমি যে ওর সামনেই বসা তাতে সে কিছুমাত্র সংকোচ বোধ করতো না। তেল মাখতে মাখতে আমার সাথে কথা বলতো। অথচ গ্রুপের মধ্যে একমাত্র সে অন্য কালো সতীর্থদের মতো বারে গিয়ে বা রুমে মদ পান করতো না। কেনিয়ার গ্রে ফোম্বে বা জাম্বিয়ার রিচার্ড থিউ এর মতো জার্মান মেয়েদের পটিয়ে রুমে আনতো না। ফোম্বে আমাদের দু’জনকে বলতো “ইয়োগী এণ্ড ভেজিটারিয়ান।” কুজো বাতসি নিয়মিত জিসাসের নামে প্রার্থনা করতো। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সেই তরুণের আচরণ আমার কাছে অশিষ্ট মনে হয়েছে। আপনি দু’জন খ্যাতিমান ব্যক্তির নাম উল্লেখ করেছেন তাদের একজন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমানের সাথে দিল্লির দুটি হোটেলে একই রুমে পাঁচদিন কাটানো, একসাথে চলাফেরার অভিজ্ঞতা হয়েছে। একটি ওয়ার্কশপে বাংলাদেশ থেকে আমরা দু’জনই প্রতিনিধিত্ব করেছি। আমি তাকে চিনলেও ঢাকায় কখনো তার সাথে কথা হয়নি। ২০০২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ এবং রমজান মাস। আমি রোজা ছিলাম। যাওয়ার সময় ঢাকা এয়ারপোর্টেই ড. আতিউরকে দেখেছি। আমি জানতাম না যে তিনিও দিল্লিতে একই প্রোগ্রামে যাচ্ছেন। বিমানে উঠে তাকে দেখলাম। কলকাতা এয়ারপোর্টে ইন্টারন্যাশনাল এরাইভ্যাল থেকে একই জিপে উঠে ডমেস্টিক ডেপারচার লাউঞ্জে গেলাম। একই বিমানে দিল্লিতে গেলাম। তবুও কথা হয়নি। দিল্লি যেহেতু আমার পরিচিত শহর, এয়ারপোর্ট থেকে ট্যাক্সি নিয়ে সোজা আনন্দনগরে নির্ধরিত হোটেলে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে, খেয়ে শুয়ে পড়েছি। ঘন্টাখানেক পর দরজায় টোকা পড়লো। খুলে দেখি ড. আতিউর। দু’জনই অবাক হলাম। ঢাকা থেকে একসাথে আসার পর তখনই বোঝা গেল আমরা একই প্রোগ্রামে এসেছি। বেশ রাত হয়ে গিয়েছিল। রাতে আর কথা হয়নি। সেহরির জন্য আমি সামান্য খাবার রুমে এনে রেখেছিলাম, খেয়ে শুয়ে পড়লাম। সকালে উঠে উনি নাশতা সেরে এলেন। ড. আতিউর বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার এক বছরের সিনিয়র। তার সাবজেক্ট অর্থনীতি, আমার রাষ্ট্রবিজ্ঞান। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের কখনো দেখা হয়নি। পরিবেশ বিষয়ক একটি সংগঠন ছিল তার, সেই সুবাদে নাম জানতাম। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে ড. আতিউরকে জনতা অথবা অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান করেছিল। তখন তার পরিচিতি আরো বাড়ে। বিএনপি এসে তাকে সরিয়ে অন্য কাউকে চেয়ারম্যান করেছে। রাতেই তিনি বলেছিলেন যে বিএনপি তাকেই চেয়ারম্যান রাখতে পারতো। তিনি চলবেন সরকারের নীতি অনুযায়ী। আমি বলি আপনি আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ট না হলে তারা আপনাকে চেয়ারম্যান করতো না। আপনি কী করে আশা করতে পারেন যে বিএনপি আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক নিয়োগ মেনে নেবে।

ওয়ার্কশপের আয়োজক প্রতিষ্ঠান ভারতের প্রখ্যাত পরিবেশবিদ অনীল আগরওয়ালের প্রতিষ্ঠিত সেন্টার ফর সায়েন্স এণ্ড এনভায়রনমেন্ট বা সিএসই।  দীর্ঘদিন ক্যান্সারের সাথে লড়ে যখন আমাদের ওয়ার্কশপ হচ্ছিল তার এক মাস আগে মাত্র ৫৪ বছর বয়সে তিনি মারা গেছেন। ১৯৯৯ সালেও সিএসই’র এক কর্মসূচিতে দিল্লি গিয়ে তাঁর ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার কথা শুনেছি। ব্যতিক্রমী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন অনীল আগরওয়াল। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিগ্রি নিলেও পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন সাংবাদিকতা। হিন্দুস্থান টাইমসের সায়েন্স রিপোর্টার হিসেবে কাজ করার সময় পরিবেশ আন্দোলনে ঝুঁকে পড়েন এবং প্রতিষ্ঠা করেন সিএসই। তাঁর পরিবেশ বিষয়ক লেখা প্রধানমন্ত্রী রাজিব গান্ধীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং তিনি তাকে আমন্ত্রণ জানান তার মন্ত্রীসভায় বক্তব্য  দেয়ার জন্য, যা এক নজীরবিহীন ঘটনা। অনীল আগরওয়াল তার অবদানের জন্য ভারতের রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পদ্মভূষণ ও পদ্ম বিভূষণে ভূষিত হয়েছিলেন। তার মৃত্যুতে সিএসই’র পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন তূখোড় নারী পরিবেশবিদ সুনীতা নারায়ণ। ওয়ার্কশপের স্থান হ্যাবিট্যাট সেন্টার। আমাদেরকে বলা হয়েছিল নিজেদের টাকায় টিকেট করে যেতে, যা দিল্লিতে গেলেই রিমবার্স করা হবে। এটা নতুন কিছু নয়, এর আগেও তা করেছি। অনুষ্ঠানস্থলে যাওয়ার পরই সবাইকে ফরম দেয়া হলো তা পূরণ করে এয়ারটিকেটের সাথে জমা দিতে। টিকেটের দাম ডলারের হিসেবে ২৪ হাজার রুপির কিছু বেশি, তার সাথে দিল্লি এয়ারপোর্ট থেকে হোটেল পর্যন্ত ট্যাক্সি ভাড়া ১২০ রুপি। 

ড. আতিউর এগিয়ে এসে আমার ফরম দেখতে চাইলেন। দেখে বললেন, এতো কম কেন? উনার ফরম দেখালেন, ২৮ হাজার রুপির বেশি। আমি বললাম টিকেটের দাম তো একই, আপনার এমাউন্ট এতো বেশি কেন? উনি বললেন, আপনি তো দেখছি ঢাকায় এয়ারপোর্টে আসা, ফেরার সময় এয়ারপোর্ট থেকে বাসায় যাওয়া, হোটেল থেকে আবার যে এয়ারপোর্টে যাবেন সেই ট্যাক্সি ভাড়াও লিখেননি। ফরম পাল্টে আরেকটা নিন। 

বাসা থেকে আমার এয়ারপোর্টে আসা আরেক কাহিনি। হাসি চাপলাম। ফ্লাইটের সময় ছিল ইফতারের কাছাকাছি সময়ে। এয়ারপোর্টের কাছেই বনানীতে থাকি। তবুও তো ঘন্টা দেড়েক আগে পৌঁছানো প্রয়োজন। ইফতারের আগে ঢাকায় যানজট স্বাভাবিক সময়ের যানজটের চেয়েও বেড়ে যায়। রফিককে গাড়ি নিয়ে আসতে বলেছিলাম, সে জানালো পল্টনে আটকা পড়ে আছে। আমার ছেলে সাদকে বললাম ক্যাব, স্কুটার যা্ পায় নিয়ে আসতে। সে যে কাকলি মোড়ে গেছে, আর ফিরে আসে না। আমার উৎকণ্ঠা বাড়ছে। আধা ঘন্টা পর  সে নিয়ে এলো একটা মিশুক, আর কোনকিছু পায়নি। ভাবার সময় ছিল না। মিশুক চালাচ্ছে এক বাচ্চা ছেলে। বললো রাস্তায় ক্যাব বা স্কুটার পেলে আমাকে উঠিয়ে দেবে। কিছুই পাওয়া যায়নি। সে বললো, স্যার, চিন্তা কইরেন না, ফার্স্ট গিয়ারে এমুন টান দিমু, ওপরে উইঠা যাইবো। এয়ারপোর্টের প্রবেশ পথে সিকিউরিটি আটকালো। কিছুতেই মিশুক যেতে দেবে না। তাদেরেকে অন্য যান না পাওয়ার কাহিনি, ফ্লাইটের সময় ঘনিয়ে আসার কথা বলি। তাদের দিল নরম হয়। মিশুক চালক ফাষ্ট গিয়ারে দিয়ে টান দেয়, খুব এগুতে পারে না। ভয় হচ্ছিল পেছনে ছুটতে শুরু করবে কিনা। শেষ পর্যন্ত সে ওঠতে সক্ষম হয়। ওর ভাড়া ছিল ষাট টাকা, আমি ওকে একশ টাকা দেই। এই টাকাও আামাকে যোগ করতে হবে। আমার চেয়ে তার তিন হাজার রুপি বেশি হওয়ার কারণ ঢাকা ও দিল্লির ট্যাক্সি ভাড়া বাড়িয়ে লেখা। আমি প্রকৃত ভাড়া যোগ করতে পারতাম, কিছুতেই বাড়িয়ে লিখতাম না। দিল্লিতে তিন হাজার রুপি অনেক রুপি। আমি তার পরামর্শ না শুনে ২৪ হাজার প্লাস রুপি নিলাম। তিনি ২৮ হাজার প্লাস নিলেন। 

আশির দশকের শেষ দিকে তথ্য সচিব ছিলেন আবদুস সোবহান। অত্যন্ত সজ্জন ও সৎ মানুষ হিসেবে তার খ্যাতি ছিল। তিনি যখন ডেপুটি সেক্রেটারী ছিলেন তখন প্রায়ই সচিবালয়ে তার অফিসে যেতাম। তার অফিসের হেড করণিক রেজাউল করীম আমাদের বিজ্ঞাপন বিভাগে রাতের বেলায় পার্টটাইম কাজ করতেন। যিনিই ওই সেকশনে ডেপুটি সেক্রেটারী হিসেবে যান, রেজাউল করীম তার ট্যুরের  টিএ/ডিএ বিল তৈরি করে ডেপুটি সেক্রেটারীর স্বাক্ষর নেন। সোবহান সাহেব ওই সেকশনে বদলি হয়ে আসার পর রাজশাহী রেডিও ষ্টেশনে ট্যুরে গেছেন। রেজাউল করীম টিএ/ডিএ বিল করে স্বাক্ষর নিতে এসেছেন। উনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেন এবং বলেন, রাজশাহী যাওয়ার সময় আমি আমার এক বন্ধুর গাড়িতে গেছি, আরিচা থেকে ফেরিতে পার হওয়ার সময় লাঞ্চ করিয়েছে আমার বন্ধু। রাজশাহীতে রেডিও অফিস খাওয়ার ব্যবস্থা করেছে। বন্ধুর বাড়িতে ছিলাম। হোটেল ভাড়া লাগেনি। আপনি নতুন করে লিখে আনুন শুধু রাজশাহী থেকে ঢাকায় ফেরার ভাড়া। ফেরার পথে খাওয়ার খরচও লেখার প্রয়োজন নেই। বাড়িতে থাকলেও তো আমাকে নিজের খরচেই খেতে হতো। সোবহান সাহেবে সাথে ড. আতিউরকে মেলানোর চেষ্টা করি।

তিনদিনের ওয়ার্কশপ শেষে আমি আরো কয়েকদিন দিল্লিতে থাকবো। তিনিও দু’দিন থাকার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। আমার সাথে দিল্লি ঘুরে দেখতে চান। সিএসসি’র দেয়া হোটেলে থাকা যাবে না। অনেক ভাড়া। আমি সাধারণত সিআর পার্কের এক রেস্ট হাউজে থাকি। দিল্লির প্রধান বাঙালি এলাকা এবং অধিকাংশই তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান থেকে শরণার্থী হিসেবে যাওয়া প্রায় তিন হাজার বাঙালি পরিবারকে প্লট বরাদ্দ দেয়া হয় ষাটের দশকে, যার নাম ছিল “ইস্ট ডিসপ্লেসড পারসনস কলোনি” বা ইপিডিপি কলোনি। আশির দশকে জায়গাটির নামকরণ করা হয় দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস কলোনি। ওয়ার্কশপ  শেষ হওয়ার পর রেষ্ট হাউজে উঠি। হোটেলের মতো নয়। বাড়ির মতো পরিবেশ। জনৈক নাগ বাবু এই রেস্ট হাউজ চালান। তার কর্মচারি সবাই বাঙালি। আমরা যা খেতে চাই তারা তেমন রান্না করে দেয়। আমরা আগে যখন গেছি তখন মাছ সব্জি কিনে এনে দিলেও তারা রান্না করে দিয়েছে। ড. আতিউরকে নিয়ে কাঁচা বাজারে যাই। বড় সাইজের পাবদা মাছ কিনি। ছোটু, গোপাল রান্না করে দেয়। ইফতারের প তৃপ্তি সহকারে খাই। পরদিন কোথায় ঘুরতে চান জেনে ওদেরকে বলি পরদিন সারাদিনের জন্য একটি ট্যাক্সি ঠিক করে রাখতে। আমি তাকে কুতুব মিনার, চাঁদনি চক, হুমায়ুনের মাজার ঘুরিয়ে দিল্লি হাটে নিয়ে যাই। এখানে ভারতের সব রাজ্যের হস্তশিল্পজাত পন্যের অনেক দোকান, খোলামেলা বিশাল জায়গা। ড. আতিউরের ভালো লাগে। তিনি কিছু কেনাকাটা করতে চান। তাকে সেন্ট্রাল মার্কেটে নিয়ে যাই, তিনি কিছু কেনাকাটা করেন। পরদিন তিনি চলে যাবেন। আমি আরও ক’দিন থাকবো। চলে যাবার আগে তিনি শুধু রেস্ট হাউজের ভাড়াটিই শেয়ার করেন অন্য কোনো খরচ দেননি। আমি অবাক হই। কিছু বলতে পারি না। সাধারণত আমরা বাইরে ট্যুরে গেলে একজনই খরচ করে। পরে মোট খরচ সমান ভাগ করে প্রত্যেকে দিয়ে দেয়। ড. আতিউর তাতে রাজি হননি। যাহোক, তিনি পরদিন চলে আসেন। আমি আরও দু’দিন থাকি।

সৈয়দ শামসুল হক বাংলাদেশের সেরা লেখকদের একজন বলে বিবেচিত। কোনো ক্ষেত্রে কেউ সেরা হলে মানুষ হিসেবে সেরা হবেন এমন গ্যারান্টি নেই। তার কিছু গল্প-কবিতা পড়া থাকলে প্রথম পুরো একটি বই পড়ি তার উপন্যাস ‘খেলারাম খেলে যা’। এটা পড়ে সৈয়দ শামসুল হককে উপন্যাসের মূল চরিত্র বাবর বলে মনে হয়েছে, যে বাবরকে দিয়ে তিনি রাতের বেলায় রেস্টহাউজে তার পিরিয়ড চলা ভ্রমণসঙ্গিনীকে প্যাড খোলার জন্য টানাটানি করেছেন। আমি এর চেয়েও রগরগে বর্ণনার অনেক উপন্যাস পড়েছি এবং অনুবাদ করেছি। কিন্তু সৈয়দ হকের বাবরের কথা ভুলিনি। বাবর ও সৈয়দ হককে এক করে ভেবেছি। ঢাকায় ‘আলুর দোষ’ বলে একটি কথা প্রচলিত আছে। অনেকে বলতেন সৈয়দ হকের আলুর দোষ ছিল। এমনকি তার পুত্রবধুকে আদর করতে গিয়ে ঠোঁটে চুম্বন করেছিলেন এমন কথাও শুনেছি। এসবের সত্য মিথ্যা যাচাই করার উপায় নেই। তবে শুরু থেকে তার ব্যাপারে একটা নেতিবাচক মনোভাব ছিল আমার, যা প্রায় সত্য হয়েছে তসলিমা নাসরিনের লেখায়, তার পিঠে হাত বুলানোর সময় ব্রা’র ফিতা অনুভব করার চেষ্টাসহ সৈয়দ হকের অবাঞ্চিত আচরণের বর্ণনা দিয়েছেন তসলিমা। অবশ্য সৈয়দ হক এর প্রতিবাদ করেছিলেন। যাহোক, ১৯৯৭ সালের অক্টোবরে সেনাবাহিনীর একটি আমন্ত্রণ পেলাম সাত দিনের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম সফরের জন্য। নির্ধারিত দিনে এয়ারপোর্টে গেলাম। সেখানে অভ্যর্থনা জানালেন সম্ভবত মেজর হামিদ নামে একজন অফিসার। দেখা গেল আমার সফরসঙ্গীরাও এয়ারপোর্টে উপস্থিত: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক মনিরুজ্জামান মিয়া, ঢাক বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ডিন অধ্যাপক এরশাদুল বারী, নিউ নেশন সম্পাদক আলমগীর মহীউদ্দিন, সৈয়দ শামসুল হক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। বিমানে উঠার পর দেখা গেল প্রথম সারিতে চট্টগ্রামের মেয়র এবিএম মহীউদ্দিন চৌধুরী। আমাদের মধ্যে সৈয়দ শামসুল হক তার পরিচিত এবং তিনি দুই হাত যুক্ত করে জয় বাংলা বলে মেয়র সাহেবকে শুভেচ্ছা জানালেন। মেয়রও জয় বাংলা উচ্চারণ করলেন। সালামের পরিবর্তে জয় বাংলা কেন! পাশ্ববর্তী দেশে ইউনিফরমড বাহিনীগুলোতে শুভেচ্ছা জানাতে জয় হিন্দ ব্যবহৃত হলেও সাধারণভাবে নমস্কার, আদাব এবং দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে ‘মানক্কম’ প্রচলিত। চট্টগ্রাম পৌছার পর হেলিকপ্টারে তুলে নেয়া হলো চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে। সেখানে ব্রিফিং ও লাঞ্চ শেষে হেলিকপ্টারে নেয়া হলো খাগড়াছড়িতে। সেখানেও আরেক দফা ব্রিফিং দেয়া হলো, শান্তি চুক্তির পর পাহাড়ে কী অবস্থা বিরাজ করছে তার ওপর। বিপদের মধ্যে থাকলে সবাই ধর্মের আশ্রয় নেয়। সশস্ত্র বাহিনীতে এমনিতে ধর্মচর্চার ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে যারা নিয়োজিত স্বাভাবিক কারণেই তারা ধর্মানুরাগী। যারা ব্রিফিং দিচ্ছিলেন তাদের মুখে আল্লাহ রাসুলের কথা শুনে সৈয়দ হকের যে ভালো লাগছিল না, তার মন্তব্যে তা বোঝা যাচ্ছিল। তার প্রশ্নে খোঁচার সুর ছিল। পরদিন সকালে আমাদেরকে একটি দুর্গম জায়গায় বেশ উঁচু এক টিলায় স্থাপিত ছানিতে নেয়া হলো। হেলিকপ্টার ছাড়া সেখানে যাওয়া কঠিন। সেখানে সৈনিক ও অফিসার মিলে প্রায় পঞ্চাশ জন। একজন ক্যাপ্টেন বলছিলেন বাজার করে আনতে হয় ৫ মাইল দূরের বাজার থেকে। পাহাড়ি পথে পাঁচ মাইল মানে পনের মাইল। তার ওপর কোথায় বিপদ লুকিয়ে আছে কেউ জানে না। সপ্তাহে একদিন দশ জনের একটি দল সকল প্রস্তুতি নিয়ে বাজারে যান, সব্জি, মাছ মাংস যা পান কিনে আনেন। পানি আনতে হয় ঢালু বেয়ে প্রায় আধ মাইল দূরের ঝরনা থেকে। সহজে যাওয়া যায়, কিন্তু পানিভর্তি জ্যারিক্যান নিয়ে ওঠতে পঞ্চাশ-ষাট গজ পর থেমে দম নিতে হয়, পানি পান করতে হয়। এভাবে জেরিক্যানের অর্ধেক খালি হয়ে যায়। তার ওপর আছে মশার যন্ত্রণা। পার্বত্য চট্টগ্রামে এক প্রজাতির মশা আছে, কামড়ালে একেবারে সেরিব্রাল ম্যালেরিয়া। বেশ কয়েকজন রোগীকে হেলিকপ্টারে চট্টগ্রাম সিএমএইচে পাঠিয়েও রক্ষা করা যায়নি। খোলা জায়গাগুলোতে তারা এক ধরনের তেল মালিশ করেন। এক পাশে একটি ছনে ছাওয়া ঘর। সৈয়দ হক জানতে চাইলেন ওখানে কি হয়? এক সৈনিক বললেন, “স্যার, ওটা মসজিদ।” তাঁর গায়ে যেন বিছুটির ছোঁয়া লেগেছে। বিস্মিত হয়ে বললেন, “এখানেও মসজিদ?” সৈনিক উত্তর দিলেন,“ডিউটি, ঘুম ও ভলিবল খেলার সময়ের বাইরে সৈনিকরা মসজিদেই বেশি সময় কাটায়। আল্লাহর ওপর ভরসা করেই আমরা এখানে আছি।” সৈয়দ হকের একটু পেছনে আমি এবং এরশাদুল বারী। তিনি আমাকে খোঁচা দেন। নিচু কণ্ঠে বলেন, প্রশ্ন করার ধরন ও উদ্দেশ্য খেয়াল করুন। আমি খেয়াল করি। সৈনিককে সৈয়দ হকের প্রশ্ন, “সবাই নামাজ পড়ে?” সৈনিকের উত্তর,“জি স্যার, প্রায় সবাই নামাজ পড়েন”। সৈয়দ হক, “নামাজ পড়ানোর জন্য ইমাম আছে?” সৈনিক, “নির্ধরিত কোনো ইমাম নেই স্যার। আমাদের মধ্য থেকেই কেউ না কেউ ইমামতি করেন। সবাই মুসলমানের ছেলে, কমবেশি সবাই কোরআন পড়তে পারে। কেউ কেউ ভালো পারেন। দু’একজন আছেন, যারা সেনাবাহিনীর বার্ষিক কিরাত, আজান, হামদ-নাত প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন। আমরা তাদেরকেই ইমামতির দায়িত্ব দেই। তারা ডিউটিতে থাকলে আমরা উপস্থিভাবে ইমাম ঠিক করে নেই।” সৈনিক আরও বলেন, “এখানে আমরা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের আজানও দেই। তাতে কাছাকাছি যেসব বাঙালি বসবাস করেন তাদের মনোবল বাড়ে।” সৈয়দ হক হতাশ হন। সৈনিক স্যালিউট দিয়ে চলে যান। সৈয়দ হক অন্যদিকে মনোযোগ দিলে এরশাদুল বারী আমাকে বলেন, “সৈয়দ শামসুল হকের মতো লোকেরা যে কী চায় তারা নিজেরাও তা জানে না। ব্যাটা তুই নামাজ না পড়িস, ঠিক আছে। আরেকজন পড়লে তোর কষ্ট লাগবে কেন। আমরা যে এখানে এসেছি কেউ তো নামাজ পড়ছি না। সৈনিকটি যখন নামাজ পড়ার কথা বলছিল তখন তো লজ্জা পাচ্ছিলাম যে আমার ছেলের বয়সী একটা ছেলে নামাজ পড়ছে, আমি পড়ছি না”

 

জহিরুলঃ আপনার সাংবাদিকতা জীবনে অগ্রজ হিসেবে যাদেরকে পেয়েছেন তাদের মধ্যে এমন কেউ কি আছেন যাদেরকে আদর্শ হিসেবে অনুসরণ করেছেন? বাংলাদেশের এবং বিশ্বের আদর্শ দু/চারজন সাংবাদিকের কথা বলেন যাদের এথিক্স, কর্মকৌশল, দক্ষতা অন্যদের জন্য অনুকরণীয়।


 মঞ্জুঃ সাংবাদিকতায় অগ্রজ হিসেবে পেয়েছি অনেককে। অনেকের কাছে সাংবাদিকতার কলাকৌশলও শিখেছি। অনেক সাংবাদিকের লেখার ধরন অনুসরণের চেষ্টা করেছি। কিন্তু আদর্শ হিসেবে কাউকে গ্রহণ করিনি। কারও মাঝে যদি ন্যূনতম যোগ্যতা না থাকে, প্রয়োজনীয় পড়াশোনা না থাকে, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিবেশ-পরিস্থিতি মাথায় না থাকে, ধারণাশক্তি না থাকে, সব শ্রেনির মানুষের সাথে মেলামেশার স্বত:স্ফূর্ততা বা উদারতা না থাকে অথবা রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট হয় তাহলে সাংবাদিকতার মতো সৃজনশীল একটি পেশায় তার বা তাদের আসা উচিত নয়। বাংলাদেশে কোনো সাংবাদিককে যদি অনুসরণ করতে হয় তাহলে একসময়ে তুখোড় রিপোর্টার, দৈনিক মানবজমিন সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীকে অনুসরণ করতে পারেন। এথিক্সের দিক থেকে হয়তো তাকেও অনেক সময় আপোষ করতে হয়েছে, তবুও কর্মকৌশল ও দক্ষতার দিক থেকে বাংলাদেশের নবীন সাংবাদিকদের পরামর্শ দেব, তাকে অনুসরণ করতে। 

এ প্রসঙ্গে আমি একটা কথা বলে রাখি, যা ইতিপূর্বে কখনো প্রকাশ করিনি, তা হলো ১৯৯৮ সালে আমি এশিয়ার নোবেল খ্যাত ফিলিপাইনের ‘র‍্যামন ম্যাগসেসে’ পুরস্কার কমিটির নমিনেটর ছিলাম এবং মতিউর রহমান চৌধুরীকে নমিনেট করেছিলাম। কিন্তু আমার বা মতিউর রহমান চৌধুরীর জানা ছিল না যে এসব পুরস্কারের জন্য নমিনেট করাই আসল কথা নয়, বেশ তদবিরও করতে হয়। আমার নমিনেশন কাজে না লাগলেও তাকে নমিনেট করে আমি পরিতৃপ্তি লাভ করেছি। 

বিদেশি সাংবাদিকদের মধ্যে আমার সাথে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব আমেরিকান সাংবাদিক ছিলেন তাদের একজন ফিলাডেলফিয়া এনকোয়ারারের রিপোর্টার  জন ওয়েস্টেনডিক, সকল বিচারে একজন আদর্শ রিপোর্টার। ১৯৮৮ সালে তিনি পুলিৎজার পুরস্কার লাভ করেন ভুল বিচারে সাজা ভোগকারী এক বন্দীর ওপর রিপোর্ট করে তাকে কারামুক্ত করায় ভূমিকা রাখার কারণে। পরে তিনি বাল্টিমোর সান এ যোগ দেন। ২০১০ সালে সাংবাদিকতা থেকে অবসর নিয়ে কুকুরের ওপর অমানবিক আচরণে বিরুদ্ধে ক্যাম্পেইন শুরু করেন, এর ওপর বই লিখেন। এ বছরের (২০২০) মে মাসে তিনি মারা গেছেন। ভারতের বিশিষ্ট সাংবাদিক এম জে আকবর যদিও রাজনীতিতে যোগ দিয়ে এবং দল বদল করে বিতর্কিত হয়েছেন, তবুও তার সাংবাদিকতার দিকটি এখনো অনুসরণযোগ্য। 

 

 

Comments

Popular posts from this blog

শিল্পী কাজী রকিবের সাক্ষাৎকার

নন-একাডেমিক শিল্পীরাই নতুন কিছু দেয় -    কাজী রকিব  [কাজী রকিব বাংলাদেশের একজন গুণী শিল্পী। রাজশাহী আর্ট কলেজের একজন প্রতিষ্ঠাতা-শিক্ষক। কলেজের প্রথম ক্লাসটি নেবার কৃতিত্বও তাঁর। নিরন্তর ছবি আঁকেন। নানান মাধ্যমে ,  নানান ভাবনার ছবি। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে সস্ত্রীক বসবাস। তার স্ত্রী মাসুদা কাজীও একজন গুণী শিল্পী। বৈচিত্রপ্রিয় এই শিল্পীর একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন কবি কাজী জহিরুল ইসলাম। ধারাবাহিকভাবে তা এখানে প্রকাশ করা হবে। আজ উপস্থাপন করা হলো প্রথম পর্ব।]   জহিরুলঃ  বেশিরভাগ শিল্পীই নিজের একটা স্টাইল তৈরি করেন ,  নিজস্বতা যাকে আমরা বলি। আবার কেউ কেউ একই ধরণের ছবি বারবার আঁকেন। আপনার কাজে বৈচিত্র খুব বেশি ,  এতে করে "টাইপড" অপবাদ থেকে আপনি মুক্ত কিন্তু নিজের একটি স্টাইল তৈরি করতে না পারা বা তৈরি হয়নি বলে কি আক্ষেপ হয় ,  নাকি এই যে ভার্সেটিলিটি এটাই আপনি বেশি উপভোগ করেন ?    রকিবঃ   আমি আসলে আলাদা করে ভাবিনি এই স্টাইল বিষয়ে। কারো মতো আঁকারও চেষ্টা করিনি তেমন ভাবে। অল্প বয়সে ,  আমার ১৯ / ২০ বছর বয়সে ,  সালভাদর দালির মতো আঁকতে চেষ্টা করেছিলাম কিছুদিন ।

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জুর সাক্ষাৎকার - তৃতীয় পর্ব

মঞ্জু আমার ওপর রাগ করেছে                                                           - আল মাহমুদ [লেখক, সাংবাদিক, অনুবাদক আনোয়ার হোসেইন মঞ্জুর সাক্ষাৎকারের  তৃতীয় পর্ব আজ প্রকাশ করা হলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কবি কাজী জহিরুল ইসলাম।]  সাক্ষাৎকার নেবার এক পর্যায়ে আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু  ও কাজী জহিরুল ইসলাম। ওয়ান্টাগ পার্ক, নিউ ইয়র্ক।  ছবি তুলেছেন ড. মাহবুব হাসান।   জহিরুলঃ  খুশবন্ত সিং তার সকল বই অনুবাদ করার লিখিত অনুমতি দিলেন আপনাকে এবং সেই অনুমতিপত্রটি তিনি নিজ হাতে আপনার সামনেই বাংলায় লিখে দিলেন। তিনি কিভাবে বাংলা শিখলেন তা কি জানতে পেরেছিলেন ?  মঞ্জুঃ    জ্বি ,  ঘটনাটি  ঘটে  ১৯৯২ সালের ডিসেম্বর মাসে ,  এ সম্পর্কে আমি আগের এক প্রশ্নে বলেছি। তারিখটি আমার স্মরণে নেই। তবে বাবরি মসজিদ ধ্বংস করার পর ,  ডিসেম্বরের শেষ দিকে। না ,  বাংলায় নয় ,  উনি ইংরেজিতে লিখেছেন। আমার কফি পানের সময়ের মধ্যেই লিখে দিয়েছেন। ১৯৮৪ থেকে মাঝে দীর্ঘ বিরতি দিয়ে আমাকে তিনটি বা চারটি চিঠি লিখেছেন। লিখেছেন বলতে আমার চিঠির উত্তর দিয়েছেন। প্রতিটি চিঠি ইংরেজিতেই লিখেছেন। প্রতিটি চিঠিতে আমাকে সম্বোধন করেছেন  “ আনোয়ার ভাই ,”  বলে।