Skip to main content

দক্ষতার পাশাপাশি নৈতিকতাটাও দরকার

পেশাগত নৈতিকতা

|| কাজী জহিরুল ইসলাম || 


 
 

একজন বিচারপতির সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কথা বলার সুযোগ হয়েছিল। তিনি আমার এক প্রতিবেশীর ভগ্নীপতি। শ্যালকের বিবাহবার্ষিকীর দাওয়াতে এসেছিলেন। বিশাল লিভিংরুমের একমাত্র নীরব দর্শক ছিলেন তিনি। সকলের মুখে যখন রাজনীতি বিষয়ক মুখর আলোচনার খই ফুটছে তখন তিনি মুখে কুলুপ এঁটে চুপচাপ বসে আছেন। খুব যে মনোযোগ দিয়ে কথা শুনছেন তাও না। স্যুট-টাই পরা, কামানো মুখে ছোটো করে ছাটা গোঁফ, প্রায় ছয়ফুট উঁচু, মোটাসোটা এক জবরদস্ত ভদ্রলোক। তার এই অস্বাভাবিক নীরবতা আমাকে তার প্রতি আকৃষ্ট করে তোলে। আমি এগিয়ে যাই, পাশে বসি। হাত বাড়িয়ে করমর্দন করি এবং পরিচিত হই। পেশার কথা জানতে চাইলে তিনি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন। আমি যখন নিজের পরিচয় দিয়ে বলি, আমি একটি আন্তর্জাতিক সংস্থায় কাজ করি এবং দেশের বাইরে থাকি, এবং যখন দ্বিতীয়বারের মত তার কাজের কথা জানতে চাই তখন বলেন, তিনি একজন বিচারপতি। আমার অদম্য আগ্রহের কারণেই তার এই নীরবতা এবং পরিচয় দিতে না চাওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করেন। বিচারপতিদের কোড অব কন্ডাক্ট বোঝান। বিচারপতিরা মূলত বসবাস করেন সামাজিক জেলখানায়। সমাজে বাস করেও তারা অসামাজিক প্রাণী। বিয়ে, জন্মদিনের মতো সামাজিক কোনো দাওয়াতে আমি যাই না, একান্তই পরিবারের কিছু না হলে। আমি কখনো বাজারে যাইনি, সামাজিক-রাজনৈতিক কোনো অনুষ্ঠানের দাওয়াতে যাই না। কোনো সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে জড়িত হই না, সভা সমিতিতে যাই না। যতটা সম্ভব সমাজ থেকে দূরে থাকি। কারণ সমাজে মিশতে গেলেই কারো না কারো সঙ্গে সখ্য গড়ে উঠবে। যা আমার বিচারিক কার্যে প্রভাব ফেলতে পারে। 

আমি খুব আগ্রহ নিয়ে ভদ্রলোকের কথা শুনি। তিনি বলেন, দেশ বিভাগের আগে থেকেই বিচারকদের এই কোড অব কন্ডাক্ট মেনে চলতে হয়। আমি বিস্ময় প্রকাশ করে বলি, এখনো, মানে বাংলাদেশ সরকারের অধীনেও, কী এই কোড অব কন্ডাক্ট বিচারকদের জন্য প্রযোজ্য? মানে এটা কী মানতেই হয়, না কালচারে পরিণত হয়েছে? তিনি বলেন, এই কোড অব কন্ডাক্ট এখনো বহাল আছে এবং তা অবশ্যই মানতে হয়। আমি জানি আপনি কেন এই প্রশ্ন করেছেন, কারণ অনেকেই তা মানছেন না। আমি মানি, একশতভাগ মেনে চলি। আমি একটি জেলা আদালতের বিচারপতি। জেলা শহরে মোটামুটি সবাই সবাইকে চেনেন, আমি যদি বাজারে যাই, মাছের দোকানী জজ সাহেবকে খাতির করতে চাইবে, সামাজিক অনুষ্ঠানে গেলে আমাকে উঁচু আসনে বসতে দেবে, এইসব সুবিধা যদি আমি নেই, তারা তদবীর নিয়ে আমার কাছে আসতে থাকবে। সুবিধা নেবার কারণে তাদেরকে বিচারিক সুবিধা দিতে হবে, মানে আমার রায় হবে পক্ষপাতদুষ্ট।

আমি ভদ্রলোকের কথা শুনতে শুনতে ভাবছিলাম একজন বিচারকের পক্ষপাতমূলক রায়ে সমাজের কী ক্ষতি হতে পারে। একটি রায় একজন মানুষের জীবনাবসান ঘটাতে পারে, আবার একজন মানুষকে নতুন জীবন দিতে পারে। এর প্রভাব যে শুধু আসামীর ওপর পরে তা-ই নয়, এই রায় একটি সম্ভাবনাময় পরিবারকে ধ্বংস করে দিতে পারে, আবার সঠিক রায়ের ফলে যখন একজন নির্দোষ মানুষ মুক্তিলাভ করে তখন অথৈ সমুদ্রে ডুবতে থাকা একটি পরিবার কূলের সন্ধান পেতে পারে। 

এই গল্প থেকে দুটি জিনিস নিই। জেলা শহর, মানে যেখানে অপেক্ষাকৃত কম মানুষ বসবাস করার ফলে সকলেই সকলকে চেনেন। অন্যটি হচ্ছে কোড অব কন্ডাক্ট বা আচরণবিধি, এক্ষেত্রে এথিকস বা নৈতিকতা। সমাজের সকল ক্ষেত্রেই নৈতিকতার উপস্থিতি কাম্য। কিছু কিছু পেশা আছে যেখানে নৈতিকতা অত্যাবশ্যক। বিচারপতির পেশায় নৈতিকতার ব্যত্যয় একটি ভয়ঙ্কর সমাজের জন্ম দেয় তা আমরা খুব সহজেই বুঝতে পারি। চিকিৎসা-সেবা বা খাদ্য-ব্যবসায়ের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের অনৈতিক কর্মকান্ড সরাসরি সমাজের ক্ষতি করে। মানুষের তাৎক্ষণিক মৃত্যুর কারণ হয়েও দাঁড়ায়। 

সাংবাদিকতা পেশায় নৈতিকতা কতখানি গুরুত্বপূর্ণ তা একটু আলোচনা করি। একটি তো হচ্ছে অসৎ সাংবাদিকতা, কলমের ভয় দেখিয়ে সুযোগ-সুবিধা আদায় করা বা অনৈতিক খবর চেপে যাওয়া, এটি চরম পর্যায়ের অনৈতিকতা বা দুর্নীতি। আরেকটি হচ্ছে ব্যক্তিগত ইচ্ছা-নিচ্ছা, পছন্দ-অপছন্দের প্রতিফলন। এটি মফস্বল সাংবাদিকতায় বেশি দেখা যায়। এর দুটি কারণ। প্রথমত মফস্বল সাংবাদিকেরা যথাযথভাবে প্রশিক্ষিত নন, তারা জানেনই না, সাংবাদিকতায় এথিকস কতখানি গুরুত্বপূর্ণ। দ্বিতীয় কারণটি হচ্ছে সাংবাদিকদের সমাজ-সম্পৃক্ততা। একটি জাতীয় দৈনিক বা ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার জেলা প্রতিনিধিকে আমরা সকল সামাজিক-রাজনৈতিক অনুষ্ঠানের মধ্যমনি হয়ে বসে থাকতে দেখি। তিনি অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন এবং সেই বক্তৃতার সংবাদে নিজের কথাই লেখেন। মফস্বলের অনেক গুণী মানুষের গুণের কথা জাতীয় মাধ্যমে উঠে আসে না মফস্বল সাংবাদিকের ব্যক্তিগত অপছন্দের কারণে আবার অনেক নির্গুণের খবর ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে লেখা হয় বা দেখানো হয় মফস্বল সাংবাদিকের সাথে সখ্য থাকার কারণে। 

সাংবাদিকও একজন মানুষ, তার ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ থাকতেই পারে, তিনি সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশ নিতেই পারেন কিন্তু তার সমাজ সম্পৃক্ততা পেশায় যেন প্রভাব না ফেলে এটি খুব সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনা করতে হয়। এই বিবেচনাবোধ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অনুপস্থিত। বিবেচনার প্রতিফলন নানানভাবে ঘটানো যেতে পারে, কে তা কীভাবে করবেন তা তিনি নিজেই ঠিক করে নেবেন। দেশের বাইরে, লন্ডন, নিউ ইয়র্ক, টরন্টো, লস এঞ্জেলেস, সিডনি বা অকল্যান্ড, যেখানেই উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাঙালি অভিবাসী রয়েছে সেখানেই কিছু কিছু প্রিন্ট বা ইলেকট্রনিক মিডিয়া গড়ে উঠছে, সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে উঠছে। এটি খুবই আশার কথা। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির চর্চাকে এই মিডিয়াগুলো, সংগঠনগুলো দেশের বাইরে বাঁচিয়ে রেখেছে। কিন্তু অপেক্ষাকৃত কম সংখ্যক বাঙালি বসবাস করার ফলে প্রবাসের বাঙালি কম্যুনিটিগুলোও বাঙালিদের মফস্বল শহর হয়ে উঠেছে এবং এখানেও সাংবাদিকতার পেশাদারিত্ব ছাপিয়ে ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের সাংবাদিকতাই তৈরী হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে প্রবাসের এইসব মিডিয়াগুলো বা সংগঠনগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শেষ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠে না, হয়ে ওঠে একেকটি দোকান। সম্প্রতি বাংলাদেশের কিছু জাতীয় দৈনিকও প্রবাসে এসেছে এবং আরও অনেকেই আসছে বলে শুনেছি। এই কাগজগুলো যেহেতু প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিত্ব করছে এদের কাছ থেকে পেশাদারিত্ব আশা করাটা অমূলক হবে না কিন্তু প্রকৃত চিত্র হচ্ছে, যতই দিন যাচ্ছে ততই এদের মফস্বল সাংবাদিকতার চেহারাটিই স্পস্ট হয়ে উঠছে।

বিচারপতির, অষুধ ব্যবসায়ীর বা স্বাস্থসেবা প্রদানকারীর অনৈতিকতার ফল আমরা সরাসরি ভোগ করি বলে খুব সহজেই চোখে পড়ে, কিন্তু সাংবাদিকের অনৈতিকতার ফল সরাসরি ভোগ করি না বলে এটা আমাদের চোখে তেমন পড়ে না। আমরা ও কিছু নয় বলে উড়িয়ে দিই। দীর্ঘমেয়াদে অসৎ এবং অনৈতিক সাংবাদিকতা একটি সমাজের অনেক বড় ক্ষতি করে। সমাজ থেকে, রাষ্ট্রব্যাবস্থা থেকে, জবাবদিহিতা উঠে যায়, দুর্নীতি বাড়তে থাকে, মূর্খদের উত্থান ঘটে, সততা তিরোহিত হয়।

 

নিউ ইয়র্ক। ১৬ মে ২০১৯। 

Comments

Popular posts from this blog

শিল্পী কাজী রকিবের সাক্ষাৎকার

নন-একাডেমিক শিল্পীরাই নতুন কিছু দেয় -    কাজী রকিব  [কাজী রকিব বাংলাদেশের একজন গুণী শিল্পী। রাজশাহী আর্ট কলেজের একজন প্রতিষ্ঠাতা-শিক্ষক। কলেজের প্রথম ক্লাসটি নেবার কৃতিত্বও তাঁর। নিরন্তর ছবি আঁকেন। নানান মাধ্যমে ,  নানান ভাবনার ছবি। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে সস্ত্রীক বসবাস। তার স্ত্রী মাসুদা কাজীও একজন গুণী শিল্পী। বৈচিত্রপ্রিয় এই শিল্পীর একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন কবি কাজী জহিরুল ইসলাম। ধারাবাহিকভাবে তা এখানে প্রকাশ করা হবে। আজ উপস্থাপন করা হলো প্রথম পর্ব।]   জহিরুলঃ  বেশিরভাগ শিল্পীই নিজের একটা স্টাইল তৈরি করেন ,  নিজস্বতা যাকে আমরা বলি। আবার কেউ কেউ একই ধরণের ছবি বারবার আঁকেন। আপনার কাজে বৈচিত্র খুব বেশি ,  এতে করে "টাইপড" অপবাদ থেকে আপনি মুক্ত কিন্তু নিজের একটি স্টাইল তৈরি করতে না পারা বা তৈরি হয়নি বলে কি আক্ষেপ হয় ,  নাকি এই যে ভার্সেটিলিটি এটাই আপনি বেশি উপভোগ করেন ?    রকিবঃ   আমি আসলে আলাদা করে ভাবিনি এই স্টাইল বিষয়ে। কারো মতো আঁকারও চেষ্টা করিনি তেমন ভাবে। অল্প বয়সে ,  আমার ১৯ / ২০ বছর বয়সে ,  সালভাদর দালির মতো আঁকতে চেষ্টা করেছিলাম কিছুদিন ।

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জুর সাক্ষাৎকার || পর্ব ৭

মতিউর রহমান চৌধুরীকে  র‍্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কারের জন্য নমিনেট করেছিলেন  আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু       [লেখক, সাংবাদিক, অনুবাদক আনোয়ার হোসেইন মঞ্জুর সাক্ষাৎকারের সপ্তম  পর্ব আজ প্রকাশ করা হলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কবি কাজী জহিরুল ইসলাম।]          জহিরুলঃ  আপনার সাংবাদিকতা জীবনের প্রায় পুরোটাই ব্যয় করেছেন জাতীয় সংসদ কভার করে। এই সংসদে আমাদের সংবিধানের অনেকগুলো সংশোধনী পাশ হয়েছে। আমাদের নেতারা সব সময় বলেন, ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড় কিন্তু প্রকৃত চিত্র হচ্ছে দেশের চেয়ে দলের স্বার্থ বড় হয়ে ওঠে এবং দলের চেয়ে ব্যক্তির/পরিবারের স্বার্থই বেশি গুরুত্ব পায়। প্রধান প্রধান সংশোধনীগুলোর আলোকে যদি বিশ্লেষণ করেন কতোটা জাতীয় স্বার্থে আর কতটা ব্যক্তি বা পরিবারের স্বার্থে এইসব সংশোধনীগুলো করা হয়েছে।    মঞ্জুঃ   আপনি ঠিকই বলেছেন, এযাবত বাংলাদেশে ১১টি জাতীয় সংসদ গঠিত হয়েছে এবং এর মধ্যে দ্বিতীয় সংসদ থেকে নবম সংসদ পর্যন্ত মোট আটটি সংসদের অধিবেশন কভার করা সুযোগ হয়েছে আমার। আমার সংসদ কভারের সময়ে আমাদের সংবিধানের ১০টি সংশোধনী অনুমোদিত হয়েছে এবং সংশোধনী প্রক্রিয়া কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। এখন পর্যন্ত স

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জুর সাক্ষাৎকার - তৃতীয় পর্ব

মঞ্জু আমার ওপর রাগ করেছে                                                           - আল মাহমুদ [লেখক, সাংবাদিক, অনুবাদক আনোয়ার হোসেইন মঞ্জুর সাক্ষাৎকারের  তৃতীয় পর্ব আজ প্রকাশ করা হলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কবি কাজী জহিরুল ইসলাম।]  সাক্ষাৎকার নেবার এক পর্যায়ে আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু  ও কাজী জহিরুল ইসলাম। ওয়ান্টাগ পার্ক, নিউ ইয়র্ক।  ছবি তুলেছেন ড. মাহবুব হাসান।   জহিরুলঃ  খুশবন্ত সিং তার সকল বই অনুবাদ করার লিখিত অনুমতি দিলেন আপনাকে এবং সেই অনুমতিপত্রটি তিনি নিজ হাতে আপনার সামনেই বাংলায় লিখে দিলেন। তিনি কিভাবে বাংলা শিখলেন তা কি জানতে পেরেছিলেন ?  মঞ্জুঃ    জ্বি ,  ঘটনাটি  ঘটে  ১৯৯২ সালের ডিসেম্বর মাসে ,  এ সম্পর্কে আমি আগের এক প্রশ্নে বলেছি। তারিখটি আমার স্মরণে নেই। তবে বাবরি মসজিদ ধ্বংস করার পর ,  ডিসেম্বরের শেষ দিকে। না ,  বাংলায় নয় ,  উনি ইংরেজিতে লিখেছেন। আমার কফি পানের সময়ের মধ্যেই লিখে দিয়েছেন। ১৯৮৪ থেকে মাঝে দীর্ঘ বিরতি দিয়ে আমাকে তিনটি বা চারটি চিঠি লিখেছেন। লিখেছেন বলতে আমার চিঠির উত্তর দিয়েছেন। প্রতিটি চিঠি ইংরেজিতেই লিখেছেন। প্রতিটি চিঠিতে আমাকে সম্বোধন করেছেন  “ আনোয়ার ভাই ,”  বলে।