Skip to main content

কাজী জহিরুল ইসলামের ভ্রমণ গদ্য || কাজী রোজী

কাজী জহিরুল ইসলামের ভ্রমণগ্রন্থ 

কসোভোর পথে-প্রান্তরে

 

|| কাজী রোজী || 

 



আলোর গতি কিংবা শব্দের গতি কিংবা বাতাসের গতির চেয়ে মনের গতি অনেক বেশী দ্রুতগামী। মুহূর্তে মন ছুটে যেতে পাড়ে যেখানে ইচ্ছে সেখানে। মনের এ নিঃশব্দ চলাচলের নাম মনন-ভ্রমণ। কবি কাজী জহিরুল ইসলামের কসোভোর পথে-প্রান্তরে পড়তে পড়তে আমার তেমনি মনন-ভ্রমণ হয়ে গেল। স্থল পথে জল পথে কিংবা আকাশ পথে নয় – মনের দৃষ্টি মেলে কসোভোতে হারিয়ে গেলাম আমি। নীরবে নিভৃতে মুহূর্তে ভৌগলিক সীমারেখা অতিক্রম করে আমার মন আশ্রয় নিল কসোভোর মানুষশিক্ষাসংস্কৃতিরাজনীতিঅর্থনীতি এবং সামাজিক ঘটনাবহুল নান্দনিকতার অবস্থানে। সাথে ছিলেন ঘুরে ফিরে সেই অদৃশ্য মানুষ যার নাম কাজী জহিরুল ইসলাম।

 

কাজী জহিরুল ইসলামের কবিতা পড়েছিআলোচনাও করেছিসেখানে অনেক স্বাচ্ছন্দবোধ করেছি। কিন্তু গদ্য – এ যে ভীষণ অন্য জগত! তার ওপর এখানে-সেখানে নিকট ও দূরের খবরাখবর মিশ্রিত গদ্য। কসোভোর পথে প্রান্তরে” কোনো উপন্যাস নয়ছোট গল্প কিংবা প্রবন্ধ নয়। বিদেশে থাকারবেড়াবার অভিজ্ঞতা। জীবনের কিছুটা সময় বাংলাদেশে না থেকে কসোভোতে থাকার অভিজ্ঞতা। কম বেশী তিন বছরকাল কাজী জহিরুল ইসলাম চাকরির সুবাদে কসোভোতে ছিলেন। সেই সব দিন যাপনচাকরীর পরিবেশসাথে সাথে বিচিত্র মানুষের শৈল্পিক সান্নিধ্য তাকে কতটা ভারাক্রান্ত কিংবা আশ্বস্ত করেছে সে সব বর্ণনাই এ বইটিতে পাওয়া যায়। কসোভোর পথে প্রান্তরে” বইটিকে আমি নিছক ভ্রমণকাহিনী বলবো না। পর্যটক ভ্রমণ করেন – দেখেন – শোনেনতারপর বর্ণনার আশ্রয়ে নিজেকে সমর্পণ করেন। অর্থাৎ নিছক মনের পিপাসা মেটানোর তাগিদ থাকে সেখানে। কিন্তু কাজী জহিরুল ইসলাম শুধু মনের নয়জ্ঞানের পিপাসা অধিক পরিমাণে নিবৃত্ত করেছেন। সমৃদ্ধ করেছেন কৌতূহলী পাঠকের জানার আগ্রহকে। বইটির ভূমিকায় লেখক বলেছেন, ‘অস্বাভাবিক ঝড় বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। যাব কসোভো। কথাটা শুনে সবাই আঁতকে উঠছে। ওখানে মানুষ যায়ওটাতো একটা বদ্ধভূমি। এক মহাশ্মশান। সম্মানিত পাঠকএটুকুর ভেতর দিয়ে যখন দৃষ্টিপথ মেলে ধরবেন নিশ্চয়ই আপনাদের মনে কিকেনকোথায়এসব প্রশ্ন জাগবে। বদ্ধভূমি কেন – মহাশ্মশান কিভাবে হলোএসব বিষয়ে আগ্রহ জাগবে। এভাবেই লেখক টেনে নিয়ে গেছেন তার প্রান্তিক অবস্থানে। যেহেতু কর্মসূত্রে অবস্থানএবং প্রাতিষ্ঠানিক প্রভাব রয়েছেতাই অনেক তথ্য এবং তত্ব জানা এবং উপলব্ধি করা সম্ভব হয়েছে লেখকের। তাড়না ছিল না চটজলদি অবস্থা এবং অবস্থান ফেলে চলে যাবার। আজ না হয় কালকাল না হয় পরশুঘোরা যাবেদেখা যাবেজানা যাবে। সময়ের অভিজ্ঞতা অনেক গুরুত্ব বহন করে। কসোভোতে জহিরের অবস্থান চিন্তার খোরাক জুগিয়েছেআনন্দের সান্নিধ্যে টেনেছে এবং অত্যন্ত জ্ঞানসমৃদ্ধ একটি গ্রন্থ রচনায় সহায়তা করেছে। বইটির একাদশ অধ্যায় থেকে কসোভোর ভৌগলিক অবস্থার সাথে পরিচিত হবেন সুধী পাঠক। জানবেন এর পূর্বদিকে মেসিডোনিয়াদক্ষিণে আলবেনিয়াপশ্চিমে মন্টেনিগ্রো এবং উত্তরে সার্বিয়ার সাথে কসোভোর যে সীমান্ত তা আজ আন্তর্জাতিক সীমান্তের মর্যাদা লাভ করেছে। এই সীমান্তকে এখন বলা হয়, “জাতিসংঘ সীমান্ত। কসোভোতে বর্তমানে কোন সরকার নেই। যুগোস্লাভিয়ার সাবেক প্রভিন্স কসোভোর পুরো নিয়ন্ত্রণ করছে উনমিক। উনমিকই এখন এখানে সরকার। উনমিকের ব্যাখ্যা হচ্ছেইউনাইটেড নেশন্স মিশন ইন কসোভো। লেখক ইওরোপিয়ান টেরিটোরির কসোভোর ভিটিনায় মূল প্রশাসনের একজন সিভিল পদস্থ কর্মকর্তা হিশেবে ভোটার ও সিভিল রেজিস্ট্রেশনের মতো একটি স্পর্শকাতর কাজের দায়িত্ব নিয়ে গিয়েছেন। ভিটিনা মিউনিসিপ্যালিটির জন্যে ছয়জন আন্তর্জাতিক রেজিস্ট্রেশন সুপারভাইজার এসেছেন। লেখক কাজী জহিরুল ইসলাম তাদের একজন। লেখক বলেছেন – তিনি এবং তার সহযোদ্ধারা সবাই যেন আকাশ থেকে নেমে আসা একদল এঞ্জেল। গলায় স্বর্গের আইডি ঝোলানো। কোন এক ঈশ্বর যেন তাদেরকে পাঠিয়েছেন সে দেশের অসহায় মানুষকে যুদ্ধের বিভীষিকামুক্ত একটি স্বর্গরাজ্য উপহার দিতে। এজন্য সার্বিয়ান এবং আলবেনিয়ান দ্বন্দ্ব সংঘাতের পূর্বাপর ইতিহাস বিশদ জানার প্রয়োজন হয়েছে লেখকের। সার্বিয়ানরা সংখ্যালঘু। ওদের বাড়িগুলো খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। প্রতিহিংসাবশত যে কোন সময় আলবেনিয়ানরা বোমা মেরে উড়িয়ে দিতে পারে সার্বিয়ানদের বাড়িঘর। এহেন পরিস্থিতির মধ্য দিয়েই গ্রীন হাউজে থাকতে হয়েছে লেখককে। জাতিসংঘ সিস্টেমে কাজ করতে হয়েছে। প্রচুর মিটিং করতে হয়েছে। কমিউনিটি লিডারদের সাথে মিটিং এবং কাজ করতে খুব ভাল লেগেছে। এদের সাহায্যেই সফলভাবে রেজিস্ট্রেশন কার্যক্রম পরিচালনা সম্ভব হয়েছে। আলবেনিয়ানরা কসোভোতে ফিরে এসেই ভোটার রেজিস্টারে নিজেদের নাম লেখাচ্ছেন নিজেদের তাগিদেই। সুতরাং কাজ অনেকটা সহজ হয়ে গেছে। 

 

অমন বিভূঁই বিদেশে এদেশের কবি জাহিদ হায়দারের সঙ্গে দেখা হয়েছে লেখকের। তিনিও সেখানে কর্মরত একজনএটা অত্যন্ত আনন্দের বিষয়। অনেক অনেক বিদেশী এবং কিছু স্বদেশীর সাথে কসোভোতে দেখা হয়েছে লেখকের। তবে কবি জাহিদ হায়দারের বাসায় পিকনিক পিকনিক আমেজে খাওয়া-দাওয়া করা লেখকের মনে স্কুল পালানো বালকের ভয়ানক এক্সকারশনের মতো স্মৃতিবহুল ছবি এঁকে দিয়েছে

 

কসোভোর নারী-পুরুষের সাথে কাজ করতে গিয়ে অনেক ভালোলাগা-ভালোবাসাআনন্দ-বেদনা এবং প্রীতিকর সম্পর্কের জন্ম হয়েছে। ধরা পড়েছে সেখানকার শিক্ষাসংস্কৃতিখাবারঅর্থ ও সামাজিক পরিবেশের ভিন্ন ভিন্ন চিত্রের ঘটনা।  লেখক অত্যন্ত সাবলীল ভাষায় এবং আন্তরিক মননে কসোভোর নানাবিধ বৈশিষ্টের সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। মানুষের মনের ভেতরে অনেক ইচ্ছের কথা থাকে যা কাউকে বলা যায় না। লেখক কখনো কখনোকোথাও কোথাও বেশ আবেগপ্রবন হয়ে কিছু গোপন কথা অবলীলাক্রমে বলে গেছেন। এখানে লেখক শুধু সাহসী নন সৎ একজন মানুষ বলে আমার কাছে মনে হয়েছে। জীবনে মানুষ একা নয় – পারিপার্শ্বিক পরিবেশ তাকে মানতেই হয় এবং সে জন্যে হয়তো বেশ কিছু ছাড় দিতে হয় সঠিক মূল্যায়নের জন্যে।

 

কসোভোর পথে প্রান্তরে বইটি পড়তে সবার যে ভালো লাগবে তা নয়। কারণ এ বইতে অনেক বেশি তথ্য-উপাদান সংযোগ করা হয়েছে। ভ্রমণ কাহিনী বটেতবু শুধুমাত্র ভ্রমণ নয় কসোভোর পথে প্রান্তরে”, এটি একটি শিক্ষনীয় গ্রন্থও। যারা জ্ঞান পিপাসু তাদের অবশ্যই ভাল লাগবে।

ধন্যবাদ লেখক কাজী জহিরুল ইসালামকে তার অনবদ্য গদ্যের জন্যে।

 

মিরপুর, ঢাকা। মার্চ ২০০৭।     

Comments

Post a Comment

Popular posts from this blog

শিল্পী কাজী রকিবের সাক্ষাৎকার

নন-একাডেমিক শিল্পীরাই নতুন কিছু দেয় -    কাজী রকিব  [কাজী রকিব বাংলাদেশের একজন গুণী শিল্পী। রাজশাহী আর্ট কলেজের একজন প্রতিষ্ঠাতা-শিক্ষক। কলেজের প্রথম ক্লাসটি নেবার কৃতিত্বও তাঁর। নিরন্তর ছবি আঁকেন। নানান মাধ্যমে ,  নানান ভাবনার ছবি। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে সস্ত্রীক বসবাস। তার স্ত্রী মাসুদা কাজীও একজন গুণী শিল্পী। বৈচিত্রপ্রিয় এই শিল্পীর একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন কবি কাজী জহিরুল ইসলাম। ধারাবাহিকভাবে তা এখানে প্রকাশ করা হবে। আজ উপস্থাপন করা হলো প্রথম পর্ব।]   জহিরুলঃ  বেশিরভাগ শিল্পীই নিজের একটা স্টাইল তৈরি করেন ,  নিজস্বতা যাকে আমরা বলি। আবার কেউ কেউ একই ধরণের ছবি বারবার আঁকেন। আপনার কাজে বৈচিত্র খুব বেশি ,  এতে করে "টাইপড" অপবাদ থেকে আপনি মুক্ত কিন্তু নিজের একটি স্টাইল তৈরি করতে না পারা বা তৈরি হয়নি বলে কি আক্ষেপ হয় ,  নাকি এই যে ভার্সেটিলিটি এটাই আপনি বেশি উপভোগ করেন ?    রকিবঃ   আমি আসলে আলাদা করে ভাবিনি এই স্টাইল বিষয়ে। কারো মতো আঁকারও চেষ্টা করিনি তেমন ভাবে। অল্প বয়সে ,  আমার ১৯ / ২০ বছর বয়সে ,  সালভাদর দালির মতো আঁকতে চেষ্টা করেছিলাম কিছুদিন ।

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জুর সাক্ষাৎকার || পর্ব ৭

মতিউর রহমান চৌধুরীকে  র‍্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কারের জন্য নমিনেট করেছিলেন  আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু       [লেখক, সাংবাদিক, অনুবাদক আনোয়ার হোসেইন মঞ্জুর সাক্ষাৎকারের সপ্তম  পর্ব আজ প্রকাশ করা হলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কবি কাজী জহিরুল ইসলাম।]          জহিরুলঃ  আপনার সাংবাদিকতা জীবনের প্রায় পুরোটাই ব্যয় করেছেন জাতীয় সংসদ কভার করে। এই সংসদে আমাদের সংবিধানের অনেকগুলো সংশোধনী পাশ হয়েছে। আমাদের নেতারা সব সময় বলেন, ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড় কিন্তু প্রকৃত চিত্র হচ্ছে দেশের চেয়ে দলের স্বার্থ বড় হয়ে ওঠে এবং দলের চেয়ে ব্যক্তির/পরিবারের স্বার্থই বেশি গুরুত্ব পায়। প্রধান প্রধান সংশোধনীগুলোর আলোকে যদি বিশ্লেষণ করেন কতোটা জাতীয় স্বার্থে আর কতটা ব্যক্তি বা পরিবারের স্বার্থে এইসব সংশোধনীগুলো করা হয়েছে।    মঞ্জুঃ   আপনি ঠিকই বলেছেন, এযাবত বাংলাদেশে ১১টি জাতীয় সংসদ গঠিত হয়েছে এবং এর মধ্যে দ্বিতীয় সংসদ থেকে নবম সংসদ পর্যন্ত মোট আটটি সংসদের অধিবেশন কভার করা সুযোগ হয়েছে আমার। আমার সংসদ কভারের সময়ে আমাদের সংবিধানের ১০টি সংশোধনী অনুমোদিত হয়েছে এবং সংশোধনী প্রক্রিয়া কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। এখন পর্যন্ত স

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জুর সাক্ষাৎকার - তৃতীয় পর্ব

মঞ্জু আমার ওপর রাগ করেছে                                                           - আল মাহমুদ [লেখক, সাংবাদিক, অনুবাদক আনোয়ার হোসেইন মঞ্জুর সাক্ষাৎকারের  তৃতীয় পর্ব আজ প্রকাশ করা হলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কবি কাজী জহিরুল ইসলাম।]  সাক্ষাৎকার নেবার এক পর্যায়ে আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু  ও কাজী জহিরুল ইসলাম। ওয়ান্টাগ পার্ক, নিউ ইয়র্ক।  ছবি তুলেছেন ড. মাহবুব হাসান।   জহিরুলঃ  খুশবন্ত সিং তার সকল বই অনুবাদ করার লিখিত অনুমতি দিলেন আপনাকে এবং সেই অনুমতিপত্রটি তিনি নিজ হাতে আপনার সামনেই বাংলায় লিখে দিলেন। তিনি কিভাবে বাংলা শিখলেন তা কি জানতে পেরেছিলেন ?  মঞ্জুঃ    জ্বি ,  ঘটনাটি  ঘটে  ১৯৯২ সালের ডিসেম্বর মাসে ,  এ সম্পর্কে আমি আগের এক প্রশ্নে বলেছি। তারিখটি আমার স্মরণে নেই। তবে বাবরি মসজিদ ধ্বংস করার পর ,  ডিসেম্বরের শেষ দিকে। না ,  বাংলায় নয় ,  উনি ইংরেজিতে লিখেছেন। আমার কফি পানের সময়ের মধ্যেই লিখে দিয়েছেন। ১৯৮৪ থেকে মাঝে দীর্ঘ বিরতি দিয়ে আমাকে তিনটি বা চারটি চিঠি লিখেছেন। লিখেছেন বলতে আমার চিঠির উত্তর দিয়েছেন। প্রতিটি চিঠি ইংরেজিতেই লিখেছেন। প্রতিটি চিঠিতে আমাকে সম্বোধন করেছেন  “ আনোয়ার ভাই ,”  বলে।