শরাঘাত সহ্য করার ক্ষমতা তাঁর দৃষ্টান্ত তূল্য
|| আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু ||
নিউ ইয়র্ক সিটিতেই কবি কাজী জহিরুল ইসলামের সাথে আমার পরিচয়। কিন্তু কবি বা লেখক হিসেবে নয়। সে প্রসঙ্গে আসছি একটু পরে। কাজী জহিরুল ইসলাম যেহেতু একজন কবি, অতএব তার সাথে দেশেই পরিচয় হওয়াটা সঙ্গত ছিল। ঢাকায় বসবাসকারী উদীয়মান প্রায় সকল কবির সাথেই কোনো না কোনো সূত্রে আমার সাক্ষাৎ ঘটতো তখন। একটি জাতীয় দৈনিকে রিপোর্টার হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি আমার সম্পাদনায় ১৯৮৭ সালের এপ্রিল মাস থেকে নতুন ঢাকা ডাইজেস্ট নামে একটি মাসিক ম্যাগাজিন প্রকাশিত হচ্ছিল।
ঢাকা ডাইজেস্ট অল্প সময়ের মধ্যেই জনপ্রিয় হয়ে উঠে। প্রকাশনার পাঁচ বছরের মধ্যে পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে, চাহিদা অনুযায়ী ছাপা সম্ভব হতো না কাগজের ক্রমবর্ধমান মূল্যের কারণে। ম্যাগাজিনের কবিতা বিভাগে যাদের কবিতা নিয়মিত প্রকাশিত হতো তাদের মধ্যে ছিলেন সৈয়দ আলী আহসান, আল মাহমুদ, শামসুল ইসলাম, আল মুজাহিদী, ওমর আলী, আবদুল হালিম খাঁ, রবীন্দ্র গোপ, হাসান হাফিজ, সোহরাব হাসান, রেজাউদ্দিন ষ্টালিন, মুজতাহিদ ফারুকী, বুলবুল সরওয়ার, হালিম আজাদ, শাকিল রিয়াজ এবং বাংলাদেশের কাব্যাকাশে যারা এখন বিকশিত তাদের অনেকে। ভুলেও গেছি অনেকের নাম। কিন্তু কবি জহিরের কোনো কবিতা ডাইজেস্টে কেন প্রকাশিত হয়নি, তা ভেবে এখন বিস্মিত হই। পরিচয়ের পরই জানতে পারলাম, শাকিলের সাথে ঘনিষ্টতা ছিল জহিরের। শাকিল ঢাকা ডাইজেস্টের সাথে জড়িত হয়ে বেশ কিছুদিন আমাকে সহযোগিতাও করেছে, কিন্তু কখনো কবি কাজী জহিরের কথা বলেনি, অথবা তার কোনো কবিতাও আমাকে এনে দেয়নি ডাইজেস্টে প্রকাশের জন্য। তিনি কী কখনো ডাইজেস্টে তার কবিতা বা অন্য কোনো লিখা প্রকাশের ব্যাপারে আগ্রহী হননি? ঢাকা ডাইজেস্ট কখনো দলকানা বা কোনো দল বা দলীয় মালিকানাধীন ম্যাগাজিন ছিল না। এটি পুরোপুরি আমার ব্যক্তিগত উদ্যোগ ছিল এবং আমার কয়েকজন সহকর্মী ম্যাগাজিনটি দীর্ঘ ১৪ বছর পর্যন্ত প্রকাশ করার কাজে আমাকে সহযোগিতা করেছেন। কিছু সহৃদয় বিত্তবান ব্যক্তি অনেকটা সময় ঢাকা ডাইজেস্টের প্রকাশনা অব্যাহত রাখতে আর্থিকভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন।
কবি কাজী জহিরুল ইসলাম যখন নিউইয়র্কে থিতু হলেন তখন তার বহুমুখী প্রতিভার মুগ্ধতায় আমি আবিষ্ট। কবি ও লেখক সত্ত্বা ছাড়িয়েও নানা মত এবং নানা পথের পথিক কবি-সাহিত্যিকদের সংগঠিত করতে তার কুশলতা দেবতূল্য সার্থকতার মতো। তার আড়ালের বিরূপ সমালোচনা অথবা তাকে লক্ষ্য করে নিক্ষিপ্ত শরাঘাত সহ্য করার ক্ষমতা দৃষ্টান্ত তূল্য। সাহিত্যের প্রতি আমি সামান্য অনুরাগ পোষণ করলেও দেশে-বিদেশে কখনো কোনো সাহিত্য সংগঠনের সাথে সংশ্লিষ্ট হওয়ার কথা ভাবিনি। সাহিত্য আড্ডা বা অন্য কোনো ধরণের আসরে কাটানোর মতো অভ্যাস বা সময় আমার ছিল না। কিন্তু নিউইয়র্কে কাজী জহিরুল ইসলামের ডাকে সাড়া না দিয়ে পারিনি।
যে কর্মগুলো ফেলে আসা জীবনে কখনো করিনি, কবি জহিরের তাড়ায় সেই বিষও গিলেছি; স্বরচিত লেখা পাঠ করেছি ভরা আসরে। আমার পক্ষে এসব সম্ভব হয়েছে, কারণ আমার কাছে তিনি শুধু হঠাৎ পরিচিত ব্যক্তি নন। আমার বোনের স্বামী। হ্যাঁ, মুক্তির কারণেই তার স্বামী কাজী জহির অতি নিকটের মানুষ। জহিরের মেধা, মনন, অভিজ্ঞতা ও সাফল্য ঈর্ষণীয়। যে অর্জনগুলো আমাদের মতো পটভূমি থেকে আসা অধিকাংশ মানুষকে ধরাকে সরাজ্ঞান করতে শেখায় কাজী জহির সেই প্রজাতির নন বলেই অসামান্য। যাদের সাথে তিনি মেলামেশা করেন, আলাপচারিতায় মেতে উঠেন, তিনি সহজে তাদের আপন হয়ে উঠতে পারেন। এই গুণ ও যোগ্যতা সবার থাকে না।
কাজী জহিরের নিউইয়র্কের জীবন সূচিত হওয়ার আগে তাঁর সাথে আমার পরিচয় হয়নি। ছোট বোন মুক্তির স্বামী হিসেবে তার সাথে ঘনিষ্টতা। এই বোনটিকে আবিস্কার করি যখন সে দুই সন্তান নিয়ে লন্ডনে থাকেন। মুক্তি জহির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের ছাত্রী ছিল। ইউরোপের একটি দেশের আর্কিটেকচার স্কুলেও পড়াশুনা করেছেন। আমি কখনো জানতে চাইনি, সেখানে কী বিষয়ে শিক্ষা নিয়েছেন। বোধ করি কারিগরি বা নন্দনতত্ত্বের কোনো বিষয় হবে। আমি খুব অবাক হইনি।
পাশ্চাত্যের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এটা সম্ভব। নন-টেকনিক্যাল বিষয়ে শিক্ষা নিয়ে কেউ টেকনিক্যাল বিষয়ে পড়াশুনা করবে সাধারণভাবে এমন ধারণা বাংলাদেশে কেউ না করতে পারলেও উনত্রিশ বছর আগে ক্যালিফোর্নিয়ার ষ্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে কিছুকাল পড়াশুনা করার সময়ে দেখেছি, যে যা পড়তে বা করতে চায়, বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সেই সুযোগ দেয়ার জন্য যেন এক পা এগিয়েই থাকে। আমার সহপাঠি তুরস্কের এরগুন বাবাহান (আঙ্কারায় সাবাহ নিউজ এর সাবেক সম্পাদক) - এর স্ত্রী সুনাই বাবাহান এর সখ হলো সে ভাস্কর্য তৈরি করতে শিখবে। ষ্ট্যানফোর্ড ক্যাম্পাসে মিউজিয়ামের পাশেই ‘রডিন গার্ডেন’ নামে একটি উন্মুক্ত ভাস্কর্য জাদুঘর আছে, যেখানে স্থান পেয়েছে বিখ্যাত ফরাসি ভাস্কর অগাষ্টে রডিন এর প্রায় একশ ভাস্কর্য। এগুলো দেখেই সুনাই ভাস্কর্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে খোজখবর নিয়ে জেনেছেন, এটা কোনো ব্যাপারই নয়। আগ্রহ থাকলেই হলো। কোর্সের মেয়াদকালে ষ্টুডেন্টদের স্পাউজরা বিনা খরচে তাদের সখের বিষয় পড়তে পারে বা শিখতে পারে। এগুলো হবে নন-ক্রেডিট কোর্স। তবে কেউ যদি সুনাই এর বানানো ভাস্কর্য কেনে, তাহলে অর্থের মালিক স্বয়ং সুনাই।
বিশ্ববিদ্যালয় এতে নাক গলাবে না। এসব খবর শুনে আমার গিন্নিও পিছিয়ে থাকে না। সুনাই এর তখনো সন্তান নেই। কিন্তু আমাদের দুটোকে সামলে কিভাবে সে কী করবে। আমি আশ্বাস দেই, বাচ্চা না হয় আমি সামলাবো, বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারে গিয়ে খোঁজখবর নাও, দেখো, তোমার বিদ্যাবুদ্ধি দিয়ে তুমি কী করতে পারো। সে খোঁজ নেয়, খুশি মনে ঘরে ফেরে। বাংলাদেশী বা ইন্ডিয়ান রান্না শেখাবে। বোর্ডে নোটিশ সাঁটিয়ে দেয়, বেশ কয়েকজন রান্না শেখার আগ্রহ ব্যক্ত করে। একদিন সে মশলাপাতি নিয়ে ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারে রান্না শিখিয়ে আসে কয়েকজনকে। কিছু ডলারও পায়। কিন্তু ওই একদিনই। অতএব মুক্তির আর্কিটেকচার স্কুলে পড়াশুনা নিঃসন্দেহে বাড়তি যোগ্যতা। সব মিলিয়ে ভালো লাগে মুক্তিকে, আমার ছোট আপুকে। উচ্চ শিক্ষিতা। মায়াভরা মুখ। দুই সন্তানের গর্বিতা মা। এমন মানুষের সন্ধানই তো করেছি আশৈশব, যাদের কাছে কিছু জানবো, শিখবো। শেখার ক্ষেত্রে আমি সবসময় নবীন ও নবীশ।
২০১০ সালের শেষ দিক থেকে মুক্তির সাথে নিয়মিতই কথা হতো। আমি নিউইয়র্কে, মুক্তি লন্ডনে। পড়াশুনা, সংসার, পেশা, সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে আমরা আলোচনা করি। কবি কাজী জহিরুল ইসলামের পোষ্টিং যতদূর মনে পড়ে সাউথ সুদানের দারফুর-এ। ছুটিতে লন্ডনে আসেন, পরিবারের সাথে কয়েক দিন কাটিয়ে আবার চলে যান কর্মস্থলে। কিছুদিন পরই জানতে পারি কাজী জহির বদলি হয়ে আসছেন নিউইয়র্কে জাতিসংঘ হেডকোয়ার্টারে। আনন্দিত হই। প্রাথমিকভাবে সপরিবারে নিউইয়র্কে আসবেন, এরপর লন্ডনে ফিরে যাবেন, মাত্র কিছুদিন আগে কেনা লন্ডনের বাড়িটি বিক্রি করে পাকাপাকি চলে আসবেন নিউইয়র্কে। আমি আগাম দাওয়াত দিয়ে রাখি। বলে রাখি, আমার দাওয়াতের আগে নিউইয়র্কে যাতে আর কারও দাওয়াত গ্রহণ না করে।
নিউইয়র্কে আসার পর মুক্তি-জহির দম্পতিকে আমি আপ্যায়ন করবো। তারা নিউইয়র্কে এলে এক সন্ধ্যায় জ্যামাইকার হিলসাইডে তাজমহল রেষ্টুরেন্টে ছোট বোন মুক্তি ও কাজী জহিরকে ডিনারে ডাকি। আমার মেয়ে দীয়া এবং ওর স্বামী রায়হানও ডিনারে যোগ দেয়। এর পর প্রায় সাত বছর কেটে গেছে। আমরা আরো নিবিড় হয়েছি। কাজী জহিরের সামাজিক উদ্যোগের কারণে অনেকগুলো পরিবারের সাথে সুসম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছে।
প্রবাসে পেশাগত ও পারিবারিক ব্যস্ততা সত্ত্বেও কবি কাজী জহিরুল ইসলামের সাহিত্য কর্ম থেমে নেই। বয়সের মধ্য গগণ পেরিয়ে তিনি দ্বিধারী তলোয়ারের ক্ষিপ্রতায় অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ বহুমাত্রিক রচনাসম্ভার তুলে দিচ্ছেন পাঠকের হাতে। তাঁর এই অগ্রযাত্রা অনেক দূর বিস্তৃত হোক।
নিউ ইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র। ১৭ ডিসেম্বর ২০১৭।
Comments
Post a Comment