মঞ্জু আমার ওপর রাগ করেছে
- আল মাহমুদ
[লেখক, সাংবাদিক, অনুবাদক আনোয়ার হোসেইন মঞ্জুর সাক্ষাৎকারের তৃতীয় পর্ব আজ প্রকাশ করা হলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কবি কাজী জহিরুল ইসলাম।]
সাক্ষাৎকার নেবার এক পর্যায়ে আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু
ও কাজী জহিরুল ইসলাম।ওয়ান্টাগ পার্ক, নিউ ইয়র্ক।
ছবি তুলেছেন ড. মাহবুব হাসান।
জহিরুলঃ খুশবন্ত সিং তার সকল বই অনুবাদ করার লিখিত অনুমতি দিলেন আপনাকে এবং সেই অনুমতিপত্রটি তিনি নিজ হাতে আপনার সামনেই বাংলায় লিখে দিলেন। তিনি কিভাবে বাংলা শিখলেন তা কি জানতে পেরেছিলেন?
মঞ্জুঃ জ্বি, ঘটনাটি ঘটে ১৯৯২ সালের ডিসেম্বর মাসে, এ সম্পর্কে আমি আগের এক প্রশ্নে বলেছি। তারিখটি আমার স্মরণে নেই। তবে বাবরি মসজিদ ধ্বংস করার পর, ডিসেম্বরের শেষ দিকে। না, বাংলায় নয়, উনি ইংরেজিতে লিখেছেন। আমার কফি পানের সময়ের মধ্যেই লিখে দিয়েছেন। ১৯৮৪ থেকে মাঝে দীর্ঘ বিরতি দিয়ে আমাকে তিনটি বা চারটি চিঠি লিখেছেন। লিখেছেন বলতে আমার চিঠির উত্তর দিয়েছেন। প্রতিটি চিঠি ইংরেজিতেই লিখেছেন। প্রতিটি চিঠিতে আমাকে সম্বোধন করেছেন “আনোয়ার ভাই,” বলে। আমি বিব্রত বোধ করেছি। কারণ আমি যখন তাঁর প্রথম চিঠি পাই তখন আমার বয়স ৩০ বছর, আর তাঁর বয়স ৬৯ বছর। তাঁর সাথে যখন আমার দেখা হয় তখন তাঁর বয়স ৭৭ বছর। প্রথম চিঠি প্রাপ্তি নিয়েও একটি মজার ঘটনা আছে। আমি দৈনিক সংগ্রামের সিনিয়র রিপোর্টার। খুশবন্ত সিং এর যে লেখাটির অনুবাদ পাক্ষিক নিপূণ প্রকাশ করেছিল, সেটি আমার অফিসের অনেকে পড়েছেন। আমি খুশবন্ত সিং সম্পর্কে অনেক কথা ইতোমধ্যে অনেককে বলেছি। তখন সংবাদপত্রে সন্ধ্যার শিফট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বিশেষ করে রিপোর্টাররা সবাই সন্ধ্যায় অফিসে হাজির হতো। এক সন্ধ্যায় আমি অফিসে যাওয়ার পরই আমাদের তরুণ রিপোর্টার আজম মীর খুব উৎসাহে চিৎকার করে বলতে লাগলো, “উস্তাদ মিষ্টি খাওয়াতে হবে।” আমি বুঝতে পারছিলাম না মিষ্টি খেতে চাওয়ার মতো কী ঘটলো। আজম মীর নাছোড়বান্দা টাইপের ছেলে। মিষ্টি না হোক, সিঙ্গারা-চা এর পয়সা আদায় করে আমাকে খুশবন্ত সিংয়ের চিঠি ধরিয়ে দিল। অত্যন্ত আনন্দিত হলাম, সিঙ্গারা-চা এর দাম আদায় বৃথা যায়নি। তাঁর সব কটি চিঠি এবং বই অনুবাদ করার জন্য দেয়া অনুমতিপত্র আমি সযত্নে সংরক্ষণ করেছিলাম। ২০১০ সালে আমি যুক্তরাষ্ট্রে আসার পর আমার স্ত্রী তিনবার বাসা বদল করেছে। এ সময়ে আমার বই ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র কোথায় কীভাবে রেখেছে তা বলতে পারে না।
খুশবন্ত সিং কখনো বাংলা শিখেননি। তিনি থেমে থেমে বাংলা পড়তে পারতেন। বললে সবই বুঝতেন। ‘কেমন আছেন?’ ‘আমি ভালো আছি?’ ‘আমি বাংলাদেশ ভালোবাসি,’ অথবা ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’ ধরনের কমন বাংলা বলতে পারতেন। তবে আমাকে বলেছিলেন, কিছু রবীন্দ্র সঙ্গীত তাঁর খুব ভালো লাগে। ভারতের জাতীয় সঙ্গীত “জনগণমন ভারত ভাগ্যবিধাতা,” রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা, সেটি পুরোটাই জানেন এবং বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত “আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’র কয়েক লাইন তিনি গুণগুণ করেছিলেন। স্বাধীনতা অর্জনের পর তিনি যখন প্রথমবার বাংলাদেশ সফর করেন তখন তিান মানুষের মুখে এবং দোকানপাট, সর্বত্র বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত উচ্চারিত হতে শুনেছেন।
জহিরুলঃ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তার কিছু লেখালেখি আছে। তিনি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানীর সাথে দেখা করেন এবং তার সাক্ষাৎকার নেন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তার মূল বক্তব্যটা কি ছিল? তিনি এবং সম্প্রতি ভারতের আধ্যাত্মিক গুরু সাতগুরুর এক মন্তব্য থেকে বুঝতে পারি যেসব হিন্দু মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহন করেছেন তাদেরকে তারা ভারতীয় বলে উল্লেখ করেছেন, বাংলাদেশের বা তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের ডেমোগ্রাফি সম্পর্কে তাদের কিছুটা অজ্ঞতাই কি এতে প্রকাশ পায় না?
মঞ্জুঃ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তাঁর বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ লেখা রয়েছে। ওই সময়ে তিনি ‘ইলাসট্রেটেড উইকলি অফ ইণ্ডিয়া’র সম্পাদক ছিলেন এবং একই সময়ে নিউইয়র্ক টাইমস তাঁকে মুক্তিযুদ্ধের ওপর রিপোর্ট করার জন্য দায়িত্ব দিয়েছিল। এই সূত্রে তিনি যুদ্ধ শুরু হওয়ার সময় থেকে যুদ্ধে বিজয় অর্জন পর্যন্ত এবং পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ সফর করে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের প্রশাসন পরিচালনার সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত ছিলেন তাদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, ওই সময়ের বিরোধী দলীয় নেতা এবং সাধারণ মানুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এসময় তিনি পাকিস্তানেও যান এবং “বাংলার কশাই” খ্যাত জেনারেল টিক্কা খানের সাথেও সাক্ষাৎ করেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান, ইস্টার্ন কমাণ্ডের প্রধান লে: জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা, জেনারেল এমএজি ওসমানি, খন্দকার মুশতাক আহমেদ, মাওলানা ভাসানী, কমরেড মনি সিং, অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ, কবি জসীমউদ্দিন, অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক, অধ্যাপক রওনক জাহান প্রমুখ। মুক্তিযুদ্ধের ওপর তার এসব নিবন্ধ, রিপোর্ট ও সাক্ষাৎকার “ওয়ার এণ্ড পিস ইন ইণ্ডিয়া, পাকিস্তান এণ্ড বাংলাদেশ” নামে একটি গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে। শিগগিরই গ্রন্থটির বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হবে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তাঁর বক্তব্য ছিল অত্যন্ত স্পষ্ট। তিনি তাঁর এক নিবন্ধে উল্লেখ করেছেন: “হানাদার বাহিনীকে বিতাড়ণ করার জন্য বাংলার মুক্তিযোদ্ধা বাহিনীকে সাহায্য করতে এবং বাংলাদেশের জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত একমাত্র বৈধ সরকারকে পুন:প্রতিষ্ঠিত করতে আমাদের পক্ষে যা করা সম্ভব আমরা তা করব। আমাদের উচিত আমাদের প্রচার মাধ্যমের সাহায্যে পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণকে বোঝানো যে, তাদের শাসকরা কিভাবে অবদমন, নিপীড়ণ ও স্বেচ্ছাচার চালাচ্ছে এবং আমাদের উচিত এভাবে সামরিক গোষ্ঠীকে অসহযোগিতা করার জন্য তাদেরকে উৎসাহিত করা।” ভারতের গুরু সাতগুরু মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী হিন্দুদের যদি ভারতীয় বলে দাবী করে থাকেন তাহলে নি:সন্দেহে ভুল করেছেন। কারণ আজ পর্যন্ত ভারত সরকারিভাবে কখনো বলেনি যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তাদের হিন্দু নাগরিকরা অংশগ্রহণ করেছে। পাকিস্তানের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তারা তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের ভূখণ্ডে প্রবেশ করার কথা স্বীকার করে। ভারতীয় কোনো বেসামরিক হিন্দু নাগরিক বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে সাতগুরুর এমন দাবী বিভ্রান্তিকর। বাংলাদেশে বহু হিন্দু তরুণ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে এবং তাদের অনেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য যুদ্ধে আত্মদান করেছে। স্বাধীনতার পাঁচ দশক পর একজন হিন্দু গুরুর এ ধরনের বক্তব্য দান অজ্ঞতাপ্রসূত অথবা উদ্দেশমূলক।
জহিরুলঃ ঢাকা ডাইজেস্ট নামে তো একটি পত্রিকা ছিল, নতুন করে একই নামে আপনি আরো একটি পত্রিকা কেন বের করলেন? অবশ্য আপনার সম্পাদিত ও প্রকাশিত ডাইজেস্টই ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। ঢাকা ডাইজেস্টের এই বিপুল পাঠকপ্রিয়তার মূল কারণ কি ছিল এবং কোন বয়সের পাঠক সবচেয়ে বেশি ছিল?
মঞ্জুঃ আপনি ঠিকই বলেছেন “ঢাকা ডাইজেস্ট” নামে একটি মাসিক ম্যগাজিন সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে আশির দশকের প্রথম দিক পর্যন্ত বাজারে ছিল। তারও আগে ষাটের দশকের শেষ দিকে “বাংলা ডাইজেস্ট” নামে একটি মাসিক ম্যাগাজিন ছিল। আমি স্কুল জীবন থেকে “বাংলা ডাউজেস্ট” এর গ্রাহক ছিলাম। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলা ডাইজেস্ট আর প্রকাশিত হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর আমি “ঢাকা ডাইজেস্ট” অফিসে যাতায়াত শুরু করি এবং মাঝে মাঝে কিছু লেখাও দেই। এটির অফিস ছিল তোপখানা রোডে। ম্যাগাজিনের সম্পাদক ছিলেন রশীদ চৌধুরী নামে একজন ব্যবসায়ী এবং নির্বাহী সম্পাদক ছিলেন ফজলে আজিম নামে একজন সাবেক কলেজ শিক্ষক। এই ম্যাগাজিনের সঙ্গে নাজির আহমেদ নামে আরো একজন ছিলেন। কিন্তু সক্রিয় ছিলেন না। যাহোক, তারা আমাকে মাঝে মাঝে এসাইনমেন্ট দিতে শুরু করেন। আমি উৎসাহের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করি। তখন থেকেই আমার মনে হতো কখনো সম্ভব হলে আমি এ ধরনের একটি ম্যাগাজিন বের করবো। সম্ভবত ১৯৮২ সালের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকা ডাইজেস্ট বন্ধ হয়ে যায়। আমি তখন দৈনিক সংগ্রামে স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে কাজ করছিলাম। আমার মাথায় মাসিক ম্যাগাজিনের ধারণা তখনো কাজ করছিল। কয়েকজন সহকর্মীর সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করি এবং তারাও উৎসাহিত হন। আমরা আসলে বন্ধ হয়ে যাওয়া ঢাকা ডাইজেস্ট পুন:প্রকাশের কথাই ভেবেছিলাম। সেজন্য ম্যাগাজিনের তিন মালিকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। আগে যেভাবে প্রকাশিত হতো সেভাবে তাদের নামেই প্রকাশের আগ্রহের কথা জানালে তারা সম্মত হন। পরিচালনার শর্ত কি হবে না হবে, তারা নির্ধারণ করে দেন। কিন্তু দলিল স্বাক্ষরের মুহূর্তে তাদের দুজন রশীদ চৌধুরী ও ফজলে আজিম টালবাহানা শুরু করলে আমরা হতাশ হয়ে পড়ি। তৃতীয় মালিক আমাকে বলেন উনাদের পেছনে সময় ব্যয় না করে আমি কেন নতুন একটি ম্যাগাজিন প্রকাশের ডিক্লারেশন নেয়ার চেষ্টা করছি না। তাঁর পরামর্শ আমাকে সাহসী করে তোলে। তবে ঢাকা ডাইজেস্টের যে সুনাম ছিল তা কাজে লাগানোর ইচ্ছায় ও দুই মালিকের ওপর ক্ষোভের কারণে ঢাকা ডাইজেস্টের প্রথমে “নতুন” শব্দ যোগ করে ডিক্লারেশনের জন্য আবেদন করি। ডিক্লারেশন পাওয়া কঠিন এক প্রক্রিয়া। ডিপার্টমেন্ট অফ ফিল্মস এন্ড পাবলিকেশন্স (ডিএফপি), পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ (এসবি), ন্যাশনাল সিকিউরিটির ইন্টেলিজেন্স (এনএসআই), স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রাজনৈতিক শাখা, তথ্য মন্ত্রণালয় ঘুরে ঢাকা জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে চূড়ান্ত অনুমোদন পেতে কয়েক মাস লেগে যায়। প্রতিটি অফিসে গিয়ে ফাইল আটকে যেত। প্রতিটি অফিসে গিয়ে ব্যক্তিগতভাবে ধর্ণা দিয়ে ফাইল এক অফিস থেকে আরেক অফিসে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হয়েছে। কোনো কোনো অফিসে ‘চা-পানির’ খরচও দিতে হয়েছে।
আমার সঙ্গে আরো তিন জন ছিলেন। তাদের মধ্যে শুধু একজন সাংবাদিকতায় নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছেন, তিনি মাসুমুর রহমান খলিলী। আমরা ১৯৮৭ সালের এপ্রিল মাসে মাসিক “নতুন ঢাকা ডাইজেস্ট”-এর প্রথম সংখ্যা বের করার উদ্যোগ গ্রহণ করি। আমরা দু’একটি সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দেই এবং হকারদের সঙ্গে যোগাযোগ করি। বিপুল সাড়া পাওয়া যায়। প্রথম সংখ্যা যাতে পাঠকদের মন কাড়তে পারে সেজন্য আমরা কবি আল মাহমুদের লেখাসহ পাঠকপ্রিয় কবি ও লেখকদের গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ প্রকাশ করি, যথাসময়ে এজেন্ট ও হকারদের কাছে পৌঁছানো এবং বিক্রয়লব্ধ অর্থ প্রাপ্তি নিশ্চিত করার সিদ্ধান্ত নেই। প্রথম সংখ্যা সাদরে গৃহীত হয় এবং আমাদের মধ্যে উৎসাহের সৃষ্টি হয় যে আমরা দিন দিন ম্যাগাজিনের মান বৃদ্ধি করতে সচেষ্ট থাকি। প্রতিষ্ঠিত কবি লেখকরা তো আমাদের সাথে ছিলেন, পাশাপাশি দেশের নবীন লেখকদের উৎসাহিত করার জন্য যারাই লেখা পাঠাতো, সেগুলো যদি মানসম্মত নাও হয়, প্রয়োজনীয় সংশোধন ও পরিমার্জন করে প্রকাশ করতে শুরু করি। প্রতি সংখ্যায় দেশী বা বিদেশী বিখ্যাত কোনে উপন্যাস সংক্ষিপ্তাকারে প্রকাশ করি, ঠিক রিডার্স ডাইজেস্ট যা করতো। সাহিত্য ছাড়াও রাজনীতি, অর্থনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতির ওপর বিশ্লেষণধর্মী লেখার জন্য বেশ ক’জন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, আমলা ও সাংবাদিকের সাথে যোগাযোগ করি। এসব কারণে ঢাকা ডাইজেস্ট দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করে। ওই সময় ঢাকা ডাইজেস্টের আর কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না। সেবা প্রকাশনীর মাসিক রহস্য পত্রিকা ছাড়া বুক সাইজের আর কোনো ম্যগাজিন ছিল না। রহস্য পত্রিকার বিষয়বস্তুর বৈচিত্রের চেয়ে আমাদের বিষয়বৈচিত্র ছিল অনেক বেশি।
নতুন ঢাকা ডাইজেস্টের পাঠকদের মধ্যে ছাত্র সংখ্যাই ছিল বেশি। স্কুলের উচ্চ শ্রেনির ছাত্র থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাই আমাদের পাঠক ছিল। তারা পেশাদার হকারের কাছ থেকে ম্যাগাজিন নেয়ার জন্য অপেক্ষা করার পরিবর্তে নিজেরাই এজেন্সি নিয়ে নিতো। বন্ধুবান্ধবদের কাছে বিতরণ করতো। এর মূখ্য কারণ ছিল ছাত্রদের কাজে লাগার মতো অনেক খোরাক দেয়ার চেষ্টা করতাম আমরা। এমনকি আমরা এমনও দেখেছি, বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নেয়ার জন্য বাজারে যেসব গাইড বই বিক্রি হতো, সেগুলোতে অবধারিতভাবে ঢাকা ডাইজেস্টে প্রকাশিত রাজেনৈতিক, অর্থনৈতিক ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষণমূলক নিবন্ধগুলো অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এর ফলে আমরা সামাজিক দায়বদ্ধতার মধ্যেও পড়েছিলাম এবং ম্যাগাজিনে আরো পাঠযোগ্য বিষয় দেয়ার কথা ভাবতাম। আমরা অনুবাদ সাহিত্যকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলাম এবং ঢাকা ডাইজেস্টে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও মেধাবী ছাত্ররা নির্বাচিত গল্প ও নাটক অনুবাদ করতেন। ইংরেজি, উর্দু ও আরবি ভাষা থেকেই তারা অনুবাদ করতেন। এছাড়া আমরা বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার নেয়ার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী আয়োজন করতাম। চার-পাঁচজন সাংবাদিক একজনের সাক্ষাৎকার নিতাম। দীর্ঘ সাক্ষাৎকার, পাঁচ থেকে ছয় ঘন্টা ব্যয় হতো, সাক্ষাৎকারের মাঝে আমরা কোনো চাইনিজ রেষ্টেুরেন্টে মধ্যাহ্নভোজের ব্যবস্থা রাখতাম। এভাবে আমরা গ্রহণ করেছিলাম কবি আল মাহমুদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর মুহাম্মদ মনিরুজ্জামান মিয়া, প্রধানমন্ত্রী কাজী জাফর আহমেদ, তিনি অবশ্য দু’দিনে তাঁর সাক্ষাৎকার দিয়েছেন তাঁর দফতরে। এভাবে বেশ ক’জন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সাক্ষাৎকার প্রকাশ করায় ঢাকা ডাইজেস্টের গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা আরো বেড়েছিল। আমাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল, পাঠকদের সাথে সরাসরি সম্পর্ক গড়ে তোলা এবং আমার বিশ্বাস আমরা তাতে সফল হয়েছিলাম।
জহিরুলঃ 'উপমহাদেশ' উপন্যাসটি আল মাহমুদ লেখেন ঢাকা ডাইজেস্ট পত্রিকার জন্য। এই উপন্যাসটি লেখার পেছনে বেশ নাটকীয় ঘটনা আছে। রীতিমতো অ্যারেস্ট করে তাকে লিখতে বসানো হয়েছে, সেইসব গল্প শুনতে চাই।
মঞ্জুঃ সে এক দীর্ঘ কাহিনি। এ প্রসঙ্গে আমি ইতোমধ্যে আমার এক লেখায় উল্লেখ করেছি। আল মাহমুদের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে সাংবাদিক নেতা মুহাম্মদ আবদুল্লাহ এক ভিডিও কনফারেন্সের আয়োজন করে, আমাকেও অতিথি হিসেবে রেখেছিলেন, সেখানেও ঢাকা ডাইজেস্টে ‘উপমহাদেশ’ প্রকাশের ওপর বিস্তারিত আলোচনা করেছি। প্রসঙ্গটি যখন আবার এসেছে, আমি আল মাহমুদের সঙ্গে আমার সম্পর্কের সূচনা থেকে বলতে চাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালে ১৯৭৬ বা ’৭৭ সাল থেকে আমি একাধিক সাপ্তাহিক ও মাসিক ম্যাগাজিনে বিভিন্ন বিষয়ের ওপর ফিচার লিখতে শুরু করেছিলাম। ওই সময়ে রশীদ চৌধুরী সম্পাদিত মাসিক ঢাকা ডাইজেষ্ট আমাকে দায়িত্ব দেয় কবি ফররুখ আহমদ সম্পর্কে অন্যান্য শীর্ষস্থানীয় কবির মূল্যায়ন জানতে। আমি কবি হাসান হাফিজুর রহমান, কবি আহসান হাবীব, কবি মোহাম্মদ মাহফুজুল্লাহ, কবি আল মাহমুদ, কবি শামসুর রাহমান, কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ ও কবি আসাদ চৌধুরীর সাক্ষাতকার গ্রহণ করি। শুধুমাত্র শামসুর রাহমানের সাক্ষাৎকার নিতে পারিনি। আজ না, অমুক দিন বলে বলে কয়েক দিন ঘোরানোর পর আমি আর তাঁর সাক্ষাৎকার নিতে যাইনি। ওই সাক্ষাৎকারগুলো দিয়েই ম্যাগাজিনের কভার ষ্টোরি করা হয়েছিল। আল মাহমুদ শিল্পকলা একাডেমীর সহকারী পরিচালক। তাঁর সাথে প্রথম সাক্ষাতেই ঘনিষ্ট হয়ে উঠি এবং সাক্ষাৎকারের এক পর্যায়ে বলেই ফেলি যে, “এতো ছোট একটা চাকুরি না নিলেই কী ভালো হতো না?’ যখন ঢাকায় আসিনি তখন মফ:স্বল শহরে ‘গণকন্ঠ’ পড়তাম, আমার কাছে একজন সম্পাদক ও তাঁর অবস্থান ও মর্যাদা দেবতূল্য। তার ওপর তিনি একজন কবি। বেশ কম বয়সে, স্কুলের শেষ দিকে থাকতে তাঁর কবিতার বই ‘লোক লোকান্তর’ পড়েই মুগ্ধ হই। আমার প্রশ্নে তিনি বিব্রত হন না। স্মিত হেসে মাথা নেড়ে বলেন, “মঞ্জু মিয়া, আমিও নিজেকে তাই ভাবতাম। কর্ম জীবনের শুরু থেকে সাংবাদিকতাই করেছি। একজন সাংবাদিকের সম্পাদক হওয়ার আকাংখা থাকে। যে কোনো পেশায় প্রত্যেকের স্বপ্ন থাকে শীর্ষ পদটিতে যাওয়ার। কিন্তু সে আকাংখা পূরণ হওয়া খুব সহজ নয়। আমি সেই পদ অলংকৃত করার সুযোগ পেয়েছি। কিন্তু পরিবারকে অসহায় অবস্থার মধ্যে ফেলে যদি কারাগারে কাটাতে হয়, কারাগার থেকে বের হয়ে যদি তুমি দেখতে পাও, যে চাকুরিটি করতে তা আর নেই। কী করবে তুমি?” তাঁর কথাই হয়তো সত্যি। তবুও আমার মেনে নিতে কষ্ট হয়েছিল। যাই হোক, পরবর্তীতে আমার সেই মুগ্ধতা তাঁর প্রতি ভক্তিতে পরিণত হয়। প্রথম সাক্ষাতের পর কালেভদ্রে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাত হতো। কিন্তু যখনই হতো, তখন আন্তরিকতার সাথে কুশল জানতে চাইতেন। শিল্পকলা একাডেমীর পরিচালক হিসেবে তিনি অবসর নেন। আসলে যে অবস্থায় তাঁকে ওই ক্ষুদ্র চাকুরিটি গ্রহণ করতে হয়েছিল সেটি বাংলাদেশের ইতিহাসে এক ন্যাক্কারজনক অধ্যায় হয়ে আছে। ১৯৭৪ সালে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে দেশে সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বাতিল করে একদলীয় রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়েছিল। সব দল নিষিদ্ধ করে “বাকশাল” নামে এক দল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। চারটি সংবাদপত্র ছাড়া সকল সংবাদপত্রের অস্তিত্ব বিলুপ্ত করা হয়েছিল। অন্যান্য সকল পত্রপত্রিকার মতো সেই বিলুপ্তির শিকার হয়েছিল স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে সরকার বিরোধী একমাত্র সংবাদপত্র দৈনিক গণকন্ঠ; যে পত্রিকাটির সম্পাদনা করতেন আল মাহমুদ। বন্ধ হয়ে যাওয়া সংবাদপত্রের শতশত সাংবাদিক-কর্মচারি বেকার হয়ে পড়েন। বেকার সাংবাদিকদের আন্দোলনের মুখে শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন সরকার বিভিন্ন সরকারি, বিধিবদ্ধ সরকারি প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্রায়ত্ত্ব কর্পোরেশনে বেশ কিছু সাংবাদিকের চাকুরির ব্যবস্থা করে। আল মাহমুদকে দেয়া হয় শিল্পকলা একাডেমীর সহকারী পরিচালকের একটি পদ। একটি জাতীয় দৈনিকের সম্পাদক সরকারি চাকুরি কাঠামোর একেবারে প্রারম্ভিক পর্যায়ে নিয়োগ পান। কোনো উপায় ছিল না তাঁর। অনেকগুলো সন্তানসহ একটি বড় পরিবার কিভাবে সামাল দেবেন?
ঢাকা ডাইজেস্টের অফিসে বসে আল মাহমুদ লিখছেন 'তৃষিত জলধি'
১৯৮৭ সাল থেকে আল মাহমুদের সঙ্গে নিয়মিত সাক্ষাত ঘটতে থাকে আমার সম্পাদনায় মাসিক নতুন ঢাকা ডাইজেষ্ট প্রকাশিত হওয়ার পর। ম্যাগাজিনের প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত হয় তার ছোটগল্প “তৃষিত জলধি”। এরপর ঢাকা ডাইজেষ্টে তার কবিতা, গল্প, ভ্রমণ কাহিনী এবং একটি উপন্যাস “উপমহাদেশ” প্রকাশিত হয়েছে। আল মাহমুদের কাছ থেকে লেখা আদায় করা কঠিন কাজ ছিল। এ নিয়ে অনেক সময় তাঁর ওপর রাগও করেছি। কিন্তু তিনি কখনো রাগ করতেন না। তার মুখের হাসি কখনো অমলিন হয়ে যেতো না। তাঁর কাছ থেকে লেখা আদায়ের অভিজ্ঞতার ওপর আমি ফেসবুকে একটি ষ্ট্যাটাস দিয়েছিলাম। তাতে আমি যা উল্লেখ করেছি, তা এখানে তুলে ধরছি:
“আল মাহমুদ এর কাছ থেকে লেখা আদায় করা সাধনার মতই ছিল। তাঁর লেখা হাতে পাওয়া মানে সেই সাধনায় সিদ্ধি লাভ। মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পাতনের মত অবস্থা। এই সিদ্ধি লাভ করতে গিয়ে মাসুমুর রহমান খলিলি, বুলবুল সরওয়ার সহ নতুন ঢাকা ডাইজেষ্টের একাধিক কর্মীর কলকে ফাটার উপক্রম হয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত ডাইজেস্ট এর অনেক সংখ্যা তাঁর লেখায় সমৃদ্ধ হয়েই প্রকাশিত হয়েছে। ডাইজেষ্টে তিনি তাঁর সব ধরনের লেখা দিয়েছেন। কবিতা, গল্প, তাঁর ওমরাহ পালনের অভিজ্ঞতা এবং উপন্যাস। চার-পাঁচজন সাংবাদিক মিলে তার দীর্ঘ সাক্ষাৎকারও নিয়েছি ঢাকা ডাইজেষ্টের জন্য। সেই সাক্ষাৎকার দিয়ে তাঁর ওপর কভার ষ্টোরি করেছি। আল মাহমুদ যখন তাঁর মুক্তিযুদ্ধ-ভিত্তিক উপন্যাস ‘উপমহাদেশ’ ধারাবাহিকভাবে নতুন ঢাকা ডাইজেষ্টে লেখার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন আমরা ডাইজেস্ট পরিবারের সদস্যরা উচ্ছসিত হয়েছিলাম। তাঁর হাতে এডভান্সও গুঁজে দিয়েছিলাম। প্রথম প্রথম কয়েক সংখ্যার জন্য নিয়মিতই লিখলেন। এরপর তাঁর বাসায় গিয়ে ধর্ণা দিতে হয়। বাসা থেকে ধরে অফিসে এনে আটকে রাখতে হয়। খাওয়ার ব্যবস্থা করি, সিগারেট কিনে আনি। কিন্তু এক বসায় তিনি লেখা শেষ করেন না। কখনো অর্ধেক পৃষ্ঠা লিখেন, লোকজন এলে আড্ডায় মেতে ওঠেন। হঠাৎ উঠে বলেন, ‘আজ ছেড়ে দাও, কাল সকালে লেখা শেষ করে তোমাকে দিয়ে যাব।’ অনেক সময় বলেন, ‘এখন আমার সাথে দোকানে চলো। তোমার ভাবী কী কী বলে দিয়েছে, কিনতে হবে।’ তাঁর সাথে দোকানে যাই, তিনি চাল, ডাল, তেল, আরও টুকটাক জিনিস নেন। দাম চুকিয়ে জিনিসগুলো রিকশায় তুলে রিকশাওয়ালার হাতে ভাড়াও দিয়ে দেই। আল মাহমুদের জন্য এসব করতে ভালই লাগত। কিন্তু লেখা যথাসময়ে না দেয়ার বিরক্তিও ঝাড়তাম তার ওপর। ‘উপমহাদেশ’ যখন একেবারেই শেষদিকে; হয়ত আর আট-দশ সংখ্যায় ছাপা হলেই শেষ হবে, তখন তাঁর কাছ থেকে লেখা আদায় করা ক্রমেই কঠিন হতে লাগল। তিনি বলেন, ‘আজ আর কাউকে আসতে হবে না। শরীফকে (তাঁর বড় ছেলে) দিয়ে লেখা পাঠিয়ে দেব; ইত্যাদি প্রতিশ্রুতির পর এক সংখ্যায় তিনি লেখা দিতে পারলেন না। বললেন, ‘এ সংখ্যায় বাদ দাও, নানা ঝামেলার মধ্যে আছি। পরে বলব।’ মেজাজ খারাপ করলাম। লাভ কী! ডাইজেষ্ট ছাপায় বিলম্ব হলো। এজেন্টদের অভিযোগ। ততদিনে ‘উপমহাদেশ’ পড়তে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন অনেক পাঠক। তারা পরবর্তী সংখ্যার জন্য অপেক্ষা করতেন। ঢাকা সিটির বহু পাঠক সরাসরি অফিসে এসে জানতে চাইতেন, এ সংখ্যায় ‘উপমহাদেশ’ নেই কেন? মফ:স্বলের পাঠকরা চিঠি লিখে তাদের উষ্মা ও বিরক্তি প্রকাশ করতেন। আল মাহমুদকে তাঁর ভক্তদের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে জানাই। তিনি বলেন, ‘এমন আর হবে না’। যদিও তিনি হেসে হেসে বলেন, কিন্তু প্রতিবার লেখা আদায় করার প্রচেষ্টা প্রাণান্তকর। যখনই তিনি তাঁর প্রয়োজনের কথা বলেন, তা পূরণ করতে কার্পণ্য করি না। তিনি কখনও দাবী করেন না। বিনয়ের সাথে বলেন। ‘উপমহাদেশ’ যখন একেবারেই শেষ পর্যায়ে। হয়ত আর চার-পাঁচ সংখ্যায় শেষ হয়ে যাবে, তখন তিনি লেখা দিতে অনিয়মিত হয়ে গেলেন। পাঠকদের অভিযোগের কী জবাব দেই, কিভাবে তাদের শান্ত করি? একদিন ফোন করলাম আল মাহমুদকে। কঠোরভাবেই বললাম, ‘নতুন ঢাকা ডাইজেস্ট’ এ খ্যাতিমান কারও লেখা ছাপি না। কারণ কাউকে তেল দেয়ার সাধ্য ও সময় আমাদের নেই। আপনার লেখা ছাড়াই দেশের সব সেরা পত্রপত্রিকা চলে। আমাদের ক্ষুদ্র মাসিকটিও চলবে। মাঝখান থেকে বিপদে ফেলে দিয়েছেন। আমি আর আপনার কাছে চেয়ে লেখা চেয়ে নেব না।’ পর পর দুই সংখ্যায় ‘উপমহাদেশ’ ছাপা হলো না। কেউ অভিযোগ করলে বলি, ‘কবির কাছেই জিজ্ঞাসা করুন।’ তার টেলিফোন নম্বর দিয়ে দেই। এ পরিস্থিতির মধ্যে একদিন ফোন করলেন তখনকার সচিব শাহ আবদুল হান্নান। সম্ভবত তিনি তখন অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং ডিভিশনের সচিব। তিনি জানান ‘উপমহাদেশ’ তিনি নিয়মিত পড়েন। ডাইজেষ্টে লেখা না পেয়ে আল মাহমুদকে ফোন করেছেন। আল মাহমুদ তাকে বলেছেন, ‘মঞ্জু আমার উপর রাগ করেছে।’ সেজন্য শাহ হান্নান আমাকে ফোন করেছেন। তিনি বললেন, ‘কবিদের এটুকু মানতে হবে। উনার সাথে আমার কথা হয়েছে। লেখা দিতে আর বিলম্ব করবেন না। একটা ভাল কাজ হচ্ছে। শেষ করো। উনার উপর রাগ করো না। বিরাট সংসার তাঁর। সংসার চালাতে তাঁকে হিসসিম খেতে হয়। এরপরও যে লিখেন, সেটাই তো দেশের মানুষের জন্য অনেক। তাকে যদি আরও কিছু টাকা দিতে হয়, আমার কাছ থেকে নিয়ে উনাকে দিয়ো। আমি সরাসরি দিলে তাঁর ইগোতে লাগতে পারে।’ শাহ হান্নানের কথায় আবার আল মাহমুদের কাছে ধর্ণা দেই। অফিসে ধরে আনি। বাসায় কাউকে বসিয়ে রাখি। এভাবে শেষ হয় তাঁর ‘উপমহাদেশ’।
এখানে আমি নতুন ঢাকা ডাইজেস্টের উদ্বোধনী সংখ্যায় আল মাহমুদের প্রথম লেখা আদায় করার কাহিনি বলার ইচ্ছা দমন করতে পারছি না। ডাইজেস্টের শুরু থেকে ২০০৬ সালের জুলাই মাসে প্রকাশনা বন্ধ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত দীর্ঘ চৌদ্দ বছর শিল্পী ফরিদী নুমানম্যাগাজিনের অলঙ্করণ ও অঙ্গসজ্জার কাজে যুক্ত ছিলেন। তিনি কিছুদিন আগে সেই কাহিনি উল্লেখ করেছেন, যা অত্যন্ত চমকপ্রদ। আমি ফরিদী নুমানের জবানীতেই তা উপস্থাপন করছি:
“একটি গল্প, একজন কবি, একটি ইতিহাস এবং একটি আলোকচিত্র...
১৯৮৭ সাল। কাঁঠালবাগান ঢালের উপরের ডানপাশের বাড়িটিতে আমাদের আবাসিক অফিস। এখানে প্রায়ই আড্ডা হতো বাংলাদেশের নবীন-প্রবীন কবি-শিল্পী-সাহিত্যের মানুষদের। কবি আল মাহমুদ সেখানে নিয়মিত মধ্যমণি। পাশেই কবি আবিদ আজাদের প্রকাশনা সংস্থা শিল্পতরু। পাশাপাশি হওয়ায় ম্যারাথন আড্ডাও হত। অর্থাৎ কবি আবিদ আজাদের ওখানে আড্ডা শেষ করে আমাদের অফিসে, কিংবা আমাদের অফিসে শেষ করে শিল্পতরুতে। আমাদের অফিস বলতে নতুন ঢাকা ডাইজেস্টের অফিস।
যে সময়ের কথা বলছি, পত্রিকাটি তখনো বের হয়নি। সম্পাদক আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু ভাইয়ের ইচ্ছে প্রতিসংখ্যায় 'এ সংখ্যার বই' নামে একটি বিভাগ থাকবে। প্রথম সংখ্যায় আল মাহমুদ একটা বড়গল্প দিতে রাজী হলেন যেটা ঐ বিভাগে ছাপা হবে। লেখা আদায়ের দায়িত্ব নির্বাহী সম্পাদক মাসুমুর রহমান খলিলী ভাইয়ের। কবি আমাদের আড্ডায় নিয়মিত আসেন। খলিলী ভাই গল্পের কথা জিজ্ঞেস করলেই বলেন, আরে তোমার গল্প প্রায় শেষ। এই তো দিচ্ছি.... কাল না হয় পরশু.... পেয়ে যাবে। খলিলী ভাই কবির বাসা কিংবা শিল্পকলায় তাঁর অফিস, শিল্পতরু কিংবা আমাদের আড্ডা, যেখানে পান সেখানেই কবিকে লেখাটা দেয়ার জন্য তাগাদা দেন। গল্পের জন্য ঘুরে দু'একজোড়া স্যান্ডেলও মনে হয় শেষ করে ফেলেছেন। কবি স্বভাবসুলভ উত্তর দেন, আরে পেয়ে যাবে। এদিকে পত্রিকা বাজারে দেয়ার সময় ঘনিয়ে এসেছে। সব রেডি... কিন্তু আল মাহমুদের গল্পের খবর নাই।
শেষমেষ লেখা আদায়ের জন্য খলিলী ভাই একটা কৌশল বের করলেন। কবিকে পটিয়ে পটিয়ে একদিন আমাদের অফিসে আনা হলো। কবিকে বলা হলো আজ সারাদিন আপনি আমাদের মেহমান। তাঁর কাপড় বদল করে লুঙ্গি পরিয়ে দেয়া হলো। কবির পছন্দের খিচুড়ী আর মাগুর মাছ রান্নার আয়োজন হলো। কবির প্রিয় শলাকা গোল্ডলীফ সিগারেটের প্যাকেট দিয়ে আমার রুমটি ছেড়ে দেয়া হলো। কাগজ কলম দেয়া হলো। শর্ত একটাই গল্প না লিখে রুম থেকে বেরোনো যাবে না। এরপর বাইরে থেকে রুম বন্ধ করে দেয়া হলো। আমি আর শফিউল আলম রতন থাকলাম কবির পাহারায়। যদি তার কোনো কিছুর প্রয়োজন হয় সেজন্য। কবি প্রথমে গাঁই-গুই করলেও শেষমেষ লিখতে বসলেন। আমার পুরনো কাঠের টেবিলে বসেই কবি লিখে চললেন.... সমুদ্রে হিজবুল বাহার জাহাজে দূরদর্শী প্রেসিডেন্টকে নিয়ে অসাধারণ এক গল্প। গল্পটি আসলে গল্প নয় ইতিহাসকে আরাধ্য করে লেখা ঐতিহাসিক সাক্ষ্য। গল্পের নাম 'তৃষিত জলধি'। আল মাহমুদের জীবনে এক বসায় এরকম গল্প বা উপন্যাস লেখার কোনো ঘটনা আছে কিনা আমি জানিনা। আর লেখা আদায় করতে কোনো কবিবে এরকম 'হাউস এ্যারেস্ট' হতে হয়েছে কিনা তা-ও জানি না।
সেই ঐতিহাসিক গল্পটি লেখার সময় ছবিটি আমি তুলে রেখেছিলাম।”
আল মাহমুদকে ডাইজেস্টে অত্যন্ত নিবিড়ভাবে পেয়েছিলাম। ডাইজেস্ট তাঁর লেখায় সমৃদ্ধ হয়েছে এবং ওই সময়গুলো তাঁর জন্যও অত্যন্ত উৎপাদনশীল সময় গেছে বলে আমার বিশ্বাস। এজন্য আমরা গর্বিত। আল মাহমুদ একজন কবি হিসেবে সবসময় মানুষের মাঝে থাকবেন। তিনি শেষ হয়ে যাবেন না। তিনি বলেছেন, “যেদিন আমি কবরে প্রবেশ করলাম, সেইদিন থেকে শুরু হলো আমার আরেক জগৎ; আমি শেষ হয়ে যাব না।"
এ সম্পর্কে কবি মির্জা গালিবের কবিতাংশ উদ্ধৃত করছি:
“ইয়া রব, জমানা মুঝকো মিটাতা হ্যায় কিস লিয়ে
লোহ-এ জাহান পে হরফে মুকাররার নাহি হুঁ ম্যায়:”
(হে খোদা, পৃথিবী কেন আমাকে মুছে ফেলতে চায়?
আমি এমন এক অক্ষর, যা জীবনের শ্লেটে মুছে ফেলা যায় না)।
জহিরুলঃ ঢাকা ডাইজেস্টে লিখে লেখক হয়ে উঠেছেন এমন কিছু লেখকের কথা বলুন।
মঞ্জুঃ এই সংখ্যা অনেক। ঢাকা ডাইজেস্টে প্রথম লেখা প্রকাশিত হয়েছে এবং পরবর্তীতে পরিচিত লেখকে পরিণত হয়েছেন, তাদের মধ্যে অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা আবু রুশদ, পরবর্তী সময়ে যিনি বাংলাদেশে সামরিক ও আঞ্চলিক ভূ-রাজনৈতিক কৌশলের ওপর লেখার ক্ষেত্রে বলা যায় বিরাট পরিবর্তন এনেছিলেন। যে সময়ে সামরিক বিষয়ে লেখা স্পর্শকাতর বিবেচনা করে কেউ হাত দিতে চাইতো না, তিনি সেই অচলায়তন ভাঙেন। ঢাকা ডাইজেস্টে তাঁর প্রকাশিত ধারাবাহিক লেখাগুলো দিয়ে তিনি একাধিক গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। এর বাইরেও তিনি বেশ ক’টি বই লিখেছেন। পরবর্তীতে তিনি পেশা হিসেবে সাংবাদিকতা বেছে নেন। বর্তমানে “ডিফেন্স জার্নাল” নামে আন্তর্জাতিক মানের একটি সাময়িকী প্রকাশ করছেন। নাজমুল আলম সিজার বাংলাদেশে প্রচলিত ধরনের সায়েন্স ফিকশনের চেয়ে ব্যতিক্রমী সায়েন্স ফিকশন লিখেছেন ঢাকা ডাইজেস্টে। তাঁরও প্রথম লেখা প্রকাশিত হয়েছে ডাইজেস্টে এবং ধারাবাহিক লেখাগুলো পাঠকপ্রিয় ছিল। তিনিও ভালো লেখক হয়ে ওঠেন। মাসরুর আরেফিন ছাত্রাবস্থায় ঢাকা ডাইজেস্টে নিয়মিত লিখতেন। তিনিও এখন জনপ্রিয় লেখক, সাদাত হুসাইন নামে একজন প্রবীণ লেখক আছেন, যার কয়েকটি বই আগে প্রকাশিত হলেও তিনি লেখা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। ঢাকা ডাইজেস্টে তাঁকে লিখতে অনুপ্রাণিত করার পর তিনি নিয়মিত লিখতেন এবং এভাবে তিনি আবার বই লেখায় আত্মনিয়োগ করেন। আমলাদের মধ্যে সাবেক সচিব ড. মিয়া মুহাম্মদ আইয়ুব, মরহুম সচিব জাফর আহমেদ চৌধুরী, মরহুম সচিব মাহবুবুর রহমান (মাহবুব মোর্শেদ নামে লিখতেন), জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক ও পটুয়াখালী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর ড. আবদুল লতিফ মাসুম, নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রফেসর মাহবুবুর রহমান, প্রবীণ সাংবাদিক মীযানুল করীম প্রমুখ বিচ্ছিন্নভাবে লেখালেখি করলেও তাদেরকে নিয়মিত লেখক হিসেবে গড়ে তুলতে ঢাকা ডাইজেস্টের যথেষ্ট অবদান রয়েছে। আমি উল্লেখযোগ্য কিছু লেখকের নাম উল্লেখ করলাম, যাদের কথা এ মুহূর্তে মনে পড়ছে। এর বাইরেও ঢাকা ডাইজেস্টে লিখেই লেখক হওয়ার অনুপ্রেরণা লাভ করেছেন এমন অনেকেই আছেন, যাদের কথা স্মরণ করতে পারছি না।
জহিরুলঃ আজ আমরা যাদের খ্যাতিমান লেখক বলে জানি এমন কিছু লেখকের কথা বলুন যারা ঢাকা ডাইজেস্টে নিয়মিত লিখতেন।
মঞ্জুঃ সৈয়দ আলী আহসান, কবি আল মাহমুদ, দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, আফজাল চৌধুরী, খোন্দকার আলী আশরাফ, আবুল আসাদ, রাবেয়া খাতুন, আল মুজাহিদী, রণজিৎ কুমার বিশ্বাস, মাফরুহা চৌধুরী, আহমদ ইমরান (ভারতীয় পার্লামেন্টের সদস্য), সালাহউদ্দিন বাবর, রেজাউদ্দিন স্টালিন, রবীন্দ্র গোপ, হাসান হাফিজ, সোহরাব হাসান, হালিম আজাদ, আহমেদ ফারুক হাসান, মোহাম্মদ আবদুল মান্নান, মাসরুর আরেফিন, মতিউর রহমান মল্লিক, মুজতাহিদ ফারুকী, শাকিল রিয়াজ। পশ্চিমবঙ্গের খ্যাতিমান লেখক সৈয়দ মোস্তফা সিরাজ, আবুল বাশার ও সাংবাদিক পরিতোষ পাল, আসামের সাংবাদিক নব ঠাকুরিয়া।
জহিরুলঃ এমন জনপ্রিয় এবং শিক্ষনীয় উপাদানে সমৃদ্ধ একটি পত্রিকা বন্ধ হয়ে গেল কেন? আবার শুরু করার ইচ্ছে আছে কি?
মঞ্জুঃ একাধিক কারণে বন্ধ হয়েছে। প্রথমত: ১৯৯১ সালের বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর সংবাদপত্রের প্রকাশনার ওপর নিয়ন্ত্রণ শিথিল করে। বিশেষ করে ডিক্লারেশন পাওয়ার বিষয়টি অনেক সহজ করে দেয়। আমি নতুন ঢাকা ডাইজেস্ট-এর ডিক্লারেশন নেয়ার ক্ষেত্রে যে আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কথা বলেছি, এসব নিয়ন্ত্রণের অনেকগুলো তুলে দেয়া হয়। ডিএফপি থেকে পত্রিকার নামের ক্লিয়ারেন্স নিয়ে জেলা প্রশাসকের দফতরে গিয়ে দরখাস্ত করলেই মোটামুটি ডিক্লারেশন পাওয়া যেত। এর ফলে ঢাকা থেকেই প্রায় একযোগে অনেকগুলো দৈনিক সংবাদপত্র বের হয়। এগুলোর মধ্যে বাংলাবাজার পত্রিকা, ভোরের কাগজ, আজকের কাগজ, জনকণ্ঠ, আসে প্রথম পর্যায়ে, দ্বিতীয় পর্যায়ে আসে ডেইলি স্টার, ডেইলি ইণ্ডিপেন্ডেন্ট, প্রথম আলোসহ আরো কয়েকটি দৈনিক। এগুলোর মধ্যে কয়েকটি দৈনিক প্রতি সপ্তাহে ২/৩টা করে ফ্রি ম্যাগাজিন দিতে শুরু করে। শুধু ঢাকা ডাইজেষ্ট নয়, সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনগুলোর সাকুর্লেশনের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে। ঢাকা ডাইজেস্ট বিক্রয় নির্ভর ম্যাগাজিন ছিল। আয়ের আশি শতাংশই আসতো বিক্রয় থেকে।
দ্বিতীয় আরেকটি কারণে ঢাকা ডাইজেস্টের সার্কুলেশনের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়েছিল। আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে যে ১৯৯৬ সালে জাতীয় সংসদের দুটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ষষ্ঠ ও সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারী, যে নির্বাচন সকল বিরোধী দল বর্জন করে এবং বিএনপি এ-নির্বাচনে সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে ২৭৮ আসন পায়। ভোটারের অংশগ্রহণ ছিল মাত্র ২১ শতাংশ। এটি স্বল্পমেয়াদী একটি সংসদ ছিল। মাত্র ১২ দিন স্থায়ী ছিল এইসংসদ। ১৯৯৬ সালের ২৬ মার্চ নির্দলীয় কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থার বিধান সম্বলিত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বিল পাস করার মধ্য দিয়ে ষষ্ঠ জাতীয় সংসদের অবসান ঘটে। প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি সরকার পদত্যাগ করার পর কেয়ারটেকার সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন প্রধান বিচারপতি হাবিুবর রহমান এবং তাঁর অধীনে ১৯৯৬ সালের ১২ জুন সপ্তম জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৪৬টি আসন লাভ করে, বিএনপি পায় ১১৬টি আসন, জাতীয় পার্টি জয়ী হয় ৩২টি আসনে এবং জামায়াতে ইসলামী মাত্র তিনটি আসন লাভ করে। বলা যায় জামায়াতে ইসলামীর ভরাডুবি ঘটে এ নির্বাচনে। এর আগে ১৯৮৬ সালে অনুষ্ঠিত তৃতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াত ১০টি এবং ১৯৯১ সালে পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে জামায়াত ১৮টি আসনে জয়লাভ করেছিল। আপনার আরো একটি বিষয় জানা থাকার কথা যে জামায়াতে ইসলামী ১৯৮১ সাল থেকেই কেয়ারটেকার সরকার চালুর দাবীতে আন্দোলন করে আসছিল এবং দশ বছর পর আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি এবং আওয়ামী লীগের সাথে জোটবদ্ধ ছোট বামপন্থী দলগুলো একযোগে নির্দলীয় নিরপেক্ষ কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবীতে মাঠে নামে এবং এ দাবী আদায় হয় সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে। জামায়াত এটিকে তাদের রাজনৈতিক বিজয় বলে বিবেচনা করতো। অতএব কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে প্রথম নির্বাচন, অর্থ্যাৎ সপ্তম সংসদ নির্বাচনে তারা ৩০০ আসনে প্রাথী দেয়। জয়ী হয় মাত্র ৩টি আসনে। কিন্তু ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায় ৪৯টি আসনে জামায়াত যদি প্রাথী না দিয়ে বিএনপির প্রার্থীকে সমর্থন করতো তাহলে ওই আসনগুলোতে বিএনপি প্রাথী জয়ী হতে পারতো। অথবা বিএনপি ও জামায়াত নির্বাচনী জোট করে ওই আসনগুলোতে একক প্রার্থীকে মনোনয়ন দিতো, তাহলে বিএনপি বা বিএনপি-জামায়াত জোট সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করতো। ঢাকা ডাইজেস্ট সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগে থেকেই নির্বাচনের গতিপ্রকৃতি ও সম্ভাব্য ফলাফলের ওপর বিশ্লেষণ ও বিভিন্ন জরিপ প্রকাশ করে আসছিল এবং প্রতিটিতে নির্বাচনে জামায়াত যে ভালো করবে না, সেই পূর্বাভাস ছিল। এতে জামায়াত ক্ষুব্ধ হয়। নির্বাচনের পর আমার এক নিবন্ধে জামায়াতের কেয়ারটেকার সরকারের আন্দোলন, ৩০০ আসনে প্রার্থী দেয়া, অন্তত ৫০টি আসনে নিশ্চিত বিজয়ের আশা করা নিয়ে অতি তীর্ষক ভাষায় সমালোচনা করি। জুলাই ১৯৯৬ সংখ্যায় লেখাটি ঢাকা ডাইজেস্টে প্রকাশিত হওয়ার পর জামায়াত মহলে আমি ‘পারসন নন গ্রাটা’ হয়ে পড়ি। কিছু হুমকি-ধামকিও আসে। জামায়াত আনঅফিসিয়ালি তাদের নেতাকর্মীদের ঢাকা ডাইজেস্ট না পড়ার নির্দেশ দেয়। ইসলামী ব্যাংক, ইবনে সিনাসহ জামায়াতের নিয়ন্ত্রণাধীন কিছু প্রতিষ্ঠান বিজ্ঞাপন দেয়া বন্ধ করে। ফলে তাৎক্ষণিকভাবে আমাদের সার্কুলেশন কিছুটা কমে যায়। আয়ে ঘাটতি পড়ে। কিন্তু পরবর্তী কয়েক সংখ্যায় আমি একই ভাষায় জামায়াতের কঠোর সমালোচনা করে আমার লেখা অব্যাহত রাখি। বিশেষ করে গোটা পৃথিবীতে ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে বা অন্তবর্তীকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচন পরিচালনাকে বৈধ ভাবা হলেও বাংলাদেশে নির্বোচন পরিচালনা করতে জামায়াতের কেন কেয়ারটেকার সরকার লাগবে, এ নিয়ে আমার লেখায় জামায়াত নেতৃবৃন্দের দৈন্যতা তুলে ধরে তাদের তুলোধুনা করি। ফলে চার মাস পর ১৯৯৬ সালের অক্টোবর মাসে দৈনিক সংগ্রাম থেকে আমাকে চাকুরিচ্যুত করা হয়। পরের মাসেই আমি মতিউর রহমান চৌধুরীর সম্পাদনায় দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকায় যোগ দেই। ঢাকা ডাইজেস্টের সার্কুলেশন এবং বিজ্ঞাপনের আয়ের ওপর যে চাপ সৃষ্টি হয়েছিল তাতেও সমস্যা হচ্ছিল না। কিন্তু নিউজপ্রিন্টের দাম ক্রমাগত বেড়ে চলেছিল। ১৯৮৭ সালে ডাইজেস্ট শুরু করার সময় এক টন নিউজপ্রিন্টের দাম ছিল ১৮ হাজার টাকা, ১৯৯৮ সালে তা ৩১ হাজারে উঠে। আমরা ডাইজেস্টের দাম রেখেছিলাম দশ টাকা, তা কখনো বৃদ্ধি করিনি। ফলে ঘাটতি পোষানো যাচ্ছিল না। দৈনিক সংবাদপত্রগুলোর ফ্রি ম্যাগাজিনের পাশাপাশি ইন্টারনেট সুবিধা বিস্তৃত হওয়ায়, আমরা সার্কুলেশন বৃদ্ধির চেষ্টা করে কোনোভাবেই সার্কুলেশন বৃদ্ধি করতে পারছিলাম না। এ অবস্থায় ২০০৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকা ডাইজেস্ট বন্ধ করে দিতে বাধ্য হই। দুই বছর বন্ধ থাকার পর একটি বাণিজ্যিক গ্রুপ ঢাকা ডাইজেস্ট পুন:প্রকাশের জন্য তহবিল যোগান দিতে এগিয়ে আসে। তারা আমাকে অফিস দেয়, দু;জন সাংবাদিকসহ ৬ জন কর্মী দেয়। নতুন উৎসাহে আমরা আবার কাজ শুরু করি এবং আগের চেয়েও মানসম্পন্ন ডাইজেস্ট প্রকাশিত হতে থাকে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাণিজ্যিক গ্রুপটি বিএনপি সরকারের রোষানলে পড়ে এবং তাদের বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়। এ পরিস্থিতিতে তাদের পক্ষে ঢাকা ডাইজেস্টকে আর্থিক সহায়তা অব্যাহত রাখা সম্ভব হচ্ছিল না। ২০০৬ সালের জুলাই সংখ্যার পর ঢাকা ডাইজেস্টের প্রকাশনা বন্ধ রাখতে বাধ্য হই। ২০১৩ সাল থেকে ঢাকা ডাইজেস্ট অনলাইন-এ চালানোর উদ্যোগ নেই। দুই বছর পর্যন্ত নিয়মিত আপলোড করেছি। এরপর আর সম্ভব হয়নি। তবে এখনো পরিকল্পনা রয়েছে অনলাইনে এই জনপ্রিয় ম্যাগাজিনকে নিয়মিত করার।
জহিরুলঃ সম্পাদকদের বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ আছে তারা অচেনা লেখকদের লেখা ছাপেন না। এই বদনামের দায় ঢাকা ডাইজেস্টের সম্পাদককে কি দেয়া যাবে?
মঞ্জুঃ এ অভিযোগ আমার নিজেরও আছে। শুধু অচেনা নয়, পরিচিত ও খাতিরের লোকজনের লেখা ছাড়া স্বল্প পরিচিত ও ব্যক্তিগতভাবে অপছন্দের লেখকদের লেখাও তারা ছাপেন না। এটি একটি কোটারির মতো হয়ে গেছে। এছাড়া সংবাদপত্রগুলোর দলীয় পরিচয়ের ভিত্তিতেও কবি ও লেখকদের সম্পৃক্ত করে ফেলার প্রবণতাও দেখা যায় দৈনিক পত্রিকাগুলোর সাহিত্য সম্পাদকদের মধ্যে। কোনো সংবাদপত্রে যদি কোন একজন লেখকের লেখা প্রকাশিত হয়, তাহলে অন্য আরেকটি সংবাদপত্র তার লেখা ছাপে না। খ্যাতিমান কয়েকজন লেখকের ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম হতে পারে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সাধারণ লেখকরা সাহিত্য সম্পাদকদের সুনজরে আসেন না। ঢাকা ডাইজেস্টে আমরা অচেনা লেখকদের লেখাই বেশি প্রকাশ করেছি। মফস্বল থেকে পাঠানো কবি, লেখক যদি মোটামুটি মানের লেখাও পাঠাতেন তাহলে আমরা কিছু পরিমার্জন করে প্রকাশ করতাম। এটিও ডাইজেস্টের জনপ্রিয় হয়ে ওঠার পেছনে অবদান রেখেছে। শুধু তাই নয়, যার লেখাই ডাইজেস্টে প্রকাশিত হতো, মাসের শুরুতে প্রত্যেকের সম্মানী গুনে গুনে খামে ভরে রাখতাম। এমন বহু লেখক আছেন, যারা ঢাকা ডাইজেস্ট থেকে তাদের লেখার জন্য প্রথম সম্মানী পেয়েছেন। আমি মফস্বলের এক কবির কথা বলতে চাই। ডাকে কবিতা পাঠাতেন এবং আমি নিয়মিত তার কবিতা ছাপতাম। তাঁর নাম আবদুল হালিম খাঁ। ঠিকানা হিসেবে লিখতেন টাঙ্গাইলের ভূয়াঁপুরের এক প্রাইমারী স্কুলের নাম। একদিন লুঙ্গি-পাঞ্জাবি পড়া মলিন চেহারার মাঝবয়সী এক ভদ্রলোক ডাইজেস্ট অফিসে এলেন। বসার পর পরিচয় জানতে চাইলে বললেন, তিনি আবদুল হালিম খাঁ। ভূয়াঁপুরের এক প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক। আসলে আমি তাঁকে চিঠি লিখেছিলাম, ঢাকায় এলে যাতে দেখা করেন। তিনি এতো ভদ্র যে চোখ তুলেও তাকান না। চা-বিস্কুট খাওয়ানোর পর একটি খামে তাঁর জমা সম্মানী তুলে দিলে তিনি প্রায় কেঁদেই ফেললেন। বললেন যে, ঢাকার কোনো পত্রিকায় তাঁর লেখা ছাপা হবে তা তিনি কখনো কল্পনাও করেননি। ঢাকা ডাইজেস্ট তাঁর কবিতা ছাপানোর কারণে এলাকায় তার সম্মান আরো বেড়েছে। কিছুতেই তিনি সম্মানী নেবেন না। বেশ জোর করেই তাঁর পকেটে সম্মানীর অর্থ তুলে দিয়েছিলাম।
জহিরুলঃ বাংলাদেশের নারীবাদ আন্দোলনকে আপনি একজন সাংবাদিক হিসেবে কতটা আগ্রহ নিয়ে কাভার করেছেন। বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখেন? হুমায়ূন আজাদ বা তসলিমা নাসরিনের নারীবাদকে আপনি কিভাবে দেখেন?
মঞ্জুঃ আপনার কাছে আমার পাল্টা প্রশ্ন হচ্ছে যে, বাংলাদেশে কী আদৌ কোনো নারীবাদী আন্দোলন আছে? গত ত্রিশ বছর যাবত বাংলাদেশের সরকার ও রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে নারী নেতৃত্ব। এই ত্রিশ বছরের মধ্যে কোনো পুরুষ প্রধানমন্ত্রী হয়ে সরকার পরিচালনা করেননি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীত্ব করেছেন নারী। বিরোধী দলেও ছিলেন নারী। জাতীয় সংসদের স্পীকারও বর্তমানে নারী। ওইসব পর্যায় থেকে যখন বলা হয় বাংলাদেশে নারীরা কতো স্বাধীন এবং সর্বত্র তাদের অধিকার এবং নারী সংগঠনগুলো যখন তাদের কথা মেনে নেয় তখন নারীবাদী আন্দোলনের আর অস্তিত্ব থাকে না। কিন্তু বাস্তব অবস্থা হলো বাংলাদেশে নারীরা এখনো পিছিয়ে আছে। নারীর ক্ষমতায়ন সঠিকভাবে হয়নি। যদিও সরকারি চাকুরিতে, বিশেষ করে সিভিল সার্ভিস ও শিক্ষকতায় নারীরা যথেষ্ট এগিয়ে গেছেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মেয়েদের সংখ্যা ছেলেদের সংখ্যার কাছাকাছি এবং ফলাফলও ভালো করছে, কিন্ত সামগ্রিক বিশ্লেষণে দেখা যাবে বাংলাদেশে রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও প্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রে নারীরা পিছিয়ে আছে। বাংলাদেশের মূল সংবিধানে জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত নারী আসন রাখা হয়েছিল ৩০টি, যা ১৫ বছর বহাল থাকবে বলে বলা হয়েছিল। সংবিধান প্রণেতারা আশা করেছিলেন যে, ১৫ বছরের মধ্যে নারীরা যথেষ্ট এগিয়ে আসবেন এবং তাদের জন্য সংরক্ষিত আসনের প্রয়োজন পড়বে না। তারা পুরুষদের মতোই সরাসরি নির্বাচনে অংশ নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সংসদে আসবেন জনগণের প্রতিনিধিত্ব করতে। কিন্তু তা হয়নি। সংরক্ষিত নারী আসনের ১৫ বছরের মেয়াদ শুধু বৃদ্ধি করা নয়, সংরক্ষিত নারী আসন ৩০ থেকে ৪৫ এ উন্নীত করা হয়েছে এবং দাবী উঠেছে সংরক্ষিত নারী আসন ৬০ এ উন্নীত করার। বাংলাদেশকে সোনার বাংলায় পরিণত করার যা যা স্বপ্ন দেখা হয়েছিল, তা পূরণ হয়েছে বা হচ্ছে, কিন্তু সংসদকে সংরক্ষিত নারী আসন মুক্ত করার স্বপ্ন পূরণ হয়নি। সংরক্ষিত সুবিধা মানুষকে এবং ব্যাপক অর্থে সমাজকে কলুষিত ও দুর্নীতিগ্রস্থ করে। রাজনীতি সচেতন সকলের মনে থাকার কথা যে, সংসদের সংরক্ষিত ৩০টি আসনে মনোনীত হওয়ার জন্য প্রতিযোগিতায় সংশ্লিষ্ট নারীরা প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদকে তুষ্ট করতে কী কী করেছেন। এর ওপর লিখে প্রবীণ সাংবাদিক শফিক রেহমানকে গ্রেফতার এড়াতে দেশ থেকে গোপনের পালাতে হয়েছিল এবং তাঁর সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন যায় যায় দিন নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। এখন হয়তো এরশাদ নেই, কিন্তু সংরক্ষণ ব্যবস্থা থাকলে সংসদ সদস্য হওয়ার মতো লাভজনক পদে মনোনয়ন লাভের জন্য উমেদারদের একটি অংশ যে দুর্নীতির আশ্রয় নেবেন তাতে সন্দেহ নেই। নারীর ক্ষমতায়ন সঠিকভাবে হলে এই সংকট সৃষ্টি হতো না। এসব সত্বেও আমি বলবো যে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে সাধারণভাবে নারীরা যেভাবে শোষিত ও বঞ্চিত, তার তুলনায় বাংলাদেশে নারীদের অবস্থান ভালো। কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য, যৌন শিকারে পরিণত করা, সামাজিকভাবে দমিয়ে রাখার প্রবণতা বাংলাদেশেও বিদ্যমান, যা দূর করতে নারী সংগঠনগুলোর আরো সক্রিয় ভূমিকা পালন করা প্রয়োজন।
আমার সাংবাদিকতার ক্ষেত্র কখনোই নারীবাদ ছিল না। আমি মূলত রাজনীতি, অর্থনীতি ও জাতীয় সংসদ কভার করতাম। এসব ক্ষেত্রে নারী প্রতিনিধিদের কোনো ভূমিকা থাকলে সেগুলোকে প্রাপ্য কভারেজের চেয়েও বেশি গুরুত্ব দিতাম এই বোধ থেকে যে, পনের জনের মধ্যে তো মাত্র একজন নারী কথা বলেছেন, অতএব তিনি অনেক পুরুষ প্রতিনিধির চেয়ে অনেক বেশি কভারেজ পাওয়ার অধিকারী। তসলিমা নাসরিন ও হুমায়ুন আজাদের যে নারীবাদী বক্তব্য তা পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীর হীন অবস্থান এবং বিভিন্ন ধর্মের বিধিবিধানে নারীকে সীমিত গণ্ডিতে রাখার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। তসলিমা নাসরিন এক্ষেত্রে শুধুমাত্র ইসলাম ধর্মের ওপর তার বিষোদগার করেছেন এবং বিদ্বেষপ্রসূত কথা বলেছেন। তিনি নারীর সম-অধিকার প্রতিষ্ঠার পক্ষে কথা বলতে গিয়ে কোরআন-হাদিস সংশোধন, বোরকা পুড়িয়ে ফেলার আহবান জানিয়েছেন। তিনি মুসলিম দেশগুলোতে ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠার জন্য একমাত্র পথ হিসেবে ইসলামের কঠোর সমালোচনায় অবতীর্ণ হতে বলেছেন। পক্ষান্তবে হুমায়ুন আজাদ একাডেমিক আলোচনা করেছেন। নারীবাদী বলতে তিনি সোজাসাপ্টা বলেছেন: “যিনি নারী-পুরুষের সাম্যে ও সমান অধিকারে বিশ্বাস রাখেন তিনিই নারীবাদী। নারীকে মনে রাখতে হবে, সে মানুষ, নারী নয়। নারী তার লৈঙ্গিক পরিচয় মাত্র। ক্রোমোজমের পার্থক্যের কারণে একজন প্রভু আরেকজন পরিচারিকা হতে পারে না,” ইত্যাদি। উভয়েই নারীর সাথে বৈষম্যের বিষয় আলোচনা করতে প্রধানত প্রাচ্যের দিকে, বিশেষত ইসলামের দিকে বাঁকা দৃষ্টিতে তাকিয়েছেন। কিন্তু ইতিহাস বলে যে, পাশ্চাত্যে নারীরা প্রাচ্য দেশগুলোর চেয়ে আদৌ কম নিগৃহীত ছিল না। মধ্যযুগীয় ইউরোপে নারীর শিক্ষালাভ ও সরকারি দায়িত্বে অংশগ্রহণ করার অধিকার ছিল না। তাদের কাজকর্ম গণ্ডিবদ্ধ ছিল ঘরে। তাদেরও মাথা আবৃত করে রাখতে হতো, স্বামীরা স্ত্রীকে বিক্রয় করে দেয়ার অধিকার রাখতো, ঊনবিংশ শতাব্দীতে তাদের ভোটের অধিকার ছিল না। এমনকি স্বামীর অনমুতি ছাড়া সন্তানের ব্যাপারেও কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারতো না। পাশ্চাত্যকে “সম-বেতন আইন” করতে হয়েছে ১৯৬৩ সালে। একথা সত্য যে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীর অর্থনৈতিক, শারীরিক, সামাজিক বৈষম্য সৃষ্টি করে রাখে, ফলে তাদের মানসিক বিকাশের পথ অবরুদ্ধ থাকে। তসলিমা নাসরিন যেসব গ্রন্থ রচনা করেছেন সেগুলোতে নারীকে তুলে ধরতে গিয়ে সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও উত্তাপ সৃষ্টি করেছেন, যা কোনো বিচক্ষণ মানুষের কাজ হতে পারে না। তাঁর ভূমিকা তার প্রতিপক্ষকে উগ্র করেছে এবং নারী স্বাধীনতার কথা বলতে গিয়ে নারীকে আরো অবদমনের পথ খুলে দিয়েছে। আমার মনে আছে নব্বইয়ের দশকে তাঁর সমালোচনা করতে গিয়ে একজন লেখক তাকে “ইন্টেলেকচুয়াল প্রস্টিটিউট” বলে উল্লেখ করেছিলেন, কারণ তিনি তাঁর মেধাকে সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে সমাজে সংস্কার আনার কোনো হিতোপদেশ দেননি।
জহিরুলঃ বৃহত্তর ময়মনসিংহ এলাকা শিল্প-সাহিত্যে বেশ সমৃদ্ধ, অনেক বিখ্যাত লেখকের জন্ম হয়েছে আপনাদের অঞ্চলে। আপনার কাছ থেকে ময়মনসিংহ অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ লেখক, শিল্পীদের একটি আউটলাইন জেনে নিতে চাই। আপনার বিবেচনায় কারা অধিক গুরুত্বপূর্ণ এবং কারা বিখ্যাত বা জনপ্রিয় হয়েছেন কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ নয়?
মঞ্জুঃ শুধু শিল্প-সাহিত্য নয়, অনেক দিক থেকেই ময়মনসিংহ বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ জিলা। যদিও ছোটবেলায় শুনেছি “হাওড় জঙ্গল মোষের সিং, এই তিনে ময়মনসিং।” কিন্তু বাস্তবে এই তিনটি ছাড়াও ময়মনসিংহের বৈচিত্র সীমাহীন এবং ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ। এ জেলার রাজনৈতিক অবদান সীমাহীন। স্বাধীন বাংলাদেশে ঊনিশজন রাষ্ট্রপতি হয়েছেন, তাদের পাঁচ জনই বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার। ব্রিটিশ আমলে ব্রহ্মপুত্র নদীর উত্তর থেকে গারো হিলস, যা বর্তমানে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের অন্তর্গত, সেই এলাকাকে নিয়ে “আদিস্তান” নামে একটি পৃথক রাষ্ট্র গঠনের আন্দোলন করেছিলেন ময়মনসিংহের তিন নেতা। যাদের মধ্যে রবি নিয়োগী ও জলধর পালের নাম আমার মনে আছে। রবি নিয়োগী শেরপুরের মানুষ, ব্রিটিশ সরকার যাকে দ্বীপান্তরের শাস্তি দিয়েছিল এবং তিনি দীর্ঘদিন আন্দামানের কুখ্যাত সেল্যুলার কারাগারে বন্দী ছিলেন। পাকিস্তান আমলের অধিকাংশ সময় তিনি কারাগারে কাটিয়েছেন। তার স্ত্রীও কারাগারে কাটিয়েছেন দীর্ঘদিন। তাদের ছোট ছেলে কাজল নিয়োগী স্কুলে আমার সহপাঠি ছিল, তার জন্ম হয়েছে কারাগারে। এ ছাড়াফকির বিদ্রোহ, সন্যাসী বিদ্রোহ, টিপু পাগলার বিদ্রোহের সূতিকাগার ছিল ময়মনসিংহ।
শিল্প -সাহিত্যের কথা বলতে গেলে “ময়মনসিংহ গীতিকা”র কথা বলবো। বিক্ষিপ্তভাবে মহুয়া, মলুয়ার কাহিনি পাঠ করলেও দীনেশ চন্দ্র সেন সংকলিত পুরো ময়মনসিংহ গীতিকা পড়ার সুযোগ পাই সম্ভবত আমি যখন দশম শ্রেনিতে পড়ি তখন। প্রতিটি কাহিনির বর্ণনার সরলতায় মুগ্ধ হয়েছি। ছোটদের জন্য লিখেছেন উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী ও সুকুমার রায়। তাদের গল্প পড়ার বহু পর জানতে পেরেছি যে তারা ময়মনসিংহের মানুষ। মীর মোশাররফ হোসেন কুষ্টিয়ার মানুষ হলেও কর্মজীবন কাটিয়েছেন টাঙ্গাইলে এবং তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ “বিষাদ সিন্ধু” প্রথম ছাপা হয়েছে শেরপুরের জগৎ প্রেসে। গিরিশ চন্দ্র সেনের কোরআনের বঙ্গানুবাদও জগৎ প্রেসে ছাপা হয়েছে বলে শুনেছি। তবে এ সম্পর্কে আমি নিশ্চিত নই। পরবর্তী সময়ে যাদেরকে সরাসরি দেখার ও তাদের বই পড়ার সুযোগ পেয়েছি তাদের মধ্যে লেখক ও রাজনীতিবিদ আবুল মনসুর আহমদ, সৈয়দ আবদুস সুলতান, খন্দকার আবদুল হামিদ উল্লেখযোগ্য। গোলাম সামদানী কোরায়শী সর্বজন পরিচিত সাহিত্যিক। ইব্রাহিম খাঁ একইসাথে শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক হিসেব পরিচিত নাম। সাহিত্যের জগতে দুই উজ্জ্বল নক্ষত্র নির্মলেন্দু গুণ ও হুমায়ুন আহমেদ তাদের অবদানের কারণেই দেশজোড়া খ্যাতি পেয়েছেন। বিতর্কিত লেখিকা তসলিমা নাসরিন শুধু বাংলাদেশে নয়, নারীবাদী হিসেবে পাশ্চাত্যেও সুপরিচিত। এছাড়াও নাম উল্লেখ করতে পারি ড: আশরাফ সিদ্দিকীর, হেলাল হাফিজ, রফিক আজাদ, আবিদ আজাদ, সাযযাদ কাদীর, মোশাররফ করিম, রাহাত খান, মাহবুব সাদিক, মাহবুব হাসান, খালেকদাদ চৌধুরী, মাহবুব আনাম, মাহফুজ আনাম, রেজওয়ান সিদ্দিক প্রমুখের। শিল্পীদের মধ্যে যাদুকর পিসি সরকার,অভিনেতা ও চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়, উৎপল দত্ত খ্যাতির অধিকারী। শিল্পাচার্য খ্যাত জয়নুল আবেদিন ময়মনসিংহের অহঙ্কার। স্যার জগদিশ চন্দ্র বসু, খ্যাতনামা লেখক শীর্ষেন্দু মুখোপ্যাধ্যায়ের পৈতৃক নিবাস ময়মনসিংহে। বাংলা চলচ্চিত্রে আনোয়ার হোসেন ও আমজাদ হোসেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন, তারাও ময়মনসিংহের। এর বাইরেও আরো অনেকে আছেন, যারা বাংলা সাহিত্যে অবদান রেখেছেন, তাৎক্ষণিকভাবে তাদের নাম স্মরণ করতে পারছি না। আমি যাদের নাম উল্লেখ করেছি, তারা প্রত্যেকে নিজ নিজ কাজে স্বকীয়তার ছাপ রেখেছেন এবং অধিকাংশ ব্যক্তিই তার অবদান অনুযায়ী জনপ্রিয়। কাউকে আমি খাটো করে দেখতে চাই না। একজন যদি আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ বা পছন্দনীয় না হন, তাহলেও অনেকের কাছে তিনি তাঁর কাজের মধ্য দিয়েই গুরুত্বপূর্ণ।
সাক্ষাৎকারটি পড়তে গিয়ে মাঝে মাঝে ট্রেনের লাইনচ্যুতির মতো করে খেই হারাচ্ছিলাম। ভিন্ন ভিন্ন প্রসঙ্গের বিচিত্রপূর্ণ দীর্ঘ এই সাক্ষাৎকারটিতে একাধারে অনেকগুলো বিষয় হুবহু উঠে এসেছে। স্মৃতি বিজড়িত স্মৃতির পাতার অনেককিছু রোমন্থন করতে গিয়ে থেমে থেমে নিজের মাঝে নিজেই হারিয়ে যাচ্ছিলাম। খুব ভালো লাগলো, মোহিত ও হলাম বেশ। কবি কাজী জহির ভাই ও মনজু ভাই দু'জনকেই অনেক ধন্যবাদ।
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ আপনার সুন্দর ও গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্যের জন্য। অনেক শুভকামনা ও ভালোবাসা।
Delete