Skip to main content

স্বপ্নতাড়িত মায়াজাল || ইকবাল হাসান

স্বপ্নতাড়িত মায়াজাল 

 

|| ইকবাল হাসান || 



 

 

বাইরে বিরামহীন তুষারপাতচারদিক সাদা আর সাদাযেন বরফ-সমুদ্রে ভেসে যাচ্ছে পুরো শহরআর খুব অচেনা হয়ে উঠছে পরিপার্শ্ব। অতলান্ত বিষাদের অন্তহীন বেদনা যেন দখল নিচ্ছে মন ও শরীর। থান্ডার বে’ থেকে  দীর্ঘ প্রায় ১৫০০ কিলোমিটারের তুষারাক্রান্ত ঝড়ো-পথ পেড়িয়ে এসে দেখিঅতি চেনা প্রিয় টরন্টো শহর মৃত্যুর মতো হীম শীতলসাদা কাফনে আবৃত হয়ে নরকের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছে। যেন আকালের কচ্ছপ বাড়িয়েছে অশুভ গ্রীবা। ঘরে ঢুকেই হাফ কফি হাফ হট ওয়াটারে দীর্ঘ চুমুক আর স্বগৃহের উষ্ণ আমন্ত্রণে দূর হলো পথের ক্লান্তিউবে গেল বিষাদ ও বেদনাপোষা বিড়ালের শব্দহীন পায়ের পাতার মতো ধীরে ধীরে ফিরে এলো স্বস্তি ও আনন্দ। আর এই স্বস্তি ও আনন্দে যেন সহসাই ভাগ বসাতে চাইলো ধূমায়ীত কফির পাশে সদ্য ম্যাসেজ বক্সে আসা মন ভালো করা একটি কবিতা। 

 

হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ মনে হয়/ আমি স্থির দাঁড়িয়ে আছি/  আমার পায়ের নিচ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে পথ/ আজকাল সবকিছু এমন উল্টোপাল্টা লাগে/ পাঁয়ের নিচ দিয়ে হেঁটে যাওয়া পথটাকে আবার/ মাঝে মাঝে মনে হয় চলমান রেলগাড়ি...আমার বুকের উপর দিয়ে/ অথবা আমার পিঠের নিচ দিয়ে ছুটে যাওয়া/ মায়াবী একটি রেলগাড়ির ধূসর বগি থেকে/ হঠাৎ লাফিয়ে পড়ে কৈশোরের বিনিদ্র বেড়াল/ অন্য একটি প্রিজন বগি থেকে লাফ দেয় সোনাব্যাঙ শৈশব/ আহাকী সুন্দর লাফাতে লাফাতে নেমে গেল স্বভাবের বিলে।... 

 

[আকালের কচ্ছপ বাড়িয়েছে অশুভ গ্রীবা - কাজী জহিরুল ইসলাম ]।

    

এক সান্ধ্যআড্ডায় কেউ একজন বলেছিলেনকবির ধর্ম সময়ের দীপ্র পোষাকে আবহমান সৌন্দর্যে অবগাহন। সুদূর প্রবাসে বসেও যারা আধুনিক বাংলা কবিতার মুলধারার সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত রেখে আবহমান সৌন্দর্যে অবগাহন করে চলেছেন কবি কাজী জহিরুল ইসলাম তাদের একজন। নিউইয়র্ক প্রবাসী এই কবির সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম প্রধান প্রাণ-পুরুষ কবি শহীদ কাদরী ও নীরা কাদরী আয়োজিত কবিতা সন্ধ্যার অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠানে কাজী জহিরুল ইসলাম স্বরচিত কবিতা পাঠ করেছিলেন। অই অনুষ্ঠানে কবি শহীদ কাদরী  আমাকে বলেছিলেনআগুন আছে ওর মধ্যে। সেখান থেকেইসত্যি বলতে কিকাজী জহিরুল ইসলামের কবিতার প্রতি আমার আগ্রহের শুরু এবং আমাদের পরিচয়ের শুভ-সূত্রপাত। এরপর যতোবার নিউইয়র্ক গিয়েছিআমাদের দেখা হয়েছেআড্ডা হয়েছেকথা হয়েছে কবিতা নিয়েকবিতার অন্তর্গত ভাবনাবিষয় নিয়ে। 

 

কবিতা কিকেন লেখা হয় কবিতা

 

কবিতা যে স্বপ্নতাড়িত মায়াজালবাস্তব-অবাস্তবের প্রতীকলৌকিক-অলৌকিকতার আশ্চর্য এক মোহময় বিভ্রমএকটি মুহূর্ত কিংবা মুহূর্তের ভগাংশবোধের ভিতর থেকে উৎসারিত গল্পের নির্যাসঅনুগল্প কিংবা স্মৃতিময় কোনো দূরাগত সংকেতকবিতা যে ভাবনাকাশে বিপন্ন বিদ্যুতের হিরন্ময় ঝিলিকবুকের ভেতর দূরারোগ্য অসুখবেদনা মধুর ক্ষতশব্দ রং ও রেখার এক বর্ণময় চিত্রায়ন উপমাপ্রতীক আর চিত্রকল্পের কারুকার্যময় দরোজা দিয়ে কাজী জহিরুলের কবিতা কাব্যপ্রেমী পাঠককে নিয়ে যায় অস্থির এক আনন্দের জগতে। এ যেন কখনো মধ্যরাতে পন্ডিত শীবকুমার শর্মার সন্তুরের অনির্বচনীয় শব্দধ্বনি কিংবা কখনো শীতের শেষ রাতে চৌরাশিয়ার বাঁশির অলৌকিক সম্মোহন।

 

একবার নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অক্টোভিও পাঁজ [ তখনো তিনি নোবেল পাননি ] আমেরিকান কবি রবার্ট ফ্রষ্টের সাক্ষাৎকার গ্রহনের জন্য ভারমন্ড গিয়েছিলেন। ফ্রষ্ট তখন ভারমন্ডের এক পাহাড়ের কেবিনে থাকতেন। পাঁজ-এর একটি প্রশ্ন ছিলোএকজন কবির জন্য অপরিহার্য বিষয় কি হওয়া উচিতফ্রষ্ট উত্তর দিয়েছিলেননিজস্ব কাব্য-ভাষা তৈরি করা। নিজস্ব কাব্য-ভাষাই একজন কবিকে স্বতন্ত্র করে তুলতে পারে। [ গ্রন্থ : অন পোয়েটস এন্ড আদার্স / অক্টোভিউ পাঁজ ]

 

আমার বিশ্বাসকাজী জহিরুল ইসলামও ইতোমধ্যে নিজস্ব কাব্য-ভাষা তৈরিতে সক্ষম হয়েছেন। ছন্দ প্রকরণউপমা চিত্রকল্পবাক্যরীতিউচ্চারণে তাঁকে আলাদাভাবে সনাক্ত করা যায়। একজন কবি তো এভাবেই আলোকিত হয়ে ওঠেন।

 

কবি শিল্পীরা কখনোই থেমে থাকেন না। তাদের সৃষ্টিতে প্রচলিত রীতিনীতি ভেঙে নতুন কিছু সৃষ্টির আগ্রহ অনিবার্য হয়ে ওঠে। ১৯০৫ সালে প্যারিসের এক প্রদর্শনীতে ক্যানভাসে রঙের  ব্যকরণহীন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে ফোবিষ্টরা শিল্পের প্রচলিত ধারার বিপরীতে সৃষ্টি করেছিলেন অনির্বচনীয় এক আলোক-তরঙ্গ। আমাদের কাব্যক্ষেত্রে সুধীন দত্তের সংবর্ত’ কিংবা ষাটের দশকে আবদুল মান্নান সৈয়দের জ্যোৎস্না-রৌদ্রের চিকিৎসাও প্রচলিত ধারার বিপরীতে যেন দীপ্র এক আলোর ভুবন। 

 

কবি কাজী জহিরুল ইসলামের কবিতায় ব্যকরণহীন শিল্পসম্মত বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির প্রবনতা লক্ষ্যনীয়। ক্রিয়াপদহীন কবিতা তাঁর কবিতাকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে নিঃসন্দেহে। প্রিয় বন্ধুসাপ্তাহিক বাঙালী’ সম্পাদক কৌশিক আহমেদ যথার্থ বলেছেন, ‘...এই কবিতাগুলোর মূল শক্তি হলক্রিয়াপদ না থাকায় এরা সর্বকালের। এরা অতীতেরবর্তমানের এবং ভবিষ্যতের।’ প্রসঙ্গত ক্রিয়াপদহীন ক্রিয়াকলাপ’ গ্রন্থের ভূমিকায় কবির বক্তব্য উল্লেখের দাবী রাখে। আমি ছন্দের মানুষ। ছন্দে লিখতেই স্বাচ্ছন্দ বোধ করি। অন্ত্যমিলহীন কবিতা সাধারণত অক্ষরবৃত্তে লেখা হয়কেউ কেউ মাত্রাবৃত্তেও লিখে থাকেন। এই গ্রন্থের কবিতাগুলো আমি সচেতনভাবে ছন্দে লিখিনি। কোথাও কোথাও অক্ষরবৃত্তের পর্ব পেয়ে যাবেনযা এমনিতেই এসে গেছে। মূলত ক্রিয়াপদহীন কবিতাকে আমি ছন্দের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত রাখতেই চেয়েছি।  

 

পর্যবেক্ষণ তো কবিরই কাজএমন কি নারীর অন্তর্বাসও 

তারও অভ্যন্তরে কেবল কবিরই অনুপ্রবেশদৃষ্টির।

সৃষ্টির তরঙ্গ কবির প্রথম ধারাপাতকবিতার উন্মেষ

বিকাশের অনুষঙ্গে আসঙ্গ সভ্যতারআরোপিত যদিও

ডালে ডালে বিস্তৃতিপত্রপুষ্পশিমুলরঙা সকাল।

 

চন্ডিদাসের প্রতীক্ষায় নিস্তরঙ্গ দুপুর

বিকেলের নড়বড়ে সাঁকোতে বাসন্তির পারাপার

কিশোরীর জামরঙা ঠোঁটে সন্ধ্যার চুমু

এরপর...এরপর বৃষ্টিবৃষ্টিতুমুল বৃষ্টিপাত

আমাদের অস্তিত্বের রাত্রিপ্রগাঢ়অন্তহীন পর্যবেক্ষণের সুদীর্ঘ বিছানা।

 

[পর্যবেক্ষণ/ কাজী জহিরুল ইসলাম]

   

এ ধরনের কবিতা এর আগে কেউ লিখেছেন কিনা আমার জানা নাই। কবিতার ক্ষেত্রে যে কোনো ধরনের পরীক্ষা- নীরিক্ষা-কে আমি স্বাগত জানাই। শুভ হোক কবির এই যাত্রা।

  

Comments

Popular posts from this blog

শিল্পী কাজী রকিবের সাক্ষাৎকার

নন-একাডেমিক শিল্পীরাই নতুন কিছু দেয় -    কাজী রকিব  [কাজী রকিব বাংলাদেশের একজন গুণী শিল্পী। রাজশাহী আর্ট কলেজের একজন প্রতিষ্ঠাতা-শিক্ষক। কলেজের প্রথম ক্লাসটি নেবার কৃতিত্বও তাঁর। নিরন্তর ছবি আঁকেন। নানান মাধ্যমে ,  নানান ভাবনার ছবি। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে সস্ত্রীক বসবাস। তার স্ত্রী মাসুদা কাজীও একজন গুণী শিল্পী। বৈচিত্রপ্রিয় এই শিল্পীর একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন কবি কাজী জহিরুল ইসলাম। ধারাবাহিকভাবে তা এখানে প্রকাশ করা হবে। আজ উপস্থাপন করা হলো প্রথম পর্ব।]   জহিরুলঃ  বেশিরভাগ শিল্পীই নিজের একটা স্টাইল তৈরি করেন ,  নিজস্বতা যাকে আমরা বলি। আবার কেউ কেউ একই ধরণের ছবি বারবার আঁকেন। আপনার কাজে বৈচিত্র খুব বেশি ,  এতে করে "টাইপড" অপবাদ থেকে আপনি মুক্ত কিন্তু নিজের একটি স্টাইল তৈরি করতে না পারা বা তৈরি হয়নি বলে কি আক্ষেপ হয় ,  নাকি এই যে ভার্সেটিলিটি এটাই আপনি বেশি উপভোগ করেন ?    রকিবঃ   আমি আসলে আলাদা করে ভাবিনি এই স্টাইল বিষয়ে। কারো মতো আঁকারও চেষ্টা করিনি তেমন ভাবে। অল্প বয়সে ,  আমার ১৯ / ২০ বছর বয়সে ,  সালভাদর দালির মতো আঁকতে চেষ্টা করেছিলাম কিছুদিন ।

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জুর সাক্ষাৎকার || পর্ব ৭

মতিউর রহমান চৌধুরীকে  র‍্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কারের জন্য নমিনেট করেছিলেন  আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু       [লেখক, সাংবাদিক, অনুবাদক আনোয়ার হোসেইন মঞ্জুর সাক্ষাৎকারের সপ্তম  পর্ব আজ প্রকাশ করা হলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কবি কাজী জহিরুল ইসলাম।]          জহিরুলঃ  আপনার সাংবাদিকতা জীবনের প্রায় পুরোটাই ব্যয় করেছেন জাতীয় সংসদ কভার করে। এই সংসদে আমাদের সংবিধানের অনেকগুলো সংশোধনী পাশ হয়েছে। আমাদের নেতারা সব সময় বলেন, ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড় কিন্তু প্রকৃত চিত্র হচ্ছে দেশের চেয়ে দলের স্বার্থ বড় হয়ে ওঠে এবং দলের চেয়ে ব্যক্তির/পরিবারের স্বার্থই বেশি গুরুত্ব পায়। প্রধান প্রধান সংশোধনীগুলোর আলোকে যদি বিশ্লেষণ করেন কতোটা জাতীয় স্বার্থে আর কতটা ব্যক্তি বা পরিবারের স্বার্থে এইসব সংশোধনীগুলো করা হয়েছে।    মঞ্জুঃ   আপনি ঠিকই বলেছেন, এযাবত বাংলাদেশে ১১টি জাতীয় সংসদ গঠিত হয়েছে এবং এর মধ্যে দ্বিতীয় সংসদ থেকে নবম সংসদ পর্যন্ত মোট আটটি সংসদের অধিবেশন কভার করা সুযোগ হয়েছে আমার। আমার সংসদ কভারের সময়ে আমাদের সংবিধানের ১০টি সংশোধনী অনুমোদিত হয়েছে এবং সংশোধনী প্রক্রিয়া কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। এখন পর্যন্ত স

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জুর সাক্ষাৎকার - তৃতীয় পর্ব

মঞ্জু আমার ওপর রাগ করেছে                                                           - আল মাহমুদ [লেখক, সাংবাদিক, অনুবাদক আনোয়ার হোসেইন মঞ্জুর সাক্ষাৎকারের  তৃতীয় পর্ব আজ প্রকাশ করা হলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কবি কাজী জহিরুল ইসলাম।]  সাক্ষাৎকার নেবার এক পর্যায়ে আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু  ও কাজী জহিরুল ইসলাম। ওয়ান্টাগ পার্ক, নিউ ইয়র্ক।  ছবি তুলেছেন ড. মাহবুব হাসান।   জহিরুলঃ  খুশবন্ত সিং তার সকল বই অনুবাদ করার লিখিত অনুমতি দিলেন আপনাকে এবং সেই অনুমতিপত্রটি তিনি নিজ হাতে আপনার সামনেই বাংলায় লিখে দিলেন। তিনি কিভাবে বাংলা শিখলেন তা কি জানতে পেরেছিলেন ?  মঞ্জুঃ    জ্বি ,  ঘটনাটি  ঘটে  ১৯৯২ সালের ডিসেম্বর মাসে ,  এ সম্পর্কে আমি আগের এক প্রশ্নে বলেছি। তারিখটি আমার স্মরণে নেই। তবে বাবরি মসজিদ ধ্বংস করার পর ,  ডিসেম্বরের শেষ দিকে। না ,  বাংলায় নয় ,  উনি ইংরেজিতে লিখেছেন। আমার কফি পানের সময়ের মধ্যেই লিখে দিয়েছেন। ১৯৮৪ থেকে মাঝে দীর্ঘ বিরতি দিয়ে আমাকে তিনটি বা চারটি চিঠি লিখেছেন। লিখেছেন বলতে আমার চিঠির উত্তর দিয়েছেন। প্রতিটি চিঠি ইংরেজিতেই লিখেছেন। প্রতিটি চিঠিতে আমাকে সম্বোধন করেছেন  “ আনোয়ার ভাই ,”  বলে।