Skip to main content

কে মেধাবী?

 মেধাবী শনাক্ত করার উপায় 

 || কাজী জহিরুল ইসলাম || 





একটি অবয়বপত্র-স্ট্যাটাসে লিখেছিলাম সামাজিক মান মর্যাদার ক্ষেত্রে যদি মেধাকে অগ্রাধিকার দেয়া হয় তাহলে উন্নয়নের দৌড়ে দ্রুত এগিয়ে যেতে পারবো। উন্নত বিশ্বের দিকে তাকালে এই চিত্রই আমরা দেখি। মানুষের চূড়ান্ত লক্ষ তো সামাজিক মান-মর্যাদাই। আমরা প্রথমে মন দিয়ে, ধ্যান দিয়ে, পরিশ্রম করে, ডিগ্রী অর্জন করি, লক্ষ হচ্ছে ভালো চাকরি পাওয়া। চাকরি পাওয়ার পর পরিশ্রম করে ভালো পারফর্ম করি, লক্ষ হচ্ছে পদোন্নতি পাওয়া এবং বেশি আয় করা। এরপর আমরা ক্রমাগত আমাদের যৌবনব্যাপী পরিশ্রম করতে থাকি সম্পদ আহরণের জন্য। যখন প্রচুর সম্পদের মালিক হয়ে যাই তখন সম্পদ ব্যয় করতে থাকি সামাজিক মান-মর্যাদা অর্জনের জন্য। সামাজিক মান-মর্যাদাই সর্বসাধারণের চূড়ান্ত লক্ষ। ব্যতিক্রমী মানুষদের কথা আলাদা। এখন সামাজিক মান-মর্যাদা দেওয়ার ক্ষেত্রে আমরা যদি সম্পদশালীকে বা অন্য কোনো শালীকে (শ্যালিকা নয় কিন্তু) বিবেচনা না করে মেধাবীকে, প্রজ্ঞাবানকে বিবেচনা করি তাহলে মানুষ মেধা এবং প্রজ্ঞা অর্জনে অধিক উৎসাহী হবে। সম্পদশালী যদি মেধাবী হয়, প্রজ্ঞাবান হয় এবং মানবিক বোধসম্পন্ন মানুষ হয় তাকে সম্মানের আসনে বসাতে কোনো অসুবিধা নেই।

ড. আবেদীন কাদের এই মেধার জায়গাটিতে খুব যুক্তিযুক্তভাবেই একটি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, অর্বাচীন মূর্খও নিজেকে মেধাবী দাবি করে হুংকার তুলতে পারে। কারণ মেধা পরিমাপের মানদণ্ড নির্ধারণ সহজ নয়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার রেজাল্ট একটা পথ কিন্তু সৃষ্টিশীল মানুষ আবার এমন সব উদ্ভট দাবি নিয়ে আসবে যেটা সামলানো কঠিন হবে। কারণ একজন তৃতীয় শ্রেণীর চলচ্চিত্র নির্মাতা চতুর্থ শ্রেণীর কবিপঞ্চম শ্রেণীর চিত্রকরসপ্তম শ্রেণীর সুরশিল্পী এমন দাপাদাপি শুরু করবে যে আপনার পক্ষে তখন মেজাজ ঠিক রাখা কঠিন হবে। তার এই বক্তব্যে উষ্মা আছে, অভিমান আছে কিন্তু তিনি এই চিত্রটি সমাজ থেকেই তুলে এনেছেন। এখন কথা হচ্ছে তাই বলে কি মেধার মূল্যায়ন করবো না? একটি সমস্যার অজুহাতে আমরা কি অন্য একটি সমস্যাকে বাঁচিয়ে রাখবো? এটি আমাদের মজ্জাগত বৈশিষ্ট্য যে কেউ যখন আমার পাপের কথা বলে আমি তখন তার একটি অতীত পাপের উদ্ধৃতি দিয়ে নিজের পাপকে যুক্তিযুক্ত করার চেষ্টা করি। ব্যক্তিজীবন থেকে জাতীয়জীবন সর্বত্রই এই দৃশ্য প্রকট। আমাদের রাজনীতিতে তো এটিই একমাত্র সংস্কৃতি হয়ে উঠেছে। আমরা অতীতের বা অন্যের মন্দ দৃষ্ঠান্ত উপস্থাপন করবো শুধুমাত্র মন্দ কাজকে নিরুৎসাহিত করার জন্য বা নিজে মন্দ কাজ না করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করার জন্য। এ ছাড়া মন্দ-দৃষ্ঠান্ত আর কোনো কাজে লাগে না। কিন্তু আমাদের সংস্কৃতিতে মন্দ দৃষ্ঠান্ত তুলে ধরি আরেকটি মন্দকে বৈধতা দেবার জন্য। এটি বাঙালি সংস্কৃতির সবচেয়ে খারাপ দিক, যা আমাদেরকে ক্রমশ কেবল নিচের দিকেই নিয়ে যাচ্ছে।     

কিভাবে মেধা শনাক্ত করা যায় তার একটি সমাধানে যাবার চেষ্টা করি। প্রথমে পরিষ্কারভাবে একটি রেখা টানতে হবে সম্মান নেয়া ও সম্মান দেয়ার মধ্যে। আমরা শুধুমাত্র সম্মান দেয়ার ক্ষেত্রটিই বিবেচনা করবো। সম্মান নেয়ার ক্ষেত্রটি বাতিল করে দেব। অর্থাৎ নিজের মেধাকে কোনোভাবেই বিবেচনায় রাখবো না। এবং নিজের সঙ্গে কাউকে তুলনা করবো না। 

নিজের স্বার্থ রহিত হওয়ার ফলে মেধা বিচারে আমরা অনেকটাই নৈর্ব্যক্তিক হতে পারবো। এখন আমরা প্রত্যেকে যদি কাকে সম্মান দেবো শুধু তা নিয়ে চিন্তা (আমাকেও দেবে কিনা, অতীতে দিয়েছিল কিনা, এসব চিন্তা দূরে রাখতে হবে) করি তাহলে তৃতীয়, চতুর্থ বা পঞ্চম শ্রেণীর মেধার আস্ফালন আমাকে স্পর্শ করবে না। কে মেধাবী কে মেধাবী নয় তা আমরা প্রত্যেকে নিজের মত করে ঠিক করবো। অন্যের বিবেচনার ওপর নির্ভর করবো না। তবে এই আত্মপ্রতিশ্রুতি নিশ্চিত করতে হবে যে আমি নিজের বিবেচনার সাথে প্রতারণা করবো না। এমন হাজারো দৃষ্টান্ত আছে, আমি নিশ্চিত জানি ক এর চেয়ে খ বেশি মেধাবী কিন্তু আমি সম্মানের আসনে ক-কেই বারবার বসাচ্ছি কারণ এতে আমার ব্যক্তিগত প্রাপ্তি নিহিত আছে। এই জায়গাটি থেকে আমাদের অবশ্যই বেরিয়ে আসতে হবে। আমি একজন পিএইচডি এবং পোস্ট ডক্টরেটধারীকে একটি রাজনৈতিক দল ও তার প্রধানের নাম নিয়ে বলতে শুনেছি আমি চাই যে কোনো মূল্যে অমুক ক্ষমতায় আসুক, ভোট চুরি করে, ভোট ডাকাতি করে, যেভাবে পারে সেভাবে। তিনি তো ভালো করেই জানেন, ভোট চুরি করে বা ভোট ডাকাতি করে ক্ষমতায় আসা অন্যায়, তার বিবেচনাবোধ নিশ্চয়ই এটাকে সমর্থন করে না, তবুও এই অন্যায়কে তিনি সমর্থন করছেন, কারণ এতে তার ব্যক্তিগত লাভ নিহিত। এই জায়গাটি থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে কোনো ফর্মূলাই কাজ করবে না।  

প্রথমে নিজের চিন্তার, নিজের বিবেচনাবোধের, সততা নিশ্চিত করতে হবে। এরপর আমার বিবেচনায় যিনি বেশি মেধাবী তাকেই আমি বেশি সম্মান করবো, এই জায়গাটিতে আসতে হবে। কেউ আমাকে ঠিক করে দেবে না অমুকবেশি মেধাবী। শুধুমাত্র আমার নিজের জবাবদিহিতার জায়গাটি নিজের কাছে স্বচ্ছ রাখতে হবে। এখন কথা হচ্ছে এতে করে কি সমস্যার পূর্ণ সমাধান হবে? আমাদের সকলেরই কি মেধা যাচাইয়ের যোগ্যতা আছে? সমাজ কি প্রকৃত মেধাবীকে পাবে? সকলের জাজমেন্ট কি এক হবে? না সকলের জাজমেন্ট এক হবে না এবং মেধা যাচাইয়ের ক্ষমতা প্রত্যেকেরই তার নিজের মত করে আছে। কারো বিবেচনাবোধকেই পুরোপুরি বাতিল করে দেয়া যাবে না। প্রত্যেকে তার নিজের বিদ্যাবুদ্ধি এবং বিচারক্ষমতা অনুযায়ীই তার মেধাবীকে শনাক্ত করবে। একটি জাতির গড় বিবেচনাবোধ যে পর্যায়ে আছে আমরা সে পর্যায়ের ফলাফল পাবো এবং তা আমাদের খুশিমনে মেনে নিতে হবে। এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আমরা যাকে বা যাদেরকে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে মেধাবী বলে শনাক্ত করবো কোনো এক সময়ে আমাদের কাছে তাদেরকে সঠিক মনে নাও হতে পারে, আমাদের গড় বিবেচনাবোধ, গড় বিদ্যাবুদ্ধি বাড়লে, মেধাবীদের নামও বদলে যাবে, এভাবেই আমরা ক্রমশ ধাপে ধাপে অগ্রসর হতে থাকব। শুধুমাত্র আমাদের নিজের কাছে সৎ থাকতে হবে। আত্মজবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।

 

হলিসউড, নিউ ইয়র্ক। ২২ মে ২০১৯।  

Comments

Popular posts from this blog

অসাধারণ এই শিল্পীর জীবনের গল্প বড় করুণ

  [এই সময়ের অত্যন্ত প্রতিভাবান শিল্পী সারফুদ্দিন আহমেদ। বাড়ি পশ্চিমবঙ্গে। আর্ট কলেজে খণ্ডকালীন শিক্ষকতা করেন ,  আর শুধু ছবি আঁকেন। নানান মাধ্যমে ,  নানান বিষয়ের ছবি। সারফুদ্দিন আহমেদের ছবি থেকে চোখ ফেরানো যায় না ,  আপনাতেই ওঁর নান্দনিক সৃষ্টিকর্মে দৃষ্টি আটকে যায় ,  কী জল রঙ ,  কী অ্যাক্রিলিক ,  কিংবা স্রেফ পেন্সিলের ড্রয়িং। এই গুণী শিল্পীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কবি কাজী জহিরুল ইসলাম। সাক্ষাৎকারটি এখানে উপস্থাপন করা হলো।]       ভারত আমাকে চোখ দিয়েছে ,  বাংলাদেশ দিয়েছে দৃষ্টি -     সারফুদ্দিন আহমেদ     কাজী জহিরুল ইসলামঃ  ব্যাক গ্রাউন্ডে তবলা বাজছে আপনি ছবি আঁকছেন কাচের ওপর।    এই যে বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে ছবি আঁকা, এই ছন্দটা ছবিতে কিভাবে ধরেন? আর কোনো শিল্পী ছবি  আঁ কার সময় যন্ত্রানুসঙ্গ ব্যবহার করেছেন?   সারফুদ্দিন আহমেদঃ   কাঁচ নয়,   এটি এক বিশেষ ধরনের কাপড়-নেট। এই নেটের উপরে বর্তমানে আমার এক্সপেরিমেন্ট চলছে।    জহিরুলঃ ও ,  ফেইসবুকে যখন ছবিটি দেখি কাচের মতো ...

কাজী জহিরুল ইসলামের কবিতা || আবুল কাইয়ুম

কাজী জহিরুল ইসলামের কবিতা: জাতীয়-বৈশ্বিক মেলবন্ধন   || আবুল কাইয়ুম ||    কবি যদি হন বিশ্বপরিব্রাজক ,  তবে তিনি তো কবিতায় আঁকবেন তাঁর দেখা দুনিয়ার ছবি। বৃহত্ত্বকে আশ্লেষ করার পরিণামে স্বাভাবিকভাবে তাঁর মধ্যে জন্ম নেবে মানবিক মহত্ত্ববোধ ,  তা যে কাব্যাদর্শের লাঠিতে ভর করেই হোক। আশির দশক থেকে ক্রমবিকশিত কবি কাজী জহিরুল ইসলামের ক্ষেত্রেও একথা সত্যি । পর্যাপ্ত বিশ্বভ্রমণের অভিজ্ঞতায় আলোকিত হয়েছেন বলেই তিনি যে কোনো সঙ্কীর্ণতার উর্ধ্বে থেকে নিজেকে উদারনৈতিক মানবিক চৈতন্যে সংগঠিত করতে পেরেছেন ,  বিশ্বমানবতা ও বিশ্বশান্তির মন্ত্রে উজ্জীবিত রেখেছেন। তাঁর ব্যক্তিত্বে জড়ো হয়েছে বৃহত্তর সমষ্টিচেতনা ,  তাঁর প্রেম ও প্রার্থনা মানব কল্যাণের আশ্রয়ে গড়ে উঠেছে। তার লেখনীতে নানা দেশের মানুষের জীবন ,  সংস্কৃতি ,  প্রেম ,  ত্যাগ ও সংগ্রামের চালচিত্র কীভাবে উঠে এসেছে তা তাঁর কবিতার সংস্পর্শে না এলে বোঝা যাবে না। তাঁর  ‘ এল সালভাদর ’  শীর্ষক কবিতার কথাই ধরা যাক। এই অত্যুজ্জ্বল কবিতার মাত্র কয়টি বিস্ময়কর পংক্তিই শুধু এখানে তুলে ধরছি-    হণ্ডু...

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জুর সাক্ষাৎকার || পর্ব ৭

মতিউর রহমান চৌধুরীকে  র‍্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কারের জন্য নমিনেট করেছিলেন  আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু       [লেখক, সাংবাদিক, অনুবাদক আনোয়ার হোসেইন মঞ্জুর সাক্ষাৎকারের সপ্তম  পর্ব আজ প্রকাশ করা হলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কবি কাজী জহিরুল ইসলাম।]          জহিরুলঃ  আপনার সাংবাদিকতা জীবনের প্রায় পুরোটাই ব্যয় করেছেন জাতীয় সংসদ কভার করে। এই সংসদে আমাদের সংবিধানের অনেকগুলো সংশোধনী পাশ হয়েছে। আমাদের নেতারা সব সময় বলেন, ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড় কিন্তু প্রকৃত চিত্র হচ্ছে দেশের চেয়ে দলের স্বার্থ বড় হয়ে ওঠে এবং দলের চেয়ে ব্যক্তির/পরিবারের স্বার্থই বেশি গুরুত্ব পায়। প্রধান প্রধান সংশোধনীগুলোর আলোকে যদি বিশ্লেষণ করেন কতোটা জাতীয় স্বার্থে আর কতটা ব্যক্তি বা পরিবারের স্বার্থে এইসব সংশোধনীগুলো করা হয়েছে।    মঞ্জুঃ   আপনি ঠিকই বলেছেন, এযাবত বাংলাদেশে ১১টি জাতীয় সংসদ গঠিত হয়েছে এবং এর মধ্যে দ্বিতীয় সংসদ থেকে নবম সংসদ পর্যন্ত মোট আটটি সংসদের অধিবেশন কভার করা সুযোগ হয়েছে আমার। আমার সংসদ কভারের সময়ে আমাদের সংবিধানের ১০টি সংশোধনী অনুমো...