তিনি যেনো এক ধ্যানমগ্ন ঋষি
|| নাসরীন আখতার রেবা ||
আফ্রিকার বোতসোয়ানায় বসবাস করছি আমি। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল কাজী জহিরুল ইসলামের বাংলাদেশের স্বাধীনতার উপর লেখা “পা” কবিতাটি আবৃত্তি করার। আমি এই কবিতার প্রতিটি লাইনে দেখেছি গনগনে দেশপ্রেম। এক্কেবারে দীপ্ত চোখ আমি দেখতে পেয়েছি। এ যেমন ক্রোধের তেমনি গভীর মমতার? কয়েকটি লাইন এখানে তুলে দিচ্ছিঃ
আজকে দুটো পা কিনেছি আমি
ওই দুটো পা ছিল না খুব দামী
পড়েই ছিল অবহেলায় খোলা টেবিলটাতে
কি খুঁজতে কি খুঁজে পেলাম,
ওরা আমার হাতে।
মোটাসোটা মাংসল পা রঙটি খুবই কালো
কী বিচ্ছিরি নোখের ওপর পড়লো এসে আলো
ওখানেতো কাদামাটি, দূরের ধূলিঝড়
পায়ের ওপর তখন দেখি খাড়া একাব্বর।
একাত্তুরে এই দু’পায়েই মাড়িয়ে কাদা-জল
এনেছিলো এক মুঠো রোদ টকটকে উজ্জ্বল
হঠাৎ আমায় হেচকা টানে নামিয়ে দিলো পথে
কোথায় যেন লাগলো আঘাত
অচেনা কোন ক্ষতে!
কবি কাজী জহিরুল ইসলামের কবিতায় রয়েছে উছলে পড়া প্রেম, বিশেষ করে এ ক'টা লাইন তো আমার ভীষণ ভালো লেগেছে,
"রাত, নেবে না বুঝি?
অন্ধকারে ভয়?
দাঁড়াও তবে। অন্য কিছু খুঁজি।
ভোর? আলোকোজ্জ্বল দিনই?
না, না, রাতই দেব।
অন্ধকারেই তোমায় ভালো চিনি।”
[কবিতাঃ কি নেবে]
তাঁর কবিতা পড়ে কখনো বা মনে হয়েছে কবি যেনো এক ধ্যানমগ্ন ঋষি। পেতে চান এক মন্ত্রসিন্দুক। যে মন্ত্রে পাল্টে দেবেন এই পৃথিবী। জোছনায় ধুয়ে দেবেন তাবৎ অন্ধকার। স্বর্গনদী নিয়ে আসবেন মানুষের কাছে। সুন্দর ভাবনার মৌটুসি নিয়তই ডেকে যায় তাঁর কবিতায়। তিনি ভাবুক, তিনি সংস্কারক। তিনি সাফ করে দিতে চান কবিতা ও মানবিক অবক্ষয়ের জঞ্জাল।
এই কবি কবিতায় বিচরণ করেন মূর্ত-বিমূর্তের মাঝখানে। তাঁর বলার ঢঙ অন্য সাতজনের চেয়ে আলাদা। লেখায় তাঁর মুন্সীয়ানা সাঁচিধানের মতো পুষ্ঠ। আত্মা তাঁর সত্তার উঠানে, দুপুরমুখী রোদ্দুর তাঁর কবিতার দর্শন। কবি যেনো একের ভেতরে তিন। লেখক, চিত্রকর, ভাস্কর। কবিতার পালাবদলে তিনি তীরন্দাজ।
এই কবির কাব্যকথা মুল্যায়ন করা আমার জন্য স্পর্ধা ছাড়া আর কি হতে পারে, আমি সাহিত্য পাড়ায় একজন শান্ত পাঠক মাত্র। কবি কাজী জহিরুল ইসলামের সব লেখাই অন্য ঘরানার আমি লক্ষ্য করেছি। তার দেহকাব্য, ভ্রমন কাহিনী এবং কবিতা, সবখানেই আমি তার কাব্য জাদুর ছোঁয়া পেয়েছি। কবির বন্ধু হয়েছি আমি তার লেখা আফ্রিকার এক ভ্রমণ কাহিনী পড়ে। ধীরে ধীরে আমি তার কাব্যানুরাগিণী হয়েছি। আজ পঞ্চাশ পেরিয়ে প্রবল দর্পে মাতিয়ে রেখেছেন বাংলার সাহিত্যাঙ্গন। আমি তার যে ক'টা লেখা পড়েছি আমার মনে হয়েছে, প্রতিটি লেখাতেই প্রেম, কাম, অপত্য, ভক্তি, শ্রদ্ধা, ঘৃণা, বৈরিতা, ক্রোধ, সমবেদনা এবং এমন কি ঔদাসীন্যের বোধগুলোও দেওয়ালির রাতের অসংখ্য প্রদীপের কম্পমান শিখার মতো, তিনি অনুভূতির ম্যাজিক আঙুলে জীবনকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে গেছেন। খুব বেশি বই আমার পড়ার সুযোগ হয়নি, তবে আমি এখনো সংগ্রহের অপেক্ষায় আছি। প্রত্যাশা করছি এই মাধুকরী জীবনে তিনি আরো অনেক দূরতক সদর্পে হেঁটে যাবেন।
বোতসোয়ানা, আফ্রিকা। ৫ ডিসেম্বর ২০১৭।
Comments
Post a Comment