Skip to main content

ভাষা শহীদ রফিকের জীবন কাহিনী

 রফিক

|| কাজী জহিরুল ইসলাম ||  




পুরান ঢাকার বাবুবাজার। আকমল খাঁ রোডের পারিল প্রিন্টিং প্রেসের এক বৃদ্ধ কম্পোজিটরের কপালের ওপর ঝুলে আছে ষাট ওয়াটের বাল্ব। নিচেটেবিলের ওপরখোপ কাটা কাঠের ট্রে। ট্রের খোপে খোপে সীসার টুকরো দিয়ে তৈরী ১৪ পয়েন্টের অজস্ত্র বাংলা অক্ষর। তিনি একটার পর একটা অক্ষর সাজিয়ে তৈরী করছেন শব্দ। শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে তৈরী করছেন বাক্যএরপর প্যারাএরপর পৃষ্ঠাছাপাখানার ভাষায় ফর্মা। ফর্মাতে ব্রাশ দিয়ে কালি মেখে নিউজ প্রিন্টে হালকা পানির ছিটা দিয়ে তাতে ছাপ দিয়ে প্রুফ দেখছেন যিনিতাঁর নাম আবদুল লতিফ। তিনিই পারিল প্রিন্টিং প্রেসের মালিক। নিজের গ্রামের নামে প্রেসের নাম। প্রেসের সাইনবোর্ডের দিকে তাকালে সিঙ্গাইরের পারিল গ্রামের ছায়াঘেরা দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে ওঠে আবদুল লতিফের। মধ্য চল্লিশে বয়স। দেশভাগের পর বড় ছেলে রফিকউদ্দিনকে সাথে নিয়ে কলকাতা থেকে ফিরে আসেন লতিফ। চোখে স্বপ্নবুকে দেশপ্রেম। রফিক ছড়া/কবিতা লেখে। মন্দ লেখে না। বেশ কিছু লেখা হলে পারিল প্রিন্টিং প্রেস থেকেই একটি বই বের করে দেওয়ার ইচ্ছে আছে।  

বৃদ্ধ কর্মচারী যখন সীসার বর্ণমালা সাজায় রফিক তখন দুই গালে হাত দিয়ে টেবিলের ওপর কনুই রেখে গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখে বাংলা বর্ণগুলোকে। কী আপন লাগে। আকমল খাঁ রোডে দুপুরের নিস্তব্ধতা ভেঙে একটি শব্দ ওঠে, ‘মিষ্টি-বাকরখানিলাগবো মিষ্টি বাকরখানিএরপর চা গরমএ...ই গরম চা কিছুক্ষণ পরে আরো একজন হকারের কন্ঠ শোনা যায়, ‘কুলফি বরফএ...ই কুলফি বরফ বরফ শব্দটি যখন সে উচ্চারণ করে শোনা যায় বর্ফ এবং খুব তীব্র। হকার ছাড়া এই ভর দুপুরে জনমানুষের তেমন আনাগোনা নেই। বুড়ো কর্মচারীর দিকে তাকিয়ে আবদুল লতিফ বলেনমাষ্টার কাকুচা খাবেনবৃদ্ধ  লোকটি সীসার বর্ণমালা থেকে চোখ তুলে অন্ধকার দেখে। চোখ সয়ে এলে টুলের ওপর ঘুরে বসে। প্রথমে ছেলেপরে বাপের দিকে তাকিয়ে ভারী লেন্সের চশমাটা খুলে লুঙ্গির ঝুল উল্টো করে তুলে হাই পাওয়ারের কাচ মুছতে মুছতে বলেনডাকুন চা-ওয়ালাকেখাই এক কাপ। লতিফ প্রেসের শিকছাড়া জানালা দিয়ে মাথা বের করে চিৎকার করে ডাকেএই চা। দুই মিনিটের মধ্যেই বিশাল এক কেতলি হাতে চা-ওয়ালা এসে হাজির।

চা খেতে খেতে কম্পোজিটারলতিফ যাকে মাস্টার কাকা আর রফিক যাকে বর্ণদাদু বলে ডাকেতিনি রফিকের পেটে খোঁচা দিয়ে বলেনকলেজে যাও দাদুপ্রেসের কাজে লেগে গেলে জীবন শেষ।   

রফিক ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে আছে বাবার দিকে।

-   ভর্তি হয়ে যা বাপধন। আরেকটু বয়স বাড়লে আর পারবি না। জগন্নাথ কলেজ দশ মিনিটের পথ।

১৯৪৯ সালের শেষের দিকে রফিক জগন্নাথ কলেজের বাণিজ্য বিভাগে ভর্তি হয়। দিনে কলেজ আর রাতে সে পিতাকে প্রেসের কাজে সাহায্য করে। সীসার তৈরী বাংলা বর্ণগুলোর প্রতি কী এক আকর্ষণ অনুভব করে রফিক। যতটা না কাজের জন্য তার চেয়েও বেশি সীসার অক্ষরগুলোর টানেই সে প্রেসে এসে বসে থাকে।

অর্থনীতির ক্লাসে প্রসঙ্গক্রমে বাণিজ্যিক ভূগোল পড়াচ্ছেন অধ্যাপক যোগেশচন্দ্র রায় প্রেইরি অঞ্চলের গম যখন আলোচনার বিষয় তখন কচি-সবুজ গমের মত শাড়ি পরা এক যুবতী এসে ঢোকে শ্রেনিকক্ষেওর পেছনে আরো কয়েকজন ছাত্রী। ছিপছিপে যুবতী যোগেশ বাবুকে প্রণাম করে ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্দেশে বক্তৃতা শুরু করেন। যুবতীর নাম শাফিয়া খাতুন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের এম এ ক্লাসের ছাত্রী। 

প্রিয় ভাই ও বোনেরাসামনে আপনাদের পরীক্ষাপাস করেই বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবেন। আপনাদের পড়ালেখার কোনো ক্ষতি হোক তা আমি চাই না কিন্তু আপনাদের মায়ের ভাষা যখন সঙ্কটাপন্ন তখন এই ভাষাকে উদ্ধার করা আপনারআমারআমাদের সকলের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। মুসলিম লীগ সরকার উর্দূকে আমাদের ওপর চাপানোর ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র করছে। আরবী অক্ষরে বাংলা  লেখারও পাঁয়তারা শুরু হয়েছে। এইসব চক্রান্ত প্রতিহত করে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবী আদায় করতে হবে। আগামী ৫ই জুলাই বৃহস্পতিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় বাংলা ভাষার দাবীতে  সভা ডেকেছে স্টেট লেঙ্গুয়েজ মুভমেন্ট কমিটি। যারা যারা পারেন আসবেন। জগন্নাথ কলেজের নেতৃবৃন্দও পৃথক সভার আয়োজন করবে। বাংলা ভাষার দাবীতে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জোর আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। 

এরপর তিনি চিৎকার করে স্লোগান ধরেন, ‘রাষ্ট্রভাষারাষ্ট্রভাষা শাফিয়ার পেছনে যে কয়জন মেয়ে দাঁড়িয়ে ছিল তারা জবাবে বলে, ‘বাংলা চাইবাংলা চাই শাফিয়া যখন দ্বিতীয়বার বলে, ‘রাষ্ট্রভাষারাষ্ট্রভাষা তখন পুরো ক্লাস একসাথে বলে ওঠে, ‘বাংলা চাই বাংলা চাই এভাবে চারবার স্লোগান দেবার পর আধ্যাপক যোগেশ বাবুকে প্রণাম করে বেরিয়ে যান শাফিয়া ও তার দল। ক্লাস যখন চুপযোগেশ বাবু ব্লাক বোর্ডে কিছু একটা লিখছেনতখন রফিক সটান দাঁড়িয়ে মুষ্ঠি শূন্যে ছুঁড়ে স্লোগান ধরে, ‘রাষ্ট্রভাষারাষ্ট্রভাষাসব ছাত্র কিংকর্তব্যবিমূঢ়শিক্ষকের মুখ দেখা যাচ্ছে না। তিনি শরীর দিয়ে আড়াল করে ব্লাক বোর্ডে কিছু একটা লিখছেন। ছাত্ররা তবু জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে পেছন ফেরানো শিক্ষকের দিকেই তাকিয়ে আছে। কয়েক সেকেন্ড পর যোগেশ বাবু এক পাশে সরে সহাস্যে ঘুরে দাঁড়াতেই ছাত্ররা দেখে ব্লাক বোর্ডে লেখা রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাইসব ছাত্র তখন সমস্বরে রফিকের স্লোগানের জবাবে গলা ফাটিয়ে স্লোগান ধরে, ‘বাংলা চাইবাংলা চাই এভাবে মুহুর্মুহু স্লোগানে মুখর হয়ে ওঠে সেদিন১৯৫১ সালের ৬ জুনবুধবারজগন্নাথ কলেজের বাণিজ্যিক ভূগোলের ক্লাস।

মানিকগঞ্জ এক অজ পাড়া গাঁ। এখান থেকে সিঙ্গাইর পর্যন্ত গরুর গাড়ির রাস্তা। লতিফের হাতে ছোট্ট এক তোরঙতোরঙের ওপর লাল রঙ দিয়ে গোলাপফুল আঁকা। তিনি সেটা যক্ষের ধনের মত হাঁটুর ওপর নিয়ে বুকের সাথে চেপে ধরে বসে আছেন হারাধনের মিষ্টির দোকানে। আজ হাটবারগঞ্জে লোক সমাগম ব্যাপক। হারাধন একটু পর পর লতিফের দিকে আঁড়চোখে চায়। বিষয়টা লতিফ বুঝতে পারলেও তার কিছু করার নেইআরো কিছুক্ষণ এখানেই বসে থাকতে হবে। আশরাফ মাস্টার গঞ্জ/হাট করবেনতার কাজ শেষ হলে একত্রে সিঙ্গাইর রওয়ানা দিবেন। আশরাফ মাস্টার জানিয়েছেন আরো ২/৩ জন সিঙ্গাইর থেকে এসেছেসূর্য হেলে পড়লে সবাই একত্রে যাত্রা করবে। ওরা গরুর গাড়ি রিজার্ভ করেই নিয়ে এসেছে। হারাধনের মিষ্টির দোকানের একদিকে বেড়াবেড়ার কাছেভেতরের দিকেএকটি চুলোয় মিষ্টির শিরা জাল হচ্ছেসামনের দিকে একটি কাচ লাগানো মিষ্টির আলমারিঅন্য তিনদিকে টিনের ঝাঁপঝাঁপ তুলে দিলে পুরো দোকানটাই খোলাএপাশ-ওপাশ বাতাস খেলা করে। কয়েকটি টিনের গামলায় রসগোল্লাকালোজামছানার সন্দেশ। কাচের আলমারির ভেতরমিষ্টির গামলার ওপরবড় বড় নীল রঙের কয়েকটি মাছি ভন ভন করে উড়ছে। পশ্চিম পাশে একটুখানি জায়গা দরোজার মতো রেখে তিনদিকেই বাঁশের স্থায়ী বেঞ্চ বসিয়ে দিয়েছে হারাধনসেই বেঞ্চে এখন এক ইঞ্চিও জায়গা খালি নেই। খদ্দের এসে বসার জায়গা না পেয়ে হারাধনের পিসতুতো ভাই নিবারণের দোকানে চলে যাচ্ছে। হারাধন তার ভালোমানুষি আর ধরে রাখতে পারে না।

-   দাদায় আর কিছু খাইতেন?

লতিফ কোনো কথা না বলে হারাধনের চোখের দিকে কটমট করে তাকায়। বুদ্ধিমান হারাধন একটা হাসি দিয়ে খুব নরম গলায় বলে,

-   দাদাএইডা আমার ব্যাবসা নাআইজ হাটবারআইজ যদি না বেঁচিবেঁচুম কবে?

হারাধনের মিষ্টি ব্যবহারে মুগ্ধ হয় লতিফ। এক আনা বিল মিটিয়ে দিয়ে বাঁশের মাচা থেকে উঠে দাঁড়ায়। হাঁটতে হাঁটতে ঘাটের দিকে এগোয়। মাথার ওপর গনগনে সূর্য। দূরে তাকিয়ে দেখে বিলের পানি নেমে গেছে কালিগঙ্গায়। ভাটির টানে সরু এক নদী কালিগঙ্গা ছুটে চলেছে দক্ষিণেপদ্মার দিকে।  বিলের বুকে ভেসে বেড়ানো জলজ উদ্ভিদ কাদায় পড়ে অসহায়পুড়ছে কার্তিকের রোদে। এখানে-ওখানেনিচু জায়গায়যেখানে খানিকটা পানি জমে আছেসেই জায়গাগুলোতে ঝাঁকে ঝাঁকে বক। বকের মাথার ওপর উড়ছে কয়েকটি ফিঙে। লতিফ মুগ্ধ হয়ে দেখছে কার্তিকের বিল। এমন সময় একজন অচেনা লোক ছুটে এসে লতিফের কাঁধে হাত রাখে।

আফনে সিঙ্গাইরের লুক

জ্বি

কলিকাতা থনে আইছেননা?

ওই যেআফনেরে ডাক পারে।

লোকটি আঙুল তুলে যাকে দেখায় তিনি আশরাফ মাস্টারএকটি হিজল গাছের নিচে দাঁড়িয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছেন। 

- আরে তুমার দো সুখবর লতিফ। পারিল থাইক্কা মিলন আইছেতুমার পুত ঐছে। 

আলহামদুলিল্লাহ।

আশরাফ মাষ্টারের হাত চেপে ধরে লতিফ। 

পুলার মা বালা আছে তোকইমিলন কই?

আছেদুইডা ছাগল নিয়া আইছে। বেচা ঐলে এনে আইবো। তুমি হারাধনের ঘরে যাও মিয়ামিষ্টি নিয়াহো। আছেআছেপুলার মাও বালা আছে।  

গরুর গাড়ির ভেতরে ছয়জনঠাসাঠাসি করে বসেছে। মিলন আর লতিফ যোগ হয়েছে। লতিফ কলকাতায় ব্যবসা করেস্ত্রীর সন্তান হবেতাই অন্য একজনের হাতে ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে এসেছে। আসতে আসতে সারা পথ ব্যবসার কথা ভাবলেও এখন আর ব্যবসার কথা ভাবছে না। ভাবছে নবজাতকের কথা। গরুর গাড়ি খানাখন্দে পড়ে দুলছেওরা একে-অন্যের ওপর গড়িয়ে পড়ে। এই যে নিজের দেশের মানুষ একে অন্যের ওপর গড়িয়ে পড়ছেএটা ওরা সবাই উপভোগ করেকেউ কাউকে ঠেলে সরিয়ে দেয় না। এতে ওদের পারস্পরিক বন্ধন আরো সুদৃঢ় হয়। মিলন কলাপাতায় মোড়ানোমোর্তার বেত দিয়ে বাঁধা প্যাকেট খুলে মুরুলি বের করে। ওরা এক কলাপাতা থেকে ভাগ করে কুড়মুড় করে মুরুলি খায়। একজন পানি ভর্তি পিতলের জগ এগিয়ে দিলে তাতে মুখ লাগিয়ে সকলে পানি খায়।   

পুলারে কলিকাতা নিয়া যাবানি মিয়াতুমারে একটা কতা কই। প্রাইমারিডা আমার উপ্রে ছাইরা দেও। গুরাডা শক্ত কৈরা দেই। পরে কলিকাতা নেও আর ডাহা নেওনিয়া যাবা।

- আশরাফ ভাইদিল্লী বহুত দূর। মাত্র তো পুলা ঐলো। অহনও পুলার নামই রাকলাম না।

ভালো কতা মনে করছ। কি নাম রাখবা?

আপনে একটা নাম দেন।

রফিকউদ্দিন আহমদ

আইচ্ছা। রফিকউদ্দিন আহমদ আপনের ইশকুলৈ যাবো।

দিনটি ছিল ১৯২৬ সালের ৩০ অক্টোবর। আবদুল লতিফের স্ত্রী রাফিজা খাতুন সকাল নয়টায় তার প্রথম সন্তান প্রসব করেন। গ্রামের স্কুলের শিক্ষক আশরাফউদ্দিন চৌধুরীর ইচ্ছানুযায়ী স্বামী-স্ত্রী দুজন একমত হয়েই ছেলের নাম রাখেন রফিকউদ্দিন আহমদ। আশরাফউদ্দিন চৌধুরী এবং বীরেন্দ্রমোহন দত্তগুপ্তএই দুজন জ্ঞানী শিক্ষকের কাছে বাল্যশিক্ষা গ্রহণ করেন রফিক। পরবর্তি ১৯ বছরে লতিফ-রাফিজা দম্পতি আরো ৬টি সন্তান জন্ম দেন। সবচেয়ে ছোটো সন্তান জাহানারা বেগম জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৫ সালে। 

বাপ কাছে না থাকলে যা হয়রফিকেরও তাই হয়েছে। পঞ্চম শ্রেণি পাশ করেছে দুই বছর আগেহাই স্কুলে ভর্তি হওয়ার কোনো খবর নেই। তিন বছরের খালেক আর ছয় বছরের রশিদদুই শিশুকে নিয়ে রাফিজা খাতুন ব্যস্তরফিক স্কুলে গেল কি গেল না এই চিন্তা করতে পারলেও তাকে স্কুলে পাঠানোর মত সময় তার নেই। রফিকও ক্রমশ ডানপিটে হয়ে উঠছে। গোল্লাছুটদাড়িয়াবান্ধাকাবাডিগুল্লি খেলাসব কিছুতেই আছে রফিক। এ-পাড়ার সাথে ও-পাড়ার ছেলেদের মারামারিসেখানেও রফিক। কতবার যে পড়ে গিয়ে হাত-পা ভেঙেছেঅন্য ছেলেদের মার খেয়ে মাথা ফাটিয়েছেনাক-মুখ ভেঙেছে তার হিসেব কে রাখে।

এক দুপুরে পাড়ার ছেলেদের নিয়ে শুরু করে বান্দর খেলা। তেতুল গাছের ডালে বান্দরের মত ঝুলে থাকা। কে কতক্ষণ এবং কত উঁচু ডালে ঝুলে থাকতে পারেসেটাই হচ্ছে শ্রেষ্ঠত্ব। শ্রেষ্ঠত্ব দেখাতেই হবেউঁচু এক ডালে উঠে ঝুলতে গিয়ে বান্দর ধপাস। পড়ে গিয়ে বাম হাত ভেঙে ফেলে রফিক। সিঙ্গাইরের কবিরাজের ঝাড়ফুঁকতেল পড়ামালিশ চিকিৎসাকিছুতেই হাত ভালো হয় না। দিনের বেলায় যেমন-তেমন রাতে ব্যথায় চিৎকার করতে থাকে রফিক। খবর পেয়ে লতিফ কলকাতা থেকে ছুটে আসেন। ছেলেকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যান কলকাতায়।

 

আমার নাম জাহানারা বেগম। আমি ১৯৪৫ সালের ১২ জুন মানিকগঞ্জ জেলার সিঙ্গাইর থানার পারিল গ্রামে জন্মগ্রহণ করি। আমার পিতার নাম আবদুল লতিফমাতার নাম রাফিজা বেগম। আমরা ৭ ভাই-বোন। পাঁচ ভাই আর দুই বোন। আমি সকলের ছোটো। আমার বড় ভাইয়ের নাম রফিকউদ্দিন আহমদ। তিনি ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে মিছিল করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে শহিদ হন। আমরা সবাই তাঁকে বড় ভাইজান বলে ডাকতাম। আমার অন্য ভাইদের নামআব্দুর রশিদআবদুল খালেকআব্দুস সালাম এবং খোরশেদ আলাম। বোনের নাম আলেয়া বেগম। সালাম ভাই ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে শহিদ হন। বড় ভাইজান আমাকে খুব আদর করতেন। তিনি আব্বার সাথে ঢাকায় থাকতেন। জগন্নাথ কলেজে পড়তেন আর পারিল প্রিন্টিং প্রেসের কাজে আব্বাকে সাহায্য করতেন। বাড়িতে এলেপ্রায় সারাক্ষণ আমাকে কোলে নিয়ে রাখতেন। যেখানে যেতেন আমাকে সাথে নিয়ে যেতেন। ছোটো ভাই-বোনের প্রতি তাঁর ছিল খুব মায়া। তিনি যখন নিহত হন তখন আমার বয়স মাত্র সাড়ে ছয় বছর। কিন্তু বড় ভাইজানের সব কথা আমার মনে আছেতাঁর মায়া ভরা মুখদুষ্টু দুষ্টু চোখএকটু বেঁকে যাওয়া বাম হাতএলোমেলো চুল সব আমার মনে আছে। একবার গাছ থেকে পড়ে গিয়ে বড় ভাইজানের হাত ভেঙে যায়। অনেক দিন ভোগেন। আমার তখন জন্মই হয় নাই। পরে আম্মার কাছে শুনেছিবড় ভাইজান খুব অস্থির আর ডানপিটে ছিলেন। ভাঙা হাত সারতে অনেক দিন লাগে। হাত ভালো হলেও একটু বেঁকে যায়। এই নিয়ে অবশ্য ভাইজানের কোনো ভ্রূক্ষেপ ছিল না। তিনি মুখে মুখে ছড়া/কবিতা বানাতেন। গ্রামের গাছ-পালাপাখিনদীকৃষকএইসব নিয়েই বেশি কবিতা বানাতেন। সেইসব কবিতা কোথাও লেখা হয় নাই। আমাদের কারোর মনেও নাই। তবে আমাকে নিয়ে যখন গ্রামের এমাথা-সেমাথা ঘুরে বেড়াতেন তখন আমি জিজ্ঞেস করতামভাইজান আমরা কই যাইজবাবে তিনি বলতেন, ‘রাজকন্যা জাহানারা বনবাসে যাবে গো/ পোলাও-কোর্মা পাবে না সে বনের মধু খাবে গো। আমি সকলের ছোটো ছিলাম বলে সব ভাই-বোনের চোখের মনি ছিলাম। বড় ভাইজানের বানানো এই ছড়া অন্য ভাইয়েরাও আমাকে নিয়ে বলত। 

হাতের চিকিৎসার জন্য ভাইজান ১২ বছর বয়সে কলকাতা চলে যান। সেখানে নয় বছর ছিলেন। এই সময়ে তিনি কিছুদিন কলকাতার মিত্র ইন্সটিটিউটে পড়ালেখা করেন। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ হয়ে গেলে আব্বার সাথে ফিরে আসেন। আব্বা ঢাকায় পারিল প্রেস খোলেন। ভাইজান বায়রা স্কুল থেকে ১৯৪৯ সালে২৩ বছর বয়সেমেট্রিক পাস করেন। এরপর মানিকগঞ্জের দেবেন্দ্র কলেজে ভর্তি হলেও পড়ালেখা তেমন কিছুই হয় নাই। পরে জগন্নাথ কলেজ থেকে আইকম পাশ করে হিসাব বিজ্ঞান বিভাগে অনার্সে ভর্তি হন। 

আমি একজন গর্বিত বোন। আমার দুই ভাই মানুষের জন্যমাটির জন্যভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছেন। বড় ভাইজান আমাকে ভাষা দিয়েছেনসালাম ভাইজান আমাকে দেশ দিয়েছেন।  

১৯৯২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারিবৃহস্পতিবার। স্থানঃ দৈনিক জনকণ্ঠ অফিসমতিঝিল। সাহিত্য সম্পাদক নাসির আহমেদের কিউবিক্যাল। সময়ঃ বিকেল তিনটা। পাত্র-পাত্রীঃ ভাষা সৈনিক আবদুল মতিনকবি নাসির আহমেদকবি কাজী রোজীকবি শাকিল রিয়াজকবি কাজী জহিরুল ইসলামকথাশিল্পী বুলবুল চৌধুরী ও কয়েকজন সাংবাদিক। পরের দিন একুশে ফেব্রুয়ারীজনকন্ঠের বিশেষ সংখ্যার কাজ শেষভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক ঘটনাসমূহ আন্দোলনের অন্যতম নেতা আবদুল মতিনের মুখ থেকে শোনার জন্য সকলে তাঁকে ঘিরে ধরেন। 

বুলবুলঃ মতিন ভাই একটু গোড়া থেকে বলেনআপনি কখন কীভাবে এই আন্দোলনের সাথে জড়িত হন?

মতিনঃ শুরু থেকেই ছিলাম। ১৯৪৮ সালে পাবনায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে জনমত তৈরী করি। কিন্তু দূর্বল এবং স্বার্থান্বেষী নেতৃত্বের কারণে ঢাকায় ৪৮ সালের আন্দোলন স্তিমিত হয়ে যায়। ১৯৫১ সালে আমি চেষ্টা করি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীক স্বতন্ত্র রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটিকে শক্তিশালি করে তুলতে।  

শাকিলঃ আপনিই তো এর আহ্বায়ক হন

মতিনঃ হ্যাঁআমিই আহ্বায়ক হই।

নাসিরঃ সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সাথে আপনাদের মূল তফাৎটা কোথায় ছিল?

মতিনঃ সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদে নানান মতের মানুষ ছিলেন। কমিউনিস্টরা ছিলেনদক্ষিণ এবং অর্ধ দক্ষিণপন্থিরাও ছিলেন। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ যারা গঠন করেছিলেন তাঁরা নিজেদের মধ্যে ছিলেন বিভক্ত এবং মতাদর্শগত দিক থেকে হতাশ। এই কম্বিনেশন দিয়ে জোরালো আন্দোলন হয় কি করেসর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সিদ্ধান্ত মেনে নিলেতো ৫২ সালের আন্দোলনও ৪৮ সালের মত মুখ থুবড়ে পড়ত।

জহিরুলঃ ভাষা আন্দোলনের সাথে জড়িত দক্ষিণপন্থি কে কে ছিলেন?

মতিনঃ কমরুদ্দিন শহুদতাজউদ্দিন আহমদশওকত আলীবাহাউদ্দিনশামসুল হকঅলি আহাদ প্রমূখ ছিলেন প্রথম সারির দক্ষিণপন্থিদ্বিতীয় সারিতে ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানআবদুল হামিদওদুদদবিরউদ্দিননইমউদ্দিনকাজী গোলাম মাহবুবজালালউদ্দিননুরুল ইসলাম প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ। এই দুই শ্রেণি ছাড়াও দক্ষিণের আরো বিচিত্র অবস্থানে থাকা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীহাশিমউদ্দিন প্রমূখও ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন। দুই একজন কমিউনিস্টও নেতৃত্বে ছিলেন যেমনঃ মোঃ তোয়াহা। আমার মতো হাতে গোনা দুই একজন ছিল যারা কমিউনিস্টও না আবার পাকিস্তান আন্দোলনেও ছিল না। আমাদের মূল লক্ষ্যই ছিল রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন। 

রোজীঃ মতিন ভাইএটা একটু পরিষ্কার করে বলেন তো২০ তারিখ রাতের সভায় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ১৪৪ ধারা না ভাঙার সিদ্ধান্ত কেন নিয়েছিল?

মতিনঃ প্রধান কারণ ছিল ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার ফলে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে যেখানে একদিকে আন্দোলন তাঁদের নেতৃত্বাধীন বা নিয়ন্ত্রণে না থাকতে পারেঅন্যদিকে সেইরকম পরিস্থিতিতে সরকার নির্বাচন নিয়ে যেসব কথাবার্তা বলছিল তা রক্ষা না করে দীর্ঘকালের জন্য নির্বাচন পিছিয়ে দিতে পারে বা তা বাতিল করে দিতে পারেএমন কি সামরিক শাসনের মতোও কিছু আরোপ করতে পারে।  তবে কারণ যাই হোক তাঁদের এইরকম ধারণা বা আশঙ্কা বাস্তব সম্মত ছিল না। বরং ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার মাধ্যমে ২১ ফেব্রুয়ারি ও তার পরবর্তি অবস্থা এবং তার ফলে ভাষা আন্দোলনের মহান বিজয়ই সরকারকে একদিকে গণবিচ্ছিন্নঅন্যদিকে ভীত সন্ত্রস্ত করে নির্বাচন ত্বরান্বিত ও অনুষ্ঠিত করতে বাধ্য করেছিল। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ হয়েছিল বলেই তো ২১-এর ভাষা আন্দোলন সফল হয়েছিল। 

নাসিরঃ ৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের শোচনীয় পরাজয়ের একটা বড় কারণ ২১-এর ভাষা আন্দোলনের সফলতাঠিক কি-না মতিন ভাই?

মতিনঃ একদম ঠিক বলেছ নাসির। বাঙালির অধিকার আদায়ের পরবর্তি প্রতিটি আন্দোলনের ভিত্তি হচ্ছে ২১-এর ভাষা আন্দোলনের সফলতা।  

শাকিলঃ ২১ তারিখ সকাল ১১টায় আমতলার সভায় আপনি সভাপতিত্ব না করে গাজীউল হক কেন সভাপতিত্ব করলেন?

মতিনঃ আগের দিন রাতেই আমরা এই সিদ্ধান্ত নেই। সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি যখন সিদ্ধান্ত নিলো ১৪৪ ধারা ভাঙা হবে নাআমরা ১১জন ছাত্রযাদের কেউ সর্বদলীয় কমিটিতে ছিলাম নাতড়িঘড়ি করে রাত বারোটায় মিটিং করি। সেই মিটিংয়ে ঠিক হয় সকালে আমতলায় যে সভা হবে সেখানে গাজীউল হক সভাপতিত্ব করবেন। প্রথমেই ভাষণ দেবেন সর্বদলীয় কমিটির পক্ষে আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক। তাঁর পরে বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম কমিটির মুখপাত্র হিসাবে আমি এবং শেষে গাজীউল হক সভাপতির ভাষণে ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্ত জানিয়ে সভা শেষ করবেন। 

জহিরুলঃ মতিন ভাইযতটুকু মনে করতে পারেনআপনার সেদিনের বক্তব্যের সার সংক্ষেপ যদি বলেন।

মতিনঃ আমি মূলত বলেছি যে আমরা ১৪৪ ধারা ভাঙবোকীভাবে ভাঙবোকি কর্মসূচী হবে সেইসব বলেছি। সভাশেষে মিছিল সহকারে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গনে জমায়েত হওয়াসেখান থেকে আইন পরিষদ ভবনে গিয়ে বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব পাস করানো এবং সেই প্রস্তাবকে ভিত্তি করে দেশব্যাপী দূর্বার আন্দোলন গড়ে তোলার পদক্ষেপগুলোতে শত বাঁধা বিপত্তি আসতে পারেতা সত্বেও বাস্তবায়িত করার আহ্বান জানাই এবং বলি যেআমাদের এই সঠিক এবং মহান কর্মসূচী বাস্তবায়নের মাধ্যমেই কেবল বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করা সম্ভব। কিন্তু সেই সঠিক ও মহান কর্মসূচীর অঙ্কুরেই বিনাশ ঘটবে যদি আমরা স্বৈরাচারী শাসকদের উদ্দেশ্যমূলকভাবে আরোপিত ১৪৪ ধারা মেনে নিই। সুতরাং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলনকে জয়যুক্ত করার জন্য আমাদের কর্তব্য হবে ১৪৪ ধারা অমান্য করা এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রয়োজনেই আমাদের করণীয় হবে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের ভ্রান্ত ও চরম ক্ষতিকর প্রস্তাব গ্রহণ না করা। আমার এইরকম যুক্তিভিত্তিক বক্তব্য শেষ হতেই সমবেত ছাত্ররা তুমুল করতালির মাধ্যমে আমাদের ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার সিদ্ধান্তের প্রতি সমর্থন জানায়। 

রোজীঃ পুলিশ গুলি ছোঁড়ে কখনআর কজন শহিদ হয় সেদিনএকেক জায়গায় আমরা একেক রকম সংখ্যা দেখিএকেকজনের নাম দেখি।

মতিনঃ ঠিক হয়েছিল ছোটো ছোটো মিছিল বের হবে কিন্তু পাঁচজনের না দশজনের এই নিয়ে কিছুটা সময় নষ্ট হল। এরপর ঠিক হল ১০জন করে মিছিল বের হবে। প্রথম মিছিলটি ছিল ছাত্রীদের। পরপর তিনটি মিছিলকে পুলিশ গ্রেফতার করে ট্রাকে তুলে নিয়ে যায়। স্বতঃস্ফুর্তভাবে ছাত্রজনতা বেরিয়ে এসেছে। দশ হাজারের কম হবে না লোক সমাগম হয়েছে। জগন্নাথ কলেজ থেকে প্রচুর ছাত্র এসেছে। রফিকউদ্দিন আহমদ ছিলেন জগন্নাথ কলেজের ছাত্র। তখন তিনটা দশ মিনিট। ম্যাজিস্ট্রেট কোরেশীর হুকুমে পুলিশ প্রথমে টিয়ার শেল পরে গুলি ছুঁড়তে শুরু করে। অনেকেই মাটিতে লুটিয়ে পরে। সেদিন ৯৬জন গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয় এবং সাথে সাথে দুই ছাত্র শহিদ হনএদের একজন রফিক এবং অন্যজন জব্বার। রাতে হাসপাতালে মারা যান বরকত। সালাম মারা যায় বেশ অনেক দিন পরে। পরের দিন গায়েবানা জানাজা শেষে সারা ঢাকায় মিছিল বের হয়। পাকিস্তান আর্মির ফোর্টিন ডিভিশনের একটি আস্তানা ছিল হাইকোর্টের পেছনে। ওরা বেরিয়ে আসে। নবাবপুর রোডে রথখোলার কাছে সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহত হন সফিউর রহমান। 

শাকিলঃ একজন ছাত্রের মাথার খুলি উড়ে যায় গুলিতেতিনি কে ছিলেন?

মতিনঃ আহাও ছিল রফিক। জগন্নাথ কলেজের হিসাব বিজ্ঞানের ছাত্র। অনার্সে পড়লেও ওর বেশ বয়স হয়েছিল। মাথার অর্ধেকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। একজন হাতে করে মগজটা রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে আসে। কী যে হৃদয় বিদারক দৃশ্যমেডিকেল কলেজ হোস্টেলের সামনে তখন কারবালা। কিন্তু কারবালার এই শোকই শক্তি হয়ে ওঠেবাংলা ভাষার চেতনা হয়ে ওঠে। পরদিন লক্ষ লক্ষ মানুষ ১৪৪ ধারা ভেঙে ভাষার দাবী নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে আসে। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। 

 

এক সকালে কলেজে না গিয়ে হাঁটতে হাঁটতে জনসন রোডের ন্যাশনাল মেডিকেল স্কুল ভবনে পৌঁছে যায় রফিক। হাতে একটি খাতাপরণে খাকি প্যান্টগায়ে হাফ হাতা সাদা শার্ট। মাথায় উস্কো-খুস্কো চুল এবং এই চুলের নিচে তার চেয়েও উস্কো-খুস্কো ভাবনা। মেডিকেল স্কুলের গেটের পাশে একটি ভাঙা দেয়ালদেয়ালের ভেতরে একটি বিশাল ছাতিম গাছ। ছাতিম গাছের নিচে অনেকখানি জায়গা খোড়া হয়েছে কোনো কারণেখোড়া জায়গাটিতে লাল রঙের ভেজা মাটি হাঁ করে আছেময়লা আবর্জনার স্তুপ এবং কিছুটা বৃষ্টির পানি জমে আছে সেখানে। আবর্জনার স্তুপের ওপর বসে আছে কয়েকটি ধবল বক। হয়ত জমে থাকা বৃষ্টির পানিতে মাছও থাকতে পারে। মাছ না থাকলে বক আসার কথা না। রফিক ভাঙা দেয়ালের ওপর বসে ছাতিম গাছ আর তার নিচের গর্তটির ছবি আঁকছে আপন মনে। ছবি আঁকা শেষ হতেই দেখে কালো মত এক লোক ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। প্রথমে সে কিছুটা ভড়কে গেলেও লোকটির অমায়িক ব্যাবহারে সে মুগ্ধ হয়। তিনি তাঁর কামানো চিবুক বার দুই চুলকে নিয়ে বলেনহবেতোমাকে দিয়ে হবে। আসো আমার সাথে।

কোথায়?

এলেই দেখতে পাবে। কলেজে পড়ো?

হুমজগন্নাথে।

কোন শাখা

বাণিজ্য। 

ততক্ষণে একটি জড়াজীর্ণ বিশাল হলঘরে এসে পৌঁছে যায় রফিক। দেয়ালে নানান রকম ছবি লাগানো। অমসৃণ পাকা ফ্লোরের ওপর পিতলেরলোহারমাটির বেশ কিছু ভাস্কর্য। রফিক দ্রুত সামনের বড় দেয়ালটির দিকে এগিয়ে যায়। বেশ কিছু দূর্ভিক্ষের ছবি। মুগ্ধ হয়ে ছবিগুলো দেখে রফিক।

এইগুলি কে আঁকছে?

আমি। আমার নাম জয়নুল আবেদীন। এই ছবিগুলি আমি ৪৩ সালে আঁকি। এটা একটা আর্ট স্কুল। সরকারী আর্ট স্কুল। আমি এর অধ্যক্ষ। তুমি চাইলে ভর্তি হতে পারো। আমাদের তেমন বেশি ছাত্রছাত্রী নেই।   

রফিক ঘাড় ঘুরিয়ে স্কুলটির দৈন্যদশা দেখে।

-   কিছুক্ষণের মধ্যে স্টুডেন্টরা চলে আসবে। এখন এর অবস্থা বেশ খারাপতবে আমরা একটা জায়গা পেয়ে গেছিসেগুন বাগিচায়। ওখানে চলে যাব। সেগুন বাগিচা চেনো তো

হল ঘরটির দশা যত খারাপই হোক রফিকের খুব ভালো লাগে। চারদিকে শিল্পের ছড়াছড়ি। ওর মা যখন কাপড়ের ওপর রঙিন সুতো দিয়ে নানান রকমের নকশা করেরফিক মুগ্ধ হয়ে দেখেমার কাছ থেকে ফ্রেমটা নিয়ে মাঝে মাঝে নিজেও সুঁই চালায়। এই পুরো ঘরটিকে রফিকের মনে হচ্ছে মায়ের সূচীকর্মের ফ্রেমআর ছবিগুলোভাস্কর্যগুলোএখানে ওখানে পড়ে থাকা রঙের ফোটাগুলো সেই ফ্রেমে ভেসে ওঠা এক একটি শৈল্পিক নকশা। 

একটি অল্প বয়সী ছেলে কেতলিতে চা নিয়ে আসে। জয়নুল আবেদীন চায়ের কাপ হাতে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাগানে চলে যান। রফিক তাঁকে কিছু না বলেই আর্ট ইনস্টিটিউট থেকে বেরিয়ে কলেজে চলে যায়। এর কিছুদিন পরেই আর্ট ইনস্টিটিউট সেগুন বাগিচায় স্থানান্তরিত হয়। রফিক সেখানে আর কোনো দিন যায় নি। কিন্তু এই জড়াজীর্ণ হলঘরে সে যে রঙের খেলা দেখেছে তা তাঁর মাথায় বর্ণিল আলোর ফোয়ারার মত সব সময় খেলা করে।

১৯৫২ সালের ২৫ জানুয়ারীবিকেল তিনটা। আকাশে মিষ্টি রোদ। রফিক বসে আছে চামেলী হিস্টেলের সামনে ঘাসের ওপর। পূর্বদিকে মুখ করে বসায় নিজের প্রলম্বিত ছায়া দেখতে পায়। ওর হাতে রোল করা একটি কাপড়। রোলটি খাড়া করে এর দীর্ঘ ছায়া ফেলে ঘাসের মাঠে। আলো-ছায়ার খেলাটি বেশ লাগছে। মেয়েদের হোস্টেলের সামনে এভাবে শিকারির মত ওঁত পেতে বসে থাকা খুব অশোভন। তাই সে হোস্টেলের গেটের উল্টোদিকে মুখ করে বসেছে। হঠাৎ ওর মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। যাকে খুঁজছিল তাঁকে পেয়ে গেছে। রিক্সা থেকে নেমে শাফিয়া খাতুন হোস্টেলের দিকে হেঁটে আসছেন। ওর পরনে সাদা শাড়ি। কাঁধে চটের ব্যাগ। কপালে কাজলের টিপ। রফিক লাফ দিয়ে উঠে এক দৌড়ে শাফিয়ার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।

- আমার নাম রফিকআমি জগন্নাথ কলেজে পড়ি। আপনি আমাদের ক্লাসে ভাষণ দিয়েছিলেন।

গত বছর। কেমন আছেন আপনিআপনার বন্ধুরাসবাই ভালো তোবাংলা ভাষার জন্য আমাদের কিন্তু খুব জোরালো আন্দোলন করতে হবে। আপনাদের সহযোগিতা দরকার হবে।

জ্বি আমরা প্রস্তুত আছি। 

রফিক হাতের রোলটি বাড়িয়ে দেয় শাফিয়ার দিকে। শাফিয়া সেটি হাতে নিতে নিতে বলে – 

কি এটাখুলি

রুমে গিয়ে দেখবেন। ঠিক আছেএখন যাই।

আচ্ছা। ভালো থাকবেন।

কিছুদূর গিয়ে পেছনে ফিরে তাকায় রফিক। শাফিয়া তখনো চামেলী হোস্টেলের গেটের ভেতরে ঢোকে নি। রফিক চিৎকার করে ডাকে।

-   আপা।

শাফিয়া থমকে দাঁড়ায়। রফিকের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসে। ওরা দুজন দুজনের দিকে এগিয়ে আসে। মাঝখানে ঘাসের মাঠে ওরা মুখোমুখি দাঁড়ায়।

-   এটা খোলেন।

শাফিয়া আবারো মিষ্টি করে হাসে। হাতের রোলটা খুলে মেলে ধরে।

 

সাদা কাপড়ে লাল সূতোর নান্দনিক সূচীকর্ম। দুটি লাইন, ‘বাংলা আমার ভালোবাসা/ বাংলা আমার প্রাণের ভাষা

খুব সুন্দর। আপনার মা করেছেনাকি বোন?

আমি করেছি।

শাফিয়ার ইচ্ছে হয়রফিককে জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু সে তা করে না। কাপড়ের টুকরোটি রোল করে ডান হাতে নিয়ে দ্রুত ছুটে যায় চামেলী হোস্টেলের গেটের দিকে। তখন ওর চোখ ঝাপসা।      

হলিসউডনিউ ইয়র্ক। ৩১ মে ২০১৮।               

Comments

Popular posts from this blog

শিল্পী কাজী রকিবের সাক্ষাৎকার

নন-একাডেমিক শিল্পীরাই নতুন কিছু দেয় -    কাজী রকিব  [কাজী রকিব বাংলাদেশের একজন গুণী শিল্পী। রাজশাহী আর্ট কলেজের একজন প্রতিষ্ঠাতা-শিক্ষক। কলেজের প্রথম ক্লাসটি নেবার কৃতিত্বও তাঁর। নিরন্তর ছবি আঁকেন। নানান মাধ্যমে ,  নানান ভাবনার ছবি। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে সস্ত্রীক বসবাস। তার স্ত্রী মাসুদা কাজীও একজন গুণী শিল্পী। বৈচিত্রপ্রিয় এই শিল্পীর একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন কবি কাজী জহিরুল ইসলাম। ধারাবাহিকভাবে তা এখানে প্রকাশ করা হবে। আজ উপস্থাপন করা হলো প্রথম পর্ব।]   জহিরুলঃ  বেশিরভাগ শিল্পীই নিজের একটা স্টাইল তৈরি করেন ,  নিজস্বতা যাকে আমরা বলি। আবার কেউ কেউ একই ধরণের ছবি বারবার আঁকেন। আপনার কাজে বৈচিত্র খুব বেশি ,  এতে করে "টাইপড" অপবাদ থেকে আপনি মুক্ত কিন্তু নিজের একটি স্টাইল তৈরি করতে না পারা বা তৈরি হয়নি বলে কি আক্ষেপ হয় ,  নাকি এই যে ভার্সেটিলিটি এটাই আপনি বেশি উপভোগ করেন ?    রকিবঃ   আমি আসলে আলাদা করে ভাবিনি এই স্টাইল বিষয়ে। কারো মতো আঁকারও চেষ্টা করিনি তেমন ভাবে। অল্প বয়সে ,  আমার ১৯ / ২০ বছর বয়সে ,  সালভাদর দালির মতো আঁকতে চেষ্টা করেছিলাম কিছুদিন ।

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জুর সাক্ষাৎকার || পর্ব ৭

মতিউর রহমান চৌধুরীকে  র‍্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কারের জন্য নমিনেট করেছিলেন  আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু       [লেখক, সাংবাদিক, অনুবাদক আনোয়ার হোসেইন মঞ্জুর সাক্ষাৎকারের সপ্তম  পর্ব আজ প্রকাশ করা হলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কবি কাজী জহিরুল ইসলাম।]          জহিরুলঃ  আপনার সাংবাদিকতা জীবনের প্রায় পুরোটাই ব্যয় করেছেন জাতীয় সংসদ কভার করে। এই সংসদে আমাদের সংবিধানের অনেকগুলো সংশোধনী পাশ হয়েছে। আমাদের নেতারা সব সময় বলেন, ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড় কিন্তু প্রকৃত চিত্র হচ্ছে দেশের চেয়ে দলের স্বার্থ বড় হয়ে ওঠে এবং দলের চেয়ে ব্যক্তির/পরিবারের স্বার্থই বেশি গুরুত্ব পায়। প্রধান প্রধান সংশোধনীগুলোর আলোকে যদি বিশ্লেষণ করেন কতোটা জাতীয় স্বার্থে আর কতটা ব্যক্তি বা পরিবারের স্বার্থে এইসব সংশোধনীগুলো করা হয়েছে।    মঞ্জুঃ   আপনি ঠিকই বলেছেন, এযাবত বাংলাদেশে ১১টি জাতীয় সংসদ গঠিত হয়েছে এবং এর মধ্যে দ্বিতীয় সংসদ থেকে নবম সংসদ পর্যন্ত মোট আটটি সংসদের অধিবেশন কভার করা সুযোগ হয়েছে আমার। আমার সংসদ কভারের সময়ে আমাদের সংবিধানের ১০টি সংশোধনী অনুমোদিত হয়েছে এবং সংশোধনী প্রক্রিয়া কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। এখন পর্যন্ত স

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জুর সাক্ষাৎকার - তৃতীয় পর্ব

মঞ্জু আমার ওপর রাগ করেছে                                                           - আল মাহমুদ [লেখক, সাংবাদিক, অনুবাদক আনোয়ার হোসেইন মঞ্জুর সাক্ষাৎকারের  তৃতীয় পর্ব আজ প্রকাশ করা হলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কবি কাজী জহিরুল ইসলাম।]  সাক্ষাৎকার নেবার এক পর্যায়ে আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু  ও কাজী জহিরুল ইসলাম। ওয়ান্টাগ পার্ক, নিউ ইয়র্ক।  ছবি তুলেছেন ড. মাহবুব হাসান।   জহিরুলঃ  খুশবন্ত সিং তার সকল বই অনুবাদ করার লিখিত অনুমতি দিলেন আপনাকে এবং সেই অনুমতিপত্রটি তিনি নিজ হাতে আপনার সামনেই বাংলায় লিখে দিলেন। তিনি কিভাবে বাংলা শিখলেন তা কি জানতে পেরেছিলেন ?  মঞ্জুঃ    জ্বি ,  ঘটনাটি  ঘটে  ১৯৯২ সালের ডিসেম্বর মাসে ,  এ সম্পর্কে আমি আগের এক প্রশ্নে বলেছি। তারিখটি আমার স্মরণে নেই। তবে বাবরি মসজিদ ধ্বংস করার পর ,  ডিসেম্বরের শেষ দিকে। না ,  বাংলায় নয় ,  উনি ইংরেজিতে লিখেছেন। আমার কফি পানের সময়ের মধ্যেই লিখে দিয়েছেন। ১৯৮৪ থেকে মাঝে দীর্ঘ বিরতি দিয়ে আমাকে তিনটি বা চারটি চিঠি লিখেছেন। লিখেছেন বলতে আমার চিঠির উত্তর দিয়েছেন। প্রতিটি চিঠি ইংরেজিতেই লিখেছেন। প্রতিটি চিঠিতে আমাকে সম্বোধন করেছেন  “ আনোয়ার ভাই ,”  বলে।