বর্ণময় মানুষ জহিরুলদা
|| অজিত পাত্র ||
অনেক মানুষকে আমরা কোনো দিন দেখিনি অথচ ওরা আমাদের খুবই একান্ত আপন হয়ে ওঠেন । ঠিক এমনি এক মানুষ জহিরুলদা। কাজী জহিরুল ইসলামের সঙ্গে আমার এখনও সামনা সামনি দেখা হয়নি কিন্তু সাহিত্যিক জহিরুলদার সাথে আমার নিবিড় সম্পর্ক।
জহিরুলদা কী-ই না! একসঙ্গে একজন সফল কবি, ঔপন্যাসিক, শিশু-কিশোর লেখক, সম্পাদক, সাহিত্য সংগঠক, টি. ভি পর্দায় ভেসে ওঠা উপস্থাপক, বাচিক, বিহঙ্গপ্রবণ এক যাযাবর, জাতিসংঘের মুখ্যালয় নিউ ইয়র্কের একজন বিশিষ্ট কর্মকর্তা আর সবার উপরে একজন মানবিকতার পুজারী।
জাতি, ধর্ম, দেশ, অর্থ, সামাজিক অবস্থান সবকিছুকে পিছনে রেখে উনি শুধু মানুষকে ভালবাসেন, ভালোবাসেন জীবকে ও প্রকৃতিকে। আর ওইখানেই তাঁর সঙ্গে সোস্যাল মিডিয়ায় আমার বন্ধুত্ব, যার শেকড় অনেক গভীরে প্রোথিত। কবিতা আমি ভালোবাসি আর জহিরুলদার কবিতার আঙিনা একদেশ ছাড়িয়ে আরেক দেশ, আরেক দেশ পেরিয়ে অন্য কোনো অজানায় অর্থাৎ তাঁর কবিতার বিষয়বস্তু, চিত্রপট, সামাজিকতা, প্রকৃতি, শব্দ চয়ন, কোনো একটি দেশে সীমাবদ্ধ নয়। এর পিছনে কারণ হচ্ছে ওই বিহঙ্গপ্রবণ মানুষটি, এ পর্যন্ত ভ্রমণ করছেন ষাটের অধিক দেশ। শুধু যে ভ্রমণ করেছেন তা নয়, ওখানকার সভ্যতা সংস্কৃতির সঙ্গে তিনি ওতোপ্রোতভাবে মিশেছেন। ওখানে থেকেছেন, ওই দেশের জন্য কাজ করেছেন, এমন অনেক দেশ আছে তাঁর ভ্রমণ তালিকায়।
তাঁর এপর্যন্ত চল্লিশেরও বেশি বই প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে কবিতা গ্রন্থের সংখ্যা বেশি হলেও উপন্যাস, শিশু-কিশোর, প্রবন্ধ, অনুবাদ ও ভ্রমণ বিষয়ক বই এ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে অনেক।
ভাবলে অবাক লাগে একজন মানুষের পক্ষে কী এতসব সম্ভব! আবার জাতিসংঘের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তার ভূমিকায় চাকরিজীবন।
জহিরুলদার এপর্যন্ত কিছু ছাপা অক্ষরের বই পড়তে পেরেছি আর সোস্যাল মিডিয়াতে পড়েছি অজস্র কবিতা ও গদ্যসাহিত্য।
এর মধ্যে তাঁর কবিতা সংগ্রহ "ক্রিয়াপদহীন ক্রিয়াকলাপ" পড়ার আগ্রহ অনেক বেশি ছিল। কারণ আমি জেনেছিলাম "ক্রিয়াপদহীন ক্রিয়াকলাপ" কবিতা সংকলনটির সমকালীন কবিতায় এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এখানে তিনি বাংলা কবিতায় একটি নিরীক্ষা করেছেন। তিনি দেখেছেন রাবীন্দ্রিক যুগের কবিতার কফিন থেকে ত্রিশের দশকের পাঁচ কবি জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, সুধীন দত্ত, অমিয় চক্রবর্তী বাংলা কবিতাকে উদ্ধার করে আর এক নতুন আধুনিকতার পথ দেখিয়েছেন। কিন্তু সেই পথ আবার আজ দীর্ঘ নয় দশক ধরে ঘুরপাক খাচ্ছে একই যায়গায়। তাই কাজী জহিরুল ইসলাম বাংলা কবিতাকে একঘেয়েমি থেকে বের করে আনেন কবিতা থেকে ক্রিয়াপদ তুলে দিয়ে। তিনি বলেছেন, কবিতা থেকে যদি ক্রিয়াপদ বর্জন করা যায় তাহলে কবিতার পঙক্তিগুলি অনেক মজবুত আর টানটান হয়। স্থুল ক্রিয়াপদ কবিতার পঙক্তিকে দুর্বল করে ফেলে। এরই ফললস্বরূপ কবিতা গ্রন্থ ,"ক্রিয়াপদহীন ক্রিয়াকলাপ" এর সৃষ্টি হয়েছে। আমি কবিতাগুলো পড়ার সময় দেখেছি বিষয়বস্তুরা দেশের সীমানা ছাড়িয়ে ছুটে গেছে কতো দূর- দূরান্তে। পড়তে পড়তে আমি মুগ্ধ হয়েছি, আমি আপ্লুত হয়েছি, হয়েছি অভিভূত। ক্রিয়াপদহীন কবিতাগুলো যে কবিতার আঙিনায় এক নতুন দিশা দিয়েছে সে সত্যটি শুধু বাংলা কবিতা পাঠকের মধ্যে আবদ্ধ না রেখে অন্যান্য ভাষার পাঠকের সামনে তুলে ধরার জন্য নিজের তাগিদেই ওর ওড়িয়া অনুবাদ করেছি যা শিগগীরই বই আকারে প্রকাশিত হতে যাচ্ছে।
"কসোভোর পথে প্রান্তরে" কাজী জহিরুল ইসলামের এক ভ্রমণগ্রন্থ হলেও এখানে তাঁর চাকুরিজীবনের এক বিরাট এডভেঞ্চার ও চ্যালেঞ্জ উঠে এসেছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত এক দেশ, তখনো বড়বড় অট্টালিকায় লাগা আগুন নেভেনি। কোথাও আশ্রয় নেওয়ার মতো অক্ষত বাড়িঘর নেই। জাতিসংঘের আহ্বানে কয়েকজন ছুটলেন কসোভোতে, দেশটিকে আবার নতুন করে গড়ার জন্য। এপ্রিল ২০০০ থেকে এপ্রিল ২০০৩ পর্যন্ত তিনি ওই দেশে থেকেছেন বিপদসংকুল ভয়াবহ প্রতিকূল অবস্থাতেও বিভিন্ন দপ্তর সামলে। এ ভ্রমণ কাহিনী পড়লে গা কাঁটা দিয়ে শিহরিত হতে থাকে। কসোভোর নাগরিকদের আবার নতুন করে ভোটার তালিকা, পরিচয়পত্র তৈরি করা থেকে আরম্ভ করে তিনি কসোভোর ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্বেও ছিলেন। ২০০২ সালের অক্টোবর মাসের দিনগুলোতে যখন ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্বে, তখন কসোভো কারাতে ফেডারেশন আন্তর্জাতিক কারাতে ফেডারেশনের এফিলিয়েটেড মেম্বারশিপ লাভ করে। সেই সেলিব্রেশনের প্রধান অতিথি হিসাবে জহিরুদা বহু আন্তর্জাতিক সাংবাদিকদের সামনে এক অভিভাষণ রেখেছিলেন। আর ওখানে একটি ভিডিও দেখানো হয়েছিল ও দেশের মেয়েদের সাফল্যের কিছু তথ্যচিত্র। জহিরুলদা দিনরাত এক করে, খুবই পরিশ্রম করে ওই মন্ত্রণালয়টিকে সাজিয়ে ছিলেন এবং স্বপ্ন দেখেছিলেন একদিন ও দেশের মেয়েরা বিশ্বজয় করবে।
জহিরুলদার স্বপ্ন বিফল হয়নি, ২০১৬ সালের অলিম্পিকে কসোভোর মেয়ে মেইলিণ্ডা জুডোতে স্বর্ণপদক লাভ করেন। জহিরুলদার সম্পর্কে লিখতে গেলে লেখা শেষ হবে না। অর্ধশতক জীবনকালে কীই না করেছেন। সে সব কথা অনেকেই জানেন। জহিরুলদা আমাকে ভালবাসেন। আমাদের বন্ধুত্বের অল্প দিনের মধ্যে জেনেছিলেন যে আমি তাঁর চেয়ে বয়সে অল্প বছর হলেও ছোট। তাই আমাকে আরো ঘনিষ্ঠতার বাঁধনে বাঁধতে 'তুমি' করে সম্বোধন করেন। যখনই সাহিত্যভিত্তিক কোনো প্রশ্ন করেছি, কিছু জানতে চেয়েছি, অতি দ্রুততম সময়ের মধ্যে আমাকে উত্তর দিয়েছেন কর্মব্যস্ততার মধ্যেও।
আমার বঙ্গানুবাদে কয়েকটি ওড়িয়া কবিতা তিনি ভূমিকা লিখে নিউ ইয়র্ক থেকে প্রকাশিত বাংলা সাপ্তাহিক "বাংলাদেশ" পত্রিকাতে প্রকাশ করেছেন। তাঁর সম্পাদনায় আর এক নতুন সাহিত্য পত্রিকা "কারুবাক" পত্রিকায় আমার অনুবাদকৃত কিছু কবিতা প্রকাশ করতে যাচ্ছেন জেনে আমি খুবই আনন্দিত।
তাঁর "উটপাখিদের গ্রামে উড়ালসভা" কবিতা সংগ্রহটি কয়েক বার পড়েছি। আমি আনন্দে অভিভূত ও বিস্মিত হয়েছি, কারণ এটি এক অসাধারণ কাব্যগ্রন্থ। "দেহকাব্য" গ্রন্থটিতে দেহও যে কাব্যময় হতে পারে তারও যে শিল্পসত্তা রয়েছে তা তিনি কবিতার তুলিতে আমাদের উপহার দিয়েছেন। উনি দেখিয়েছেন, দেহ আজও শিল্প শুধু দেখার চোখ চাই। আদি যুগে শরীরকে শিল্পময়তার গতি দেওয়াতে যুগস্রষ্টা কবি, শিল্পীদের প্রচেষ্টার সারিতে আরো একজন যুক্ত হলেন।
একদিন তিনি আমাকে জানালেন, "অজিত তোমাকে একটা সারপ্রাইজ দেব"। কী সারপ্রাইজ, এতবড় এক মানবদরদী কবির কাছ থেকে? ভাবতেই পারিনি কোনো কিছু। আমার জানার উৎসাহকে আর চেপে না রেখে উনি জানিয়েছিলেন, " অজিত পাত্র আমার কবিতার অংশ হয়ে গেছে"।
কী আশ্চর্য আমি কি করে তাঁর কবিতায় ঢুকে পড়লাম!
ঢাকা, বাংলাদেশের " অন্যান্যা " প্রকাশন প্রকাশিত কবিতা গ্রন্থ " সূর্যাস্তের পরের ফিরিস্তি " ২০১৭-র একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হওয়ার পর আমার হাতে আসে। দেখি একটি কবিতায় আমার নাম জ্বলজ্বল করছে--
বেশ ক'দিন ধরেই জেনেভা নিয়ে হাঁটছি
অথচ কথা ছিল ওকে ফেইসবুকের মোড়ে নামিয়ে দেব সেই কবেই
ওকে খুব আদরে তুলে নেবে ক'জন ওয়েব জিন, তারপর নামিয়ে দেবে
ঢাকা, কলকাতা, লন্ডন কিংবা অকল্যান্ডে।
ফন্দু চিজের সাথে শাহী মোগলাইয়ের গল্পটা
শেষমেশ আর হলো না অজিত পাত্রের
কথা ছিল ক'জন সুইস তরুনী ঢেউ তুলবে অকল্যান্ড সামারে,
মিতু এবং নোবেলের সাথে বারকিউর আগুন
জ্বালাবে মাওরি বারান্দায়, হলো না।
ড্যানিয়েল বারসাতের ভাঙা চেয়ারে চড়ে অক্সফোর্ড স্ট্রিট থেকে
ট্রাফেলগার স্কয়ার অবধি
মানবিক ভ্রমণটা আর হলো না রাহনূমা নূরের,
তোমার ওয়াটার জেট দিয়ে ভেজাতে চেয়েছিলে
আফগান মরু মঈনুস সুলতান, কিছুই হলো না।
জেনেভা, হে অনিন্দ্য সুন্দরী, বেরিয়ে এসো আমার পকেট থেকে
দেখা এক পৃথিবী ফেইস তোমার দিকে বাড়িয়ে দিয়েছে তৃষ্ণার্ত বুক।
[পকেটে জেনেভা নিয়ে হাঁটছি]
কোনো কবিতার মধ্যে কারো নাম উল্লেখ এক অসাধারণ ব্যাপার। তাছাড়া আমার মতো এক সাধারণ কবির। সে মানেও আমি খুঁজতে যাইনি। তবুও এটুকু বলতে পারি, কবিতা সৃজনবেলায় কোনোও অজিত পাত্র উনার সামনে এসে প্রকাশিত হয়েছে, এই-ই কি আমার জন্য যথেষ্ঠ পাওয়া নয়? জহিরুলদার অর্ধশতবছর এমন কিছু না। উনি এরই মধ্যে যা কিছু করেছেন আমার বিশ্বাস শতবর্ষে পৌঁছে তখন আমাদের এক সমুদ্র সাহিত্য উপহার দেবেন। মানবিকতার পথে পথে ওই স্বাক্ষর মানুষের জয়গান করবে যুগ থেকে যুগান্তরে। জহিরুলদার সৃজনকর্ম দিয়েই আমি তাঁকে চিনেছি, জেনেছি কিন্তু আমার বিশ্বাস আমাদের বন্ধুত্বের বন্ধন একদিন আমাদের সামনা সামনি দেখা করাবেই।
ওড়িষ্যা, ভারত। নভেম্বর ২০১৭।
Comments
Post a Comment