Skip to main content

কুতর্কের ফিরিস্তি

 জাতীয় সঙ্গীত বিতর্ক

 || কাজী জহিরুল ইসলাম || 



এপ্রিলের ২০ তারিখে পাঠকের পাতা যথারীতি একটি বাংলা বইয়ের ওপর আলোচনা করার পাশাপাশি বাংলা বর্ষবরণ উপলক্ষে বাড়তি কিছু আয়োজন করে। এবারের নির্বাচিত বই ছিল শাহাদুজ্জামানের একজন কমলালেবু। কবি জীবনানন্দ দাশের যাপিত জীবনকে লেখক তার সাহিত্যকর্ম এবং ব্যক্তিগত ডায়রিতে টুকে রাখা নোটের আলোকে দেখার চেষ্টা করেছেন এই গ্রন্থে। আমি এবং ওবায়েদুল্লাহ মামুন ছাড়াও দুজন অতিথি আলোচক গ্রন্থটি নিয়ে আলোচনা করেন, তারা হচ্ছেন হাসান ফেরদৌস এবং আহমাদ মাযহার। গ্রন্থটি নিয়ে দুজনই দীর্ঘ সময় ধরে আলোচনা করেন। আজ মে মাসের ৮ তারিখ। গত আঠার দিনে বেশ অনেকবারই এই অনুষ্ঠানের কিছু বক্তব্য এবং অনুষ্ঠনোত্তর কিছু আচরণ নিয়ে আমি ভেবেছি। হাসান ফেরদৌস বুদ্ধিমান মানুষ, আমরা তাকে পণ্ডিত বলেই সমীহ করি। আমি ব্যক্তিগতভাবে তাকে বড় ভাই বলে শ্রদ্ধা করি। কিন্তু সেদিন তিনি তার আলোচনায় এমন কিছু বলেছেন যা তার বুদ্ধিমমত্তার সঙ্গে যায় কিনা তা নিয়ে আমি কিছুটা বিভ্রান্ত। শুরুতেই তিনি উষ্মা প্রকাশ করেন আমরা কেন বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু করলাম। তার মারমুখী বক্তব্যে মনে হয়েছে অনুষ্ঠানের শুরুতে জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন একটি গর্হিত কাজ বা বড় রকমের ভুল। প্রথমে তো ভেবেছিলাম তিনি জাতীয় সঙ্গীতেরই বিরুদ্ধে, কিছুক্ষণ পরে বুঝলাম তিনি মনে করেন গাইতে হলে তা গাওয়া উচিত অনুষ্ঠানের শেষে। এরপর আমি অনেক ভেবেছি, জানার চেষ্টা করেছি পৃথিবীর বড় বড় ইভেন্টগুলোতে ন্যাশনাল অ্যান্থেম কখন পরিবেশন করা হয়। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ইভেন্ট বিশ্বকাপ ফুটবল, আমরা দেখেছি প্রতিটি খেলার শুরুতেই ন্যাশনাল অ্যান্থেম বাজানো হয়। বাংলাদেশের সংস্কৃতির সবচেয়ে বড় পেশাগত ক্ষেত্রটি হচ্ছে চলচ্চিত্র। আমরা দেখি, সিনেমা হলে সিনেমা শুরু হওয়ার আগে উড়ন্ত জাতীয় পতাকা প্রদর্শিত হয় এবং তখন জাতীয় সঙ্গীতের সুর বাজানো হয়। মননশীলতা শেখানোর আঁতুড়ঘর হচ্ছে বিদ্যালয়, বিশেষ করে প্রাথমিক বিদ্যালয়। ছেলেবেলায় বিদ্যালয়ে ক্লাস শুরু হওয়ার আগে জাতীয় পতাকার সামনে দাঁড়িয়ে জাতীয় সঙ্গীত গেয়েছি। এর সবই তাহলে ভুল? আচ্ছা ভুল/শুদ্ধের বিতর্ক মূর্খের কাজ, সেই বিতর্কে না গেলাম। সাধারণত কেউ নতুন কিছু বললে বা অপ্রচলিত/অল্প প্রচলিত কিছু বললে, আমি ভেবে দেখি এতে কতটা ইতিবাচক পরিবর্তন আছে। হাসান ফেরদৌসের বক্তব্য অনুযায়ী এখন থেকে আমরা না হয় প্রতিটি অনুষ্ঠানের শেষেই জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন করব। তাতে কি ভালো হবে আর কি মন্দ হবে সেটা ভেবে দেখা যেতে পারে। সাধারণত খুব কম সামাজিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেই দেখা যায় শেষ পর্যন্ত দর্শক বসে থাকেন। আমরা তো আর এখনো অতোটা সভ্য হয়ে উঠিনি যে একটি অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা না হওয়া পর্যন্ত আসন ছেড়ে উঠবো না। আয়োজকদেরও দোষ আছে। কয়টা অনুষ্ঠানই যথাসময়ে শুরু আর যথাসময়ে শেষ হয়। এখানে বলে রাখি, সেদিন হাসান ফেরদৌস এবং আহমাদ মাযহারকে অনুষ্ঠানের শুরুতেই বক্তব্য প্রদান করতে ডাকা হয় এবং তারা দুজনই তাদের বক্তব্য দিয়ে অনুষ্ঠান থেকে চলে যান। এবার আসি অনুষ্ঠানের শেষে জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন নিয়ে আলোচনায়। আমার বিবেচনা বলছে এতে জাতীয় সঙ্গীতের বরং অমর্যাদাই করা হবে। যখন অধিকাংশ দর্শক-শ্রোতাই অনুষ্ঠানস্থলে নেই এবং যারা আছেন তারাও যাই যাই করছেন, তখন জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন করা হলে তা কতটা গুরুত্ব পাবে? বরং অনুষ্ঠানের শুরুতে, যখন সকলের পূর্ণ মনোযোগ থাকে, তখন জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন করা হলে উপস্থিত দর্শকদের মধ্যে শুরুতেই দেশপ্রেমের একটি চেতনা তৈরী হয়, পুরো অনুষ্ঠান জুড়েই তার মধ্যে সেই চেতনার রেশ থেকে যায়। 

গ্রন্থটি নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে হাসান ভাই লেখক ও অর্থনীতিবিদ আকবর আলী খান সম্পর্কে বেশ কঠিন কিছু কথা বলেন। আকবর আলী খান তার জীবনানন্দ দাশের কবিতা গ্রন্থে বলেন, বনলতা সেন নামে নাটোরে কেউ একজন ছিলেন এবং তিনি ছিলেন একজন বারবনিতা। এই উদ্ধৃতি শাহাদুজ্জামানের একজন কমলালেবুগ্রন্থে আছে। এতে হাসান ফেরদৌস এতোই ক্ষিপ্ত হন যে, প্রথমা প্রকাশনার সেই বইটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা উচিত বলে তিনি রীতিমতো চিৎকার করেন এবং আকবর আলী খানকে একটি নোংরা গালি দিয়ে তার এবং সমস্ত আমলার বই নিষিদ্ধ করার দাবী জানান। 

আহমাদ মাযহার প্রথম আলো নিউ ইয়র্কের সঙ্গে জড়িত। পরের সপ্তাহে তিনি নিউ ইয়র্ক থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক প্রথম আলোতে এই অনুষ্ঠানের একটি রিপোর্ট করেন। রিপোর্টটি পড়লে মনে হবে আহমাদ মাযহার এবং হাসান ফেরদৌস ছাড়া এই অনুষ্ঠানে আর কেউ ছিলেন না। তিনি এবং হাসান ফেরদৌস কী বক্তব্য দিয়েছেন [অবশ্যই তার পছন্দের অংশ] তা দিয়েই রিপোর্ট শেষ। রিপোর্টার নিজে এমন নির্লজ্জভাবে নিজের আত্মপ্রচার করতে খুব কমই দেখা যায়। সবচেয়ে গর্হিত যে কাজটি তিনি করেছেন তা হচ্ছে যে সংগঠন অনুষ্ঠানটির আয়োজন করেছে সেই পাঠকের পাতার নামই তার প্রতিবেদনের কোথাও নেই। অবশ্য দয়াপরবশ হয়ে তিনি আমার এবং আব্দুল্লাহ জাহিদসহ কয়েকজনের নাম উল্লেখ করেছেন বেশ দায়সারাভাবে। ব্যক্তিগত পছন্দ -অপছন্দ থাকতেই পারে। হয়ত আহমাদ মাযহার আয়োজকদের কাউকে বা সকলকে ব্যক্তিগতভাবে অপছন্দ করেন কিন্তু তা তার পেশাগত দায়িত্বকে এভাবে প্রভাবিত করবে? তাও পেশাটি যখন সাংবাদিকতা! এমন সাংবাদিকতাই কী বিভ্রান্তি ছড়ায় না? 

হাসান ফেরদৌস এবং আহমাদ মাযহার দুজনকেই আমি যথেষ্ঠ সম্মান করি, ভবিষ্যতেও করব, তার মানে এই নয় যে আমি তাদের কাজের সমালোচনা করবো না। আমি যদি ভুল সমালোচনা করে থাকি নিশ্চয়ই আমাকে তারা, বা সেদিনের অনুষ্ঠানে যারা ছিলেন তাদের কে ধরিয়ে দেবেন, আমি কৃতজ্ঞ থাকব।

 

হলিসউড, নিউ ইয়র্ক। ৮ মে ২০১৯। 

Comments

Popular posts from this blog

শিল্পী কাজী রকিবের সাক্ষাৎকার

নন-একাডেমিক শিল্পীরাই নতুন কিছু দেয় -    কাজী রকিব  [কাজী রকিব বাংলাদেশের একজন গুণী শিল্পী। রাজশাহী আর্ট কলেজের একজন প্রতিষ্ঠাতা-শিক্ষক। কলেজের প্রথম ক্লাসটি নেবার কৃতিত্বও তাঁর। নিরন্তর ছবি আঁকেন। নানান মাধ্যমে ,  নানান ভাবনার ছবি। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে সস্ত্রীক বসবাস। তার স্ত্রী মাসুদা কাজীও একজন গুণী শিল্পী। বৈচিত্রপ্রিয় এই শিল্পীর একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন কবি কাজী জহিরুল ইসলাম। ধারাবাহিকভাবে তা এখানে প্রকাশ করা হবে। আজ উপস্থাপন করা হলো প্রথম পর্ব।]   জহিরুলঃ  বেশিরভাগ শিল্পীই নিজের একটা স্টাইল তৈরি করেন ,  নিজস্বতা যাকে আমরা বলি। আবার কেউ কেউ একই ধরণের ছবি বারবার আঁকেন। আপনার কাজে বৈচিত্র খুব বেশি ,  এতে করে "টাইপড" অপবাদ থেকে আপনি মুক্ত কিন্তু নিজের একটি স্টাইল তৈরি করতে না পারা বা তৈরি হয়নি বলে কি আক্ষেপ হয় ,  নাকি এই যে ভার্সেটিলিটি এটাই আপনি বেশি উপভোগ করেন ?    রকিবঃ   আমি আসলে আলাদা করে ভাবিনি এই স্টাইল বিষয়ে। কারো মতো আঁকারও চেষ্টা করিনি তেমন ভাবে। অল্প বয়সে ,  আমার ১৯ / ২০ বছর বয়সে ,  সালভাদর দালির মতো আঁকতে চেষ্টা করেছিলাম কিছুদিন ।

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জুর সাক্ষাৎকার || পর্ব ৭

মতিউর রহমান চৌধুরীকে  র‍্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কারের জন্য নমিনেট করেছিলেন  আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু       [লেখক, সাংবাদিক, অনুবাদক আনোয়ার হোসেইন মঞ্জুর সাক্ষাৎকারের সপ্তম  পর্ব আজ প্রকাশ করা হলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কবি কাজী জহিরুল ইসলাম।]          জহিরুলঃ  আপনার সাংবাদিকতা জীবনের প্রায় পুরোটাই ব্যয় করেছেন জাতীয় সংসদ কভার করে। এই সংসদে আমাদের সংবিধানের অনেকগুলো সংশোধনী পাশ হয়েছে। আমাদের নেতারা সব সময় বলেন, ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড় কিন্তু প্রকৃত চিত্র হচ্ছে দেশের চেয়ে দলের স্বার্থ বড় হয়ে ওঠে এবং দলের চেয়ে ব্যক্তির/পরিবারের স্বার্থই বেশি গুরুত্ব পায়। প্রধান প্রধান সংশোধনীগুলোর আলোকে যদি বিশ্লেষণ করেন কতোটা জাতীয় স্বার্থে আর কতটা ব্যক্তি বা পরিবারের স্বার্থে এইসব সংশোধনীগুলো করা হয়েছে।    মঞ্জুঃ   আপনি ঠিকই বলেছেন, এযাবত বাংলাদেশে ১১টি জাতীয় সংসদ গঠিত হয়েছে এবং এর মধ্যে দ্বিতীয় সংসদ থেকে নবম সংসদ পর্যন্ত মোট আটটি সংসদের অধিবেশন কভার করা সুযোগ হয়েছে আমার। আমার সংসদ কভারের সময়ে আমাদের সংবিধানের ১০টি সংশোধনী অনুমোদিত হয়েছে এবং সংশোধনী প্রক্রিয়া কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। এখন পর্যন্ত স

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জুর সাক্ষাৎকার - তৃতীয় পর্ব

মঞ্জু আমার ওপর রাগ করেছে                                                           - আল মাহমুদ [লেখক, সাংবাদিক, অনুবাদক আনোয়ার হোসেইন মঞ্জুর সাক্ষাৎকারের  তৃতীয় পর্ব আজ প্রকাশ করা হলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কবি কাজী জহিরুল ইসলাম।]  সাক্ষাৎকার নেবার এক পর্যায়ে আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু  ও কাজী জহিরুল ইসলাম। ওয়ান্টাগ পার্ক, নিউ ইয়র্ক।  ছবি তুলেছেন ড. মাহবুব হাসান।   জহিরুলঃ  খুশবন্ত সিং তার সকল বই অনুবাদ করার লিখিত অনুমতি দিলেন আপনাকে এবং সেই অনুমতিপত্রটি তিনি নিজ হাতে আপনার সামনেই বাংলায় লিখে দিলেন। তিনি কিভাবে বাংলা শিখলেন তা কি জানতে পেরেছিলেন ?  মঞ্জুঃ    জ্বি ,  ঘটনাটি  ঘটে  ১৯৯২ সালের ডিসেম্বর মাসে ,  এ সম্পর্কে আমি আগের এক প্রশ্নে বলেছি। তারিখটি আমার স্মরণে নেই। তবে বাবরি মসজিদ ধ্বংস করার পর ,  ডিসেম্বরের শেষ দিকে। না ,  বাংলায় নয় ,  উনি ইংরেজিতে লিখেছেন। আমার কফি পানের সময়ের মধ্যেই লিখে দিয়েছেন। ১৯৮৪ থেকে মাঝে দীর্ঘ বিরতি দিয়ে আমাকে তিনটি বা চারটি চিঠি লিখেছেন। লিখেছেন বলতে আমার চিঠির উত্তর দিয়েছেন। প্রতিটি চিঠি ইংরেজিতেই লিখেছেন। প্রতিটি চিঠিতে আমাকে সম্বোধন করেছেন  “ আনোয়ার ভাই ,”  বলে।