কাজী জহিরুল ইসলাম বহুমাত্রিক লেখক
|| প্রবীর বিকাশ সরকার ||
কবি, সাহিত্যিক, সংগঠক এবং সম্পাদক কাজী জহিরুল ইসলামের সঙ্গে আমার কখনো সাক্ষাৎ ঘটেনি, কথাও হয়নি। কিন্ত তার লেখার সঙ্গে, বিশেষ করে কবিতার সঙ্গে যৎকিঞ্চিৎ পরিচিত ছিলাম। বিচ্ছিন্নভাবে ফেইসবুকে কিছু কবিতা পড়ার সুযোগ হয়েছে। সম্প্রতি পাঠ করলাম তার তিনটি গ্রন্থ। দুটি কাব্য একটি প্রবন্ধ। একাধিক গুণে গুণান্বিত বহুমাত্রিক পরিশ্রমী লেখক তিনি, তার প্রমাণ পাওয়া যায় তার গ্রন্থগুলোর নামে এবং সৃজনশীল কর্মতৎপরতায়। বহুবর্ণ, বহুকণ্ঠ, বহুচিন্তা তার লেখাকে বৈচিত্র্যময় করেছে নিঃসন্দেহে।
কবি কাজী জহিরুল ইসলামের ‘নির্বাচিত ১০০ কবিতা’ পড়ার পর তিনি যে শক্তিশালী একজন কবি সেটা গভীরভাবে উপলদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছি। তার এই শক্তিময়তা নানারূপে জ্বলজ্বল করছে কবিতাগুলোর শব্দ, বাক্য, ছন্দ এবং পঙক্তিতে। নিখাদ, সজাগ এবং আপোষহীন এক শান্তিবাদী কবির প্রতিকৃতিকেই নির্দেশ করছে এই শক্তিমত্তা। তাই শান্তি, মানবতা এবং স্বদেশ অক্রান্ত হলে, খুন হলে, আহত হলে তিনি টলে ওঠেন, আহত হন। ‘মৃত ঘোড়া ভেবে’, ‘কার অঙ্গুলি নির্দেশে চলছে আমার দেশ’, ‘অভিজিতের রক্ত’, ‘পা’, ‘ষড়ঋতুর বোন’, ‘চশমা’, ‘নদী’, ‘প্রহর বাজে’, ‘ফুল’, তুই-২’ প্রভৃতি কবিতা এক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বহির্বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায়, নানা জাতির মানুষের সঙ্গে মেলামেশা, ভূপ্রকৃতির অভিজ্ঞতা তার কবিতাকে ঋদ্ধ এবং বৈচিত্র্যময় করেছে। বেশকিছু বিদেশি শব্দের উপস্থিতি লক্ষণীয় যদিওবা অর্থ অজ্ঞাত কিন্তু ভিন্ন মাত্রাযুক্ত।
তার ‘দেহকাব্য’ এক কথায় অনন্য, অনবদ্য এবং বাংলা সাহিত্যে আলাদা একটি মাত্রা যোগ করেছে বলে আমার একান্ত বিশ্বাস। এরকম নারীদেহচিত্রীর সন্ধান বাংলা কবিতায় পাইনি বলাই বাহুল্য। আসলেই যে নারীদেহ একটি জটিল কাব্য ‘দেহকাব্য’ না পাঠ করলে এই রহস্য উন্মোচন সম্ভব নয়। এই কাব্যটি নারীদেহের একটি আশ্চর্য রূপসী মহাভারত! তার পরতে পরতে আলোকিত হাজার হাজার বছরের পুরাণ এবং ইতিহাসগন্ধী নারীদেহের দ্যুতিময় নানাবর্ণ ও বর্ণনা প্রকম্পিত করার মতো! কবি কাজী জহিরুল ইসলাম যে বিস্তর পাঠ্যানুরাগী এবং সুরুচিসম্পন্ন অনুসন্ধানী ‘দেহকাব্য’ পাঠে তা ধরা পড়ে, ধরা পড়ে জাগতিক এবং আধ্যাত্মিক চেতনা ও সৌন্দর্য যে নারীদেহকে জড়িয়ে আছে সে সম্পর্কে তিনি একান্তই পরিজ্ঞাত এবং সেই বর্ণিল ভালোলাগাকে পাঠকের চোখে চমৎকারভাবে প্রদর্শন করতেও সক্ষম। ‘দেহকাব্য’ যে সমাদৃত হবে এতে সন্দেহ দেখি না।
যে কোনো জাতির সামগ্রীক পরিচয় তার মাতৃভাষায়। তাই তারও মাতৃভাষা বাংলার উৎস, উৎপত্তি, বিকাশ, পরিবর্তন এবং বিবর্তন নিয়ে সহজ ভাষায় যেভাবে তুলে ধরেছেন ‘শেখরের খোঁজ’ নামক শ্রমলদ্ধ গবেষণা প্রবন্ধে তা পড়ে চমৎকৃত হয়েছি, হয়েছি উপকৃত। বাংলা ভাষার হাজার বছরের ধারাবাহিক ইতিহাস যে কোনো পাঠকের কাছে ভালো লাগবে এবং আদরণীয় হবে তা বলেই দেয়া যায়। নিঃসন্দেহে প্রাবন্ধিক কাজী জহিরুল ইসলাম সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য।
প্রবাসে শত ব্যস্ততার মধ্যেও তার সাহিত্যের প্রতি টান, সাহিত্য সৃজনের প্রতি ভালোবাসা ও তাগিদ আমাকে মুগ্ধ করেছে। একজন একনিষ্ঠ কর্মবীর হওয়ার পথে যে তিনি পা রেখেছেন তার প্রমাণ মেলে তার সাহিত্যকর্মগুলোর দিকে তাকালে।
বাঙালি সমিতি-সংগঠনপ্রিয় গোষ্ঠী। তিনিও তার ব্যতিক্রম নন ‘ঊনবাঙাল’ তারই জ্বলন্ত সাক্ষী। বিভিন্ন অনুষ্ঠান করে প্রবাসে স্বদেশকে তুলে ধরার প্রয়াস উৎসাহব্যঞ্জক। অন্যদিকে বহুমাত্রিকতাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে এগিয়ে চলেছেন সম্পাদনার দিকেও। ত্রৈমাসিক সাহিত্য পত্রিকা ‘কারুবাক’ এর সম্পাদক তিনি।
এই বছর আমার এই প্রিয়তম বন্ধুটি পঞ্চাশ অতিক্রম করে পা দিচ্ছে দ্বিতীয় অর্ধশতকে। এই শুভক্ষণে তাকে জানাই অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে রাশি রাশি অভিনন্দন এবং শুভকামনা। তার স্বপ্ন, তার আশা এবং আকাংখা পূর্ণাঙ্গ বাস্তবরূপ অর্জন করতে যেন সক্ষম হয় তার জন্য পরম করুণাময়ের কাছে প্রার্থনা করছি। সেইসঙ্গে তার এবং পরিবারের সকলের সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করছি।
টোকিও.জাপান। ১৩ ডিসেম্বর ২০১৭।
Comments
Post a Comment