ভাবিকের সত্যাগ্রহ
|| কাজী জহিরুল ইসলাম ||
যুবকের নাম ভাবিক। আমার মনে হয় ভাবুক থেকেই শব্দটির উৎপত্তি। তিনি জাতিসংঘ সদর দফতরের সামনে সত্যাগ্রহে বসেছেন। কালো জ্যাকেট, গ্যাভাডিনের কালো প্যান্ট, জ্যাকেটের হুডিতে মাথা ঢাকা। আজ জানুয়ারীর ২১ তারিখ। হাড়কাঁপানো শীত ম্যানহাটনে। দুপুরে কিছুটা রোদের দেখা মিলেছে বলে বাইরে খানিক দাঁড়ানো যাচ্ছে। কিন্তু ভাবিক বসেছে অনশনে। স্থির, অনড়। কংক্রিটের ওপর একটি নীল প্লাস্টিক বিছিয়ে বসে পড়েছে। খাবে না, পান করবে না। সামনে ফার্স্ট এভিনিউ, সাঁই করে দ্রুতগতির গাড়িগুলো ছুটে যাচ্ছে আপ-টাউনের দিকে। ওর পেছনে একটি ব্যানার। তাতে ইংরেজিতে অনেক কিছু লেখা। লেখাগুলোর বাংলা করলে দাঁড়ায়, ‘অনির্দিষ্টকালের জন্য অনশন। জাতিসংঘ পাকিস্তানে হিন্দু ও শিখদের বাঁচাও।’ এই দুই লাইন হেডিং। এর নিচে লেখা, ‘জাতিসংঘ, এখনই ব্যবস্থা গ্রহন করো। স্বাধীনতার পর থেকেই পাকিস্তান সরকার ও সেনাবাহিনী ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের গণহত্যা করছে। ১৯৪৭ সালে ২৬ শতাংশ হিন্দু ছিল আর আজ ২ শতাংশও নেই। এই সংখ্যাটিই বলে দেয় পাকিস্তান তার দেশের সংখ্যালঘুদের জন্য কতটা বিপজ্জনক। পাকিস্তান সরকার ও সেনাবাহিনী হিন্দু ও শিখদের নিশ্চিহ্ন করে এথনিং ক্লিঞ্জিং করছে। পুরুষদের কর্তৃপক্ষ ধরে নিয়ে যাচ্ছে এবং হত্যা করছে। নারী ও তরুণীদের ধরে নিয়েনির্যাতন, ধর্ষণ ও বলপূর্বক বিয়ে করছে। পাকিস্তানে সংখ্যালঘুদের জোর করে ধর্মান্তরিত করা হচ্ছে। পাকিস্তান পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়াবহ দেশ। জাতিসংঘের অবশ্যই দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহন করে হিন্দু, শিখ ও অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা উচিত।’
ভাবিক যে অভিযোগনামা নিয়ে ফার্স্ট এভেনিউতে বসেছে, তা নতুন নয়। সংখ্যালঘু মানুষকে পাকিস্তানে ব্লাসফেমি আইনের শিকার হতে আমরা দেখেছি। কিছুদিন আগে নাগরিকত্ব আইন সংশোধন বিল প্রসঙ্গে ভারতের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল বিজেপির প্রধান অমিত শাহকে বলতে শুনেছি পাকিস্তানে ২৩% হিন্দু ছিল এখন আছে মাত্র ৩.৭%। ১৬ ডিসেম্বর ২০১৯ তারিখে ইন্ডিয়া টুডে পত্রিকায় মুকেশ রাওয়াত লিখেছে অমিত শাহের এই তথ্য সত্যি নয়। ১৯৪১ সালের আদমশুমারি থেকে জানা যায় পাকিস্তানে সংখ্যালঘু মানুষের সংখ্যা ছিল ৫.৯ মিলিয়ন।২০১২ সালে এই সংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছিল ৭.৩ মিলিয়নে। এই সময়ের মধ্যে পাকিস্তানের জনসংখ্যা বেড়েছে সাত গুণ, সেই হিসেবে সংখ্যালঘু জনসংখ্যা বেড়ে ৪২ মিলিয়ন হবার কথা ছিল। তা হয়নি, কারণ প্রধানত ১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে দেশ ভাগ হবার ফলে ৪৭ লক্ষ হিন্দু এবং শিখ ধর্মাবলম্বী মানুষ পাকিস্তান ছেড়ে ভারতে চলে গেছে এবং ৬৫ লক্ষ মুসলমান ভারত ছেড়ে পাকিস্তানে চলে গেছে। চলে যাওয়া ৪২ লক্ষ বাদ দিলে পাকিস্তানে ১৯৪৭ সালের পর ছিল ১৭ লক্ষ সংখ্যালঘু, আজ যার সাত গুণ ১ কোটি ১৯ লক্ষ বা ১১.৯ মিলিয়ন হলে হিসেবটা ঠিক হত। তো সেই হিসেবে পাকিস্তানে সংখ্যালঘু মানুষের সংখ্যা কমেছে কিন্তু অমিত শাহ বা ভাবিক যে তথ্য দিচ্ছে তা মোটামুটি অবাস্তব বলা চলে। যদি শুধু একজন সংখ্যালঘু মানুষের ওপরও নির্যাতন হয় তার বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ জানাতে হবে। সেদিক থেকে আমি ভাবিকের এই অনশনকে সমর্থন করি। এবং এই যুক্তি কিছুতেই দেব না ভারতের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে মুসলমানদের ওপর যে অমানুষিক নির্যাতন হচ্ছে তার বিরুদ্ধে ভাবিক কি কোনো কথা বলেছে না অনশন করেছে? এসব যুক্তি দিয়ে আমরা সাধারণত গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুকে অগুরুত্বপূর্ণ করে তুলি, পাশ কাটিয়ে চলে যাই। আমাদের উচিত হবে প্রতিটি ঘটনাকে, আন্দোলনকে, আলাদা করে বিবেচনা করা এবং প্রতিটির গুরুত্ব অনুধাবন করা। অবশ্যই আমরা ঘটনার পারম্পর্য এবং কার্যকারণ দেখবো কিন্তু সেইসব পারম্পর্য বা কার্যকারণের নিরিখে এই মুহূর্তের অরাজকতাকে পাশ কাটাব না।
আমি অনুমতি ছাড়াই ভাবিকের ছবি তুলি। দেখি সে নড়ে-চড়ে বসেছে এবং মনে হলো সে চাইছে আমি তাঁর ছবি তুলি। দু’তিনটি ছবি তুলে আমি এগিয়ে যাই এবং ওর পাশে, নীল প্ল্যাস্টিকের ওপর, বসে পড়ি।
আমি কি আপনার সাথে কথা বলতে পারি?
অবশ্যই পারেন।
আমি হাত বাড়িয়ে করমর্দন করি এবং আমার নাম বলি। ভাবিকও ওর নাম বলে।
আপনার বাড়ি কি পাকিস্তানে?
না, ভারতে?
আপনি হিন্দু না শিখ?
আমি হিন্দু।
সত্যাগ্রহে বসেছেন?
হ্যাঁ।
কবে থেকে শুরু করেছেন?
আজই শুরু করেছি।
কয়দিন থাকবেন বা কতক্ষণ থাকবেন বলে ঠিক করেছেন?
দেখি কতক্ষণ থাকতে পারি। যতক্ষণ পারি ততক্ষণ থাকব। দিন-ক্ষণ ঠিক করে তো আর আন্দোলন হয় না।
না খেয়ে এই শীতের মধ্যে কষ্ট করছেন। কেন?
পাকিস্তানে আর্মিরা আমার হিন্দু ভাইদের মেরে ফেলছে, হিন্দু বোনদের ধর্ষণ করছে। ওদের কষ্টের কাছে তো আমার এই না খেয়ে শীতের মধ্যে বসে থাকা কিছুই না।
সত্যাগ্রহের জন্য এই জায়গাটি বেছে নিলেন কেন?
জাতিসংঘকে আমার প্রতিবাদ জানাতে চাই। (আঙুল তুলে ভাবিক জাতিসংঘ ভবনটি দেখায়)
আপনি একা কেন, আর কেউ আপনাকে সমর্থন করছে না?
আমি কারো সাথে যোগাযোগ করিনি। কেউ যদি আমাকে দেখে আগ্রহী হয়, পাকিস্তানে নির্যাতিত হিন্দু এবং শিখ ভাই-বোনদের জন্য কষ্ট হয়, আমার সাথে যে কেউ যোগ দিতে পারে।
আপনি কি চাইছেন আপনার এই প্রতিবাদ জাতিসংঘ দেখুক এবং তা বিবেচনায় নিক?
এটাই তো আমার একমাত্র উদ্দেশ্য।
কোনো মিডিয়া এটেনশন পেয়েছে আপনার এই আন্দোলন? মানে কোনো মিডিয়া এসে ছবি তুলেছে, কথা বলেছে?
না, কেউ আসেনি।
আপনি কি চান কেউ আপনার কথা লিখুক?
অবশ্যই চাই।
আমি আপনার আন্দোলনের কথা লিখবো। আপনি কি সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলতে চান?
সব তো লিখে দিয়েছি।
এর বাইরে আর কিছু?
একটিই কথা, আর যেন একজনও হিন্দু, শিখ, খ্রিস্টান, বৌদ্ধসহ কোনো সংখ্যালঘু পাকিস্তান আর্মির হাতে প্রাণ না দেয়। আর যেন একটি হিন্দু মেয়ে পাকিস্তানে ধর্ষিতা না হয়।
একই কথা কি আপনি ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমানদের জন্য বলবেন?
ভারতে মুসলমানেরা তো কোনো কষ্টে নেই। ওরা ভালো আছে।
আমি ভাবিকের নীল প্লাস্টিক থেকে উঠে আমার অফিসের দিকে হাঁটতে থাকি। ভাবছি লোকটি হয়ত তার স্বজাতি, স্বধর্মের প্রতি একটু বেশিই আবেগপ্রবণ, হয়ত সে শুধু হিন্দুদের কথাই ভাবতে পারছে, আবেগান্ধও, তবুও সে যে তার স্বজাতির ওপর নির্যাতনে কষ্ট পাচ্ছে এবং প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে সত্যাগ্রহপন্থাটি বেছে নিয়েছে এজন্য ভাবিককে আমি সাধুবাদ দিই। কোনো একদিন হয়ত ওর বৃত্ত ভেঙে যাবে তখন পৃথিবীর সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষের কষ্টেই ও বিচলিত হবে, এভাবে সত্যাগ্রহে বসে পড়বে। মানবতার জয় হোক।
নিউ ইয়র্ক। ২১ জানুয়ারি ২০২০।
Comments
Post a Comment