'কাজের ছেলে মন্তাজ ছিলো আমার প্রথম আর্ট শিক্ষক'
[কাজী রকিব বাংলাদেশের একজন গুণী শিল্পী। রাজশাহী আর্ট কলেজের একজন প্রতিষ্ঠাতা-শিক্ষক। কলেজের প্রথম ক্লাসটি নেবার কৃতিত্বও তার। নিরন্তর ছবি আঁকেন। নানান মাধ্যমে, নানান ভাবনার ছবি। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউয়য়র্কে সস্ত্রীক বসবাস। তার স্ত্রী মাসুদা কাজীও একজন গুণী শিল্পী। বৈচিত্রপ্রিয় এই শিল্পীর একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন কবি কাজী জহিরুল ইসলাম। ধারাবাহিকভাবে তা এখানে প্রকাশ করা হবে। আজ উপস্থাপন করা হলো দ্বিতীয় পর্ব।]
পর্ব – ২
জহিরুলঃ আপনার জন্ম এবং বেড়ে ওঠার গল্প শুনতে চাই। পারিবারিক, প্রাকৃতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশ কেমন ছিল, শৈশব-কৈশোরে?
রকিবঃ আমার জন্ম চট্টগ্রামের আসকার দীঘির পূব-দখিন পাড়ে, ৮৮ হেমসেন লেনে। বাঁশের বেড়ার ঘর উপরে টিনের চালা। দুই কামড়ার ঘর, সামনে বারান্দা এক চিলতে। পেছনে একটু ফাঁকা জায়গা তারপর রান্নাঘর। ঐ একটু ফাঁকা জায়গা ছোট বেলায় উঠান মনে হতো। সকালে মা রুটি বানাতেন, আব্বা রুটি ছিঁড়ে কাককে খাওয়াতেন, কিছু কাক বারবার পেতো দুর্বলেরা চেষ্টা করে ব্যর্থ হতো।
জহিরুলঃ আপনি নিশ্চয়ই দুর্বলদের পক্ষ নিতেন? এভাবেই শৈশবে মানুষের মধ্যে মানবিক বোধের বিকাশ ঘটে।
রকিবঃ একদম ঠিক। আমি আর দাদা সবলদের তাড়াতাম যাতে না পাওয়া কাকেরা পেতে পারে। ভারি মজার খেলা। এরপর আমাদের নিজেদের নাস্তা খাওয়া। ষষ্ঠীর সকালে আব্বা আমাদের নিয়ে পুজা মন্ডপে ঘুরতেন। তিনটা দূর্গাপ্রতিমা হতো দীঘির তিন পাড়ে, আমাদের বলতে হতো কোন প্রতিমা ভালো হয়েছে। আমাদের বাসাটা ছিলো জমজ বাড়ি। অন্য পাশে থাকতো রশিদ ভাইয়েরা। মজিদ, সালাম, মুকুল আমাদের খেলার সাথী, আর ছিলো উত্তরে বাবুদের বাড়ি; বাবু, নান্নুদাও আমাদের সাথী। ঐ বাড়িতে থাকতেই আমি স্কুলে ভর্তি হই, সালেহ জহুর স্কুল। আমার জীবনে আমি পাঁচটি স্কুলে পড়ি। পূজায় বাবুদের বাড়ি খাওয়া, ঈদে আমাদের বাড়ি। আমরা ছোটবেলায় হিন্দু-মুসলিমের পার্থক্য টের পাইনি। দীঘির পূবপাড়ে এক চিলতে জায়গায় ক্রিকেট ও উত্তর পাড়ে ফুটবল খেলতাম। তিনটি বাড়ি নিয়ে কম্পাউন্ড ছিলো, মধ্যবর্তি জায়গায় সাতচাড়া খেলতাম। কম্পাউন্ডে একটা বিল্ডিং ছিলো আব্বার সার্ভে স্কুলের বন্ধু থাকতেন ঐ বাসায়। আমরা ঝড়ের সময় ওই বাসায় আশ্রয় নিতাম। ওরা চলে যাওয়ার পর আমার এক মামা আসেন, বেলাল, জামান ও দুলালভাই সেই মামার তিন ছেলে। বেলাল খুব ভালো ছাত্র ছিল। বোর্ডের পড়ীক্ষায় স্ট্যান্ড করেছিলো। মামি আমাদের হাতে হরলিক্স দিতেন। গুড়া হরলিক্স খাওয়া এক পরম আনন্দের ছিলো। শীতকালে আমাদের গায়ে একেকটা চাদর পেঁচিয়ে পেছনে গিট দিয়ে দিতেন আব্বা। আমরা পেঙ্গুইনের মতো হাঁটাচলা করতাম।
জহিরুলঃ ছায়াছবির দৃশ্যের মতো আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। কী অসাধারণ সেই দৃশ্য।
রকিবঃ বড়দা ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজে পড়তেন। ছুটির দিনে বাসায় আসতেন। একদিন বড়দা এলেন একটা ডিমে আঁকা ছবি নিয়ে। ডিমে রং দিয়ে নারিকেল গাছ আঁকা। এসেই বড়দা আর আপা ডিম ছিদ্র করে ভিতরের কুসুম আর সাদা অংশ সাবধানে বের করে নিলেন। তারপর বড়দা ঐ ছবিটা কপি করলেন খুব সুন্দর করে। আমরা তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে বিস্ময় নিয়ে দেখলাম পুরা কর্মকাণ্ড। বড়দা পোর্ট্রেটও করতেন। জিন্নার একটা পোর্ট্রেট করলেন ক্রোকেল নিব ও ইন্ডিয়া কালি দিয়ে। আমি বিস্মিত হতাম। যাদুকরী মনে হতো। শিক্ষা বা কিছু একটা আন্দোলন হয়েছিল তখন, একদিন রশিদ ভাই ও তপনদা পুলিশের কাছে আহত হয়ে বাড়ি ফিরলেন। সেটা ১৯৬৪ সাল।
জহিরুলঃ সম্ভবত ছবি আঁকার প্রেমে পড়লেন তখনই। ঠিক কোন বয়সে টের পেলেন যে আপনি ছবি আঁকতে ভালোবাসেন? আর্ট কলেজে ভর্তি হওয়াটা কি নির্বিঘ্ন ছিল?
রকিবঃ আমি যখন ক্লাশ ফোরের মধ্যবর্তি বছরে তখন এক সামুদ্রিক ঝড়ে আমাদের আসকার দীঘির বাসার চাল পড়ে যায়। খুব বড় ঝড় ছিলো। ঝড়ে একটা বড় সামুদ্রিক জাহাজ তীরে উঠে গিয়েছিলো কুমিরায় । আব্বা আমাদের নিয়ে গিয়েছিলেন ডাঙ্গায় জাহাজ দেখাতে। কয়েক মাস নানান ভাবে চেষ্টা করেও জাহাজ সমূদ্রে নামানো যায়নি। পরে ভেঙ্গে টুকরা টুকরা করা হয় সেটা। পরবর্তিতে জাহাজ ভাঙ্গা শিল্প গড়ে ওঠে সেখানে যা এখনও চলছে। ঐ ঝড়ে আমাদের ঘর পড়ে যাওয়ায় আমরা আগ্রাবাদ কমার্স কলেজের দক্ষিণ দিকে নতুন বানানো সরকারি বাড়িতে উঠি। কমার্স কলেজের অধ্যক্ষের বাসা ছাড়া কোনো বাসাবাড়ি নাই। ছাত্রদের হোস্টেল আছে আর শুধু মাঠ আর মাঠ। বিরান এলাকা। পেছনে ডেবার পাড়ে কিছু বাসাবাড়ি আছে, কিন্তু আমরা বন্ধু বিহীন হয়ে পরলাম। আসকার দীঘির পাড় ছিলো জমজমাট। এখন প্রায় শব্দবিহীন এক জায়গা, দুর থেকে মাইকে গান ভেসে আসে। কাছের পশ্চিম মাদার বাড়ি প্রাইমারী স্কুলে ভর্তি হই। স্কুলের পর বা ছুটির দিনে সময় কাটতো না। বড়দা তখন বুয়েটে পড়েন। একবার আমাকে পেলিক্যান রঙের বাক্স কিনে দেন। আমি ছবি আঁকতে শুরু করি। ছবি এঁকে দেয়ালে লাগিয়ে রাখা আনন্দের ছিলো। আব্বা রাগ করতেন। কমার্স কলেজের অধ্যক্ষের বাড়িটা এঁকে পড়ার টেবিলের পেছনের দেয়ালে লাগিয়ে রেখেছি। একদিন অধ্যক্ষ সোবহান সাহেব আমাদের বাসায় এলেন সৌজন্য সাক্ষাতের জন্য। আমরা তাকে বারান্দায় পড়ার টেবিল-চেয়ারে বসিয়ে আব্বাকে ডেকে আনি। তিনি গল্প করতে করতে হঠাৎ তার বাড়ির ছবিটা দেখে চিনতে পারলেন। আব্বাকে জিজ্ঞেস করলেন, কে এঁকেছে? আব্বা আমাকে ডাকলেন। আমি এলে আব্বা বললেন, সারাদিন ছবি আঁকে, পড়াশুনায় মন নাই। অধ্যক্ষ সোবহান সাহেব আমার ছবির প্রশংসা করে পড়াশুনায় মন দেয়ার পরামর্শ দিলেন । আব্বাকে বললেন, বড় হলে আবেদিন সাহেবের আর্ট কলেজে পাঠাতে। আমি জানতাম না আর্ট করার জন্য কলেজ আছে। আমাদের বাসায় কাজের ছেলে ছিলো মন্তাজ উদ্দিন। আমাদের গ্রামেরই ছেলে। ছোটবেলায় কুমার বাড়িতে কাজ করতো। নানুবাড়ির কাছে কুমার বাড়ি, ওরা লক্ষীসরা আঁকতো। ওদের সরা বিখ্যাত, কাইলারা গ্রামের। মন্তাজউদ্দিন ছবি আঁকতে পারতো। আমাকে স্কুলের জন্য মাটির কলা, আম ইত্যাদি বানিয়ে সুন্দর করে রং করতে সাহায্য করতো। বলা যায় মন্তাজ উদ্দিন আমার আঁকার প্রথম গৃহ শিক্ষক।
আর্টকলেজে ভর্তি খুব নির্বিগ্ন ছিলো না। দুর্ভাগ্য হয়েছিলো আমার এসএসসির ফলাফল। আমি পাস করেছিলাম প্রথম বিভাগে, অংক ও ফিজিক্সে লেটার নিয়ে। এই রকম রেজাল্ট পাওয়াদের ডাক্তারি বা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে সবাই পরামর্শ দেয়। আমাকেও সেই পরামর্শের চাপ সহ্য করতে হলো। এর আগের একটা বিষয় আমাকে বলতে হয়। আমরা আগ্রাবাদের বাসা থেকে চকবাজার চলে আসি। মেজদার মেডিক্যাল কলেজ কাছে হবে বলে। আমাদের বাড়িওয়ালা গফুর সাহেবের ছেলে দানুভাই, অত্যান্ত চমৎকার ছবি আঁকতেন। ঘরভর্তি দেয়াল জুড়ে তার আঁকা ছবি। ঈদের আগে প্রচুর ঈদকার্ড আঁকতেন। চমৎকার কার্ড। চট্টেশ্বরী রোডের মাথায় একটা বইয়ের দোকানে বিক্রি করতে দিতেন। তার দেখাদেখি আমিও কয়েকটা কার্ড এঁকে তাকে বলি দোকানে দিতে। তিনি দেন। আমার দুইটা কার্ড বিক্রি হয়। এখন বুঝি খুব ভালো ছিলো না সেগুলি। দানু ভাইয়ের কার্ড বিক্রি হতো শ'য়ে শ'য়ে। দানু ভাই আমাকে ছবি আঁকা দেখান। তিনিই বললেন আর্টকলেজে পড়তে। সোবহান সাহেবের পর তিনি বললেন। আমরা বড়দা’র বিয়ে উপলক্ষে ফরিদপুর আসি ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসে। নির্বাচন ফলাফলের জটিলতা ও স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য ফিরে যাওয়া হয়নি চট্টগ্রামে। বড়দার শ্বশুরবাড়ি রাজবাড়ীতে বেড়ানোর সময় নজরুলজয়ন্তী। সেবারের নজরুলজয়ন্তী খুব আবেগী, আন্দোলন চলছে স্বাধিকারের। বড় ভাবীর কলেজে উৎসব, আমি ২২x২৮ সাইজের একটা নজরুলের প্রতিকৃতি এঁকে দিই। পরদিন ভাবীর বন্ধু লিলি আপা ছবিটার প্রশংসা করে আমাকে আর্টকলেজে পড়তে উৎসাহ দিলেন। তিনি তার ভাই শিল্পী রশীদ স্যারের গল্প করলেন। এসব ঘটনা আমাকে আর্টকলেজে ভর্তির জন্য সংকল্পবদ্ধ করে। আমার চাপাচাপিতেই আব্বা আমাকে ঢাকা নিয়ে যান আর্টকলেজে ভর্তির জন্য।
জহিরুলঃ যখন আপনি আর্ট কলেজে ভর্তি হন তখনকার সামাজিক পরিবেশ কতটা শিল্পবান্ধব ছিল, দুয়েকটি উদাহরণ দিয়ে যদি বোঝান।
রকিবঃ ১৯৭২ সালে আমি ঢাকা আর্টকলেজে ভর্তি হই। বাংলদেশের প্রথম ব্যাচ। তখন দেশে একটি মাত্র আর্ট কলেজ। আমি যখন সেখানে ভর্তি হই তখন অন্য আমি হয়ে যাই। তখন নতুন দেশ। মাটি, গাছপালা আগে যা ছিলো তাই আছে, ভাব পাল্টে গেছে। আবার আর্টকলেজে ভর্তির পর জগৎ আরেকবার পাল্টালো আমার। বড়, বিখ্যাত শিল্পীরা চোখের সামনে। নবীন দেশের তরুণশিল্পীরাও উজ্জীবিত। আমাদের কলেজের শেষ বর্ষের একদল গঠন করলেন পেইন্টার্স গ্রুপ। চন্দ্রশেখর দে, হাসি চক্রবর্তী , মনসুরুল করিম(ঠান্ডুভাই), বনিজুল হক, নজরুল ইসলাম (কার্টুনিষ্ট), অলক রায় ও খাজা কাইউম এরা । আমি, আমার বন্ধুদের প্রেরণার উৎসতারা। আযম খানের "উচ্চারণ " আত্মপ্রকাশ করে সব তরুণদের মাথা খারাপ করে দিলো। ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউটে হলো প্রথম শো। নতুন নাটকের দল "ঢাকা থিয়েটার"। লাকী আখন্দের গান। বন্ধু হ্যাপি আখন্দের গান। একাকার চারিদিকে। আমরা গঠন করলাম "ঢাকা পেইন্টার্স"। নাম রাখতে পেইন্টার্স গ্রুপ ও ঢাকা থিয়েটার আমাদের সামনে ছিলো। দ্বিতীয় প্রদর্শনীর পর দৈনিক বাংলার আহমেদ হুমায়ূন এবং সংবাদের সন্তোষ গুপ্ত আমাদের সাথে কথা বললেন, যা আমাদের ভাবনার বাইরে ছিলো। আমরা কল্পনা করতেই পারিনি ওই দুজনের মতো মানুষ তাদের অফিসে আমাদের ডাকবেন।
জহিরুলঃ আর্ট কলেজের শিক্ষক হিসেবে কাদের পেয়েছিলেন? কেমন ছিল শিক্ষকদের সাথে ছাত্রদের ঐক্য এবং সম্পর্ক।
রকিবঃ আমি পাঁচটা স্কুল ও তিনটা আর্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশুনা করেছি। ঢাকা আর্ট কলেজে শুরু, তারপর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগে, সবশেষে চট্টগ্রাম চারুকলা কলেজে। আর কোনো প্রতিষ্ঠান ছিলো না সেই সময়। ঢাকা আর্ট কলেজে আমার সরাসরি শিক্ষক ছিলেন, মাহবুবুল আমিন (প্রয়াত), কাজী গিয়াসুদ্দিন (টোকিয়ো প্রবাসী), মাহমুদুল হক, আবুল বারক আলভী এবং শহীদ কবির। এ ছাড়া দুয়েকটি ক্লাশ নিয়েছিলেন আমিনুল ইসলাম ও আব্দুর রাজ্জাক। রাজ্জাক স্যার নিয়েছিলেন বেসিক ডিজাইন, গাছের পাতার টেক্সচার কাগজে পেন্সিল ঘষে নিয়ে ডিজাইন মটিফ খুঁজে পাওয়া। আমিনুল ইসলাম স্যার ক্লাশ নিলেন কম্পোজিশন, একটা প্লেটে একটা রসগোল্লা কোথায় রাখলে ভালো লাগবে দেখতে। আলভী স্যার উডকাট ব্লক বানিয়ে ছাপা নেয়ার ক্লাশ। আলভী স্যার ব্যাক্তিগত জীবনের, বিশেষ করে অর্থনৈতিক খোঁজ নিতেন এবং যতদুর সম্ভব সহায়তা করতেন। ভাবা যায়না। শহীদ কবির স্যার সবচেয়ে আকৃষ্ট করেছিলেন তার আধুনিকতা, তারুণ্য দিয়ে। লালনগীতির চিত্ররূপ টেম্পেরা মিডিয়ামে আমাদের পাগল করে দিতো। আর ছিলেন মরনচাঁদ পাল, মৃৎশিল্পের ক্লাশ নিতেন। একেবারেই মাটির মানুষ, রসিক মানুষ। একবার রশীদ স্যার (রশীদ চৌধুরী) ঢাকায় এসে আর্টকলেজে বক্তৃতা দিলেন। কৃষ্ণকায় লম্বা মানুষ, কালো ট্রাউজার, কালো টার্টেল নেক পরা, গলায় দুটি চশমা ঝোলানো, একবার এটা, আরেকবার অন্যটা চোখে দিচ্ছেন সামনে দুরে দেখার জন্য। বাংলায় বক্তৃতা দিলেও তাতে ইংরেজি, ফরাসি ও দুয়েকটা উর্দু শব্দ বলছেন। আমি মুগ্ধ। বক্তৃতা শেষে বন্ধু মোস্তফা স্যারের সাথে সিরামিক ডিপার্টমেন্টের দিকে যাচ্ছেন। আমি নেশাগ্রস্তের মত তার পিছে হাঁটছি। গ্রাফিক ডিপার্টমেন্টের কাছে গিয়ে তিনি টের পেলেন। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন -কিছু বলবে? আমি উত্তর দিলাম,আমি যাবো স্যার, আপনার সাথে। তিনি জানতে চাইলেন কোন ইয়ারে পড়ি। বললাম প্রি-ডিগ্রী পরীক্ষা দিয়েছি মাত্র, রেজাল্ট হয় নাই। তিনি খুশি হলেন। বললেন, তোমাদের মতো কিছু ছাত্রছাত্রী লাগবে, অসুবিধে নাই। প্রবেশনাল এডমিশনের ব্যাবস্থা হবে। আমাদের ডিপার্টমেন্টে অনার্স চালু হবে এই বছর। একটানা বললেন। আমি পথ পেয়ে যাই। কিছু বন্ধু মিলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যাই। আমি, উত্তম, দীপা, মাসুদ ও তন্দ্রা ভর্তি হই প্রথম ব্যাচে, আর ভর্তি হয় অন্য সাধারণ কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করা আরো কয়েকজন। ওখানে পাই শিক্ষক হিসাবে মুর্তজা বশীর, দেবদাস চক্রবর্তী, আবুল মনসুর, মিজানুর রহিম ও আনসারি স্যারকে। আবু হেনা মোস্তফা কামাল পড়াতেন নন্দনতত্ত্ব। বশীর স্যারের কাছে শিখেছি অনেক কিছু কিন্তু ড্রইংয়ের কনফিডেন্স শিখেছি তার কাছে। দেবদাস স্যারকে আমরা ডাকতাম দেবুদা, তার কাছে শিখেছি গর্জিয়াস জীবন যাপনের আনন্দময় দিক। তিনি আমাদের ক্লাশ নিতেন না, এম.এফ.এ-র ক্লাশ নিতেন। তার সাথে ক্লাশের বাইরে আমার জীবন কেটেছে, তার জীবনের শেষ অসুস্থ কয়েক বছর আগ পর্যন্ত। আমার জীবনের গুরুত্বপুর্ণ বা কঠিন সময়ে তাকে পাশে পেয়েছি অভিবাবকের মতো।
তিনমাস পর ঢাকা আর্টকলেজের প্রি-ডিগ্রী পরীক্ষার ফল সন্তোষজনক হলো না। আমি এখনো এ বিশ্বাসেই আছি, প্রতিহিংসা মুলক ছিলো সে ফলাফল। আমাদে গ্রুপ "ঢাকা পেইন্টার্স" কিছুটা বিরক্তিকর ছিলো কিছু সংখ্যক শিক্ষকের কাছে। তাছাড়া চট্টগ্রামে নতুন শিল্পচর্চার কেন্দ্র হয়ে ওঠাকে ঢাকা ভালোভাবে নেয় নাই। আমি চট্টগ্রাম চারুকলা কলেজে ভর্তি হই। এর পেছনে একটা ঘটনা আছে। আমি বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করে চারুকলা কলেজে আসি প্রতিদিন। কিন্তু ভর্তি হওয়ার ইচ্ছা ছিলো না। প্রতিদিন আসি, ছবি আঁকি, শিক্ষকদের সাথে গল্প করি। শিক্ষকরা ছিলেন আমার সিনিয়র বন্ধু। ঢাকা আর্ট কলেজে রুমমেট ছিলেন শেখর’দা , হাসি’দা। তখন এক হতাশাজনক রাজনৈতিক সময়। আন্ডারগ্রাউন্ড অস্ত্রের রাজনীতি, সেটা দমনে হিংস্রতা, বঙ্গবন্ধু-হত্যা, পাকিস্তানী রাজনীতির পূনর্বাসন। সব মিলিয়ে অস্থিরতা। নেশাদ্রব্যের প্রতি আসক্তি কী হতাশাগ্রস্ত জীবন। সিনিয়র বন্ধুরা যারা চট্টগ্রাম চারুকলার শিক্ষক আমাকে নিত্য চাপ দেন কলেজে ভর্তি হতে। ভর্তি হওয়ার জন্য প্রয়োজন ছিলো ঢাকা আর্টকলেজ থেকে ট্রান্সফার সার্টিফিকেট আনা, যেটা আমি করবো না। একদিন মনসুর ভাই (অধ্যাপক আবুল মনসুর) বললেন, অমলেন্দুর কাছে(চারুকলা কলেজের করণিক) একটা কাগজ আছে, নিয়ে নিও। আমি যাই, অমলেন্দুদা আমাকে একটি রশিদ দেন, দেখি দুই বছরের বেতন দিয়ে মনসুর ভাই আমাকে ভর্তি করেছেন চট্টগ্রাম চারুকলা কলেজে। ঢাকা থেকে ট্রান্সফার না আনলে এ ছাড়া উপায় ছিল না। আমি অবাক হই, মনসুর ভাই বললেন তিনমাস পর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রি-ডিগ্রী পরীক্ষা সেটায় যেন আমি প্রথম স্থান পাই, এবং আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের অনার্সে ক্লাশ শুরু করি। মনসুর ভাই খুব নিচুস্বরে কথা বলেন সারাজীবন। আমার কাছে কিন্তু কঠিন নির্দেশের মতো মনে হয়েছিল। আমি পরিক্ষায় প্রথম হয়েছিলাম, কিন্তু আর অনার্স ক্লাশে ফিরে যাইনি। চারুকলা কলেজেই পড়েছি ডিগ্রী কোর্সে। আমার জীবন বদলে গেলো আবার। চট্টগ্রাম চারুকলা কলেজের জীবন অন্য রকম সৌন্দর্যময়। হাসি’দা আমার শিক্ষক হলেন, তিনি আমার রুমমেট ছিলেন ঢাকায়। আমি চট্টগ্রামেও মাঝেমধ্যে তার সাথে থাকতাম। হাসি’দা একসাথে অনেকগুলি ক্যানভাস তৈরি করতেন। আমি কয়েকদিন ধরে সেটা প্রস্তুত করতাম। তিনি আমাকে কয়েকটা ক্যানভাস দিতেন। শেখরদা’র ক্লাশ নেয়ার পদ্ধতি খুবই অন্যরকম ছিলো, আমাদের ল্যান্ডস্ক্যাপ করাচ্ছেন অয়েলে, আমি ওয়ার সেমেট্রির ছবি শুরু করলাম। কৃষ্ণচূড়া গাছ, অল্প কলি আসছে, আমি রং দেই, ড্রইং ঠিকঠিক করি। কলি বেড়ে যাচ্ছে, আমি ক্যানভাসে বাড়াই। দিন যায় ক্লাশ শেষ হয় না, কলির মুখ লাল হতে থাকে, আমি লালের ছোঁয়া দেই । আস্তে আস্তে ফুল ফুটতে থাকে, আমি লাল বাড়াই। ক্লাশ শেষ হয় না, ছবিও চলে। ফুলে ফুলে পুরা ক্যানভাস লাল হয়ে গেলো। একসময় ফুল ঝরতে থাকে, আমি মাটিতে লাল আনি। সেই লাল খয়েরি হতে শুরু করে। তিনমাস পর ক্লাশ শেষের ঘোষণা দিলেন। আমাদের ছবি শেষ হয়নি। শেখরদা বললেন বাসায় নিয়ে শেষ করতে পারো। আমরা বিস্মিত, একটা ল্যান্ডস্কেপ ক্লাশ এতদিন! শেখর’দা বলেন এটা ছিলো ন্যাচারস্টাডি। আজ ভাবি একই স্থানে একই দিকে দৃষ্টি রেখে জীবনে আর তো হলোনা দৃশ্য দেখা, তিনমাস ধরে। সম্ভব না আর কোনদিনই।
Comments
Post a Comment