Skip to main content

আরবি শব্দ মু'আইনা থেকে ময়না তদন্ত এসেছে

 বই ব্যবচ্ছেদ

|| কাজী জহিরুল ইসলাম ||  


মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মূলধারার সরকারী পাঠাগারের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রচুর বুক ক্লাব গড়ে উঠেছে। অন্য দেশেও এমন অনেক বুক ক্লাব আছে। বুক ক্লাবগুলো সাধারণত পাঠাগার ভিত্তিকই হয়। কিছু উৎসাহী পাঠক একসাথে হয়ে তাদের পছন্দের বই পড়ে এবং একত্রিত হয়ে নিজেদের পাঠ প্রতিক্রিয়া/অভিজ্ঞতা শেয়ার করে যাতে করে বইটি সম্পর্কে আরো ভালো করে জানা যায়। এতে মননশীলতার একটি নিবিড় চর্চা হয়। মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক বোধ জাগ্রত হয়, মানুষ ক্রমশ অধিক ইতিবাচক ও মানবিক হয়ে ওঠে।
 

আমেরিকায় বাঙালিদের সবচেয়ে বড় বসতি জ্যাক্সন হাইটসে। এর পরেই সম্ভবত জ্যামাইকায়। দুটো পাড়াই নিউ ইয়র্কে। মার্কিনিরা বই পড়ার ক্ষেত্রে খুব উৎসাহ দেয়। ছোটো ছোটো পাড়ায়, মহল্লায়ও রয়েছে সরকারী পাঠাগার। কুইন্সে মোট ৬২টি পাঠাগার আছে, নিউ ইয়র্ক শহরে আছে ১৪৩টি। পুরো আমেরিকাতে সরকারী পাঠাগার আছে ১ লক্ষ ১৬ হাজার ৮৬৭টি। বাঙালি অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে যেসব পাঠাগার আছে সেগুলোতে আজকাল বেশ বাংলা বইও চোখে পড়ে। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের, দুজায়গার লেখকদের বইই দেখা যায়, তবে পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের বাংলা বইই বেশি। প্রতিটি পাঠাগারকে কেন্দ্র করেই বুক ক্লাব গড়ে উঠলেও শুধুমাত্র বাংলা বইয়ের বুক ক্লাব গড়ে উঠেছে, এমন কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কুইন্স লাইব্রেরির হলিস শাখার পৃষ্ঠপোষতায় আমি, আমার স্ত্রী মুক্তি এবং আমাদের প্রতিবেশী, গল্পকার রাজিয়া নাজমী, এই তিনজন মিলে একটি বাংলা বইয়ের বুক ক্লাব গড়ে তুলি, যার নাম দেই পাঠকের পাতা। এজন্য আমরা অবশ্যই হলিশ শাখার ব্যাবস্থাপক লেখক আব্দুল্লাহ জাহিদের প্রতি কৃতজ্ঞ। তিনিও এই বুক ক্লাবের একজন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। আমরা প্রতি মাসে একটি ভালো বাংলা বই নির্বাচন করি, লাইব্রেরিতে যদি সেই বইটি থাকে আমরা তা সংগ্রহ করে পাঠ করি, যদি না থাকে লাইব্রেরি কর্তৃপক্ষ তা সংগ্রহ করে আমাদের পড়তে দেন। মাসে একদিন আমরা আড়াই ঘন্টার জন্য লাইব্রেরিতে মিলিত হই, বইটি নিয়ে আলোচনা করি। ধীরে ধীরে আমাদের সদস্য সংখ্যা বাড়ছে, এপ্রিল মাসের আলোচনায় উপস্থিতির সংখ্যা ছিল প্রায় অর্ধশত। আমাদের মধ্যে যেহেতু অনেক লেখক/কবি আছেন, আমরা বই আলোচনার পাশাপাশি নিজেদের কবিতা পাঠ এবং বিখ্যাত কবিদের কবিতা আবৃতির আয়োজনও করে থাকি। বই আলোচনা-পর্বটির আমরা একটি নাম দিয়েছি, বই ব্যবচ্ছেদ। সদস্যদের মধ্যে নয়, শুভানুধ্যায়ীদের মধ্যে কেউ কেউ ব্যবচ্ছেদ শব্দটি নিয়ে আপত্তি তুলেছেন। তারা মনে করেন ব্যবচ্ছেদ কেবল মৃতদেহেরই হয়। তাই এই শব্দটির সঙ্গে নির্মমতা জড়িত। প্রয়োগের কারণে একটি শব্দ মানুষের আবেগকে নানানভাবে স্পর্শ করে। যখন বলি, লোকটি ভয়ঙ্কর খুনি, তখন সবাই সাবধান হয়ে যাই, লোকটির কাছ থেকে দূরে থাকি। আবার যদি বলি, মেয়েটি ভয়ঙ্কর সুন্দরী, তখন আমরা দ্রুত আগ্রহ নিয়ে দেখার চেষ্টা করি মেয়েটিকে। আমরা যেহেতু নিজেদের সৃজনশীল লেখক মনে করি তাই শব্দ নিয়ে খেলতে পছন্দ করি। ব্যবচ্ছেদ শব্দটিকে তাই মর্গ থেকে অনায়াসেই তুলে এনে বসিয়ে দিতে পারি গ্রন্থশালায়। শব্দ তো আসলে নির্দোষ। এখন কথা হচ্ছে আমি/আপনি কী ধরণের যোগাযোগের জন্য শব্দটি ব্যবহার করছি।

ব্যবচ্ছেদ শব্দের আভিধানিক অর্থ তো বিশ্লেষণ। আমরা যেহেতু একটি গ্রন্থের চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে চাই তাই এই শব্দটিকেই আমাদের কাছে যথার্থ মনে হয়েছে। আর বই ব্যবচ্ছেদ এই শব্দযুগলের মধ্যে যে অনুপ্রাস আছে সেই দ্যোতনাকেই বা অগ্রাহ্য করি কোন মূর্খতায়। 

ইংরেজি পোস্টমর্টেম এর বাংলা হচ্ছে ময়নাতদন্ত। অভিধানে ব্যবচ্ছেদের অর্থ খুঁজতে গেলে এই শব্দটির সাথে সম্পৃক্ততাও খুঁজে পাবেন। যেহেতু ময়নাতদন্তের জন্য (মৃত্যুর কারণ উদ্ঘাটনের জন্য) মৃতদেহকে কাটাছেঁড়া করা হয়, বিশ্লেষণ করা হয়, তাই ব্যবচ্ছেদ শব্দটি এক্ষেত্রে বহুল ব্যবহৃত। দেখুন, ময়না পাখির মত একটি মিষ্টি পাখির নাম মৃতদেহ কাটাছেঁড়ার সঙ্গে জুড়ে দেয়া হয়েছে। তাই বলে কি ময়না পাখির আদর কমে গেল? অনেকে মনে করেন, ময়না পাখির নাম থেকেই ময়নাতদন্ত শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে। কালো রঙের এই পাখিটি অন্ধকারে বসে থাকলে কেউ তাকে খুঁজে পায় না কিন্তু তার বহুরূপি কন্ঠের শব্দ শুনে অভিজ্ঞ মানুষ বুঝতে পারে সে কোথায় আছে। ময়নাতদন্তের ফলে খুনের বা মৃত্যুর কারণ অন্ধকারে ময়নাপাখির অবস্থান খুঁজে পাবার মতোই। তাই একে ময়নাতদন্ত বলা হয়। অবশ্য ভিন্ন একটি মতও আছে, আমার কাছে সেটিই অধিক গ্রহনযোগ্য মনে হয়। আরবী মুআইনা শব্দ থেক এসেছে ময়না। মুআইনা শব্দের অর্থ প্রত্যক্ষভাবে বা পরিষ্কারভাবে। অর্থগত দিক থেকে ময়নাতদন্তের সাথে এই শব্দটির সামঞ্জস্য আছে বলে এটিকেই অধিক গ্রহণযোগ্য মনে হয়।

আরবী মুআইনা থেকেও যদি শব্দটি এসে থাকে আমরা যেহেতু বলছি ময়নাতদন্ত, চোখের সামনে তো ময়না পাখিই ভেসে ওঠে। কিন্তু যখন একটি ময়না পাখি কোনো নির্জন পাহাড়ে, সবুজ বৃক্ষের ডালে বলে শিস দিয়ে ডাকে তখন আমাদের হৃদয়ে পাখি ও প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসাই জেগে ওঠে, কোনো মৃত্যু বা খুনের দৃশ্য ভেসে ওঠে না। ঠিক তেমনি পাঠকের পাতার ব্যানারে যখন দেখি বই ব্যবচ্ছেদ তখন আমাদের চোখের সামনে একটি গ্রন্থই নিজেকে পুরোপুরি মেলে ধরে, তেমন একটি গ্রন্থ যা অনন্ত যৌবনা, আর কিছু নয়।

 

হলিসউড, নিউ ইয়র্ক। ৯ মে ২০১৯

Comments

Popular posts from this blog

অসাধারণ এই শিল্পীর জীবনের গল্প বড় করুণ

  [এই সময়ের অত্যন্ত প্রতিভাবান শিল্পী সারফুদ্দিন আহমেদ। বাড়ি পশ্চিমবঙ্গে। আর্ট কলেজে খণ্ডকালীন শিক্ষকতা করেন ,  আর শুধু ছবি আঁকেন। নানান মাধ্যমে ,  নানান বিষয়ের ছবি। সারফুদ্দিন আহমেদের ছবি থেকে চোখ ফেরানো যায় না ,  আপনাতেই ওঁর নান্দনিক সৃষ্টিকর্মে দৃষ্টি আটকে যায় ,  কী জল রঙ ,  কী অ্যাক্রিলিক ,  কিংবা স্রেফ পেন্সিলের ড্রয়িং। এই গুণী শিল্পীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কবি কাজী জহিরুল ইসলাম। সাক্ষাৎকারটি এখানে উপস্থাপন করা হলো।]       ভারত আমাকে চোখ দিয়েছে ,  বাংলাদেশ দিয়েছে দৃষ্টি -     সারফুদ্দিন আহমেদ     কাজী জহিরুল ইসলামঃ  ব্যাক গ্রাউন্ডে তবলা বাজছে আপনি ছবি আঁকছেন কাচের ওপর।    এই যে বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে ছবি আঁকা, এই ছন্দটা ছবিতে কিভাবে ধরেন? আর কোনো শিল্পী ছবি  আঁ কার সময় যন্ত্রানুসঙ্গ ব্যবহার করেছেন?   সারফুদ্দিন আহমেদঃ   কাঁচ নয়,   এটি এক বিশেষ ধরনের কাপড়-নেট। এই নেটের উপরে বর্তমানে আমার এক্সপেরিমেন্ট চলছে।    জহিরুলঃ ও ,  ফেইসবুকে যখন ছবিটি দেখি কাচের মতো ...

কাজী জহিরুল ইসলামের কবিতা || আবুল কাইয়ুম

কাজী জহিরুল ইসলামের কবিতা: জাতীয়-বৈশ্বিক মেলবন্ধন   || আবুল কাইয়ুম ||    কবি যদি হন বিশ্বপরিব্রাজক ,  তবে তিনি তো কবিতায় আঁকবেন তাঁর দেখা দুনিয়ার ছবি। বৃহত্ত্বকে আশ্লেষ করার পরিণামে স্বাভাবিকভাবে তাঁর মধ্যে জন্ম নেবে মানবিক মহত্ত্ববোধ ,  তা যে কাব্যাদর্শের লাঠিতে ভর করেই হোক। আশির দশক থেকে ক্রমবিকশিত কবি কাজী জহিরুল ইসলামের ক্ষেত্রেও একথা সত্যি । পর্যাপ্ত বিশ্বভ্রমণের অভিজ্ঞতায় আলোকিত হয়েছেন বলেই তিনি যে কোনো সঙ্কীর্ণতার উর্ধ্বে থেকে নিজেকে উদারনৈতিক মানবিক চৈতন্যে সংগঠিত করতে পেরেছেন ,  বিশ্বমানবতা ও বিশ্বশান্তির মন্ত্রে উজ্জীবিত রেখেছেন। তাঁর ব্যক্তিত্বে জড়ো হয়েছে বৃহত্তর সমষ্টিচেতনা ,  তাঁর প্রেম ও প্রার্থনা মানব কল্যাণের আশ্রয়ে গড়ে উঠেছে। তার লেখনীতে নানা দেশের মানুষের জীবন ,  সংস্কৃতি ,  প্রেম ,  ত্যাগ ও সংগ্রামের চালচিত্র কীভাবে উঠে এসেছে তা তাঁর কবিতার সংস্পর্শে না এলে বোঝা যাবে না। তাঁর  ‘ এল সালভাদর ’  শীর্ষক কবিতার কথাই ধরা যাক। এই অত্যুজ্জ্বল কবিতার মাত্র কয়টি বিস্ময়কর পংক্তিই শুধু এখানে তুলে ধরছি-    হণ্ডু...

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জুর সাক্ষাৎকার || পর্ব ৭

মতিউর রহমান চৌধুরীকে  র‍্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কারের জন্য নমিনেট করেছিলেন  আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু       [লেখক, সাংবাদিক, অনুবাদক আনোয়ার হোসেইন মঞ্জুর সাক্ষাৎকারের সপ্তম  পর্ব আজ প্রকাশ করা হলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কবি কাজী জহিরুল ইসলাম।]          জহিরুলঃ  আপনার সাংবাদিকতা জীবনের প্রায় পুরোটাই ব্যয় করেছেন জাতীয় সংসদ কভার করে। এই সংসদে আমাদের সংবিধানের অনেকগুলো সংশোধনী পাশ হয়েছে। আমাদের নেতারা সব সময় বলেন, ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড় কিন্তু প্রকৃত চিত্র হচ্ছে দেশের চেয়ে দলের স্বার্থ বড় হয়ে ওঠে এবং দলের চেয়ে ব্যক্তির/পরিবারের স্বার্থই বেশি গুরুত্ব পায়। প্রধান প্রধান সংশোধনীগুলোর আলোকে যদি বিশ্লেষণ করেন কতোটা জাতীয় স্বার্থে আর কতটা ব্যক্তি বা পরিবারের স্বার্থে এইসব সংশোধনীগুলো করা হয়েছে।    মঞ্জুঃ   আপনি ঠিকই বলেছেন, এযাবত বাংলাদেশে ১১টি জাতীয় সংসদ গঠিত হয়েছে এবং এর মধ্যে দ্বিতীয় সংসদ থেকে নবম সংসদ পর্যন্ত মোট আটটি সংসদের অধিবেশন কভার করা সুযোগ হয়েছে আমার। আমার সংসদ কভারের সময়ে আমাদের সংবিধানের ১০টি সংশোধনী অনুমো...