Skip to main content

একজন সত্যনিষ্ঠ প্রতিবাদী কবি || মনিজা রহমান ||

কাজী জহিরুল ইসলাম : একজন সত্যনিষ্ঠ প্রতিবাদী কবি

|| মনিজা রহমান || 





 

‘আজকে দুটো পা কিনেছি আমি

ওই দুটো পা ছিল না খুব দামী

পড়েই ছিল অবহেলায় খোলা টেবিলটাতে

কি খুঁজতে কি খুঁজে পেলাম, ওরা আমার হাতে। 

মোটাসোটা মাংসল পা রঙটি খুবই কালো

কি বিচ্ছিরি নোখের ওপর পড়ল এসে আলো। 

ওখানেতো কাদামাটিদূরের ধূলিঝড়

পায়ের ওপর তখন দেখি খাড়া একাব্বর।

 

সময়টা ২০১৬ সালের  ১৬ ডিসেম্বর। বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে স্বরচিত কবিতা পাঠ চলছে। আবৃত্তি করছেন নিউইয়র্কের একজন নামকরা কবি কাজী জহিরুল ইসলাম। ডিসেম্বর মানে তীব্র শীতের সময়। কনকনে ঠান্ডা বাতাসে জমে যেতে যেতে হঠাৎ বারুদের মতো জ্বলে উঠল হৃদয়, জ্বলে উঠল মনন-চেতনা। নিজেকে খুব গর্বিত মনে হল। আমি যে মঞ্চে দাঁড়িয়ে কবিতা পাঠ করছিযে শহরে বাস করিসেই মঞ্চে, সেই শহরে কাজী জহিরুল ইসলামের মতো একজন কবি আছেন। 

 

‘এই দুপায়ে কেমন যেন জলোচ্ছাসের গান

এই দু’পা কি দেবে আমায় পথেরই সন্ধান?

এই দু’পায়ের ওপর খাড়া গাজী একাব্বর

এই দু’টি পা লোহার মতো সুদৃঢ় প্রস্তুর

এই দু’পায়ে গর্জে ওঠে অনন্য সংঘাত

এই দু’পাই গুঁড়িয়ে দেবে দূরের কালো হাত।’

 

এমন তীব্র ভাষায় প্রতিবাদী কবিতা লেখার সাহস সবার থাকে না। যে সাহস কবি কাজী জহিরুল ইসলামের আছে। তিনি সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলতে পারেন। মানুষ মাত্র ভুল করে।  তবে বেশীরভাগ মানুষ সেই ভুল স্বীকার করতে চান নাকিন্তু কাজী জহিরুল ইসলাম করেন। কবির সঙ্গে আমার পরিচয় নিউইয়র্কে আসার পরে।  জ্যাকসন হাইটসে সাহিত্য একাডেমির মাসিক সভায় তাঁকে আমি প্রথম দেখি। তারপর তাঁর কবিতা পাঠ শুনি কবি শহীদ কাদরীর বাসায় আয়োজিত একটি কবিতা সন্ধ্যায়। তাঁর কবিতায় যেমন বিশেষত্ব আছেতেমনি বিশেষত্ব আছে তাঁর পাঠেও মাঝে মাঝে মনে হয়েছে  সৃষ্টিকর্তা একজন মানুষকে এত গুণ দিয়ে না পাঠালেও পারতেন। 

 

কবি কাজী জহিরুল ইসলাম শুধু পরিশ্রমী ননঅসম্ভব অধ্যবসায়ী। সবাই যেখানে নানা কাজের অজুহাতে বছরে একটা বই বের করতে হিমশিম খায়সেখানে তিনি প্রতি বছর পাঁচ থেকে দশটি বই প্রকাশ করেন। আর প্রত্যেকটি বই মানসম্মত। প্রত্যেক বইয়ে আছে নিজেকে ছাড়িয়ে যাবার চেষ্টা। অথচ তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকরী করেন। পুরো পৃথিবীর চোখ যেখানেসেই জাতিসংঘের একজন গুরুত্বপূর্ণ পদে তিনি অধিষ্ঠিত। জাতিসংঘের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা হিসেবেই তিনি অভিবাসী বাঙালি কমিউনিটিতে আলোচিত হতে পারতেন। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা যাকে দেনতাকে যেন ঢেলেই দেন। তাঁকে দিলেন কাব্য প্রতিভা। অসাধারণ গদ্য লেখার হাত। অনুবাদের দক্ষতা। উপস্থাপকের প্রতুৎপন্নমতিত্ব। এর যে কোনো একটি গুণ থাকলে অনেকে নিজের জীবন স্বার্থক মনে করতে পারতেন। 


মানুষ হিসেবে কাজী জহিরুল ইসলামের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিকতার রসবোধ। গেল নভেম্বরে তাঁর সঙ্গে উদীচি যুক্তরাষ্ট্র শাখার হেমন্ত মেলায় দুই ইভেন্টের বিচারক হিসেবে ছিলাম আমি তিনি সেখানে বসে বসে এমন সরস মন্তব্য করছিলেনতাতে সত্যি মজা পাচ্ছিলাম। দুজন মিলে খুব আনন্দের সঙ্গে কাজটা সম্পন্ন করি। 

 

মুখে না বললেও কাজী জহিরুল ইসলাম ও মুক্তি জহির দম্পতির প্রতি আমি একটা কারণে সব সময় হৃদয়ের টান অনুভব করি। আমার মতো তাঁদেরও একজন অটিস্টিক সন্তান আছে। আমার মতো তাঁরাও সেই সন্তানকে মনে করেন সৃষ্টিকর্তার সেরা আশির্বাদ। আমি যেমন যে কোনো অনুষ্ঠানে আমার স্পেশাল ছেলেটিকে নিয়ে যাইতাঁরাও নিয়ে আসেন তাঁদের কন্যাকে। কাজী জহিরুল ইসলাম লেখক হলেও গর্তজীবী ননবরং সব ধরনের সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশ নেন আনন্দের সঙ্গে। 

 

কোনো মানুষের জীবন আসলেই নিরবচ্ছিন্ন সুখের কিংবা দুঃখের নয়। কাজী জহিরুল ইসলামের জীবন তেমনই। তাই বলে তিনি কখনও সস্তা জনপ্রিয়তা কিংবা দ্রুত ওপরে ওঠার সিঁড়ি খুঁজতে দলপ্রীতি করেন না। বরং মানুষের বিবেকে কুঠারাঘাত করতে ভালোবাসেন। যে কারণে লিখেতে পারেন বিশ্ব বেহায়াকে নিয়ে একটি কালজয়ী কবিতা। যে কবিতা যুগে যুগে স্বৈরশাসকের স্বরূপ চেনায়। তিনি পারেন জালালুদ্দিন রুমীর সুফিবাদী কবিতাকে হৃদয়ে ধারণ করে তাকে বাংলাভাষী পাঠকের কাছে পরিবেশন করতে। কারণ কাজী জহিরুল ইসলামের মধ্যে বসত করে এক মরমিয়া সত্ত্বা।

 

তবু শেষ পর্যন্ত কাজী জহিরুল ইসলাম আমার কাছে রাষ্ট্র ও সমাজের নানা অসঙ্গতির বিরুদ্ধে একজন প্রতিবাদী কবি। শওকত ওসমানে বিখ্যাত রূপকধর্মী উপন্যাস ক্রীতদাসের হাসি’ উপন্যাসের সেই কবির মতো। লেখক এই উপন্যাসে বলেছিলেনকবি তিন প্রকার। প্রথম দলে যারা থাকেনতারা হলেন রাজকবি। কিছু লেখার আগে রাজার চোখের ইশারা দেখে নেন। আরেক দলে যারা আছেনতারা সব সময়ই হতাশায় ভোগেন। সব কিছুর মধ্যে নেতিবাচকতা খুঁজে পান। আরেক দল কবি আছেনযারা প্রতিবাদ করেন। তারা সত্যের প্রশ্নে কোনো কিছুর সঙ্গে আপোষ করেন না। 

 

আমার কাছে কাজী জহিরুল ইসলাম তৃতীয় দলের সত্যনিষ্ঠ ও প্রতিবাদী কবি। 

 

নিউ ইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র। ১৫ ডিসেম্বর ২০১৭। 

Comments

Popular posts from this blog

শিল্পী কাজী রকিবের সাক্ষাৎকার

নন-একাডেমিক শিল্পীরাই নতুন কিছু দেয় -    কাজী রকিব  [কাজী রকিব বাংলাদেশের একজন গুণী শিল্পী। রাজশাহী আর্ট কলেজের একজন প্রতিষ্ঠাতা-শিক্ষক। কলেজের প্রথম ক্লাসটি নেবার কৃতিত্বও তাঁর। নিরন্তর ছবি আঁকেন। নানান মাধ্যমে ,  নানান ভাবনার ছবি। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে সস্ত্রীক বসবাস। তার স্ত্রী মাসুদা কাজীও একজন গুণী শিল্পী। বৈচিত্রপ্রিয় এই শিল্পীর একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন কবি কাজী জহিরুল ইসলাম। ধারাবাহিকভাবে তা এখানে প্রকাশ করা হবে। আজ উপস্থাপন করা হলো প্রথম পর্ব।]   জহিরুলঃ  বেশিরভাগ শিল্পীই নিজের একটা স্টাইল তৈরি করেন ,  নিজস্বতা যাকে আমরা বলি। আবার কেউ কেউ একই ধরণের ছবি বারবার আঁকেন। আপনার কাজে বৈচিত্র খুব বেশি ,  এতে করে "টাইপড" অপবাদ থেকে আপনি মুক্ত কিন্তু নিজের একটি স্টাইল তৈরি করতে না পারা বা তৈরি হয়নি বলে কি আক্ষেপ হয় ,  নাকি এই যে ভার্সেটিলিটি এটাই আপনি বেশি উপভোগ করেন ?    রকিবঃ   আমি আসলে আলাদা করে ভাবিনি এই স্টাইল বিষয়ে। কারো মতো আঁকারও চেষ্টা করিনি তেমন ভাবে। অল্প বয়সে ,  আমার ১৯ / ২০ বছর বয়সে ,  সালভাদর দালির মতো আঁকতে চেষ্টা করেছিলাম কিছুদিন ।

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জুর সাক্ষাৎকার || পর্ব ৭

মতিউর রহমান চৌধুরীকে  র‍্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কারের জন্য নমিনেট করেছিলেন  আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু       [লেখক, সাংবাদিক, অনুবাদক আনোয়ার হোসেইন মঞ্জুর সাক্ষাৎকারের সপ্তম  পর্ব আজ প্রকাশ করা হলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কবি কাজী জহিরুল ইসলাম।]          জহিরুলঃ  আপনার সাংবাদিকতা জীবনের প্রায় পুরোটাই ব্যয় করেছেন জাতীয় সংসদ কভার করে। এই সংসদে আমাদের সংবিধানের অনেকগুলো সংশোধনী পাশ হয়েছে। আমাদের নেতারা সব সময় বলেন, ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড় কিন্তু প্রকৃত চিত্র হচ্ছে দেশের চেয়ে দলের স্বার্থ বড় হয়ে ওঠে এবং দলের চেয়ে ব্যক্তির/পরিবারের স্বার্থই বেশি গুরুত্ব পায়। প্রধান প্রধান সংশোধনীগুলোর আলোকে যদি বিশ্লেষণ করেন কতোটা জাতীয় স্বার্থে আর কতটা ব্যক্তি বা পরিবারের স্বার্থে এইসব সংশোধনীগুলো করা হয়েছে।    মঞ্জুঃ   আপনি ঠিকই বলেছেন, এযাবত বাংলাদেশে ১১টি জাতীয় সংসদ গঠিত হয়েছে এবং এর মধ্যে দ্বিতীয় সংসদ থেকে নবম সংসদ পর্যন্ত মোট আটটি সংসদের অধিবেশন কভার করা সুযোগ হয়েছে আমার। আমার সংসদ কভারের সময়ে আমাদের সংবিধানের ১০টি সংশোধনী অনুমোদিত হয়েছে এবং সংশোধনী প্রক্রিয়া কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। এখন পর্যন্ত স

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জুর সাক্ষাৎকার - তৃতীয় পর্ব

মঞ্জু আমার ওপর রাগ করেছে                                                           - আল মাহমুদ [লেখক, সাংবাদিক, অনুবাদক আনোয়ার হোসেইন মঞ্জুর সাক্ষাৎকারের  তৃতীয় পর্ব আজ প্রকাশ করা হলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কবি কাজী জহিরুল ইসলাম।]  সাক্ষাৎকার নেবার এক পর্যায়ে আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু  ও কাজী জহিরুল ইসলাম। ওয়ান্টাগ পার্ক, নিউ ইয়র্ক।  ছবি তুলেছেন ড. মাহবুব হাসান।   জহিরুলঃ  খুশবন্ত সিং তার সকল বই অনুবাদ করার লিখিত অনুমতি দিলেন আপনাকে এবং সেই অনুমতিপত্রটি তিনি নিজ হাতে আপনার সামনেই বাংলায় লিখে দিলেন। তিনি কিভাবে বাংলা শিখলেন তা কি জানতে পেরেছিলেন ?  মঞ্জুঃ    জ্বি ,  ঘটনাটি  ঘটে  ১৯৯২ সালের ডিসেম্বর মাসে ,  এ সম্পর্কে আমি আগের এক প্রশ্নে বলেছি। তারিখটি আমার স্মরণে নেই। তবে বাবরি মসজিদ ধ্বংস করার পর ,  ডিসেম্বরের শেষ দিকে। না ,  বাংলায় নয় ,  উনি ইংরেজিতে লিখেছেন। আমার কফি পানের সময়ের মধ্যেই লিখে দিয়েছেন। ১৯৮৪ থেকে মাঝে দীর্ঘ বিরতি দিয়ে আমাকে তিনটি বা চারটি চিঠি লিখেছেন। লিখেছেন বলতে আমার চিঠির উত্তর দিয়েছেন। প্রতিটি চিঠি ইংরেজিতেই লিখেছেন। প্রতিটি চিঠিতে আমাকে সম্বোধন করেছেন  “ আনোয়ার ভাই ,”  বলে।