কাজী জহিরুল ইসলামের কবিতায়
পরিচিত আখ্যান ও আঙ্গিকের উৎস
|| সৈয়দ কামরুল ||
নিউ ইয়র্কে আসবার পর প্রথমে ভিলেজে যাই। পায়ে পায়ে যে পথে হেটে গেছি, দেখেছি বুদ্ধদেব বসুর বীটবংশ গ্রীনিচ গ্রাম, সুনীলের ছবির দেশে কবিতার দেশে আর সল বেলো'র হামবল্ড'স গিফট এর শব্দে শব্দে আঁকা ম্যানহাটনের টপোগ্রাফ। তারপর খুঁজেছি নিউ ইয়র্কে বাঙালী কবির কবিতা। দীর্ঘ দূরবাসে, মাতৃভাষা স্রোতের বাইরে এখানে দেখা মেলেনি বাংলা ভাষার জীবন্ত কোনো কবির, যিনি কবিতাবহমানতার কবি, যিনি কবিতাকে আবেগ ও ধীদীপ্ত সৃজনশক্তিতে লেখেন। দেখা পাইনি সেই কবিতা যার কাব্য শরীরে আছে চেনা জানা আখ্যান ও আঙ্গিক, দেখিনি সেই কাব্যশরীর যা নির্মিত হয়েছে পরানের গহন থেকে উঠে আসা ভাষা ও তার অনুষঙ্গের বয়ানে। এই অনুপস্থিতি, এই শূন্যস্থান হঠাৎ ভরে ওঠে - হঠাৎ দেখা পেয়ে যাই তেমনি একজন কবির, নিউ ইয়র্কে। তিনি নিরন্তর লেখেন। হরদম লেখেন গদ্য, পদ্য, অনুবাদ। একজন লেখক সাহিত্যের নানান genre'য় লিখতে থাকলে তার সাহিত্যিক পরিচয় একক চেহারায় ফুটে ওঠে না উজ্জ্বল। কিন্তু এই কবিকে দেখলে চোখ বলে, সেখানে আছে কবি। তার লেখার অন্তরে, অববায়িক কাঠামোয় আদ্যোপান্ত দেখি সেই প্রত্যাশিত কবির চেহারা, দেখি কবির সৃজনমুখরতা, দেখি কবির অস্থিরতা। তিনি কবি, তিনি যথার্থ কবি। তিনি কবি কাজী জহিরুল ইসলাম।
তার কবিতার গতি দেখে টের পাই অরোধ্য তার গতিপথ। তার লেখা পাঠ করে বুঝতে পারি, মৌলিক গদ্য সাহিত্য এবং ট্রাভেলগ লিখলেও তিনি কবি হিসেবেই একক পরিচয়ে ছন্দিত; থেকে যাবেন কাব্যময়। জীবনকে দেখার ঢং এবং তা নিয়ে জীবন ও সময়ের সামঞ্জস্য মেলানোর কায়দা তার কবিতায় স্পষ্ট। আখ্যানের উৎস, অবস্থা ও অবস্থানের কথা ঝরে পড়ে 'হাওয়ার নেকলেস' কবিতায়, "কালো দম্পতি খুঁজে পায় যদি ঘর/ না পেয়ে শিকার সাদা নেকড়ে কি ফেরে?" এই কবিতায় দেখতে পাওয়া যায় নানাধর্মী ছবি। সেখানে যিনোফোবিয়া ধ্বনিত হয়। লাইনে লাইনে সাররিয়ালিস্ট উচ্চারণে বস্তুর গায়ে নরত্বারোপ করেন আর মেটাফর চড়িয়ে দেন এন্তার, ঘনঘন, বারবার। "বৃষ্টির সিঁড়ি হেঁটে যায় ধীরে নিচে/ হাওয়ার পাখি ছুরি হয়ে বুকে বেঁধে/ আকাশের নীল ডানা ক্ষয়ে ক্ষয়ে পড়ে/ গলে গলে পড়ে আকাশের নীল ডানা/ পাথরখন্ড রক্তবৃষ্টিপাত"।
কবিতা জীবন যাপনের নির্যাস। পোয়েট্রি ইজ এসেন্স অব অল আর্টস। কাজী জহিরুল ইসলামের হাতে প্রাণ পায় সমাজতাত্ত্বিক সংস্কৃতির প্রত্যাশা পুরনের পঙক্তিমালা। দৈশিক সংস্কৃতির সীমানা পার হয়ে যাওয়া দূরবাসী মননে তিনি সংস্কৃতির সঙ্গে সংস্কৃতির যে বন্ধন ও সন্নিধান, হোমল্যান্ড এবং হোস্টল্যান্ডের যে সুস্থির ও পাল্টে যাওয়ার দোলাচল, তাকে তিনি আত্মস্থ করেন কিছুটা পরাবাস্তবতার পরোক্ষ উচ্চারণে, কিছুটা মেটাফরের ঘোমটায়। কবিতা নির্মাণশৈলী তার নিজস্ব। আধুনিক কবিতার অনুষঙ্গ, যৌনতাকে তার কবিতায় দেখি মিলেছে তান্ত্রিক দার্শনিকতায়, সমসাময়িক নাগরিক প্রচ্ছদে।
“এই দেহটি পাল তোলা এক ছিপছিপে নৌকা
সমস্ত রাত খোঁজে শুধু ঘাটেরই মওকা
গহীন গাঙে নাও ভাসিয়ে হলাম দেশান্তরী
পাটাতনের নিচে আছে সঞ্চিত ধন-কড়ি
ঈশানে ঝড় উথাল-পাথাল ঢেউ উঠেছে গাঙে
ছৈয়ার ভিতর কাহার্বা তাল বাজায় রে কোন লাঙে
তুফান আসে তুফান থামে গাঙতো ফুরায় না
ঘাটের চুমু-তৃষ্ণা জাগে বুকতো জুড়ায় না
কে যে আমায় ভাসিয়ে দিলো এমন ভরা গাঙে
অন্ধকারে বৈঠা মেরে মাঝ নদীতে ভাঙে।”
(দেহকাব্য-৪)
কবিতায় তার ছন্দ জ্ঞান টানটান, ছান্দসিকতা বুনে যান তিনি শুদ্ধ মাত্রার বিন্যাসে। ছন্দের গতিময় নান্দনিক সৌন্দর্য নির্মাণে তিনি স্বরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত, অক্ষরবৃত্ত, এন্ডরাইম এবং ব্লাংকভার্স, টানা গদ্য - সব রকম ছন্দে স্বচ্ছন্দ। তবে, চর্যাপদত্তোর এবং উত্তর-ব্রজবুলি বৈষ্ণব পদাবলীর রাবীন্দ্রিক মাত্রাবৃত্ত ছন্দে তিনি অধিক সাবলীল। ব্যক্তিগতভাবে মাত্রাবৃত্তের কবিতা কেমন ড্রাই মরুজ লাগে আমার কাছে। তবে এই কবির মাত্রাবৃত্ত রসজ। এমন শৈলীদক্ষ কবির প্রাপ্য উষ্ণ অভিবাদন। অভিবাদন হে কবি!
"কেমন আছো দূরের শহর? জানতে চায় শুধু
তুমি অমন ধূসর কেন? কেমন যেন ধু ধু
শব্দ করে শহর হাসে কি সব বলো যা-তা
কতো রঙের দালান দেখো, ড্রয়িং করা খাতা"।
মেট্রোপলিটন নগরে এ যেন এক উন্মূল কন্ঠ জন্মের ভিটে বাড়ির দাওয়ায় যারা আছে, তাদের সংগে মনোলগ। মনোলগ হলেও সম্পর্কটা ওয়ান-টু-মেনি। দীর্ঘ কবিতা, "বাড়ি আছো?"তে ঝরে প্রেমার্ত হৃদয়। সেটি অন্তর্গত মনোলগের ভঙ্গিতে সল্যিলকি। সলিল চৌধুরীর কথায়, আইপিটিএ ঘুরে না এলে আমি এই সলিল চৌধুরী হয়ে উঠতে পারতাম না। রাজনীতির দার্শনিক কথায়, গণমানুষের সান্নিধ্য, সন্নিধান সংস্পর্শে না গেলে, গণবিপ্লবের মধ্য দিয়ে না এলে নেতা হওয়া যায় না।
কবির পায়ে প্রব্রজ্যা না থাকলে একজন কবি পুরোপুরি কবি হয়ে ওঠে না। মাইকেল মধুসূদনের গায়ে রোব, পায়ে ফরাসি কবিতার সড়ক, রবীন্দ্রনাথের নৌকা, নজরুলের ছুটোছুটি তারই প্রমাণ। কবিতায় রোমান্টিসিজমের আবেগস্রোত আর নিওক্লাসিসিস্টদের ইন্টেলেকচুয়ালিজম মিলে গেলে যে কবিতা তৈরী হয়, তার সঞ্চরণ ক্ষমতা পাঠক থেকে পাঠকে ছড়িয়ে যায়। কবিতা হয়ে ওঠে কবিতা। কবিতাকে আধুনিক বলি আর পুনরাধুনিক বা উত্তরাধুনিক বলি, হৃদয় দিয়ে লেখা শব্দাবলীর অক্ষরে অক্ষরে জীবনবীক্ষণ, জীবনকে নানা জায়গা থেকে দেখার ও জীবনকে পর্যবেক্ষণ করার অভিজ্ঞতাঋদ্ধ বোধের ধীদীপ্ত উচ্চারণে কবিতা হয়ে ওঠে কবিতা। কবি কাজী জহিরুল ইসলামের অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণের ভূগোল 'সিংহল সমুদ্র থেকে মালয় সাগরে'র মতো ব্যপ্ত। তিনি ঘুরেছেন আফ্রিকার মানবিক বিপর্যয়ের জায়গা, জমিনে, যাপন মানু্ষের সন্নিধানে। তিনি ঘুরেছেন দারফুরের বিপর্যস্ত ভূগোলে। দেখেছেন মানুষের অমানবীকরণ। বিরাণ মরুর ধূসর হাহাকার আর মনুষ্যত্বচ্যুতি, দু:শাসনের যাতনাযাপন, আফ্রিকার কালো মানুষের দু:খ সংস্পর্শে এসেছিলেন তিনি।
“বারের মাতাল অন্ধকারে ক’জন তুখোড় বুড়ো
টেকো শয়তান, গেলাসে ঠেকিয়ে ঘটায় পেরেস্ত্রৈকা,
কোরাস সংগীত ওঠে আলো-আধারির হলঘরে, নাজদারোবিয়া।
হলুদ সুন্দরী অতি নিপণু কৌশলে তখন লাল পেন্টি
খুলে দেখায় ফিদেল ক্যাস্ত্রোর অদ্ভুত দাড়িগুচ্ছ, ঝুলে আছে,
হেলোইন ডে’র রহস্যময় ব্রুম, ব্যবহারে ম্লান।
মনে পড়ে যায় পাবলো নেরুদা, ‘এসপেরেনজা’, তবুও প্রত্যাশা।
আমি নেরুদার সবুজ কলম হতে নিয়ে লিখতে শুরু করি
ঈদের কবিতা। মাও জেডোঙ দু’হাতে ঠেকায় উল্টো হাওয়া,
‘বিপ্লব কোনো নৈশভোজ নয়, নয় প্রবন্ধ পাঠ অথবা শিল্পীর
আঁকা ছবি।’ তখনি আরনেস্তো চে গুয়েভারার বাইকে চেপে
বসি। ক্রমাগত পার হয়ে যাই ধূসর দারফুর, পাগলা হাবুব,
কালো হারমাটান, সাইক্লোন, খরা-বন্যা, ক্যাটরিনা, নর্থ পোলের
দুর্ধর্ষ ব্লিজার্ট। গোধূলির প্রান্ত ছুঁয়ে হেঁটে আসা উটের
কাফেলা পার হয়ে ঢুকে পড়ি আরব্য সরাইখানায়, শিশার
ধোঁয়ার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসেন জেলাবি পরা এক মার্কিন
জাদুকর। ছুরি দিয়ে ঘচাঘচ কেটে ফেলেন পূর্ব আফ্রিকা।
অন্নদা শঙ্করের বুড়ো খোকারা তখনো
তেলের শিশির শোকে মূহ্যমান।
সমাজতন্ত্রের মঞ্চে এখন রাউল ক্যাস্ত্রো,
হলুদ সুন্দরীর ব্রার হুক খুলে আমাদের দেখান
একজোড়া দোদুল্যমান পৃথিবী।”
[একজোড়া পৃথিবী]
তিনি দেখেছেন তাদের সঙ্গে থেকে, তিনি দেখেছেন জাতিসংঘের বহির্বিশ্ব কার্যক্রমের কর্মকর্তা হয়ে মানবিক বিপর্যয়ের দু:খদীর্ণ দিনের মর্মদ্রাবী কষ্ট। শান্তির বারতাধ্বনি বাজে তার কবিতায়। সাড়ে তিন পায়ার চেয়ারের প্রতীক নগরে তিনি পকেটে নিয়ে ঘোরেন যে নাগরিক সংস্কৃতির জেনিভা, অমরাবতী বাগানে অপ্সরাদের ডালাখোলা সুন্দরের গতর, তা পাঠকের কাছে হয়ে ওঠে শান্তিপ্রতীক। 'পকেটে জেনেভা নিয়ে হাঁটছি' কবিতায় যখন কবি বলেন, "বেশ ক'দিন ধরেই পকেটে জেনেভা নিয়ে হাঁটছি/ অথচ কথা ছিল ওকে ফেইসবুকের মোড়ে নামিয়ে দেব সেই কবেই/ ওখান থেকে খুব আদরে তুলে নেবে ক'জন ওয়েবজিন,/ তারপর নামিয়ে দেবে ঢাকা, কোলকাতা, লন্ডন, কিংবা অকল্যান্ডে” - শান্তির বার্তার কথা মনে হয়। সেটা কি হওয়া স্বাভাবিক? কবি কাজী জহিরুল ইসলাম তো গিয়েছিলেন তিস্তা থেকে নিম্বা পাহাড়ের নিচে ক্যাভালি নদীর কাছে, গিয়েছিলেন দারফুরে আহত, ক্ষতিগ্রস্থ বাহর আল ঘাজাল, হোয়াইট নাইল এর কাছে। কাছ থেকে দেখেছিলেন ক্ষতবিক্ষত মানবিক বিপর্যয়ের স্রোত। তার কাছে পাঠক জেনেভাকে দেখবে সাড়ে তিন পায়া চেয়ারের প্রতীকায়িত জীবনবোধ। নবায়নের অন্তরঙ্গ চোখ যে তার আছে তা চোখে পড়ে। জলের মত সহজ নয় তাঁর কবিতা; বার্তা আছে, আবার আত্মমগ্নতা আছে। কবি প্রথমত ব্যক্তিক, তারপর বৈশ্বিক।
নিউ জার্সি, যুক্তরাষ্ট্র। জানুয়ারী ২০১৭।
Comments
Post a Comment