Skip to main content

শিল্পী কাজী রকিবের সাক্ষাৎকার

নন-একাডেমিক শিল্পীরাই নতুন কিছু দেয়

-  কাজী রকিব 


[কাজী রকিব বাংলাদেশের একজন গুণী শিল্পী। রাজশাহী আর্ট কলেজের একজন প্রতিষ্ঠাতা-শিক্ষক। কলেজের প্রথম ক্লাসটি নেবার কৃতিত্বও তাঁর। নিরন্তর ছবি আঁকেন। নানান মাধ্যমে, নানান ভাবনার ছবি। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে সস্ত্রীক বসবাস। তার স্ত্রী মাসুদা কাজীও একজন গুণী শিল্পী। বৈচিত্রপ্রিয় এই শিল্পীর একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন কবি কাজী জহিরুল ইসলাম। ধারাবাহিকভাবে তা এখানে প্রকাশ করা হবে। আজ উপস্থাপন করা হলো প্রথম পর্ব।]




 

জহিরুলঃ বেশিরভাগ শিল্পীই নিজের একটা স্টাইল তৈরি করেননিজস্বতা যাকে আমরা বলি। আবার কেউ কেউ একই ধরণের ছবি বারবার আঁকেন। আপনার কাজে বৈচিত্র খুব বেশিএতে করে "টাইপড" অপবাদ থেকে আপনি মুক্ত কিন্তু নিজের একটি স্টাইল তৈরি করতে না পারা বা তৈরি হয়নি বলে কি আক্ষেপ হয়নাকি এই যে ভার্সেটিলিটি এটাই আপনি বেশি উপভোগ করেন

 

রকিবঃ আমি আসলে আলাদা করে ভাবিনি এই স্টাইল বিষয়ে। কারো মতো আঁকারও চেষ্টা করিনি তেমন ভাবে। অল্প বয়সে, আমার ১৯/২০ বছর বয়সে, সালভাদর দালির মতো আঁকতে চেষ্টা করেছিলাম কিছুদিন । আমাদের একটা গ্রুপ ছিলো "ঢাকা পেইন্টার্স" নামে। আমরা দশজন সদস্য ছিলাম তাতেলক্ষ্য স্থির করেছিলাম পরাবাস্তব ছবি আঁকবো। 

 

জহিরুলঃ সেই দশজনের নাম মনে আছে?

 

রকিবঃ আছে। কাজী রকিবউত্তম দেতরুণ ঘোষনজরুল হোসেনদিপা হকশাহনাজ কুহুফাউজুল কবিরবিমল বনিকসুকুমার পালমাসুদুল আলম।

 

তো দেশ নতুননানান চিন্তা তখনকার তরুনদের মধ্যে। আমাদের সদস্য দিপা হক আমাদের ব্রেঁত পড়েশোনাতো। আমরা উদ্ভুদ্ধ হই। বছর তিনেক ছিলো সেটা তারপর থেমে যায়। ঐ সময়টাতেই আমি দালি-আচ্ছন্ন ছিলাম। এরপর আমার মতোই আঁকিকিন্তু ইম্প্রেশনিস্টরা মনে হয় সামনে ছিলো। কিছুকাল ছিল টার্নার। এই আমা মুগ্ধতার সময়কাল। পিকাসো ও জ্যাক্সন পোলক আমার সবসময় প্রিয়। এর পর মিরো। কিন্তু এদের মতো আমি আঁকতে চাইনি। এদের দেখতে এখনো ভালো লাগে। আর লাগে ভ্যান গঘ ও গঁগ্যা। এরা সব পছন্দের শিল্পী। আমি যখন যা চেয়েছি, এঁকেছি। কখনোই স্টাইল নিয়ে ভাবিনি। নানান ভাব নানান রূপে এসেছে তাই নানান রূপেই আমার কর্মকান্ড দেখা গিয়েছে। স্টাইল অটোমেটিক বিষয়। একবার গুলশানে একজন আমার করা টাইলে পোর্সেলিন রং দিয়ে আঁকা এক চিলতে কাজ কোন এক বাড়ির দেয়ালে দেখে আমাকে তার ভালো লাগার কথা জানায়। কাজটা ছিলো লম্বা, খাড়া ভাবে ডিসপ্লে করা, ১ ফুট বাই ১৪ ফুট। একেবারে রাস্তার উপরেও নয়। আমি জিজ্ঞেস করিসাইন দেখেছেন? আমি জানি খুব ছোট করে সাইন করেছিলাম। তিনি বলেন সাইন দেখতে পাননিকিন্তু আমার কাজ চিনতে পেরেছেন। তিনি বলেন, আপনার কাজ চেনা যায়। এটা হলো ক্যারেক্টার। আমি বিশ্বাস করি নিয়মিত কাজ করলে যদি নিজের প্রতি বিশ্বস্ততা থাকে তাহলে কাজের একটা চরিত্র ফুটে ঠে। 

 

জহিরুলঃ আর স্টাইল?

 

রকিবঃ স্টাইল খুব প্রয়োজনীয় বিষয়। দ্রুত চিনতে পারা যায়। কারো যদি চরিত্র ও স্টাইল একসাথে প্রকাশ পায় সেটা খুবই ভালো বিষয়। তবে অনেকে একই রকম ভাবে পুনরাবৃত্তি করে একটা স্টাইল দাড় করানতখন তিনি আটকে যান। অনেক সময় স্টাইল সব কথা বলতে সাহায্য করে না। কখনো কখনো বাঁধা হয়েও দাড়ায়। শিল্পী আটকে যান। পুনরাবৃত্তি ছাড়া তার আর গতি থাকে না। 

 

মার্কেট থিয়োরিতে স্টাইল খুব দরকার। এটা আসলে ব্রান্ডিং। ছবি যারা ক্রয় করেন তারাও নিশ্চিন্ত হন। বেচাকেনার জগতে ব্রান্ডিং অপরিহার্য। আমি সে পথে হাটিনি। ছবি বিক্রি হলে খুশি হই। দুইটা টাকা পকেটে আসে। কিন্তু বিক্রি করতে হবে সেটা আমার মনে হয়নি। দীর্ঘকাল নিয়মিতভাবে কাজ করলে কাজ এবং আগ্রহী মানুষের চেনাজানা হয়ে যায়।

 

জহিরুলঃ বলছেন সিরিজ আঁকায় আপনার আগ্রহ নেই?

 

রকিবঃ খুব বেশি সিরিজ আমি আঁকিনি। সিরিজ আঁকলে অবশ্য ঐ সময়টা একই ধারায় কিছু কাজ হয়। যেমন আমার শিফন সিরিজ। ২০১৫ তে আমি এটা করেছিলাম। প্রায় সবগুলি একই ধাঁচের। এছাড়া পানি, পাখি ও বৃষ্টিনিয়ে আমি অনেক কাজ করেছি জীবনের নানান সময়েসেগুলি একই ধাঁচের না। 

 

স্টাইল নিয়ে আমার কোন আক্ষেপ বা সুখ কিছুই নাই। আমি নানান ম্যাটেরিয়ালে কাজ করতে ভালোবাসিম্যাটেরিয়াল নিজেই চরিত্রগুণে অন্য ম্যাটেরিয়াল থেকে আলাদা হবেই।

 

জহিরুলঃ স্যুরিয়ালিজমকিউবিজম, ইম্প্রেশনিজম, পপ আর্ট ইত্যাদি নানান রকম শিল্পের আন্দোলন এসেছেসাধারণ দর্শকশিল্পপ্রেমিক মানুষদের জন্য অনুগ্রহ করে যদি একটু বলেনআমরা একটি ছবি দেখে কি করে বুঝবো এটি কোন ধারার ছবি?

 

রকিবঃ শেষেরর দিক থেকেই আসি। কি করে বোঝা যাবে এটি কোন ধারার ছবিসেটা বোঝার জন্য যতগুলি ইজম বলেছেন আধুনিক চিত্রকলার, তারচেয়ে বেশি আমরা দেখিরেনেসাঁ যুগের আগে-পরের ছবিতেও। এর জন্য প্রচুর বইপত্র লেখা হয়েছে নানা ভাষায়। লাইব্রেরিতে আছে। সেসব জ্ঞানের কথাশিল্পকলার জ্ঞানের জন্য বইপত্র পড়তে হবে। তবে শিল্পকর্ম দেখার জন্য অর্থাৎ রস গ্রহনের জন্য দেখার বিকল্প নাই। আমরা যখন ছবি দেখি আমাদের দেখার অভিজ্ঞতার আলোকেই দেখি। একটা সংক্ষিপ্ত ধারনা থেকে ইজম বুঝে যাওয়ার কোন উপায় নাই। যেমন ধরুণ স্বপ্নের মতো পরিবেশের বাস্তবের মতো অতিবাস্তব সবই পরাবাস্তব ন। স্যুরিয়েল ধারণার আগেও গয়া এমন কাজ করেছেন। আসলে সব ইজমই সবার দৃষ্টি কাড়ে না। যত বিখ্যাত ধারাই হোকনা কেন দর্শকের মনে না ধরলে এর কোনো মূল্যই নাই তার কাছে। এটা খুবই স্বাভাবিক। দোষের কিছু না। এই জগতে সৃষ্টিকর্তার সব সৃষ্টিও সবার মন কাড়ে না। প্রত্যেক মানুষের ভিতরে এক ভিন্ন জগৎ আছে তার কাছাকাছি কিছু দেখতে পেলে সে শিহরিত হয়। দাড়িয়ে পরেঅবলোকন করেকোনো না কোনোভাবে পরিচিত মনে হয়। 

 

জহিরুলঃ আপনি প্রায়শই বলেনপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহন করেননি এমন শিল্পীদের কাজের প্রতি আপনি অধিক আগ্রহীএর কারণ কি?

 

রকিবঃ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা একপ্রকার ঐক্য দান করে। এই ঐক্য আমাদের প্রচলিত দেখার অভিজ্ঞতার খুব কাছের। যারা একাডেমিক নন তাঁরা প্রকাশ ভঙ্গি সন্ধান করেন নিজের ভিতরেইফলে ভিন্নতা পাই সেখানে। তাদের অনেক বেশি সময় হয়তো লাগে এই অনুসন্ধানে। এমনকি অনেক সময় যে মিডিয়ামে কাজ করেন সেই মিডিয়ামও প্রয়োগ করেন নিজের মতো করেই। তারা নিবেদিত শক্তিশালি শিল্পী হলে নতুন ধারার জন্মদান করেন। ভ্যানগঘ বা গঁগ্যা এমন শিল্পীতারা একাডেমিক ননপ্রথম জীবনে অন্য কিছু করেছেন বা করার চেষ্টা করেছিলেন। নিজের অতৃপ্তি তাদের শিল্পকলায় নিয়ে আসে। ভ্যা গঘের অন্য চেষ্টা স্থায়ী হয়নি বা ব্যর্থ হয়েছিলোগঁগ্যা প্রতিষ্ঠিত ব্যাংকার ছিলেনস্টক মার্কেটে লগ্নি করেছিলেন। একডেমিকদের ভিন্নতা থাকা সত্বেও চেনার ক্ষেত্রে অভ্যস্ততা আছেস্বশিক্ষিতরা নতুন কিছু দেখায়। যে সমাজে ননএকাডেমিক শিল্পীর সংখ্যা বেশি সেই সমাজের শিল্পকলার বৈচিত্র তত বেশি। আমাদের দেশে একাডেমি বা সরকারী শিল্পকলা-প্রতিষ্ঠান সবই একাডেমিক পন্ডিতগণের নিয়ন্ত্রণে থাকায় অনেক সময়ই স্বশিক্ষিত শিল্পীরা অবমূল্যায়িত হয়েছেন বা হচ্ছেন। তবে দিন পাল্টাচ্ছেখুব সম্প্রতি কবি শামসেত তাবরিজির আঁকা দেখে আমি মুগ্ধ। 

 

জহিরুলঃ আজকাল সবাই এক্রেলিকে আঁকতেই পছন্দ করেনদ্রুত শুকিয়ে যায় বলে তাড়াতাড়ি কাজ করা যায়আর কি সুবিধা এক্রেলিকে আধুনিক এক্রেলিক ছাড়াজলরতেলরয়ের কথা আমরা জানি,আর জানি চারকোলপেন্সিলের কথা। আরো কি রং/কালি আছে যা শিল্পীরা কাগজে বা ক্যানভাসে ছড়াতে পছন্দ করেনআপনার পছন্দের রং কোনটি? কোনটিতে আপনি অধিক স্বচ্ছন্দ?

 

রকিবঃ এক্রেলিক সাম্প্রতিক মাধ্যমদ্রুত শুকায় এজন্য হয়তো অনেকের পছন্দ। আবার দ্রুত শুকায় বলে অনেকেরই অপছন্দের। মিডিয়ামের ইতিহাস আছেতারপরও কিছু মিডিয়াম নতুন মিডিয়াম আসার পরও প্রচলিত থাকেজনপ্রিয়ও থাকে। যেমন তেলরং এবং আরও প্রাচীন টেম্পারা রং এখনো প্রচলিত। টেম্পারার কথা হয়ত তেমন শোনা যায় না কিন্তু তেলরং এখনো জনপ্রিয়। এক্রেলিকের আবিষ্কার ১৯৩৪ সালেশিল্পীরা ব্যাবহার শুরু করেন ১৯৪০ সালে। এর স্বচ্ছতাজলরং বা তেলরংয়ের মতো আঁকতে পারা এবং টেক্সচার দেয়ার সুবিধা,পাতলা প্রলেপ ও ভারী করে দেয়ার ক্ষমতাই এই মাধ্যমকে জনপ্রিয় করেছে। দ্রুত শুকিয়ে যাওয়া যারা অপছন্দ করেন তাদের জন্য ধীরে করার মিডিয়ামও আছে। আমার নানা সারফেসে আঁকার অভ্যাসতাই সারফেসের উপযোগী মাধ্যমই আমার পছন্দের, যেমন আমি কাঁচে কাজ করিসেখনে কালিজলরং বা এক্রেলিক চলবে নাআমি ব্যাবহার করি এচিংয়ের জন্য এসিডপেইন্টের জন্য সচ্ছ রেজিন-বেজড রং। এক্রেলিক কাচে বসেকিন্তু আমি তা ব্যাবহার করি না, কারণ কাচের স্বচ্ছতা সেখানে নষ্ট হয়। স্বচ্ছ থাকার জন্য বা আলোর সহজ প্রবেশের জন্যই কাচকে সারফেস হিসাবে বেছে নেয়া। এছাড়া কাগজে পেন্সিল, কালি-কলমজলরংক্যানভাসে এক্রেলিক ও অয়েল। একসময় কাঠের পাটায় এগ-টেম্পারায় আঁকতাম। শিল্পী শহীদ কবির তখন এগ-টেম্পারায় কাজকরতেন। তার কাজে আমি ও আমার বন্ধুরা উদ্বুদ্ধ হয়েছিলাম। ১৯৭৬ থেকে ১৯৮২ পর্যন্ত আমি টেম্পারায় কাজ করেছি। শিল্পী তরু ঘোষ আর আমি ১৯৭৯ থেকে ১৯৮১ পর্যন্ত এক বাড়িতে বসবাস করতাম রাজশাহিতে। আমরা তখন টেম্পারায় আঁকতাম, কাঠের পাটায় ডিমের কুসুম ও গুড়া রং দিয়ে। ওই সময় শিল্পী তরু ঘোষ অসাধারণ কিছু ছবি এঁকেছিলেন । 

 

 

জহিরুলঃ ভ্যান গো শুধু স্ট্রোক দিয়ে ছবি আঁকতেনকাজটি তো বেশ কঠিন। তিনি অল্প বয়সেই আত্মহত্যা করেনমাত্র পঁয়ত্রিশেই জীবন শেষ। ১৮৮১ থেকে ১৮৯০ এই ৯ বছরে তিনি ৯০০ পেইন্টিং এবং ১১০০ ড্রইং করেনমান তো আছেইসংখ্যার দিক থেকেও যথেষ্টইতাই নয় কি?

 

রকিবঃ ভ্যানগঘ আঁকতেন স্ট্রোকেনিশ্চয়ই কঠিন ছিলো না তার কাছে। তিনি নিজেই এই পদ্ধতি বেছে নিয়েছিলেন। তার আবেগ প্রকাশে হয়তো এই পদ্ধতি সহজ বা একমাত্র ছিল। একটা কথা মনে রাখা দরকার অন্যের নির্দেশ ছাড়া কেউ কোনোদিন অপছন্দের টেকনিকে কাজ করে না। তিনি কখনোই কোনো কমিশন-কাজ করেন নাইসুতরাং যা করেছেন নিজের ইচ্ছায়ই করেছেন। ৩২৪০ দিনে ২০০০ কাজ করা খুব কঠিন কাজ না। ড্রইয়ে সময় খুব কম লাগে। গড়ে বছরে ১০০ ছবি মানে গড়ে মাসে ৮টির একটু বেশি। খুব কঠিন কিছু না কারণ তিনি বৈষয়িক ছিলেন না। কিছু অসুস্থতা থাকা ছাড়া ছবিই এঁকেছেন। এমন কি এসাইলামে থেকেও ছবি এঁকেছেন। আমি পরিসংখ্যানের দৃষ্টিকোণ থেকে উপরের কথাগুলো বললাম মাত্র। কিন্তু অদম্য প্রেরণা ছাড়া এটা সম্ভব না। মানুষের মুডের ব্যাপারও থাকে। তিনি সকালেই চলে যেতেন ল্যান্ডস্কেপ আঁকতেতারপ ফিরে স্টিল লাইফ বা পোর্ট্রেট। এতটা প্রতিদিন পারা সম্ভব ভাবা যায় না। আমার মনে হয় এই চাপটা নিতে পারছিলেন না আর। মানুষের বেঁচে থাকার তীব্র ইচ্ছা থাকলে সে বিশ্রাম নেয় জীবনী শক্তি বাড়িয়ে নিতে। নজরুলের পাগলের মতো সৃষ্টির কারণে রবীন্দ্রনাথ তাকে ধীর হতে বলেছিলেন। 

 

জহিরুলঃ একটি ছবি কি কি কারণে খুব বিখ্যাত হয়ে যায়ভ্যান গোর স্টারি নাইট এত বিখ্যাত হয়ে গেলো কেন?

 

রকিবঃ কি করে বিখ্যাত হয় আমার সে তত্ব জানা নাইতো কোনো কারণে আলোচনার বিষয় হয়ে ঠে। অনেক সময় পবর্তিতে সংগ্রাহক নিজের জন্যই এর খ্যাতি করতে থাকেন। ভ্যান গঘের কাজ পৃথিবীর বিখ্যাত মিউজিয়ামের সংগ্রহে আছেএদের আয় দর্শকদের ভিজিট ফি থেকেতারা চায় মানুষ আরো বেশি আসুক। কিন্তু আপনি শুধু স্টারি নাইটের কথা বললেনআমার কাছে তার গমক্ষেতের শেষ বিকালের ছবিটা আরো প্রাস্পর্শী মনে হয়হলুদ গমক্ষেতে নীলাকাশে কালো পাখিরা উড়ছেএটাই তার শেষ ছবি। তিনি কি পাখিদের মতোই আকাশে চলে যেতে চেয়েছিলেন? তার আত্মপ্রতিকৃতি, নিজ বিছানা বা চেয়ারে পাইপ, পটেটো ইটার, ক্যাফে ট্যারেস এট নাইট, সানফ্লাওয়ারহলুদে আঁকা কি অপূর্ব কাজ।  

 

জহিরুলঃ লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির মোনালিসা কোন বৈশিষ্ট্যের কারণে এত বিখ্যাত হয়অনেকের মতে টি তার নিজের প্রতিকৃতিএটি কি একটি কারণ?

 

রকিবঃ লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির সবচেয়ে বিখ্যাত ছবি মোনালিসা। তার আরো আরো ভালো কীর্তি এই মোনালিসার খ্যাতির আড়ালে হারিয়ে গেছে। মোনালিসা ছোট আকারের(৩০x১ ইঞ্চি) প্যানেল বোর্ডে আঁকা। কোমল আলো-ছায়ায় আঁকা প্রতিকৃতি। থেমে থেমে প্রায় ১৪ বছর (১৫০৩-১৫১৭) ধরে আঁকা। এই লম্বা সময়ে বার বার আঁকা ও রেখে দেয়ার মধ্যবর্তি সময়ে শিল্পীর মনে নানা চিন্তা বৈজ্ঞানিক বা গাণিতিক ভাবনা কাজ করেছেবিভিন্ন ধাপে তার ছায়া পড়েছে। মোনালিসা ভিঞ্চির নিজের প্রতিকৃতি না এবং এটি বিখ্যাত হওয়ার কারণ না। এটি গিওকন্ড সাহেবের স্ত্রী লিসার প্রতিকৃতি। 

 

জহিরুলঃ ফ্রান্সেস্কা ডেল গিওকন্ডের স্ত্রী ইতালির বিখ্যাত নারী লিসা জেরারদিনি।

 

রকিবঃ হ্যাঁ। ১৫১৯ সালে লিওনার্দোর মৃত্যু পর্যন্ত ছবিটি তার স্টুডিতেই ছিলো। এরপর ফরাসী রাজা ফ্রাঁসোয়া(King Farcois) তার ফন্টেনব্ল (Fontainebleau) প্রাসাদে রাখেন। সেখানে প্রায় শতাব্দীকাল থাকার পর রাজা লুই তার ভার্সাই এর গ্রান্ড প্যালেসে রাখেন। এরপর নেপোলিয়ন তার শয়ন কক্ষে রাখেন ল্যুভ মিউজিয়ামে আনা হয় ফরাসী রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি হিসাবে। ল্যুভে আসার পরই সাধারণের দেখার সুযোগ হয়। ফরাসী জনগন এর প্রেমে পড়ে যায়। অনেকে মিউজয়ামের ঠিকানায় লিসার উদ্দেশে চিঠি লেখে। মোনালিসার নামে পোষ্টবক্স আছে। ১৯১১ সালে ল্যুভ থেকে চুরি হয়ে যায় এই ছবি। দুই বছর পর উদ্ধার করা হয় মোনালিসাকে। পিকাসো ও এপোলিনিয়র সন্দেহের তালিকায় ছিলেন চুরির। এপোলিনিয়র গ্রেফতার হনকারণ তিনি একবার বলেছিলেন মোনালিসাকে পুড়িয়ে ফেলা হোক। অবশ্য এদের বিরুদ্ধে ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্টতা প্রমা হয় নাই। এইসব কীর্তিকাণ্ড মোনালিসার খ্যাতি বাড়ায়। জাপান ভ্রমনের সময় সবচাইতে বেশি বীমা করা হয় মোনালিসার জন্য। বিমান বাহিনীর বিমানও থাকে মোনালিসাকে বহনকারী জাহাজের উপর। আমেরিকার ফার্স্ট লেডি জ্যাকি কেনেডির আগ্রহে মোনালিসার মার্কিন মুলুকে আসা হয়েছিল। ওয়াশিংটনের ন্যাশনাল গ্যালারী অব আর্ট এবং নিউইয়র্কের ম্যাট্রোপলিটন মিউজিয়ামে এর প্রদর্শনী হয়। এটি লিওনার্দোর আত্মপ্রতিকৃতি বলে আমি মোটেও বিশ্বাস করি না। যদি এক্সরের মাধ্যমে প্রাথমিক ধাপে (layer) লিওনার্দোর আত্মপ্রতিকৃতি পাওয়া যায় তবে ঐ প্রতিকৃতির উপর পরবর্তিতে মোনালিসা আঁকা হয়েছেঅনেক শিল্পীই এটা করেনছবি পছন্দ না হলে তার উপর নতুন কাজ করেন। 

 

জহিরুলঃ শিল্পের মান বিচার করা তো দুরূহ কাজবিখ্যাত আর্ট ওয়ার্ক হয়ে ওঠার পেছনে মিডিয়া বা এলিট শ্রেণির একটি বড় ভুমিকা কী থাকেনাকি মানই চূড়ান্ত?

 

রকিবঃ এই প্রশ্নের উত্তর আগেই অন্য এক প্রশ্নের জবাবে দেয়ার চেষ্টা করেছি। একটা কথা মনে রাখা দরকার শিল্পীর স্টুডিয়ো থেকে শিল্পকর্ম বাইরে চলে এলে তা পণ্য হয়ে উঠে। এই পণ্য আবার অর্থমূল্যে বেশি হওয়ার কারণে প্রচার প্রসার ঘটে। সংগ্রাহক নিজের মর্যাদা বাড়ানোর জন্য তার কাছে থাকা শিল্পকর্মের গুগান করেন বা তোষামোদিদের দ্বারা প্রচার করেন। মিডিয়াও ধনীদের স্তুতি করে। ফলে শিল্পকর্ম খ্যাতি অর্জন করেশিল্পীরাও এর ভাগীদার হয়। তবে মানের বিচারও আছে। বিচারে সময় উত্তীর্ণ হলে মানই তার মর্যাদা রক্ষা করে। যে কারণে অনেক খ্যাতিমান শিল্পকর্মের হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটে। একটা উদহারণ দিলে পরিষ্কার হবেভ্যানগঘ জীবিত অবস্থায় কোনো ছবি বিক্রি করতে পারেন নাই। তখন তো ছবি বিক্রি হয়েছে অনেকঅনেক বিখ্যাত শিল্পী ওইসময় বাজার নিয়ন্ত্রণ করেছেন। উচ্চ মূল্যে ছবিও বিক্রি হয়েছে। মিডিয়া বা শিল্পপাড়ায় হইচইও ছিলো। এখন কোথায় হারিয়ে গেছে তারা। অখ্যাত প্রত্যাখ্যাত ভ্যানগঘ এসে আমাদের চেনালেন তাকে। শতাধিক বছরে ভ্যানগঘের ছবির খ্যাতি ও মুল্য কি পর্যায়ে এখন। বর্তমানকালীন খ্যাতিই সব নাসময়ের হিসাব নিকাশ আছে। 

জহিরুলঃ মিকেলেঞ্জেলো এত এত কাজ করেছেনএত বড় বড় কাজ করেছেনতাকে আমার দানবীয় ক্ষমতা সম্পন্ন শিল্পী মনে হয়। মিকেলেঞ্জেলোর কাজ এবং ব্যক্তিজীবন সম্পর্কে আপনার কাছে জানতে চাই। 

 

রকিবঃ এটা খুবই সত্য বলেছেন। যে বিশাল আয়তনের শিল্পকর্ম সে সিসতিন চ্যাপেলের ছাদে হোক বা ডেভিড পিয়েতায়ই হোক সময় ,পরিশ্রম মিলে ভাবা যায় না। তার উপর তার ডিটেইল। এটা ঠিক তার ছাত্র-সহকারীরা সাহায্য করতো।

 

 

জহিরুলঃ আমার "শিল্পী" কবিতাটি আপনি পড়েছেনএটি নিয়ে আমরা কথাও বলেছিএকদিন আপনিও বলেছিলেন একজন শিল্পী নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে পারে না। সে ঘুরে-ফিরে শুধু নিজেকেই আঁকেবিষয়টিযদি একটু ব্যাখ্যা করেন। আপনার যুক্তির সপক্ষে প্রতিষ্ঠিত কোন তত্ব থাকলে তাও যানতে চাই।

 

রকিবঃ আমরা বিশ্বকে দেখি দু'ভাবে। একটি শিক্ষা থেকে অপরটি বোধ থেকে। শিক্ষা মানে বুঝতে শেখার আগে থেকেই মা অনেক কিছু শেখানএরপর শিক্ষক এবং অন্যের অভিজ্ঞতা বা বোধের কথা বই থেকে। বইয়ের শিক্ষা অনেকের সারাজীবনভর চলতে থাকে। কিন্তু বুদ্ধি হয়া থেকে পুরা শৈশবকাল কল্পনা-বোধ থেকে বিশ্বকে দেখি। এই শৈশবে দেখা বিশ্ব কল্পনার জগতে স্থায়ী হয়। এটা এবং পরবর্তীতে নিজ অভিজ্ঞতা সৃষ্টিকর্মে প্রধান ভুমিকা রাখে। কবিতা/ছবি অন্যের কথা বলে না। নিজের কথাই নানাভাবে বলে। আপনার কবিতায় যেমন  শুধু দেখছি নদীর ঢেউয়েপাখির চঞ্চুতে আপনারই বাঁকানো ভ্রূ/ পাহাড়ে পাহাড়ে আপনার প্রশস্ত স্কন্ধযুগল;/ গ্রামের সবুজ-ভাঙা আঁকাবাঁকা নদীশাদা/ একটি রেখার মতো ছুটে যাওয়া দূরের মেঠোপথ,/ আপনার দুবাহুর আলিঙ্গন ছাড়া আর কিছু নয়

 

Comments

Popular posts from this blog

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জুর সাক্ষাৎকার || পর্ব ৭

মতিউর রহমান চৌধুরীকে  র‍্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কারের জন্য নমিনেট করেছিলেন  আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু       [লেখক, সাংবাদিক, অনুবাদক আনোয়ার হোসেইন মঞ্জুর সাক্ষাৎকারের সপ্তম  পর্ব আজ প্রকাশ করা হলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কবি কাজী জহিরুল ইসলাম।]          জহিরুলঃ  আপনার সাংবাদিকতা জীবনের প্রায় পুরোটাই ব্যয় করেছেন জাতীয় সংসদ কভার করে। এই সংসদে আমাদের সংবিধানের অনেকগুলো সংশোধনী পাশ হয়েছে। আমাদের নেতারা সব সময় বলেন, ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড় কিন্তু প্রকৃত চিত্র হচ্ছে দেশের চেয়ে দলের স্বার্থ বড় হয়ে ওঠে এবং দলের চেয়ে ব্যক্তির/পরিবারের স্বার্থই বেশি গুরুত্ব পায়। প্রধান প্রধান সংশোধনীগুলোর আলোকে যদি বিশ্লেষণ করেন কতোটা জাতীয় স্বার্থে আর কতটা ব্যক্তি বা পরিবারের স্বার্থে এইসব সংশোধনীগুলো করা হয়েছে।    মঞ্জুঃ   আপনি ঠিকই বলেছেন, এযাবত বাংলাদেশে ১১টি জাতীয় সংসদ গঠিত হয়েছে এবং এর মধ্যে দ্বিতীয় সংসদ থেকে নবম সংসদ পর্যন্ত মোট আটটি সংসদের অধিবেশন কভার করা সুযোগ হয়েছে আমার। আমার সংসদ কভারের সময়ে আমাদের সংবিধানের ১০টি সংশোধনী অনুমোদিত হয়েছে এবং সংশোধনী প্রক্রিয়া কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। এখন পর্যন্ত স

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জুর সাক্ষাৎকার - তৃতীয় পর্ব

মঞ্জু আমার ওপর রাগ করেছে                                                           - আল মাহমুদ [লেখক, সাংবাদিক, অনুবাদক আনোয়ার হোসেইন মঞ্জুর সাক্ষাৎকারের  তৃতীয় পর্ব আজ প্রকাশ করা হলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কবি কাজী জহিরুল ইসলাম।]  সাক্ষাৎকার নেবার এক পর্যায়ে আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু  ও কাজী জহিরুল ইসলাম। ওয়ান্টাগ পার্ক, নিউ ইয়র্ক।  ছবি তুলেছেন ড. মাহবুব হাসান।   জহিরুলঃ  খুশবন্ত সিং তার সকল বই অনুবাদ করার লিখিত অনুমতি দিলেন আপনাকে এবং সেই অনুমতিপত্রটি তিনি নিজ হাতে আপনার সামনেই বাংলায় লিখে দিলেন। তিনি কিভাবে বাংলা শিখলেন তা কি জানতে পেরেছিলেন ?  মঞ্জুঃ    জ্বি ,  ঘটনাটি  ঘটে  ১৯৯২ সালের ডিসেম্বর মাসে ,  এ সম্পর্কে আমি আগের এক প্রশ্নে বলেছি। তারিখটি আমার স্মরণে নেই। তবে বাবরি মসজিদ ধ্বংস করার পর ,  ডিসেম্বরের শেষ দিকে। না ,  বাংলায় নয় ,  উনি ইংরেজিতে লিখেছেন। আমার কফি পানের সময়ের মধ্যেই লিখে দিয়েছেন। ১৯৮৪ থেকে মাঝে দীর্ঘ বিরতি দিয়ে আমাকে তিনটি বা চারটি চিঠি লিখেছেন। লিখেছেন বলতে আমার চিঠির উত্তর দিয়েছেন। প্রতিটি চিঠি ইংরেজিতেই লিখেছেন। প্রতিটি চিঠিতে আমাকে সম্বোধন করেছেন  “ আনোয়ার ভাই ,”  বলে।