Skip to main content

চেষ্টা করলে কি আলোকিত মানুষ হওয়া যায়?

 আলোকিত মানুষ

 || কাজী জহিরুল ইসলাম || 



দুটি উৎস থেকে মানুষের মধ্যে আলো আসে। একটি অন্তর্গত আলো আর অন্যটি বাইরের উৎস থেকে আসা আলো। অধ্যয়ন এবং অভিজ্ঞতা থেকে যে আলো আসে সেটি বাইরের উৎস থেকে আসা আলো। এটি প্রতিফলিত আলো, চাঁদের আলোর মতো। চর্চায় একে বাঁচিয়ে রাখতে হয়। আপনি যখন ভালো ভালো বই পড়েন, আপনার হৃদয় ভালো চিন্তায় ও কাজে উদ্বুদ্ধ হয়। সেই ভালো চিন্তা ও কাজের চর্চা বন্ধ হয়ে গেলে বা ভালো বই পড়া ছেড়ে দিলে ক্রমশ আপনি আবার আলোহীন অবস্থায় ফিরে যাবেন। ভালো সঙ্গ, ভ্রমণ, বিভিন্ন পরিস্থিতির মোকাবেলা, পেশাগত ও সামাজিক দায়িত্ব পালন প্রভৃতির মধ্য দিয়েও আমাদের মধ্যে আলো আসে। সেই আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে আমাদের মনোজগতে ইতিবাচক পরিবর্তন সাধিত হয়, আমরা ভালো চিন্তা ও কাজে অনুপ্রাণিত হই। কিন্তু সেই ভালো চিন্তা ও কাজের চর্চা অব্যাহত না রাখলে, বা যেসব উৎস থেকে আলো এসেছে সেইসব উৎস বন্ধ হয়ে গেলে, আমরা ধীরে ধীরে আবার আলোহীন অবস্থায় ফিরে যাই। 

অন্য যে উৎস থেকে আলো আসে সেটি হচ্ছে ভেতরের আলো। এটি অনেকটা দেশলাইয়ের কাঠির মাথায় লেগে থাকা বারুদের মত। আছে কিন্তু জ্বলছে না। জ্বালানোর জন্য দরকার উপযুক্ত ঘষা। যেখানে সেখানে ঘষলে কি কাঠি জ্বলবে? জ্বলবে না। ঠিক জায়গায় ঘষা দিতে হবে। কাঠির মাথায় যে বারুদ তারও জ্বলে উঠবার জন্য প্রস্তুত হতে হবে। ড্যাম্প হয়ে যাওয়া বারুদকে রোদে দিয়ে জ্বলবার জন্য প্রস্তুত করে তুলতে হবে। এই প্রস্তুতির কাজটি এবং ঘষা বা ইগ্নিশনের কাজটি করে বাইরের আলো। অধ্যয়ন, ভ্রমণ, ভালো সঙ্গ, পেশাগত বা সামাজিক দায়িত্ব পালন, এমন যে কোনো ঘটনার মধ্য দিয়েই ইগ্নিশনের কাজটি ঘটে যেতে পারে। অর্থাৎ আমাদের ভেতরের আলোটি জ্বলে উঠতে পারে। এই ভেতরের আলোই হচ্ছে আধ্যাত্মিকতা। মানুষের মধ্যে যখন আধ্যাত্মিক জাগরণ ঘটে তখন তিনি আলোকিত মানুষ হয়ে ওঠেন। এই আলো সূর্যের মতো, জ্বলতেই থাকে। যতক্ষণ পর্যন্ত একজন মানুষের আধ্যাত্মিক জাগরণ না ঘটে ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি আলোকিত বা এনলাইটেন্ড মানুষ হয়ে ওঠেন না। আমি মনে করি কম/বেশি সকলের মধ্যেই সুপ্ত অবস্থায় আধ্যাত্মিক আলো আছে। কারোটা জ্বলে ওঠে, অধিকাংশেরটাই জ্বলে না।  

আমরা প্রায়শই বলি, অমুক একজন আলোকিত মানুষ। সত্যি কি তিনি আলোকিত মানুষ? আলোকিত মানুষ চেনার উপায় কি? যে মানুষ আধ্যাত্মিক জ্ঞানে প্রোজ্জ্বল তাঁর মধ্যে কিছু সুস্পষ্ট লক্ষণ দেখা যাবে। তিনি মিথ্যা বলবেন না, ব্যক্তিস্বার্থকে কখনোই সমষ্টিগত স্বার্থের চেয়ে বড় করে দেখবেন না। দুঃখ, কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা সাধারণের চেয়ে অনেক বেশি থাকবে, কাউকে আঘাত করবেন না, প্রত্যাঘাতও না। অন্যের কষ্টে কাঁদবেন, পৃথিবীর সকল মত ও পথের মানুষকে ভালোবাসতে পারবেন, মানুষের জন্য কিছু করার তাড়না তাঁকে তাড়িয়ে বেড়াবে। পৃথিবী থেকে নিতে নয় পৃথিবীকে দিতেই ব্যস্ত থাকবেন সারাক্ষণ। তাঁর সকল কাজের কেন্দ্রবিন্দু হবে মানবতা। যেহেতু প্রকৃতি নিজেই নির্বাচন করে কে হবেন আলোকিত মানুষ তাই নিজের অনেক রহস্য সে আলোকিত মানুষের কাছে মেলে ধরে, তাঁকে নিজের গুণাবলি দান করে। আলোকিত মানুষের সুরক্ষার দায়িত্ব প্রকৃতি নিজেই নেয়। আলোকিত মানুষ সেটি জানেন। আর জানেন বলেই নিজের সুরক্ষার জন্য কখনোই ব্যস্ত হয়ে পড়েন না।   

চেষ্টা করলে কি এমন মানুষ হওয়া যায়? উত্তর হচ্ছে, না। কেউ চাইলেই আলোকিত মানুষ হতে পারেন না। প্রকৃতি কারো কারো মধ্যে সেই বিশেষ আলো দিয়েই তাঁকে পৃথিবীতে পাঠায়। তবে চেষ্টা করলে আলোকিত মানুষের অনেক গুণাবলি একজন সাধারণ মানুষ অর্জন করতে পারেন। আমি আগেই বলেছি, কম/বেশি বারুদ সকলের মধ্যেই আছে, ঠিক জায়গায় ঠিক সময়ে ঘষা লাগলে সেই বারুদ জ্বলে উঠতেও তো পারে।

 

হলিসউড, নিউ ইয়র্ক। ২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯।  

Comments

Popular posts from this blog

শিল্পী কাজী রকিবের সাক্ষাৎকার

নন-একাডেমিক শিল্পীরাই নতুন কিছু দেয় -    কাজী রকিব  [কাজী রকিব বাংলাদেশের একজন গুণী শিল্পী। রাজশাহী আর্ট কলেজের একজন প্রতিষ্ঠাতা-শিক্ষক। কলেজের প্রথম ক্লাসটি নেবার কৃতিত্বও তাঁর। নিরন্তর ছবি আঁকেন। নানান মাধ্যমে ,  নানান ভাবনার ছবি। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে সস্ত্রীক বসবাস। তার স্ত্রী মাসুদা কাজীও একজন গুণী শিল্পী। বৈচিত্রপ্রিয় এই শিল্পীর একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন কবি কাজী জহিরুল ইসলাম। ধারাবাহিকভাবে তা এখানে প্রকাশ করা হবে। আজ উপস্থাপন করা হলো প্রথম পর্ব।]   জহিরুলঃ  বেশিরভাগ শিল্পীই নিজের একটা স্টাইল তৈরি করেন ,  নিজস্বতা যাকে আমরা বলি। আবার কেউ কেউ একই ধরণের ছবি বারবার আঁকেন। আপনার কাজে বৈচিত্র খুব বেশি ,  এতে করে "টাইপড" অপবাদ থেকে আপনি মুক্ত কিন্তু নিজের একটি স্টাইল তৈরি করতে না পারা বা তৈরি হয়নি বলে কি আক্ষেপ হয় ,  নাকি এই যে ভার্সেটিলিটি এটাই আপনি বেশি উপভোগ করেন ?    রকিবঃ   আমি আসলে আলাদা করে ভাবিনি এই স্টাইল বিষয়ে। কারো মতো আঁকারও চেষ্টা করিনি তেমন ভাবে। অল্প বয়সে ,  আমার ১৯ / ২০ বছর বয়সে ,  সালভাদর দালির মতো আঁকতে চেষ্টা করেছিলাম কিছুদিন ।

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জুর সাক্ষাৎকার || পর্ব ৭

মতিউর রহমান চৌধুরীকে  র‍্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কারের জন্য নমিনেট করেছিলেন  আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু       [লেখক, সাংবাদিক, অনুবাদক আনোয়ার হোসেইন মঞ্জুর সাক্ষাৎকারের সপ্তম  পর্ব আজ প্রকাশ করা হলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কবি কাজী জহিরুল ইসলাম।]          জহিরুলঃ  আপনার সাংবাদিকতা জীবনের প্রায় পুরোটাই ব্যয় করেছেন জাতীয় সংসদ কভার করে। এই সংসদে আমাদের সংবিধানের অনেকগুলো সংশোধনী পাশ হয়েছে। আমাদের নেতারা সব সময় বলেন, ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড় কিন্তু প্রকৃত চিত্র হচ্ছে দেশের চেয়ে দলের স্বার্থ বড় হয়ে ওঠে এবং দলের চেয়ে ব্যক্তির/পরিবারের স্বার্থই বেশি গুরুত্ব পায়। প্রধান প্রধান সংশোধনীগুলোর আলোকে যদি বিশ্লেষণ করেন কতোটা জাতীয় স্বার্থে আর কতটা ব্যক্তি বা পরিবারের স্বার্থে এইসব সংশোধনীগুলো করা হয়েছে।    মঞ্জুঃ   আপনি ঠিকই বলেছেন, এযাবত বাংলাদেশে ১১টি জাতীয় সংসদ গঠিত হয়েছে এবং এর মধ্যে দ্বিতীয় সংসদ থেকে নবম সংসদ পর্যন্ত মোট আটটি সংসদের অধিবেশন কভার করা সুযোগ হয়েছে আমার। আমার সংসদ কভারের সময়ে আমাদের সংবিধানের ১০টি সংশোধনী অনুমোদিত হয়েছে এবং সংশোধনী প্রক্রিয়া কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। এখন পর্যন্ত স

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জুর সাক্ষাৎকার - তৃতীয় পর্ব

মঞ্জু আমার ওপর রাগ করেছে                                                           - আল মাহমুদ [লেখক, সাংবাদিক, অনুবাদক আনোয়ার হোসেইন মঞ্জুর সাক্ষাৎকারের  তৃতীয় পর্ব আজ প্রকাশ করা হলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কবি কাজী জহিরুল ইসলাম।]  সাক্ষাৎকার নেবার এক পর্যায়ে আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু  ও কাজী জহিরুল ইসলাম। ওয়ান্টাগ পার্ক, নিউ ইয়র্ক।  ছবি তুলেছেন ড. মাহবুব হাসান।   জহিরুলঃ  খুশবন্ত সিং তার সকল বই অনুবাদ করার লিখিত অনুমতি দিলেন আপনাকে এবং সেই অনুমতিপত্রটি তিনি নিজ হাতে আপনার সামনেই বাংলায় লিখে দিলেন। তিনি কিভাবে বাংলা শিখলেন তা কি জানতে পেরেছিলেন ?  মঞ্জুঃ    জ্বি ,  ঘটনাটি  ঘটে  ১৯৯২ সালের ডিসেম্বর মাসে ,  এ সম্পর্কে আমি আগের এক প্রশ্নে বলেছি। তারিখটি আমার স্মরণে নেই। তবে বাবরি মসজিদ ধ্বংস করার পর ,  ডিসেম্বরের শেষ দিকে। না ,  বাংলায় নয় ,  উনি ইংরেজিতে লিখেছেন। আমার কফি পানের সময়ের মধ্যেই লিখে দিয়েছেন। ১৯৮৪ থেকে মাঝে দীর্ঘ বিরতি দিয়ে আমাকে তিনটি বা চারটি চিঠি লিখেছেন। লিখেছেন বলতে আমার চিঠির উত্তর দিয়েছেন। প্রতিটি চিঠি ইংরেজিতেই লিখেছেন। প্রতিটি চিঠিতে আমাকে সম্বোধন করেছেন  “ আনোয়ার ভাই ,”  বলে।