Skip to main content

ভাষা শহীদ শিশু অহিউল্লার গল্প

 অহিউল্লা

|| কাজী জহিরুল ইসলাম ||


 

‘হাইবাঅই হাইবাহৌড়ের পো জলদি কর। ভাবীসাবআঠাটা আলগা করেনহাইবারে ছাইড়া দেন।

 

পলেস্তরায় শ্যাওলা পড়া দুটি সাড়ে পাঁচ ফুট উঁচু দেয়ালকে যুক্ত করেছে একটি সাড়ে তিন ফুট টিনের গেইট। গেইট ফাঁক করে ঝাঁকড়া চুলের মাথাটা আরসিসি রাস্তার ওপর ভাসিয়ে সতীর্থ রাজমিস্ত্রী জিলুকে জবাব দেয় হাবিবুর রহমান। ওর কণ্ঠে কোনো উৎকন্ঠা নেইশীতল কন্ঠ। 

 

মামদার পোঘরে সুন্দরি বউনা ছাড়লে আহুম কেমতে?’

জিলুও কম যায় না।

সারা রাইত খাওজাইছচনা পারলে ডাক পারতি

অই মামদার পো গেলিহান্দায়া দিমু কৈতাছিএক্কেরে বারো ইঞ্চি...

খিক খিক করে হাসে জিলু।

পাঁচ ইঞ্চির বেসি যদি দেখায়া পারছ...

ইক্কেরে...দিমু না...

দাঁত কিটমিট করে হাবীব তাকায় জিলুর চোখের দিকে। তখন ওর চোয়াল শক্ত হয়। সাথে সাথেই মুখটা নরম করে কিন্তু ভরাট এবং গম্ভীর কন্ঠে বলে

লৌড়ালৌড়ি বাদ দিয়া খাড়া এহেনেযামু আর আমু।

পাঁচ মিনিটের বেসি যদি অয়কোচোয়ানের দুই আনাপুরাটা তুই দিবি ক’লাম

হ হ দিমু

 

জিলুর হাতে একটি ব্যাগ। ত্রিপলের কাপড় দিয়ে তৈরী। ভেতরে যন্ত্রপাতি। বাটালহাতুরিছেনিফিতালেভেলসুতলিকন্নি আরো কত কি। আরসিসি রাস্তার ওপর ঝাঁকড়া একটি নিম গাছ। মাত্র ফর্শা হয়েছে। পাতিকাকের ঝাঁক নিম গাছের ডাল থেকে নেমে উড়ে উড়ে বিভিন্ন বাড়ির উঠানরান্নাঘরের দিকে ছুটে যাচ্ছে। লুৎফর রহমান লেনের মাথায় একজন মাঝবয়েসী মাঠাবিক্রেতা। চৌকোনা ডালডার টিন ভর্তি মাঠা। টিনের অর্ধেক মুখ একফালি কাঠের টুকরো দিয়ে ঢাকা। কাঠের টুকরোতে বেশ কিছু মাখনের টুকরো কাচকি মাছের ভাগার মতো ছোটো ছোটো ভাগে ভাগ করে রাখা। মাখনের ভাগার ওপর লাল রঙের গামছা। একটু পর পর গামছায় ঠান্ডা পানির ছিটা দিচ্ছে মাঠাওয়ালা। ছোটো একটি টিনের মগে করে বড় টিন থেকে মাঠা তুলে অনেক উঁচু থেকে ক্রমাগত ঢালছে। এতে টিনের ভেতরে বুদ্বুদ তৈরী হচ্ছেমাঠার সুঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ছে লুৎফর রহমান লেনে। পথচারীদের অনেকেই মাঠাওয়ালার সামনে দাঁড়াচ্ছেএক আনার মাঠা খেয়ে গ্লাসটা নামিয়ে রেখেই ছুটছে। কেউ কেউ আরেকটু বেশি মাখনের জন্য পিড়াপিড়ি করছে। কিন্তু মাঠাওয়ালা সুন্দর সুন্দর গল্প বলে এক ভাগা মাখন গ্লাসের ওপর ভাসিয়ে খদ্দেরের হাতে তুলে দিচ্ছেকাউকেই সে বেশি দিচ্ছে না। লোকটি যখন হাসে ওর বাঁ দিকের কাঁটা গালে টোল পড়ে। কোনো ক্রেতা মাখনের জন্য বেশি বাড়াবাড়ি করলে সে তাঁর মাখন লাগানো আঙুলটা ক্রেতার গালে মুছে দেয়। 

 

হাবিবের বউ রীতিমত খিস্তি করছে। কারণ গতকাল সে যা কামিয়েছে ফেরার পথে বাংলা মদ খেয়ে সব টাকা শেষ। 

একসের চাইল আর আধাসের গোস্তএইটা লয়া ঘরে আইলেই ঐবোআর যা কামাইবেন সব ঐ মদের মৈদ্যেপোলাটার কোনো ববিস্যত নাইক্কাথিরিতে পড়বার লাগছেএকটা পেরাইবেট মাস্টার ভি নাইক্কাএমতে এমতেই পাস দিবোনাকি নিজের মতন মিস্তিরি বানাইবেনচুপ মাইরা আছেন কেলাবাত করেন?’ 

হাবিব কোনো বাত করে না। পাথর হয়ে যায়। বোবা হয়ে যায়। কারণ সে জানে বোবার কোনো শত্রু নেই। এরপর শুরু হয় ভাঙচুর। হাবিব এবং তাঁর দশ বছরের পুত্র অহিউল্লা দরোজার দুইপাশে। ঘরের ভেতর থেকে টিনের থালাটিনের মগতেলের শিশিতরকারির চামচএকটা একটা করে দুজনের মাঝখান দিয়ে উড়ে উড়ে গিয়ে পড়ছে উঠানে। হাবিব কোনো কথা বলে না। উঠানে তৈজষপত্রের স্তুপ। এসব মাড়িয়েই কাজের ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে আসে।

 

জিলু পুরো ব্যাপারটাই বুঝতে পারে। কিন্তু এ নিয়েও ওদের রসিকতার শেষ নেই।

 

বাজনা হুনলাম মনে অয়

তর ভাবীসাব গান ধরলআমি তবলাটা ধরছিলাম

নাস্তা-উস্তা পড়ছে কিছু পেটে?’

না খাওআয়া ছাড়বো তর ভাবীমাতা-উতা খারাপ নিকিসক্কাল সক্কাল উইঠাই পায়া বানাইছে। পরাটা বানাইছে। কি মেহনতটাই না করছে বেচারী। আফসোস সুন্দরী বউটার কদর করবার পারি নাইক্কা।

ওরা মাঠাওয়ালার সামনে থামে। জিলু ওর লুঙ্গির খুট থেকে দুআনা বের করে মাঠাওয়ালার তক্তার ওপর রেখে বলে

আউয়াল বাইমাক্ষন ভাসায়া দুই গেলাস দেন। হাইবার পেট কলাম খালি। অর গেলাসে ডাবল মাক্ষন দিবেন।

হাবিব তখন জিলুর দিকে তাকায়। ওর চোখে অশ্রু টলমল করছে। জিলু ধমকে উঠে।

হৌড়ের পো এমতে চাস কেলা। আইজকা আমি খাওয়াইছিকাইলকা তুই খাওয়াবি। অহন থেইকা রোজ মাঠা খামু। আমরা না খাইলে আউয়াল বাইয়ের ব্যবসা চলবোকিঠিক কৈছি না আউয়াল বাই?’

হাবিবের চোখ থেকে দুফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। সে অতি দ্রুত তা হাতের চেটো দিয়ে মুছে নেয়।

মাঠাওয়ালা আউয়ালের মুখে কোনো কথা নেই। দুই গ্লাসের মাঠা উল্টে-পাল্টে গ্লাসে ফেনা তুলে মাখন ভাসিয়ে ওদের হাতে নীরবে তুলে দেয়। হাবিবের গ্লাসে সে সত্যি সত্যি ডাবল মাখন দেয়। নিজের প্রতি মাঠাওয়ালার এই বিশেষ গুরুত্ব খুব ভালো লাগে হাবিবের।

 

হাবীবের পরনে চেক লুঙ্গি। মাথার লম্বা বাবরি বেঁধে রেখেছে লাল একটি গামছা দিয়ে। জিলুর গামছাটি তাঁর কোমরে বাঁধা। দুজনের পায়েই নীল রঙের রাবারের স্যান্ডেল। ওরা হাঁটতে হাঁটতে নবাবপুর রোডে চলে আসে। সামনেই খোশমহল রেস্টুরেন্ট। রেস্টুরেন্টের কাছে আসতেই পরোটা-ভাজির লোভনীয় ঘ্রাণ এসে নাকে লাগে। 

নাস্তা-উস্তা খাবি?’

হাবিব জিলুর দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকায়।

আবে হালায় চায়া রৈছচ কেলাআমি খিলামুপাত্তি আছে আমার কাছে। জানি তো ভাবীসাব পায়া খিলাইছেঐটা অজম অয়া গেছে নাঅহনতরি আছে পেটের ভিত্তে?’

শেষ পর্যন্ত ওরা রেস্টুরেন্টে ঢোকে না। হেঁটে গিয়ে ঘোড়ার গাড়িতে ওঠে। যাবে সদরঘাট। গতকাল নতুন একটি কাজে যোগ দিয়েছে। পাট কোম্পানি নতুন অফিস বিল্ডিং বানাচ্ছে মায়াকাটরায়সেই বিল্ডিংয়ের ছাদ ঢালাই।

 

হাবিব চলে যাওয়ার পর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে একঘণ্টা কেঁদেছে ময়না। তখন উঠানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে জিনিসপত্র একটা একটা করে এনে গুছিয়ে রেখেছে অহিউল্লা। তেলের লাল শিশিটি ভেঙে গেছে। কাচের টুকরোগুলোও সাফ করেছে ছেলেটা। ময়না এখন কান্নার আসন ও ভঙ্গি বদল করেছে। অহিউল্লাকে জড়িয়ে ধরে এখন সে কাঁদছে নাকি সুরে। 

তর আব্বাজান একটা লম্পটহিঁ... আমি আইজই মার বাড়ি গেতাছিহিঁ...’ 

মা ঐছেএলা চুপ কর।

কেলা চুপ মারুমবাপের লেইগা জ্বলুনি উঠছে?’

হ উঠছে। হুন মাটেকার লেইগাই তো কান্দছ। আমি তো অহন ইশকুলে যাই। থিরিতে পড়িপড়ি না?’

অহিউল্লার কথার জবাব দিতে কান্না থামায় ময়না বেগম।

পড়ছ তোঐছে কি?’

আর সাত কেলাস পাস দিলেই মেট্টিক। এরপর আমি। আমি কিক তো মা?’

অহিউল্লা চোখ ছোটো ছোটো করে মায়ের দিকে চায়। মাকে কোনো এক আনন্দময়  রহস্যের গভীরে নিয়ে যেতে চায়। 

কলেজে যাবিওছমান কি তাড়া।

ধুর...অহে নাইক্কা। তুই কিছুই জানছ না মা,  এরপরে আমি দারোগা। তহন দেখবিএত্তো এত্তো টেকাতর লেইগা নয়া সাড়িআব্বাজানের লেইগা নয়া লুঙ্গি...

 

ময়না বেগম দেখে খাকি পোশাক পরা এক মস্ত যুবক একটি সাইকেল চালিয়ে এসে ঢোকে তাঁর বাড়িতে। ছেলেটা দেখতে ঠিক ওসমানের মতন। লম্বা – চওড়াবড় বড় চোখখাড়া নাকফর্শামায়াভরা মুখমাথায় ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া কোঁকড়া চুল। এই একটা জায়গায় ওসমানের সাথে মিল নেই। ওসমানের মাথা প্লেন। ঘটনাটা কিন্তু এই বাড়িতে না। এটা তো ভাড়া বাড়ি। ওটা তাঁর নিজের বাড়ি। নিজের বাড়ির উঠানে একটি কামরাঙা গাছ। পুরো উঠান সিমেন্টে মোড়ানো। কামরাঙা গাছের সাথে সাইকেলটা হেলান দিয়ে রেখে যুবক এসে ময়না বেগমের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে। ময়না বেগমের মাথায় তখন এক গাছি শাদা চুল। যুবক বলে, ‘আমার লেইগা চিন্তা কৈরা কৈরা মাথার চুল তো সব পাকায়া ফালাইছচ মা ময়না বেগম হাসে, ‘আমার জাদু-সোনা এইবার একটা ডানাকাটা পরী আইনা দিলেই আমার চিন্তা-উন্তা সেস।

 

ময়না বেগমের সামনে দাঁড়িয়ে আছে অহিউল্লা। ওর হাতে একটি কাগজ। কাগজে হাফপ্যান্ট পরা এক কিশোরমাথায় পুলিশের টুপিঠোঁটে বাঁশি। 

দেখ মা। কতো এইটা কেঠা?’

দারোগা?’

তর পোলা অহিউল্লা।

আবেতুই কি দারোগা অয়া এই ইট্টুসিই থাকবিবড় অবি নাবাউইনা দারোগা?’

 

অহিউল্লা লজ্জা পায় এবং বুঝতে পারে সে ছবি আঁকায় মস্ত বড় একটি ভুল করে ফেলেছে। সে ভাবেনি দারোগা হতে হতে সে আর আজকের অহিউল্লা থাকবে না। অনেক বড় হয়ে যাবে।

 

ধুর মাচুপ কর তো।

 

অহিউল্লা এক দৌড়ে টিনের গেইটের বাইরে। ১৫২ লুৎফর রহমান লেনের বাড়িটি থেকে বেরিয়ে সে দৌড়াতে থাকে। দৌড়াতে দৌড়াতে নবাবপুর রোডে গিয়ে ওঠে।  খোশমহল রেস্টুরেন্ট থেকে খাবারের তীব্র গন্ধ এসে নাকে লাগছে। পেটের মধ্যে ক্ষিদে মোচড় দিয়ে ওঠে। বেশ কয়েকবার উঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করে ভেতরের খাবারের পাত্রগুলো কিন্তু কিছুই দেখতে পায় না। কারণ রেস্টুরেন্টের দরোজায় একটি লাল পর্দা ঝোলানো। রেস্টুরেন্টের সামনেফুটপাতের ওপরএকটি বড় পাথর। অহিউল্লা পাথরটির ওপর বসে পড়ে। এটি ওর রোজকার অভ্যাস। স্কুল থেকে ফিরে খেয়ে দেয়ে এসে এখানে বসে। বসে বসে রঙপেন্সিল দিয়ে ছবি আঁকে। ঘোড়া আঁকেপ্রজাপতি আঁকেহাতি আঁকে। মানুষ আঁকতে চায় কিন্তু সে মানুষ আঁকতে পারে না। মানুষ দেখতে খুব ভালো লাগে অহিউল্লার। তাই সে রোজ এই পাথরটির ওপর এসে বসে থাকে। কত কত মানুষডান দিক থেকে বাম দিকেবাম দিক থেকে ডান দিকে যাচ্ছে। বড় রাস্তা থেকে মানুষগুলি গলির ভেতর ঢুকে যাচ্ছে। আবার গলি থেকে অন্য মানুষেরা বড় রাস্তায় উঠে আসছে। ছুটছে ঘোড়ার গাড়িরিক্সাসাইকেলমোটরগাড়ি। ঘোড়ার গাড়িগুলো যখন চলে তখন টপ টপা টপ/  টপ টপা টপ, করে ঘোড়ার খুরের শব্দ হয়। এই শব্দের মধ্যে যে ছন্দ আছে সেটা অহিউল্লার খুব ভালো লাগে। সে তন্ময় হয়ে ঘোড়ার খুরের শব্দ শোনে। বাবা-মায়ের ঝগড়ার কারণে আজ নাস্তা তৈরী হয়নিঅহিউল্লা এখনো নাস্তা খায়নি। আজ স্কুলেও যায়নি।

 

সূর্য মাথার ওপর। অহিউল্লা বসা থেকে উঠে হাঁটতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে ভাবে কোথায় যাবেগন্তব্যহীনতায় ভোগে সে। এবং এক সময়  টের পায় সে একটি বড়সড় মাঠের প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। প্রচুর ছেলে বুড়ো ভরদুপুরে মাঠে এসে জড়ো হয়েছে। এর আগে এই মাঠে সে আর আসেনি। এটা কি লুৎফর রহমান লেন থেকে অনেক দূরেসে এতক্ষণ একটা ঘোরের মধ্যে ছিল। হাঁটতে হাঁটতে যে কোথায় চলে এসেছে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। 

মাঠের ভেতরে ছোটো ছোটো অনেকগুলো জটলা। একেকটি জটলায় একেকজন মধ্যমণি। মধ্যমণিকে ঘিরে সকলেই উত্তেজনায় ফেটে পড়ছে। মধ্যমণির হাতে একটি লাটাই। তিনি শরীর ঝাঁকিয়ে লাটাই ঘুরাচ্ছেন। সুতোয় বাঁধা ঘুড়ি আকাশের নীল পেট ফুটো করে খাড়া ওপরে উঠে যাচ্ছেআবার নিচে নামছে। অহিউল্লার ইচ্ছে হয় একটি লাটাইসুতো আর ঘুড়ি কিনে এনে ওদের সাথে দাঁড়িয়ে যেতে। কিন্তু সে জানে তাঁর লাটাই আর ঘুড়ি কেনার দাবী কেউ মেটাবে না।

আজও হাবিব দেরী করে ফিরেছে এবং টলতে টলতে ফিরেছে। ঘরে ঢুকেই সে খিস্তি শুরু করে।

গাইল পারবি না কলাম। গাইল পারলে ফাইরা ফালামু। হুঁমতর বাপে কি আমার চে বড়লোকতা যা নাবাপের বাড়ি যা। দিছেদুইটা টেকা দিছে আমারেতর বড়লোক বাপেমায় কৈলোমাইয়া কাইলা তো অইছে কিবাপের টেকা পসা আছে। তুঁই সুকে থাকবি। দিছেআমারে টেকা দিছেলেওড়া দিছে। দিছে একটা কাইলা মাইয়া। সুকে আছি। ওই মাতুই কৈ অহনদেইখা যা তর পোলায় কাইলা মাগী লয়া সুকে আছে। চুপএকদম চুপ। কোনো কথা নাইক্কা। গাইল-উইল বন্ধইক্কেরে বন্ধ।

 

হাবিব অনর্গল কথা বলেই যাচ্ছে। ময়না কোনো কথা বলে না। ঘর থেকে গড গড করে বেরিয়ে উঠানের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মায়ের পেছনে অহিউল্লা। অহিউল্লা জানে আব্বাজানের কোন কথাটায় মা সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছে। অহিউল্লা মাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে।

মা তুই কি মাম্মাগো বাড়ি যাবি গা?’

ময়না কোনো কথা বলে না। ফ্যাচ ফ্যাচ করে কাঁদে। অহিউল্লাও কাঁদতে শুরু করে। কাঁদতে কাঁদতে বলে

‘আমার কিচ্ছু লাগবো না মা। রঙ পিঞ্ছিল লাগবো নাখাতা-উত্তা লাগবো নাপেরাইভেট মাস্টার ভি লাগবো না। আমি হালায় ইশকুলেই যামু না। কামে লাইগা যামু। তুই মাম্মা গো বাইত্তে যাইস না মা।

ময়না তখনো কিছু বলে না। ছেলেকে জড়িয়ে ধরে নীরবে চোখের পানি ফেলে। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে ওরা। ঘরের ভেতরেও খিস্তি বন্ধ হয়। হাবিব হয়ত নিস্তেজ হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। ময়নার ইচ্ছে করে না এই ঘরে আর ঢুকতে। ওর ইচ্ছে করে সারারাত এই উঠানেখোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে থাকতে।

মাতরে একটা কথা কই?’

প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে অহিউল্লা মায়ের কন্ঠ শুনতে চায়।

ক বাপজান

নিস্তেজস্বপ্নহীন কন্ঠ ময়নার। সে তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। কোনো একটা তারাকে মনে হয় ওর মৃতা শ্বাশুরি। তিনি বেঁচে থাকতে হাবিব একটা কথাও বলতে পারেনি ময়নার গায়ের রঙ নিয়ে।

তুই কলাম কাইলা না মা। বাপজান তরে হুদাই কাইলা কয়। কাইলা কলাম সকিনা চাচীআম্মাঅই যে জিলু কাক্কার বউ। তুই কলাম বহুত ফস্যা মা। হাচা কৈতাছি।  

ময়না ছেলেকে আরো নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরে। অহিউল্লা মায়ের বুকের মধ্যে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে থাকে।

 

আজ ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২। গতকাল ঢাকা শহরে অনেক বড় একটি ঘটনা ঘটে গেছে। এইসব ঘটনার কিছুই জানে না লুৎফর রহমান লেনে বসবাসরত ঢাকার আদিবাসী এই পরিবারটি। অথচ এই ঐতিহাসিক ঘটনাটিকে আরো মহানআরো মহিমান্বিত করে তুলেছে এই পরিবারের আত্মত্যাগ।

প্রতিদিনের টানাপোড়েনপ্রত্যাশা ও প্রাপ্তির দ্বন্দ্বএক মায়ের প্রতিদিনের গড়ে তোলা স্বপ্নের সৌধ সন্ধ্যায় মুখ থুবড়ে ভেঙে পড়াএইসবই ছিল ওদের জীবন কাহিনী। কিন্তু এখনওদের জীবনে শুধু একটিই কাহিনী। 

 

কাকভোরে হাবিব কাজে চলে গেছে। রোজকার মতো আজও জিলু এসে হাইবা বলে হাঁক দিয়েছে। আজ কোনো ঝগড়া-ঝাটি নেই। ময়না রুটি আর আন্ডাভাজি করেছে। দুই বাপ বেটা একসাথে বসে খেয়েছে। হাবিব চলে যাওয়ার পর পাশের বাড়ির কলেজের ছাত্র ওসমান এসে খবর দিয়ে গেছে শহরের পরিস্থিতি ভালো নয়। অহিউল্লা বাইরে গেলে যেন সাবধানে থাকে। ময়না ছেলেকে সাবধান করে দেয়,

আব্বাজান হুনলা তো। বাইরে-উইরে যাওয়া বন। বাইত্তে বয়া ছবি আঁকো

অহিউল্লা ছবি আঁকে। গরুর ছবিঘাসের মাঠে গরুপেছনে একটি নদীনদীর ওপারে সূর্য ডুবছে। অনেকক্ষণ ধরে ঘরে বন্দি। বন্দি থাকতে আর ভাল্লাগছে না অহির। সে ছটফট করে।

মাবাইরে ঐছে কি?’

আমি কি আর ওইসব বুজি নিহিওছমান কৈলোভাসা-উসা লয়া মাইরপিট ঐতাছে। বহুত মানুস গুলি খায়া মরছে। তর আব্বাজান ত কিছুই কৈআ পারে না।

আমি ইট্টু বাইরে যাই মাদেইখা আহি আব্বাজানরে পাই কিনা।

কই না কই কামে গেছেতুই পাবি কেমতে?’

নওয়াবপুর রোডের মোড়ে খাড়াইলেই তো দেখন যাইবো   

না বাপজানআমার ডর লাগে। তুই বাইরে-উইরে যাবি না।

ধুর মা। মরদ পোলা ঘরে বৈয়া থাকা পারে?’

উঁমকি আমার মরদ পোলা ঐছে।

ময়না ছেলের পেটে একটা খোঁচা দেয়। 

চুপচাপ বয়া থাকআমি রান্দন চড়ামু। মায়ের লগে কাম কর।

ধুর মামায়ালোকের কাম করা পারুম না। আমি ইট্টু খালি বাইরে যাই। যামু আর আমু।

 

অনুমতি না দিলেও মায়ের নিষেধাজ্ঞা যে কিছুটা শিথিল হয়েছে এটা বুঝতে পারে অহিউল্লা। বুঝতে পেরেই সোজা এক দৌড়। ডান হাতে কিছুক্ষণ আগে আঁকা একটি ছবিবাঁ হাতে পেন্সিল আর একটি শাদা কাগজ। গেইট থেকে বেরিয়েই ছুটতে থাকে নবাবপুর রোডের দিকে। একটা গুঞ্জনধ্বনি ভেসে আসছে। এই ধ্বনি ওকে আরো পাগল করে তোলে। অহিউল্লা ছুটতে থাকে ধ্বনির উৎসের দিকে। মনে হচ্ছে শত শত মানুষের মিছিল। মানুষের মিছিল দেখার জন্য ছুটছে কিশোর অহিউল্লা। খোশমহল রেস্টুরেন্টের সামনে এসে থমকে দাঁড়ায় সে। ধীরে ধীরে পাথরটির কাছে এগিয়ে যায়। যেন এটি ওর সীমান্তবৃক্ষ। এর সামনে যাবার অনুমতি নেইএখান থেকে একচুলও নড়ছে না অহিউল্লা। দূরে অনেক লোকের জটলা দেখা যাচ্ছে। অনেকক্ষণ ধরে সে পাথরের ওপর বসে বসে জটলার ভেতরের নানান রকম কর্মকাণ্ড দেখে। মানুষের উত্তেজনা দেখে। বাংলা ভাষার দাবীতে ছাত্রজনতা মুষ্ঠি ছুঁড়ে শ্লোগান দিচ্ছেএইসব দেখে। হাতের শাদা কাগজটিতে একটি প্রজাপতি আঁকার চেষ্টা করে অহিউল্লা। মিছিলটি এদিকেই এগিয়ে আসছে। ছবি আঁকা বন্ধ করে কাগজটি ভাঁজ করে পকেটে রাখে সে। ওর টেনশন বাড়তে থাকে। ভয় এবং আনন্দ দুটোই কাজ করে একসাথে। একবার মনে হয় মিছিলের ভিড়ের মধ্যে ঢুকে মুষ্ঠি উঁচুতে তুলে শ্লোগান দিতেকিন্তু সে তা করে নাভয় পায়। আনমনে অন্য ছবি-আঁকা কাগজটি মুখে ঢুকিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চিবুতে থাকে। মিছিলটি তখন এগুতে এগুতে খোশমহলের বেশ কাছে চলে আসে। হঠাৎ মিছিলের পেছন থেকে ঠা ঠা ঠা ঠা রাইফেলের গুলির শব্দ হয়। মিছিল ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। কয়েকজন লুটিয়ে পড়ে। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই একটি বুলেট এসে অহিউল্লার মাথায় লাগে। মাথার খুলি উড়ে যায়সে লুটিয়ে পড়ে। 

 

মেডিকেল কলেজের ভেতরে খুব ভিড়। পুলিশ ভিড়টিকে ঘিরে রেখেছে। কিছুতেই কাছে এগুতে পারছি না। গতকাল থেকে আন্দোলনকারীদের মৃতদেহ এবং আহত মানুষ আসছে। আমাদের মত যারা মেডিকেলের ছাত্র তারাও পুরোদমে চিকিৎসা করছি কিন্তু কূল-কিনারা করতে পারছি না। আহারে বাচ্চা একটা ছেলে – এইরকম একটি কথা বলতে বলতে ভিড় থেকে লোকজন ছিটকে এসে করিডোরে গুঞ্জন তুলছে। আমার পরনে এপ্রন ছিলতাই ধাক্কা-টাক্কা মেরে কাছে এগিয়ে গেলাম। একজন পুলিশ আমার দিকে সন্দেহের চোখে তাকালো, ‘আপনি কি ডাক্তার?’

আমি বলি, ‘মেডিকেলের ছাত্রআমার নাম মাহফুজ হোসেন। ছাত্র বলে আমরা তো আর বসে নেইসবাই চিকিৎসা করছি।

পুলিশটি আর কথা বাড়ালো না। আমি স্ট্রেচারে হাত রাখলাম। স্ট্রেচার ঠেলতে ঠেলতে মুখের কাপড় সরিয়ে দেখিমাথার একটি অংশ নেই। একটি নয়/দশ বছরের কিশোরের মৃতদেহ। সরাসরি মৃতদেহ মর্গে নিয়ে যাওয়া হয়। ছেলেটির পরনে ছিল একটি হাফ হাতা নীল শার্ট। ওর মুখে লালায় ভেজা একটি কাগজ। বের করে দেখিরঙপেন্সিল দিয়ে আঁকা একটি ছবি। পকেটেও একটি কাগজ ছিলওটাতে অসমাপ্ত ছবিপ্রজাপতির ডানা। যখন গুলি লাগে তখন হয়ত ও ছবি আঁকছিল।

 

গবেষকদের বর্ণনা

 

১. 

ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের অমর শহিদদের তালিকায় একজন ১০ বছরের কিশোর রয়েছেন যার নাম হল অহিউল্লা। তিনি ছিলেন রাজমিস্ত্রী হাবিবুর রহমানের ছেলে। শহিদ হওয়ার সময় অহিউল্লা তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র ছিলেন। অহিউল্লা শহিদ হন ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ তারিখে। এই দিন নবাবপুর রোডে আনেক সেনা মোতায়েন ছিল।...ঘটনার সময় অহিউল্লা মনের আনন্দে নবাবপুর রোডের পাশে খোশমহল রেস্টুরেন্টের সামনে দাঁড়িয়ে কাগজ চিবুচ্ছিলেন। [এম আর মাহবুবউপেক্ষিত তিন ভাষা শহিদ।]

 

২.

অহিউল্লাহ শহিদ হন ১৯৫২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি। তখন তাঁর বয়স মাত্র আট বছর এবং তিনি তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র। তিনি ছিলেন রাজমিস্ত্রী হাবিবুর রহমানের ছেলে। ১৯৫২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি নবাবপুর রোডে গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনি মারা যান। ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ তারিখের দৈনিক আজাদে তাঁর মৃত্যুসংবাদ ছাপা হয়। [আহমদ রফিকভাষা আন্দোলন ও ভাষা সংগ্রামীগণগণপ্রকাশনীমার্চ২০১২পৃষ্ঠা-২৬]

 

৩.

 

অহিউল্লাহ নামক ৮/৯ বছরের একটি ছেলের মৃত্যুর খবর অবশ্য পাওয়া যাচ্ছে। অন্য কয়েকজন শহিদের পরিচয়ের সঙ্গে অহিউল্লাহর শাহদাতের খবরটি রয়েছে ১৩৬২ সালের ১১ ফাল্গুনের সাপ্তাহিক নতুন দিনে। এতে কেবল এইটুকুই বলা হয়েছে যেরাজমিস্ত্রী হাবিবুর রহমানের ছেলে ২২ ফেব্রুয়ারি নবাবপুর রোডে খোশমহল রেস্টুরেন্টের সামনে হঠাৎ মাথায় রাইফেলের গুলি লেগে নিহত হয় এবং তাঁর লাশ অপসারিত হয়। [বশির আল হেলালভাষা আন্দোলনের ইতিহাসপৃষ্ঠা ৪৮৩]

 

৪.

 

অহিউল্লাহর বাসার ঠিকানা ছাপা হয় ১৫২ লুৎফর রহমান লেন। পুরান ঢাকার এই ঠিকানায় ও মহল্লায় এক বিস্ময় আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। অন্ধকারে ঢিল ছোঁড়ার মতো অনুসন্ধান করতে গিয়ে উন্মোচিত হয় এক বিস্মৃত কিশোর-শহিদ সম্পর্কে অজানা তথ্য। কথা হয় কিশোর শহিদের আত্মীয় স্বজন ও ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী এক বন্ধুর সঙ্গে। জানা যায়সরকার থেকে সড়ক দূর্ঘটনায় মারা গেছে বলা হলেও সত্যি হচ্ছে ১৫২ লুৎফর রহমান লেনের বাসাটির এক কিশোর বায়ান্নতে শহিদ হয়েছিলেন। তাঁর বয়স ছিল দশ বছর। তিনি নওয়াবপুর রোডের যে স্থানে গুলিবিদ্ধ হনতাঁর অদূরেই প্রায় একই সময়ে ঘটনাস্থলেই নিহত হন শফিউর রহমান। অহিউল্লাহও গুলিবিদ্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মারা গিয়েছিলেন। আর মিলিটারি ও পুলিশ সঙ্গে সঙ্গেই লাশটি ঘটনাস্থল থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। প্রচারপত্রে অহিউল্লাহর নাম ভুল ছাপা হলেও তাঁর পিতার নাম ও পরিচয়টি ঠিক ছিল। তাঁর পিতা পেশায় ছিলেন একজন রাজমিস্ত্রী। তিনি ছিলেন ঢাকার আদি বাসিন্দা। [আহমেদ নূরে আলমবায়ান্নর একটি বিস্মৃত কিশোর-শহিদ] 

Comments

Popular posts from this blog

অসাধারণ এই শিল্পীর জীবনের গল্প বড় করুণ

  [এই সময়ের অত্যন্ত প্রতিভাবান শিল্পী সারফুদ্দিন আহমেদ। বাড়ি পশ্চিমবঙ্গে। আর্ট কলেজে খণ্ডকালীন শিক্ষকতা করেন ,  আর শুধু ছবি আঁকেন। নানান মাধ্যমে ,  নানান বিষয়ের ছবি। সারফুদ্দিন আহমেদের ছবি থেকে চোখ ফেরানো যায় না ,  আপনাতেই ওঁর নান্দনিক সৃষ্টিকর্মে দৃষ্টি আটকে যায় ,  কী জল রঙ ,  কী অ্যাক্রিলিক ,  কিংবা স্রেফ পেন্সিলের ড্রয়িং। এই গুণী শিল্পীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কবি কাজী জহিরুল ইসলাম। সাক্ষাৎকারটি এখানে উপস্থাপন করা হলো।]       ভারত আমাকে চোখ দিয়েছে ,  বাংলাদেশ দিয়েছে দৃষ্টি -     সারফুদ্দিন আহমেদ     কাজী জহিরুল ইসলামঃ  ব্যাক গ্রাউন্ডে তবলা বাজছে আপনি ছবি আঁকছেন কাচের ওপর।    এই যে বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে ছবি আঁকা, এই ছন্দটা ছবিতে কিভাবে ধরেন? আর কোনো শিল্পী ছবি  আঁ কার সময় যন্ত্রানুসঙ্গ ব্যবহার করেছেন?   সারফুদ্দিন আহমেদঃ   কাঁচ নয়,   এটি এক বিশেষ ধরনের কাপড়-নেট। এই নেটের উপরে বর্তমানে আমার এক্সপেরিমেন্ট চলছে।    জহিরুলঃ ও ,  ফেইসবুকে যখন ছবিটি দেখি কাচের মতো ...

কাজী জহিরুল ইসলামের কবিতা || আবুল কাইয়ুম

কাজী জহিরুল ইসলামের কবিতা: জাতীয়-বৈশ্বিক মেলবন্ধন   || আবুল কাইয়ুম ||    কবি যদি হন বিশ্বপরিব্রাজক ,  তবে তিনি তো কবিতায় আঁকবেন তাঁর দেখা দুনিয়ার ছবি। বৃহত্ত্বকে আশ্লেষ করার পরিণামে স্বাভাবিকভাবে তাঁর মধ্যে জন্ম নেবে মানবিক মহত্ত্ববোধ ,  তা যে কাব্যাদর্শের লাঠিতে ভর করেই হোক। আশির দশক থেকে ক্রমবিকশিত কবি কাজী জহিরুল ইসলামের ক্ষেত্রেও একথা সত্যি । পর্যাপ্ত বিশ্বভ্রমণের অভিজ্ঞতায় আলোকিত হয়েছেন বলেই তিনি যে কোনো সঙ্কীর্ণতার উর্ধ্বে থেকে নিজেকে উদারনৈতিক মানবিক চৈতন্যে সংগঠিত করতে পেরেছেন ,  বিশ্বমানবতা ও বিশ্বশান্তির মন্ত্রে উজ্জীবিত রেখেছেন। তাঁর ব্যক্তিত্বে জড়ো হয়েছে বৃহত্তর সমষ্টিচেতনা ,  তাঁর প্রেম ও প্রার্থনা মানব কল্যাণের আশ্রয়ে গড়ে উঠেছে। তার লেখনীতে নানা দেশের মানুষের জীবন ,  সংস্কৃতি ,  প্রেম ,  ত্যাগ ও সংগ্রামের চালচিত্র কীভাবে উঠে এসেছে তা তাঁর কবিতার সংস্পর্শে না এলে বোঝা যাবে না। তাঁর  ‘ এল সালভাদর ’  শীর্ষক কবিতার কথাই ধরা যাক। এই অত্যুজ্জ্বল কবিতার মাত্র কয়টি বিস্ময়কর পংক্তিই শুধু এখানে তুলে ধরছি-    হণ্ডু...

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জুর সাক্ষাৎকার || পর্ব ৭

মতিউর রহমান চৌধুরীকে  র‍্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কারের জন্য নমিনেট করেছিলেন  আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু       [লেখক, সাংবাদিক, অনুবাদক আনোয়ার হোসেইন মঞ্জুর সাক্ষাৎকারের সপ্তম  পর্ব আজ প্রকাশ করা হলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কবি কাজী জহিরুল ইসলাম।]          জহিরুলঃ  আপনার সাংবাদিকতা জীবনের প্রায় পুরোটাই ব্যয় করেছেন জাতীয় সংসদ কভার করে। এই সংসদে আমাদের সংবিধানের অনেকগুলো সংশোধনী পাশ হয়েছে। আমাদের নেতারা সব সময় বলেন, ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড় কিন্তু প্রকৃত চিত্র হচ্ছে দেশের চেয়ে দলের স্বার্থ বড় হয়ে ওঠে এবং দলের চেয়ে ব্যক্তির/পরিবারের স্বার্থই বেশি গুরুত্ব পায়। প্রধান প্রধান সংশোধনীগুলোর আলোকে যদি বিশ্লেষণ করেন কতোটা জাতীয় স্বার্থে আর কতটা ব্যক্তি বা পরিবারের স্বার্থে এইসব সংশোধনীগুলো করা হয়েছে।    মঞ্জুঃ   আপনি ঠিকই বলেছেন, এযাবত বাংলাদেশে ১১টি জাতীয় সংসদ গঠিত হয়েছে এবং এর মধ্যে দ্বিতীয় সংসদ থেকে নবম সংসদ পর্যন্ত মোট আটটি সংসদের অধিবেশন কভার করা সুযোগ হয়েছে আমার। আমার সংসদ কভারের সময়ে আমাদের সংবিধানের ১০টি সংশোধনী অনুমো...