Skip to main content

ভাষা শহীদ বরকতের জীবন কাহিনী

 বরকত

|| কাজী জহিরুল ইসলাম ||  





এশট্রেতে সিগারেটের বাট গুজে দিয়ে কপাল কুঁচকালেন নিউজ এডিটর।

- শোনো মেয়েতোমার জন্য আমি আর সম্পাদকের গালি খেতে পারব না।

- এখলাস ভাইসাংবাদিকতার একটা এথিকস তো আছে। আমি তো গল্পকার না যে স্টোরি ক্রিয়েট করব। আমার কাজ হার্ড নিউজ লেখা।

তিনি এবার চশমাটা খুলে হাতে নেন। পাঞ্জাবির খুট দিয়ে চশমার কাচ মুছতে মুছতে আরো কঠিন দৃষ্টিতে তাকান রিনার দিকে। 

এই মেয়েমার্শাল ল কাকে বলে বোঝোদেশে যে মার্শাল ল আসছে তা কি টের পাচ্ছো

তাহলে পত্রিকা বন্ধ করে দিন।

- তোমার সঙ্গে আমি তর্কে যাচ্ছি না। কেন যাচ্ছি নাআরেকটু বয়স হলে বুঝবে। অবশ্য সেই সম্ভাবনাও কম। এদেশের মেয়েদের তো আর সংসারের দায়িত্ব নিতে হয় না।

রিনা চেয়ার থেকে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। টেবিলের ওপর দুহাতের করতল রেখে এখলাস আহমদের দিকে ঝুঁকে বলে,

-   হয়। আমার সংসার আমিই চালাই। মা আর ছোটো তিন ভাইবোনের দায়িত্ব আমার ওপর। 

রিনা যখন টেবিলে করতল রেখে ঝুঁকে এসেছিল তখন ওর বুক থেকে শাড়ির আঁচল সরে যাওয়ায় এখলাস আহমেদ চোখ বন্ধ করে ফেলেন। এতে রিনার আরো মেজাজ খারাপ হয়। সে হন হন করে নিউজ এডিটরের রুম থেকে বেরিয়ে যায়। দ্রুত বেরিয়ে যাওয়ার সময় দরোজার পাশে রাখা কাঠের দন্ডে আটকানো বিভিন্ন পত্রিকার ৬/৭ টি মাসিক ফাইল যে হ্যাঙ্গারটিতে সাজিয়ে রাখা ছিল সেটিতে ধাক্কা খায়সবচেয়ে ওপরের ফাইলটির এক মাথা হ্যাঙ্গার থেকে সরে যায়ফাইলটি পড়তে পড়তেও পড়ে নাঅন্য একটি ফাইলের ওপর ভর দিয়ে ঝুলে থাকে। 

বেশ কয়েকটি ডেস্ক পেরিয়ে ফ্লোরের প্রায় শেষ মাথায়দেয়ালের কাছেনিজের ডেস্কের দিকে হাঁটতে হাঁটতে ওকে অনেকগুলো উৎসুক চোখ পেরুতে হয়।

সিনিয়র রিপোর্টার মতিন একটি চেয়ার টেনে ওর সামনে মুখোমুখি বসেন।

- কখন কে অ্যারেস্ট হয় ঠিক নেই। পত্রিকাও বন্ধ হয়ে যেতে পারে। কিছুদিন না হয় কলমটা সামলে রাখো।           

পারব না। 

- শোনোপ্রেসিডেন্ট সাত্তারের ১১ তারিখের ভাষণেই নিশ্চিত হয়ে গেছে, যে কোনো দিন এরশাদ ক্ষমতা নিয়ে নিচ্ছে। অফিশিয়ালি মার্শাল ল শুরু না হলেও আনঅফিশিয়ালি শুরু হয়ে গেছে। সবাইকেই খুব হিসেব করে পা ফেলতে হচ্ছে। 

- বুঝলাম মিলিটারির বিরুদ্ধে কিছু লেখা যাবে না। কিন্তু ছেলেটাকে কোনো কারণ ছাড়া পুলিশ বাড়ি থেকে রাতের অন্ধকারে তুলে নিয়ে গেল। তিন দিন কোনো খোঁজ নেই। তিনদিন পর লাশ পাওয়া গেল গাজিপুরে। সংবাদপত্র যদি মুখে কুলুপ এঁটে রাখে এরকম ঘটনা তো ঘটতেই থাকবে। ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি টাইপের সরকার ক্ষমতায়না থাকার মত ঝুলে আছে সংসদসংবাদপত্রই তো জনগণের ভরসা। আমাদের কলম যদি ধমকে ভোতা হয়ে যায় মানুষের আর থাকে কি?   

শুধু পুলিশ নিয়ে গেছে এইটুকু বাদ দিলেই তো হতো। তদন্ত চলছেকিছু বেরিয়ে আসুক তারপর লেখ। 

হেহ

মুখ ভ্যাংচায় রিনা।

- তদন্ত চলছে। তদন্তের আগেই তদন্ত রিপোর্ট লেখা হয়ে আছেএটা আপনিআমিসবাই জানি। পৃথিবীর অনেক দেশেই সাংবাদ মাধ্যম প্যারালাল গোয়েন্দার কাজ করে। সত্যটা মানুষকে জানানোই তো আমাদের কাজনাকি?

যদি তাতে প্রাণ নাশের আশঙ্কা না থাকে।

- জান বাঁচিয়ে সাংবাদিকতাবাহ। বাদ দেন মতিন ভাইএকদম ভাল্লাগছে না। আমি মনে হয় চাকরিই ছেড়ে দেব। কোনো প্রাইভেট ফার্মের কেরানি বা সেলস রিপ্রেজেন্টেটিভ হয়ে যাবসেটাই বরং ভালো। 

- শোনো রিনামন খারাপ করো না। আমরা কেউই এখন সাংবাদিকতা করছি না। আমে পোকাগমে পচনএইসব লিখে সময় পার করছি। বিরাশি সালটা হয়ত এভাবেই যাবে। অপেক্ষা করভালো দিন আসবে।

- আমার পক্ষে আমে পোকাগমে পচন বা অতিথি পাখিরা ভালো নেই জাতীয় সাংবাদিকতা করা সম্ভব নয়। আমার জার্নালিস্টিক কমিটমেন্ট সরাসরি মানুষের জন্য। কোনো ঘোরপ্যাঁচ নেই। 

- বুঝিশহিদ মুক্তিযোদ্ধার সন্তানঅন্যরকম একটা চেতনা কাজ করে। তোমাকে একটা আইডিয়া দেই। সামনে একুশে ফেব্রুয়ারিতুমি বরকতের মায়ের একটা ইন্টারভিউ করে আনো। যদি সম্ভব হয় বরকতের পুরো লাইফটা তুলে আনোপাবলিক খাবে।

মুহূর্তেই রিনার মুখ উজ্জ্বল হয়। যেন এরকম একটা কিছুই সে মতিনের মুখ থেকে শুনতে চাচ্ছিল।  

গ্রেট আইডিয়াথ্যাংকস। কিন্তু এটা কি ছাপবে?

ছাপবে। যদি বড় হয় ২/৩ কিস্তিতে যাবে। এখানে রাজনীতি আছেতবে এই রাজনীতি এরশাদকে ছোঁবে না। আর ভদ্রলোক নিজেও তো কবিভাষা আন্দোলনের প্রতি তাঁর দূর্বলতা থাকার কথা।

এখলাস ভাইকে...

- লাগবে না। আমি কথা বলে নেব। ইনফ্যাক্ট এই কাজটা আমাকে গত বছর করতে বলা হয়েছিলআমি পারিনি। সো হাউজের সম্মতি নেওয়াই আছে। তুমি কাজে লেগে পড়ো। আজ তেরো তারিখহাতে সময় বেশি নেই।

১৫ ফেব্রুয়ারি১৯৮২। বাস থেকে নেমে জয়দেবপুর চৌরাস্তার মন্যুমেন্টের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে রিনা। জাগ্রত চৌরঙ্গী। মুক্তিযুদ্ধের ওপর নির্মিত প্রথম ভাস্কর্য। ডান হাতে গ্রেনেডবাঁ হাতে রাইফেল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। ৪২ ফুট ২ ইঞ্চি উঁচু এই ভাস্কর্যটি ১৯৭৩ সালে নির্মাণ করেন ভাস্কর আব্দুর রাজ্জাক। ১৬ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ১০০ জন এবং ১১ নম্বর সেক্টরের ১০৭ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম উৎকীর্ণ রয়েছে এই ভাস্কর্যে। রিনার ডান হাত কপালেকরতল শূন্যেবীর শহীদদের প্রতি একটি স্যালুট ঠুকে নিজের মনোবলকে আরো সুদৃঢ় করে সে হাঁটতে শুরু করে ধুলোর রাস্তায়। 

রিক্সাঅলা বয়সে তরুণ। বার বার পেছনে তাকাচ্ছে আর মিটমিট করে হাসছে। প্রতিবার রিনার সাথে চোখাচোখি হতেই সে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং রিক্সার গতি বাড়িয়ে দেয়তখন ফেব্রুয়ারির এলোমেলো হাওয়ায় রিনার লম্বা চুল উড়তে থাকে।

তরুণ রিক্সাচালকের কৌতূহলকে রিনা খুব স্বাভাবিকভাবেই নেয়। জিন্সশার্ট আর এত্তোগুলো পকেটঅলা জ্যাকেট পরা মেয়ে এই অঞ্চলে কজনই বা আসে। সিটি এসাইনমেন্টগুলোতে ফটো সাংবাদিক পাওয়া যায়। দূরেরসারাদিনের বা কয়েকদিনেরএসাইনমেন্ট হলে নিজেকেই ছবি তোলার কাজটি করতে হয়। রিনার গলায় ঝুলছে ইয়াসিকা থার্টি-ফাইভ ক্যামেরা। 

-   আফায় সম্বাদিগআমি বুঝছি।

রিক্সাঅলা স্বগতোক্তি করে। রিনা বুঝতে পারে ছেলেটি কথা বলতে চায় কিন্তু সাহস পাচ্ছে না। ওর সঙ্গে আলাপ জমানোই বুদ্ধিমানের কাজ হবেকৌতূহল কমবেনইলে যেভাবে বারবার পেছনে তাকাচ্ছেযে কোনো সময় রিক্সা গজারি-বনে ঢুকিয়ে দেবে। দুপাশে গজারির বনমাঝখানে মসৃণ সরু মেঠোপথ। বাতাসে গজারি-পাতার করতালি। দূরেবনের ভেতরেকোথাও কোকিল ডাকছে। অসংখ্য টুনটুনি পাখি তিড়িং বিড়িং করে এডাল-ওডাল লাফাচ্ছে আর তীব্র স্বরে চিক চিক চিক চিক করে ডাকছে। ফরফর করে পাখনা কাঁপিয়ে একটি দুটি ফিঙে উড়ছেরকেটের মতো সোজা ওপরে উঠে আবার ধাঁ করে নিচে নামছেদূরে কিছুটা সমতলে কয়েকটি গরু চড়ছেফিঙে দুটি উড়ে গিয়ে গরুগুলোর পিঠে বা শিঙে বসছে। রিক্সায় বসে এই দৃশ্য উপভোগ করছে রিনা। কতদিন এমন সুন্দর দৃশ্য দেখা হয় না। 

টিনের বাড়িতে কাঠের গেইটগেইটের ওপর মাধবিলতার ডালসবুজ পাতার উঁকি প্রাণের জানান দিচ্ছে। গেইট খোলে বাইশ বছরের এক যুবক। ওর পরনে হাতে বোনা নীল সোয়েটারসোয়েটারের ভেতর থেকে সাদা শার্টের হাতা বেরিয়ে এসে কব্জি ঢেকে রেখেছে। লম্বাটে মুখটিকালো নাককিছুটা ম্রিয়মান চোখফর্শা এই যুবকের নাম আলাউদ্দিন। ঠোঁটের ওপর হালকা গোঁফচিবুকে খোঁচা খোঁচাগুনে ফেলা যায়এমন কয়েকটা দাড়ি। যুবকের হাসি হাসি মুখ দেখে রিনার খুব ভালো লাগে।  কোথায় যেন দেখেছে এই মুখ। 

- আসুনদাদু আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন। পথে অসুবিধে হয় নি তো

একদমই না। কেমন আছেন তিনি?

ভেতরে আসুননিজেই দেখবেন।

এখন দুপুর সাড়ে বারোটাঘরে তেমন আলো নেই। একটিমাত্র কাঠের জানালা দক্ষিণ দিকেযার এক পাটি খোলাওখান থেকে যাত্রামঞ্চের ফোকাসের মত একফালি আলো এসে পড়েছে মেঝেতে। হাসিনা বিবি খাটের ওপর অর্ধশায়িত। নীল পাড়ের একটি সাদা শাড়ি তাঁর পরণে। ফর্শা হলেও গায়ের রঙটা মরালম্বাটে মুখে চোয়ালের হাড় উঁচু হয়ে আছে। সাদা চুল ছড়িয়ে আছে বালিশের ওপর। নিস্প্রভ চোখ দুটিতে শূন্য দৃষ্টি।  

-   কি জানতে চাইচো বল।

মুর্শিদাবাদের কুলিন ভাষা হাসিনা বিবির কণ্ঠে জড়িয়ে যাচ্ছে। কথাগুলো বোঝার জন্য রিনা ওর চেয়ারটাকে টেনে খাটের আরো কাছে চলে আসে। 

-   আমি আপনাকে মা বলে ডাকতে পারি?

হাসিনা বিবি মাথাটা কাঁত করে রিনার মুখটা দেখেন।

-   কাচে এসো।

রিনা এগিয়ে গেলে হাসিনা বিবি ওর মুখেকপালে হাত বুলিয়ে আদর করেন। খসখসে বুড়ো হাতের স্পর্শ এতো মায়াময় কেন! আশি বছরের পুরনো আঙুলেরা ওর কপালে বিলি কাটে।  

-   মাগোবরকত চলে যাবার পর আমি তো বাংলা ভাষার মা হয়ে গেচি। এই ভাষাই আমার সন্তানএই ভাষায় যে কথা বলে সে-ই আমার সন্তান। তুমি আমায় মা বলেই ডেকোএই বৃদ্ধার এটাই তো বড় প্রাপ্তি।

রিনা হাসিনা বিবির বাঁ হাতটা নিজের মুঠোতে নিয়ে আদর মাখা কন্ঠে বলেকেমন আছেন মা?

ভালো নেই এ কথা বলবো না। তবে হাতে সময় বেশি নেই। আর কত বলকুড়ি বছরের বৈধব্য! ওই যে দেখচ ছেলেটাআলাউদ্দিনআমার নাতিও আছে বলেই এখনো বেঁচে রয়েচি। 

- মাআমি আজ সারাদিন আপনার কাছে থাকব। সব শুনব। বরকত ভাইয়ের জন্মশৈশবকৈশোর এবং...

আর বলতে পারে না রিনা। ওর কন্ঠ বাস্পরুদ্ধ হয়ে আসে। কে এই নারীকেন তাঁকে দেখার পর থেকে রিনার সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতেই ওর মনে হচ্ছিলএই বাড়িএই ঘরএই মাধবীলতার ডালঘুলঘুলির আলোর ফোয়ারা, সব ওর চেনাখুব আপন। এই বাড়ির উঠোনে যে সবুজ শ্যাওলা ওখানে লেগে আছে ওর শৈশবের পদছাপ। এও কি সম্ভব!

 

বাবলা গ্রামের মৌলভি বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে আজান দিচ্ছেন ভুলু মিয়া। এখন তো নামাজের অক্ত না। ভুলু মিয়া আজান দিচ্ছে কেন রেপুত্রসন্তান হল নাকি?

শুধু মুসলমানেরাই না পড়শি হিন্দু নারীরাও ছুটে আসে। শাঁখ বাজায়উলুধ্বনি দেয়। ১৯২৭ সালের ১৬ জুনবৃহস্পতিবার ভরদুপুরেবাবলা গ্রামে যে শিশুর জন্ম হয় তাঁর নাম আবুল বরকত।

- সবাই ওকে খুব ভালবাসত। খুব শান্ত আর লাজুক ছিল। স্কুলে সব সময় প্রথম হত। কেউ ওকে পেছনে ফেলতে পারত না। 

গ্রামের স্কুলেই পড়েছিলনা?

হ্যাঁগ্রামেই। তালিবপুর হাইস্কুল থেকে ১৯৪৫ সালে মেট্রিকুলেশন করল। বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে আই এ৪৭ এ। দুটোতেই খুব ভালো রেজাল্ট করে। যেদিন ফল বেরোয় বাড়ি ভর্তি লোক। গ্রামের ছেলেদের কাছে আমার বরকত ছিল আদর্শশিক্ষার অনুপ্রেরণা।

কি খেতে পছন্দ করতেন বরকত ভাই?

মিষ্টি। খুব মিষ্টি খেতে চাইত। আমার অন্য ছেলে-মেয়ে অতো মিষ্টি পছন্দ কত্ত না। ওর বাপ রোজই ওর জন্য মিষ্টি কিনে আনত।

অন্য কিছুএটা-ওটা চাইতজেদ করত?

একদম না। বলচি কীও ছিল মাটির মানুষ। কোনো জেদ নেইরাগ নেইঅভিমান নেই। স্কুলের ছেলেরা পিটোলেও বাড়ি এসে বলত না।   

তাঁর ছেলেবেলার মজার কোনো গল্প নেই?

আছে। শুনবেশোনো বলচি। এর আগে অনেক সাংবাদিক এয়েচে কেউ ওর ছেলেবেলার গল্প শুনতে চায়নি। সবাই শুধু বাহান্নের কথা শুনতে চায়। 

 

১০ জুন ১৯৪৫। কৃষ্ণনাথ কলেজের পেছনে যে শতবছরের পুরনো ঝুড়িনামা বৃক্ষতার বেদিতেপাথরের ওপর বসে আছে এক ফুটফুটে তরুণী। ওর পরণে কমলা রঙের শাড়িলাল ব্লাউজকপালে বড়  টিপঠোঁটে তাম্বুলের রসসারা অঙ্গভরা সোনার গহনা। কে এই নারী

গোধূলি লগ্ন। সব ছাত্র-ছাত্রী চলে গেছেহোস্টেলে বা বাড়িতে। রামনাথ পাঠাগারে তখনো একজন অধ্যায়ন করছেআবুল বরকত। বরকত লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে আসে শতবর্ষী বৃক্ষের বেদিতে। কে ওখানেমহারানি স্বর্ণময়ী দেবীমহারাজা কৃষ্ণনাথের স্ত্রীকাচভাঙা হাসিতে খান খান হয়ে যায় সন্ধ্যার মৌনতা। স্বর্ণময়ী উঠে আসেন। বরকতের কাঁধে হাত রাখেন। তারপর ওকে হাত ধরে নিয়ে যান মন্দিরের দিকে। তখন কে একজন চিৎকার করে ডাকে, ‘বরকতবাড়ি যাও স্বর্ণময়ী দেবী তখন কলেজের ভেতরে অদৃশ্য হয়ে যান।

এরপর কি হল?

মাঝে মাঝেই ও স্বর্ণময়ী দেবীকে দেখত কলেজের বারান্দায় হাঁটাহাঁটি কচ্ছেন। মজার ব্যাপার কি জানোস্বর্ণময়ী দেবী কৃষ্ণনাথ কলেজ প্রতিষ্ঠা করেচেনতাঁকে না হয় তাঁর নিজের কলেজে দেখা গেল কিন্তু ও আমাদের বাড়ি অব্দি চলে আসে। 

বাবলা গ্রামে?

সেটাই তো বলচি। 

আপনি বিশ্বাস করতেন?

ধুরএসব কি বিশ্বাস করা যায়। ওর মনের কল্পণা। তবে এই ঘটনা আমাদের একটা সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে।

কি সিদ্ধান্ত?

আই এ পাশ করেছেএখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে। ঢাকায় না কোলকাতায় এ নিয়ে চিন্তেয় পড়ে ওর বাপ।

ঢাকায় কেন পাঠালেনস্বর্ণময়ীর ভূতের ভয়ে?

হতে পারে। তবে আসল কারণ তো ভিন্ন।

কি সেটা?

রায়ট লেগে গেল। যদিও বাবলা গ্রামে হিন্দু-মুসলমানের বেশ ভাব ছিল তার পরেও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েমুসলমানদের ওরা কচু কাটা করবে। দেশ ভাগ হয়ে যাওয়ার পরে কে ভারতে থাকবে আর কে পাকিস্তানে যাবে এই হিসেব শুরু হল। আমার ভাই আবদুল মালেক ঢাকার ওয়াপদায় চাকুরি কত্তেন। ঠিক হলবরকত ঢাকায় যাবেঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে।

আপনি কি মনে করেন সেটা ভুল সিদ্ধান্ত ছিল?

একদম না। আমার ছেলে শহিদ হয়েচেবাংলা ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েচে। বরকতসালামজব্বারসফিউররফিকরা প্রাণ না দিলে এতো নিচ্চিন্তে এই প্রাণের বাংলা ভাষায় তুমি আমি আজ কথা বলতে পাত্তেম?

এ সময়ে আলাউদ্দিন দরোজা ঠেলে ঘরে ঢোকে। 

-   দাদু জোহরের ওয়াক্ত হয়েছে। অজুর পানি দিয়েছি। 

আলাউদ্দিন এবং রিনা দুজন মিলে হাজী হাসিনা বিবিকে বিছানা থেকে তোলেধরে ধরে কলতলায় নিয়ে যায়। তিনি অনেক্ষণ সময় নিয়ে অজু করেন। পা ধোয়ার জন্য আলাউদ্দিন দাদীর পায়ে পানি ঢেলে দেয়। আবার তাঁকে ধরে ধরে কলতলা থেকে এনে একটি চেয়ারে বসানো হয়। তিনি চেয়ারে বসে দীর্ঘ সময় নিয়ে নামাজ আদায় করেন। এ সময়ে আলাউদ্দিন এবং রিনা বাইরেউঠোনে দাঁড়িয়ে কথা বলে। রিনা বরকতের কথা জিজ্ঞেস করে। একমাত্র চাচার কথা বলতে গিয়ে আলাউদ্দিন পরিবারের কাছে শোনা কথাগুলোই বলতে থাকে। 

-   আমার তো তেমন কিছু জানার কথা না। বড় চাচা মারা যাবার ৮ বছর পরে আমার জন্ম। তবে বাবার কাছেদাদুর কাছে শুনে শুনে আমার মনে হয় চাচাকে আমি দেখেছি। তাঁর মুখ দেখতে পাইতাঁর হাঁটা চলা দেখতে পাই। এমন কি ৫২ সালের একুশ তারিখে মেডিকেল কলেজ ছাত্রাবাসের ১২ নম্বর শেডের সামনে তাঁর গুলি খাওয়ার দৃশ্যটিও আমি স্পষ্ট দেখতে পাই।  

১৯৪৮ সালের ২০ মার্চ। ঢাকা শহরে সাজ সাজ রব। গতকাল পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল ঢাকায় এসে পৌঁছেছেন। আগামীকাল তিনি রেসকোর্স ময়দানে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন। ২৩ ফেব্রুয়ারি করাচীতে আইন পরিষদের সভায় ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বাংলা ভাষার দাবী প্রত্যাখ্যাত হওয়ায় বাঙালিরা ক্ষেপে আছে। সবাই আশা করছে জিন্নাহ বাংলা ভাষার দাবী মেনে নেবেন।

ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশনের ওপর একটি বিশাল নিম গাছ। নিমগাছের ডালে দুটি দাঁড়কাক। ওরা পালাক্রমে খা খা করে ডাকছে। হঠাৎ একটি বাওকুড়ানি ওঠেবাওকুড়ানির ঘুর্ণাবর্ত রাস্তা থেকে একগাদা ছেঁড়া কাগজ নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে নিম গাছের দিকে এগুতে থাকে।  তখনই ট্রেন এসে থামে। ট্রেন থেকে নেমে আসে ছিপছিপে এক যুবক। তাকে দেখে হাসিতে উদ্ভাসিত মামা আবদুল মালেক। ভাগ্নেকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেন,

 

খুব ভালো সময়ে এসেছিস ভাগ্নে। কাল তোকে নিয়ে রেসকোর্স ময়দানে যাব। মা কেমন আছেন?

 

ভালোতোমার শরীর কেমনমামী কেমন আছেন?

ভালো ভালো সবাই ভালো আছে। একটাই স্যুটকেস?

হ্যাঁএকটাই। মা তোমার জন্য ডালের বড়ি পাঠিয়েছেন।

বলিস কিকতদিন তোর মায়ের হাতের ডালের বড়ি খাই না।

বরকতের সাথে দেখা করতে সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন ছাত্র আসে পল্টনের বিষ্ণুপ্রিয়া ভবনে। দুজনই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র। মানিক আর পঙ্কজ। ওরা দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। মানিক আবদুল মালেকের সহকর্মী খালেকুজ্জামানের ছোটো ভাইপঙ্কজ মানিকের বন্ধু। ওরা জেনেছে বরকত মেধাবী ছাত্রতাই ওদের ডিপার্টমেন্টেই যাতে ভর্তি হয় এই বিষয়ে রাজী করাতে এসেছে।

ঠিক করছো নিকি পড়বামানিক প্রশ্ন করে।

- নাহ। 

- তাইলে আর চিন্তা কইরা কাম নাইরাষ্ট্রবিজ্ঞানই পড়বা। এইটা হৈল আসল সাবজেক্ট। কি কস পঙ্কজ?

পঙ্কজ কিছু বলে না। বরকতের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। 

-   কাইল ভার্সিটিতে আইসো নাগ্যাঞ্জাম হৈতে পারে। জিন্নাহ কি কয় তাঁর ওপর সব ডিপেন্ড করতাছে। দুইদিন বিশ্রাম নেও। ২৪ তারিখসোমবারে আসোআমরা সব ঠিকঠাক কৈরা রাখুম।

ওদের আলোচনার মধ্যে মালেক যোগ দেন। 

মানিকপঙ্কজ তোমরা যাচ্ছ নাকি কাল রেসকোর্সে।

- যাচ্ছি মানেগভর্নর জেনারেলের ভাষণ সামনা সামনি শোনার এই সুযোগ ছাড়া কি ঠিক হবে। পঙ্কজের কণ্ঠে ব্যাপক আগ্রহ।

তুমিমানিক?

আমিও যামু। তবে মালেক ভাই আপনেরে একটা কথা কইজিন্নাহ বাংলা ভাষার পক্ষে একটা শব্দও উচ্চারণ করবো না। 

দেখি না কি বলে।

- সে যদি উল্টাপাল্টা কিছু কয় কার্জন হলে তারে আমরা অপমান করুমএইটা শিওর। 


রেসকোর্স ময়দান লোকে লোকারণ্য। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই প্রথম পাকিস্তান রাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের কাছে এসেছেন। মানুষের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনা। তরুণ-যুব সমাজ আশা করছে বাংলা ভাষার দাবী মেনে নিয়ে আজই তিনি পাকিস্তানের মুসলমান জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিভাজনের ইতি টানবেন। পূর্ব বাংলায় এসে বরকতের বেশ ভালো লাগছে। যদিও মাতৃভূমি মুর্শিদাবাদের জন্যমায়ের জন্যবাবার জন্যতিন বোনের জন্যছোটো ভাইটির জন্য মন কাঁদছে। 

আবদুল মালেক বরকতের হাত নিজের হাতের মুঠোর মধ্যে শক্ত করে ধরেন যখন জিন্নাহ উর্দুতে ঘোষণা করেন,  ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষাঅন্য কোনো ভাষা নয়

মানিকপঙ্কজ এবং বরকত দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ আলাপ আলোচনা করে। এরপর পঙ্কজ এবং মানিক চলে যায় বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়মালেক এবং বরকত ফিরে যায় বিষ্ণুপ্রিয়া ভবনে।

 

মেঝেতে পাটি বিছানো হয়েছে। খাবার সাজাচ্ছেন আলাউদ্দিনের আম্মা। হাসিনা বিবি নামাজের চেয়ারে বসেই খাবেনহাঁটুর ব্যাথার জন্য মাটিতে বসতে পারেন না। বঁথুয়া শাককাচকি মাছজলপাইয়ের ডাল আর মুরগির ঝোল। গরম গরম ধোঁয়া ওঠা বিরুই চালের ভাত সিরামিকের প্লেটে তুলে দিচ্ছেন আলাউদ্দিনের আম্মা। খেতে খেতে টুকটাক আলাপও চলছে। 

শহীদ মিনার উদ্বোধনের জন্য আপনার সাথে কে যোগাযোগ করেছিল?

বলব। আগে খেয়ে নাও। খাওয়া হল এবাদত। খাওয়ার সময় কথা বলতে নেই। 

খাওয়া শেষ করে উঠোনে নেমে আসে রিনা। ডালিম গাছে একটি টুনটুনি পাখি। আকাশে মেঘ না থাকলেও এই বাড়ির উঠোন ছায়াময়। মাথার ওপর বিশাল একটি আম গাছ। দেয়ালের ভেতরে গেইটের দুপাশে ফুলের বাগান। হাস্নাহেনার ঝাড় দেখে রিনার খুব ভালো লাগে। হাস্নাহেনা রাতের ফুলরাতেই ফোটে এবং রাতেই গন্ধ ছড়ায়। জ্যোৎস্নারাতে এই উঠোনে পাটি বিছিয়ে বসতে পারলে হাস্নাহেনার মিষ্টি ঘ্রাণ আর চাঁদের আলোস্বর্গীয় পরিবেশ উপভোগ করা যেত।

 

২০ এপ্রিল ১৯৪৮। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ। চেয়ারম্যানের কক্ষ। বিশাল সেক্রেটারিয়েট টেবিলের পেছনে বসে আছেন অধ্যাপক দেবেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়। দুপাশের দেয়ালে বেশ কয়েকটি কাচের আলমারিরাষ্ট্রবিজ্ঞানের বইপত্রে ঠাসা। মাথার ওপর সিলিং ফ্যান হালকা গতিতে কোমর দুলিয়ে দুলিয়ে ঘুরছে। 

তুমিই বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজের বরকত?

- জ্বি স্যার।

- তোমার বন্ধুরা বলেছে তুমি নাকি খুব মেধাবী ছাত্র। টেস্টিমোনিয়াল এনেছোদেখি কাগজপত্র কি এনেছোদাও।

বরকতের হাত থেকে ফাইলটা নিয়ে রেজাল্টশিটগুলো দেখে খুশি হন অধ্যাপক ব্যানার্জি। মন দিয়ে বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজের প্রিন্সিপাল নীরেন্দ্রনাথ রায়ের রেকোমেন্ডেশন লেটারটি পড়েন। এরপর চশমার কাচের ওপর দিয়ে দেখেন বরকতের বিশেষত্বহীন লম্বাটে মুখটি। দেহের তুলনায় কান দুটো বেশ বড় এবং উৎকর্ণ। চোখে প্রত্যয় আছেজিজ্ঞাসা আছে। 

তোমাকে আমি শুধু একটি প্রশ্ন করবোরাষ্ট্রবিজ্ঞান কেন পড়তে চাও?

আধুনিক রাষ্ট্রকাঠামো কেমন হলে মানুষের জন্য কল্যাণকর হবে তা বোঝার জন্য। 

- হুমআশা করি এই বিভাগ তোমাকে সেই ধারণা দিতে পারবে। এটি নতুন ডিপার্টমেন্টমাত্র দশ বছর হয়েছে ডিপার্টমেন্টের বয়স। পর্যাপ্ত রিসোর্স তৈরীর জন্য দশ বছর কিছুই না। তোমার মত মেধাবী ছাত্র পেলে আমরা খুশি হই। I hope your inclusion will enrich the Department. 

১৯৫১ সালে আাবুল বরকত রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে দ্বিতীয় শ্রেণীতে চতুর্থ স্থান অধিকার করে অনার্স পাশ করেন এবং এম এ ক্লাসে ভর্তি হন।  বাংলা ভাষার দাবী বার বার পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী কর্তৃক উপেক্ষিত হওয়ায় ক্রমশ আন্দোলন জোরালো হয়ে উঠছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ক্রমশ সোচ্চার হয়ে উঠছে ছাত্রদের চোখে মুখে আবেগউত্তেজনা; তাঁদের প্রত্যয় দেখে মনে হয়রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবী কেউ আর দাবিয়ে রাখতে পারবে না। বরকত কোনো কমিটিতে না থাকলেও বাংলা ভাষার দাবী আদায়ের বিষয়ে সচেতন এবং সক্রিয়। 

 

৭ অক্টোবর ১৯৫১। বিকেল তিনটা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। 

এই প্রথম বরকতকে কেউ দেখছে একটি মেয়ের সাথে ঘনিষ্ঠ এবং অন্তরঙ্গভাবে কথা বলতে। ডিপার্টমেন্টের লম্বা করিডোর প্রায় ফাঁকা। কোমর অব্দি উঁচু দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটিপাশেইওর দিকে মুখ করে ডান হাত দেয়ালে রেখে বাঁ হাত নেড়ে নেড়ে কথা বলছে বরকত। মেয়েটি তখন খিলখিল করে হাসছে। বড় বড় কাজল টানা কালো দুটি চোখছোটো খাটো ফর্শা মুখনাক এবং চিবুক বেশ ধারালো। মেয়েটির পরনে নীল শাড়িথ্রি কোয়ার্টার হাতা সাদা ব্লাউজ। ব্লাউজের হাতা যেখানে শেষ হয়েছে সেখানে নীল রঙের লেইস লাগানোযেন দুটি নীল প্রজাপতি বসে আছে ওর দুহাতে। গলায় চিকন একটি স্বর্ণের চেইনবিনুনি করা লম্বা চুল নেমে এসেছে নিতম্বের ওপর। মেয়েটি যখন মাথা নেড়ে নেড়ে কথা বলে বা হাসে তখন বিনুনির মাথায় বাঁধা সাদা রিবনটি একগুচ্ছ শিউলি ফুলের মতো দোল খায়। ওর নাম রিনা হায়দাররাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী।

- অনেক কথা হল। দুদিনের পরিচয়ে এর চেয়ে বেশি কথা হওয়া ঠিক না। পরিমিতি বোধ একজন মানুষের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণকি বল?

ভয় পাচ্ছেনওই যে আপনার বন্ধুরাবারান্দার শেষ মাথায়মাঝে মাঝে আঁড়চোখে দেখছে। নিশ্চয় ভাবছেনজুনিয়র একটি মেয়ের সাথে কথা বলছেনতাও সুন্দরীএ নিয়ে ওরা খেপাবে?

সেই সুযোগ ওদের না দেওয়াই ভালোঠিক না?

নাঠিক না। অন্যের কথা বিবেচনা করে মানুষ কেন নিজের জীবন নিয়ন্ত্রণ করবে?

আমরা সবাই তো অন্যের জন্যইকামিনী রায় বলেছেন না, ‘প্রত্যেকে মোরা পরের তরে  

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে তখন একটি মিছিল বের হয়। রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই স্লোগান দিতে দিতে ত্রিশ/বত্রিশজন ছেলে মেডিকেল কলেজের দিকে এগুতে থাকে। মিছিলটির নেতৃত্ব দেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ছাত্র আবদুল মতিন।

আজ বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করছে না বরকতের। অন্যরকম একটা ভালোলাগায় মনটা আচ্ছন্ন হয়ে আছে। আমি কি রিনার প্রেমে পড়েছিএর বেশি আর ভাবতে পারে না বরকত। যে ভাবনাটি ওর সমস্ত চিন্তাজগৎ মুহূর্তেই দখল করে নেয় তা হচ্ছে দারিদ্র। দুটি মাত্র জামাতাও একটির এমন বেহাল অবস্থা যে ভদ্রসমাজে পরে বের হওয়া যায় না। এই ভাগ্য নিয়ে প্রেমতাও আবার রিনার মতো একজন ইন্ড্রাস্ট্রিয়ালিস্টের মেয়ের সাথে?  

শুধু মন খারাপ নামেজাজও খারাপ। মেজাজ খারাপ নিয়ে মঙ্গলবার রাতে বাবাকে চিঠি লিখতে বসে বরকত। 

 

ঢাকা

৯.১০.১৯৫১  

প্রীতিভাজনেষু

বাবাজান আমার সালাম নিবেন। আশা করি আপনারা সকলে খোদার ফজলে ভালো আছেন। আমার শরীর বিশেষ ভাল নাই। কয়েকদিন পূর্ব্বে আপনার একখানি পত্র পেয়েছি। আমি আপনাকে টাকার জন্য লিখিয়াছিলাম কিন্তু আজ পর্যন্ত কোন টাকা পাইলাম না।  আপনি হয়ত ভাবেন টাকা না পাঠাইলে এমনি চলিয়া যাইবে। কিন্তু বিদেশে হাতে টাকা পয়সা না থাকলে যে কি অবস্থা হয় তাহা বোধ হয় ভেবে দেখেননি। আগেকার যা শার্ট ছিল সব ছিঁড়ে গিয়েছে এখন এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে বাহিরে বেরুন দায়। হাতে একটি পয়সাও নাই। একজনের ঘাড়ে আপনারা আমাকে চাপিয়ে দিয়ে নিশ্চিত হয়ে চোখ বুঝে আছেন। কিন্তু প্রত্যেক জিনিসের একটা সীমা আছে। আমি যতদিন পড়ব ততদিন কি তারা আমার পড়ার খরচের ঠিকা নিয়েছেআমার পড়া শেষ হোক বা না হোক আমি হয়ত একটা কাজে লেগে যাব অথবা বাড়ি ফিরে আসব। অন্যের ঘাড়ের বোঝা হয়ে আর থাকতে পারব না। 

আম্মাজানকে সালাম দিবেন।

ইতি-

আপনার স্নেহধন্য

বরকত   

[ফুটনোটঃ শেষের দুটি বাক্য ছাড়া পুরো চিঠিটি ভাষা শহীদ বরকতের লেখা] 

 

‘তখন আর আমার চোখে অশ্রু নেই। ছেলে হারানোর শোক এক নতুন শক্তি হয়ে উঠল। আমি নিজেকে বাংলা ভাষার মা ভাবতে শুরু করি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আমার সাথে যোগাযোগ করে। আমার স্বামী মৌলভী শামসুজ্জোহা তখন খুব অসুস্থ। কিছুদিন পরেই তিনি মারা যান। তবু আমি সিদ্ধান্ত নিই যাবোএই প্রাণের মিনার উদ্বোধন করতে আমি অবশ্যই যাবো।  

১৯৬৩ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিজনতার ঢল নামে শহিদ মিনারে। ফিতে কেটে আমি এর উদ্বোধন করি। শিল্পীরা আবদুল গাফফার চৌধুরীর লেখাআলতাফ মাহমুদের সুর করাআমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/ আমি কি ভুলিতে পারি - গানটি গাইতে শুরু করে। শহিদ মিনারের দিকে তাকিয়ে দেখিওইতো বরকতআমার জাদু, আমার সোনা।

হাজী হাসিনা বিবির চোখ ঝাপসা হয়ে আসেকন্ঠ বাস্পরুদ্ধ হয়। রিনা ওর ব্যাগ থেকে রুমাল বের করে হাসিনা বিবির চোখের পানি মুছে দেয়। 

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। বৃহস্পতিবার। সকাল এগারটা। ছাত্ররা ধর্মঘট ডেকেছে। সরকার ১৪৪ ধারা জারি করেছে। কোনো সভামিটিংমিছিল করতে দেবে না। বরকত ছটফট করছে। আবদুল মালেক ভাগ্নেকে বাইরে যেতে দিচ্ছেন না। নিজেও অফিসে যাননি। 

- বাংলা ভাষায় কথা বলার জন্য ঢাকায় এলাম। কোলকাতার মুসলমানেরা তো নিজেদের এগজিস্টেন্সের জন্য এখন উর্দু বলছে। এখানে এসেও যদি উর্দু বলতে হয় তাহলে কোলকাতায় ফিরে যাওয়াই ভালো। তুমি যাই বল মামাবাংলাকে রক্ষা করতেই হবে। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবী ওদের মানতেই হবে। 

আমি তোর সাথে দ্বিমত করেছিদাবী আদায় না হলে যে বৃহত্তর আন্দোলন হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই।

- আমি যদি বের না হইআমরা ছাত্ররা যদি বের না হইবৃহত্তর আন্দোলন কিভাবে হবে?

দেখ বরকততোর বাবা-মা তোকে আমার কাছে পাঠিয়েছে পড়াশোনা করার জন্যতোর জানের হেফাজত করা আমার দায়িত্ব। ১৪৪ ধারার মধ্যে উল্টা-পাল্টা কিছু হলে ওরা গুলি ছুঁড়তেও দ্বিধা করবে না।

- আমাকে ভয় দেখিও না মামা। অ্যাট লিস্ট ভার্সিটিতে যাই। ঠিক আছে ছাত্ররা যদি ১৪৪ ধারা ভেঙে মিছিল বের করেআমি মিছিলে যাব না। হল তো?

ভাগ্নের যুক্তিগ্রাহ্য আব্দারে না করা সম্ভব নয়। আবদুল মালেক দুশ্চিন্তায় পড়ে যান। তা ছাড়া বাংলা ভাষার দাবী আদায়ের সংগ্রামে ওদের মত ছাত্ররা যোগ না দিলে দাবী আদায় হবে কীভাবে। 

দরোজা খুলে বেরিয়ে যায় বরকত। ওর পরনে নীল হাফ হাতা শার্টখাকি প্যান্টপায়ে কাবুলি স্যান্ডেল। ছেলেটার দিকে তাকিয়ে কষ্ট পায় মালেক এখনো হালকা ঠান্ডা আছেঅথচ হাফ হাতা শার্ট পরেই বেরুল। একটা ভালো ফুল হাতা জামাও নেই। হঠাৎ মালেকের মনে হয় মুর্শিদাবাদ থেকে চিঠি এসেছেবরকতের বাবার চিঠি। মালেক পেছন পেছন ডাকতে থাকেন। বরকত শোনকাল তোর বাবার চিঠি এসেছেহট্টগোলে ভুলে গেছিলাম। এই নে চিঠিটা পড়ে তারপর যা। বরকত ততক্ষণে বিষ্ণুপ্রিয়া ভবনের মূল তোরণ অব্দি পৌঁছে গেছে। 

রেখে দাওফিরে এসে পড়বো।

 

বরকত আর ফিরে আসেনি।

 

বিকেল তিনটায় উপস্থিত ছাত্র জমায়েতে শামিল হয় বরকত। এরই মধ্যে পুলিশের সাথে ছাত্রদের বেশ কয়েক দফা ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া হয়েছে। ছাত্ররা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেয়। আকাশে বিকেলের পড়ন্ত রোদ। ১০ জন ১০ জন করে মিছিল বের হচ্ছে। ছাত্ররা স্লোগান দিচ্ছে, ‘রাষ্ট্রভাষা রাষ্ট্রভাষা/ বাংলা চাইবাংলা চাই পরপর তিনটি গ্রুপকে পুলিশ গ্রেফতার করে ট্রাকে তুলে নিয়ে যায়। এরপর আর দশজন নয়৫/৬ জনের ছোটো ছোটো গুচ্ছমিছিল বের হতে শুরু করে। পুলিশ মিছিলগুলো ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করছে। ছাত্ররা পুলিশের দিকে ইট ছুঁড়ে মারছে। গণিত বিভাগের ছাত্র জসীমউদ্দিন একটি আস্ত ইট তুলে ছুঁড়ে মারে পুলিশের দিকে। এক পর্যায়ে পুলিশ এলোপাথাড়ি গুলি ছুঁড়তে থাকে। মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের ১২ নম্বর শেডের বারান্দায় তখন বরকত। একটি গুলি এসে ওর তলপেটে লাগে। গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে। বরকত পড়ে যায়। জসীমউদ্দিন ওকে কোলে তুলে নেয়অন্য ছাত্ররা এগিয়ে আসে। ধরাধরি করে আহত বরকতকে মেডিকেল কলেজের ইমার্জেন্সিতে নিয়ে যায়। যেতে যেতে বরকত বলতে থাকে, ‘রিনাখুব কষ্ট হচ্ছে। আমি মনে হয় আর বাঁচবো না। বিষ্ণুপ্রিয়া ভবনে খবরটা পৌঁছে দিও। বাবার চিঠিটা আর পড়া হল না। বাবাতোমার ওপর রাগ করেছিলাম। আমাকে ক্ষমা করে দিও

২১ এপ্রিল ১৯৮২। নলজানিগাজীপুর। শহিদ বরকতের মা হাজী হাসিনা বিবিকে দাফন করা হচ্ছে। একটু দূরেকৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে দাঁড়িয়ে নীরবে অশ্রু বিসর্জন করছে এক তরুণী। তিনি শহিদ মুক্তিযোদ্ধা রফিক হায়দারের বড় মেয়ে রিনা হায়দায়। 

 

হলিসউডনিউ ইয়র্ক। ৯ মে ২০১৮। 

Comments

Popular posts from this blog

শিল্পী কাজী রকিবের সাক্ষাৎকার

নন-একাডেমিক শিল্পীরাই নতুন কিছু দেয় -    কাজী রকিব  [কাজী রকিব বাংলাদেশের একজন গুণী শিল্পী। রাজশাহী আর্ট কলেজের একজন প্রতিষ্ঠাতা-শিক্ষক। কলেজের প্রথম ক্লাসটি নেবার কৃতিত্বও তাঁর। নিরন্তর ছবি আঁকেন। নানান মাধ্যমে ,  নানান ভাবনার ছবি। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে সস্ত্রীক বসবাস। তার স্ত্রী মাসুদা কাজীও একজন গুণী শিল্পী। বৈচিত্রপ্রিয় এই শিল্পীর একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন কবি কাজী জহিরুল ইসলাম। ধারাবাহিকভাবে তা এখানে প্রকাশ করা হবে। আজ উপস্থাপন করা হলো প্রথম পর্ব।]   জহিরুলঃ  বেশিরভাগ শিল্পীই নিজের একটা স্টাইল তৈরি করেন ,  নিজস্বতা যাকে আমরা বলি। আবার কেউ কেউ একই ধরণের ছবি বারবার আঁকেন। আপনার কাজে বৈচিত্র খুব বেশি ,  এতে করে "টাইপড" অপবাদ থেকে আপনি মুক্ত কিন্তু নিজের একটি স্টাইল তৈরি করতে না পারা বা তৈরি হয়নি বলে কি আক্ষেপ হয় ,  নাকি এই যে ভার্সেটিলিটি এটাই আপনি বেশি উপভোগ করেন ?    রকিবঃ   আমি আসলে আলাদা করে ভাবিনি এই স্টাইল বিষয়ে। কারো মতো আঁকারও চেষ্টা করিনি তেমন ভাবে। অল্প বয়সে ,  আমার ১৯ / ২০ বছর বয়সে ,  সালভাদর দালির মতো আঁকতে চেষ্টা করেছিলাম কিছুদিন ।

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জুর সাক্ষাৎকার || পর্ব ৭

মতিউর রহমান চৌধুরীকে  র‍্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কারের জন্য নমিনেট করেছিলেন  আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু       [লেখক, সাংবাদিক, অনুবাদক আনোয়ার হোসেইন মঞ্জুর সাক্ষাৎকারের সপ্তম  পর্ব আজ প্রকাশ করা হলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কবি কাজী জহিরুল ইসলাম।]          জহিরুলঃ  আপনার সাংবাদিকতা জীবনের প্রায় পুরোটাই ব্যয় করেছেন জাতীয় সংসদ কভার করে। এই সংসদে আমাদের সংবিধানের অনেকগুলো সংশোধনী পাশ হয়েছে। আমাদের নেতারা সব সময় বলেন, ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড় কিন্তু প্রকৃত চিত্র হচ্ছে দেশের চেয়ে দলের স্বার্থ বড় হয়ে ওঠে এবং দলের চেয়ে ব্যক্তির/পরিবারের স্বার্থই বেশি গুরুত্ব পায়। প্রধান প্রধান সংশোধনীগুলোর আলোকে যদি বিশ্লেষণ করেন কতোটা জাতীয় স্বার্থে আর কতটা ব্যক্তি বা পরিবারের স্বার্থে এইসব সংশোধনীগুলো করা হয়েছে।    মঞ্জুঃ   আপনি ঠিকই বলেছেন, এযাবত বাংলাদেশে ১১টি জাতীয় সংসদ গঠিত হয়েছে এবং এর মধ্যে দ্বিতীয় সংসদ থেকে নবম সংসদ পর্যন্ত মোট আটটি সংসদের অধিবেশন কভার করা সুযোগ হয়েছে আমার। আমার সংসদ কভারের সময়ে আমাদের সংবিধানের ১০টি সংশোধনী অনুমোদিত হয়েছে এবং সংশোধনী প্রক্রিয়া কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। এখন পর্যন্ত স

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জুর সাক্ষাৎকার - তৃতীয় পর্ব

মঞ্জু আমার ওপর রাগ করেছে                                                           - আল মাহমুদ [লেখক, সাংবাদিক, অনুবাদক আনোয়ার হোসেইন মঞ্জুর সাক্ষাৎকারের  তৃতীয় পর্ব আজ প্রকাশ করা হলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কবি কাজী জহিরুল ইসলাম।]  সাক্ষাৎকার নেবার এক পর্যায়ে আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু  ও কাজী জহিরুল ইসলাম। ওয়ান্টাগ পার্ক, নিউ ইয়র্ক।  ছবি তুলেছেন ড. মাহবুব হাসান।   জহিরুলঃ  খুশবন্ত সিং তার সকল বই অনুবাদ করার লিখিত অনুমতি দিলেন আপনাকে এবং সেই অনুমতিপত্রটি তিনি নিজ হাতে আপনার সামনেই বাংলায় লিখে দিলেন। তিনি কিভাবে বাংলা শিখলেন তা কি জানতে পেরেছিলেন ?  মঞ্জুঃ    জ্বি ,  ঘটনাটি  ঘটে  ১৯৯২ সালের ডিসেম্বর মাসে ,  এ সম্পর্কে আমি আগের এক প্রশ্নে বলেছি। তারিখটি আমার স্মরণে নেই। তবে বাবরি মসজিদ ধ্বংস করার পর ,  ডিসেম্বরের শেষ দিকে। না ,  বাংলায় নয় ,  উনি ইংরেজিতে লিখেছেন। আমার কফি পানের সময়ের মধ্যেই লিখে দিয়েছেন। ১৯৮৪ থেকে মাঝে দীর্ঘ বিরতি দিয়ে আমাকে তিনটি বা চারটি চিঠি লিখেছেন। লিখেছেন বলতে আমার চিঠির উত্তর দিয়েছেন। প্রতিটি চিঠি ইংরেজিতেই লিখেছেন। প্রতিটি চিঠিতে আমাকে সম্বোধন করেছেন  “ আনোয়ার ভাই ,”  বলে।