গিনি কোনাক্রিতে গণহত্যা
|| কাজী জহিরুল ইসলাম ||
মেঘের ফাঁক দিয়ে এক চিলতে আলো এসে পড়েছে ম্যানহাটনে, তাও আটকে দিতে চাইছে সুউচ্চ দালানের সারি। সেই আলোটুকু ছোব বলে ফোর্ড ফাউন্ডেশন থেকে বেরিয়ে হাঁটতে থাকি আপটাউনের দিকে। ৪৭ নম্বর সড়কে এসে থামতেই হয়। একদল সুঠামদেহী কালো নারী, কালো পুরুষ শূন্যে মুষ্ঠি ছুঁড়ে তীব্র কন্ঠে স্লোগান দিচ্ছে "গো গো / আলফা কন্ডে", “ব্রুটাল কিলার/ আলফা কন্ডে"। ভিড়ের মুখগুলো তখন আর আমার কাছে অপরিচিত থাকে না, আমি ওদের চিনি, ওদের বাড়ি পশ্চিম আফ্রিকার গিনি কোনাক্রিতে। একটা সময় ছিল যখন আমি দেহের আকৃতি, গড়ন, মুখের আদল দেখেই মোটামুটি বলে দিতে পারতাম আফ্রিকার কোন দেশে কোন কালো মানুষটির বাড়ি। আফ্রিকা থেকে ফিরে এসেছি প্রায় এক দশক হতে চলেছে, সেই দক্ষতার ধারও এখন কমে গেছে।
মাথাপিছু গড় আয় আজ দুই হাজার ডলারের কিছু ওপরে হলেও, যখন আমি পশ্চিম আফ্রিকায় ছিলাম, ২০০৪ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত, ওদের মাথাপিছু গড় আয় ছিল মাত্র পাঁচশ ডলার। হতদরিদ্র এই দেশটির আয়তন কিন্তু বেশ বড়, ২ লক্ষ ছিচল্লিশ হাজার বর্গ কিলোমিটার। লোকের বাস মাত্র ১ কোটি ২৪ লক্ষ, জনসংখ্যার ৮৫ শতাংশই মুসলমান।
আমি এগিয়ে যাই, কিছু ছবি তুলি। জাতিসংঘ সদর দফতরের সামনের এই প্রশস্ত সড়কটিতে পৃথিবীর নানান দেশের, নানান সম্প্রদায়ের মানুষ রোজই কোনো না কোনো দাবী দাওয়া নিয়ে এসে হাজির হয়। জাতিসংঘের দিকে মুষ্ঠি ছুঁড়ে তারা তাদের দাবী দাওয়া জানাতে থাকে। এতে কোনো কাজ হয়ত হয় না, এই বোবা দালানের কানে খুব কমই পৌঁছে এইসব চিৎকার, তবে এই যে আমার মতো সাধারণ পথচারী যেতে যেতে থমকে দাঁড়ায়, স্লোগান শোনে, ছবি তোলে, সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করে, কেউ কেউ তার দেশের বা প্রবাসের কাগজে দুলাইন লেখে, এর নিশ্চয়ই কোনো ইতিবাচক প্রভাব আছে। এই ৪৭ নম্বর সড়কটিকে, যেটির অন্য নাম দ্যাগ হ্যামারশোল্ড প্লাজা, আমি বলি পৃথিবীর ট্রাফেল্গার স্কয়ার। লন্ডনের ট্রাফেল্গার স্কয়ার হচ্ছে সকল ব্রিটিশ আন্দোলনের তীর্থ, এখন অবশ্য বিশ্ববিবেক জাগিয়ে তুলতে অনেক আন্তর্জাতিক ইস্যু নিয়েও মানুষ ট্রাফেল্গার স্কয়ারে জড়ো হয়।
একজন কালো নারী তার বিশাল দেহ নিয়ে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। তিনি আমাকে বোঝাতে শুরু করেন কেন আলফা কন্ডের অনতিবিলম্বে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ানো উচিৎ। ২ অক্টোবর ১৯৫৮ সালে ফরাসিদের হটিয়ে রিপাবলিক অব গিনি স্বাধীন হয়। এই ৬১ বছরের ইতিহাসে আলফা কন্ডেই একমাত্র গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট। তাকেও কেন সরাতে চাইছে মানুষ? মেয়েটি বুঝতে পারেনি আমি ওর দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাস কিছুটা জানি। সে একটু সচেতন হয় এবং ইশারায় অন্য একজন পুরুষ কর্মীকে ডাকে। বুঝতে পারি পুরুষটিই এই আন্দোলনের প্রধান। লোকটি আমার দিকে হাত বাড়িয়ে করমর্দন করেন এবং নাম বলেন, আলফা ইসিয়াগা দিয়ালো। তিনি বেশ শুদ্ধ ইংরেজিতে আমাকে বোঝাতে চেষ্টা করেন, প্রেসিডেন্ট আলফা কন্ডে উন্মাদের মতো এথনিক ক্লিনজিং করছেন। তিনি ফুলানী সম্প্রদায়ের মানুষদের নির্বিচারে হত্যা করছেন কারণ ফুলানিরাই তার প্রধান প্রতিপক্ষ।
ফুলানি সাম্রাজ্য এক সময় গিনি শাসন করতো। পরে তারা পরাজিত হয়ে আইভরিকোস্টে চলে যায়। সেটা ১৬ শতকের কথা। আমি যেহেতু দীর্ঘদিন আইভরিকোস্টে ছিলাম, ফুলানি সম্প্রদায় সম্পর্কে সুস্পস্ট ধারণা আছে এবং এই সম্প্রদায়ের মানুষের প্রতি আমি সহানুভূতিশীল। লোকটি তার বিজনেস কার্ড বাড়িয়ে দেয়। আমি বলি, আপনাদের দেশ এবং ফুলানি সম্প্রদায় সম্পর্কে আমি জানি। এক সময় আমি পশ্চিম আফ্রিকায় ছিলাম। আপনাদের এই আন্দোলন নিয়ে আমি আমার ভাষার কাগজে লিখব। তিনি আমাকে অনুরোধ করেন লেখাটি ছাপা হলে আমি যেন লেখাটি তাকে ইমেইলে পাঠিয়ে দিই।
আটলান্টিকের গাল্ফ অব গিনির উপকূল জুড়ে গিনি নামের তিনটি দেশ আছে। সনাক্ত করার সুবিধার্থে এই তিন গিনিকে বলা হয় গিনি কোনাক্রি, গিনি বিসাউ এবং ইকুয়েটোরিয়াল গিনি। ইকুয়েটোরিয়াল গিনি হঠাৎ তেলের খনি পেয়ে এখন ধনি দেশ, মাথাপিছু আয় প্রায় পঞ্চাশ হাজার ডলার। সে দেশের মানুষের আমেরিকায় যেতে ভিসা লাগে না। আমেরিকা ওদেরকে ভিসা ফ্রি প্রবেশাধিকার দিয়েছে কারণ সে দেশের তেলের খনিগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পেয়েছেন আমেরিকা। তিন গিনির মধ্যে সবচেয়ে দরিদ্র দেশ গিনি বিসাউ। গিনি কোনাক্রিতে ২৪ টি এথনিক গ্রুপের মানুষ বাস করে। সবচেয়ে বেশি ফুলানি সম্প্রদায়ের লোক, ৪০%। একটি দেশের ৪০% মানুষকে মেরে এথনিক ক্লিনজিং করা অসম্ভব ব্যাপার।
দেশটির অর্থনীতি মূলত কৃষি নির্ভর হলেও গিনি কোনাক্রি পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম বক্সাইট উৎপাদনকারী দেশ। বক্সাইট হচ্ছে অ্যালুমুনিয়ামের কাঁচামাল, বক্সাইট থেকেই অ্যালুমুনিয়াম তৈরী করা হয়। এ ছাড়া দেশটিতে হীরা এবং সোনার মজুদ আছে বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে যদিও এখনো উত্তোলন শুরু হয়নি।
১৮৯৮ সালে গিনির রাজা সামুরি তুরেকে উৎখাত করে ফরাসিরা দেশটিকে তাদের উপনিবেশ বানায়। মাত্র ষাট বছর কলোনী শাসনের যাঁতাকলে ছিল গিনি। আহমেদ সেকু তুরের নেতৃত্বে ১৯৫৮ সালেই গিনি স্বাধীনতা লাভ করে। সেই থেকে আমৃত্যু ২৬ মার্চ ১৯৮৪ তারিখ পর্যন্ত, ২৬ বছর তিনিই ক্ষমতায় ছিলেন। ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করতে তিনি এক দলীয় শাসন ব্যবস্থা কায়েম করেন। তার দল "ডেমোক্রেটিক পার্টি অব গিনি-আফ্রিকান র্যালি (পিডিজি)" ছাড়া অন্য সব দল নিষিদ্ধ করে সংবিধান সংশোধন করেন। ফরাসী উপনিবেশ থেকে বেরিয়েই গিনি সমাজতান্ত্রিক ব্লকের দিকে ঝুঁকে পড়ে এবং একসময় সোভিয়েত ইউনিয়নের যোগ্য শিষ্য হয়ে ওঠে। এক দলীয় শাসন ব্যবস্থার বীজ ওখান থেকেই দেশে দেশে ছড়িয়েছে। তার মৃত্যুর পর প্রধানমন্ত্রী অস্থায়ী প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পেলেও কর্নেল লাসানা কন্টে এবং দিয়ারা ট্রাওরে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতা নিয়ে নেন। কন্টে প্রেসিডেন্ট এবং ট্রাওরে প্রধানমন্ত্রীর পদ দখল করেন।
১৯৯৫ সালে কন্টে নতুন রাজনৈতিক দল "পার্টি অব ইউনিটি অ্যান্ড প্রোগ্রেস" গঠন করে নির্বাচন করেন। প্রশ্নবিদ্ধ কারচুপির নির্বাচন করে তিনি তথাকথিত গণতান্ত্রিক প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় বসেন। আলফা কন্ডে তখন বিরোধী নেতা। তাকে আট মাস জেলে পুরে রাখেন প্রেসিডেন্ট কন্টে। আট মাস পর ছাড়া পেয়ে তিনি রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে ফ্রান্সে চলে যান। ২০০৮ এর ২৩ ডিসেম্বর মুসা দাদিস কামেরা ফের ক্যু করে ক্ষমতা দখল করেন। কিন্তু আন্তর্জাতিক চাপের মুখে তাকে দ্রুতই নির্বাচন দিতে হয়। ২০১০ সালে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহনে প্রথমবারের মতো একটি গ্রহনযোগ্য নির্বাচন হয় গিনিতে। সেই নির্বাচনে জয়লাভ করে আলফা কন্ডে প্রেসিডেন্ট হন। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে যা হয়, যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ। গিনির রাবণ এখন আলফা কন্ডে।
আন্দোলনকারীরা আমাকে জানান আলফা কন্ডে সংবিধান সংশোধন করে আমৃত্য প্রেসিডেন্ট থাকার চেষ্টা করছেন। যেহেতু আমি এই দেশটির রাজনৈতিক ডাইনামিক্স কিছুটা জানি তাই ওদের সকল অভিযোগই আমার কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি। তবে ক্ষমতা থেকে সরতে নারাজ আলফা, তাকে হঠাতে চলছে আন্দোলন। কোনাক্রির রাজপথে প্রতিদিনই মানুষ মরছে আলফার মিলিটেরিদের গুলিতে। আন্দোলনকারীরা এই হত্যাকাণ্ডকে গণহত্যা দাবী করছেন। আমি সংখ্যাটি জানতে চাইলে ওরা বলে ফুলানি সম্প্রদায়ের প্রায় তিন'শ মানুষ হত্যা করেছে আলফা কন্ডে।
হলিসউড, নিউইয়র্ক। ১৬ জানুয়ারি ২০২০।
Comments
Post a Comment