Skip to main content

মেধা সম্মান না পেলে সমাজ পিছিয়ে পড়ে

 সম্মানের ভিত্তি কী হওয়া উচিৎ 

|| কাজী জহিরুল ইসলাম || 

 


আমরা মানুষকে সম্মান করি, শ্রদ্ধা করি, যেসব কারণে তা হচ্ছে জ্যেষ্ঠতা, পদমর্যাদা, বংশমর্যাদা, মেধা, বিত্ত। আমার এক সহকর্মীর নাম রাজাফিমাহারো, বাড়ি মাদাগাস্কার। চাচার শেষকৃত্যানুষ্ঠানে যাচ্ছে, তখন ওর সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা হয়। তখন জানতে পারি মাদাগাস্কারের মানুষ বয়োজ্যেষ্ঠদের সবচেয়ে বেশি সম্মান করে। সম্মানের প্রধান ভিত্তিই হচ্ছে জ্যেষ্ঠতা। কারণ যিনি বড় তিনি মৃত্যুর কাছাকাছি আছেন, মৃত্যুই হচ্ছে সবচেয়ে সম্মানিত অবস্থান। মালাগাছিরা মৃতের সমাধিমন্দির নির্মাণ করে প্রচুর অর্থ ব্যয় করে। এইসব সমাধিমন্দিরের নাম তানিন্দ্রাজানা। আফ্রিকার আরো অনেক দেশের মানুষ জ্যেষ্ঠতাকে সম্মানের প্রধান ভিত্তি হিসেবে মানে। অবশ্য পদমর্যাদা এবং বিত্তকেও আফ্রিকার মানুষ সম্মানের ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করে। কোরিয়ার লোকেরা জ্যেষ্ঠদের খুব সম্মান করে, জাপান আস্তে আস্তে এই জায়গাটি থেকে বেরিয়ে আসছে, চীন প্রায় বেরিয়ে এসেছে। তারা এখন সম্মানের প্রধান ভিত্তি করেছে মেধা। ইওরোপ এবং আমেরিকার মানুষ বয়সকে পুরোপুরি বুড়ো আঙুল দেখিয়ে মেধাকেই সম্মানের প্রধান ভিত্তি হিসেবে মেনে নিয়েছে। আমেরিকায় আবার মেধা বিবেচিত হয় আয়ের ভিত্তিতে। এটাও সত্যি যে আমেরিকায় মেধাবীরাই বেশি আয় করে। বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বিবেচিত হয় পেশিশক্তি,পদমর্যাদা, বংশমর্যাদা, বিত্ত, এর পরে বয়স এবং সবশেষে মেধা। ভারত উপমহাদেশের প্রায় সব দেশেই এই চিত্র। এখন তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে দেখা যেতে পারে মেধাকে সম্মানের ভিত্তি হিসেবে যেসব দেশ প্রাধান্য দেয় তাদের অর্থনীতি এবং মানবকল্যানের সূচক কোথায় এবং যেসব দেশ বয়স, পদমর্যাদা, বিত্তকে সম্মানের ভিত্তি হিসেবে প্রাধান্য দেয় তাদের সূচক কোথায়। খুব স্পষ্টত আমরা দেখি যারা মেধাকে সর্বোচ্চ সম্মানের আসনে বসিয়েছে তারাই উন্নয়নের সূচকে সবদিক থেকে এগিয়ে আছে। যেমন পশ্চিম ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি অঞ্চল। পশ্চিম ইউরোপের গড় মাথাপিছু আয় প্রায় ৭০ হাজার ডলার। সবচেয়ে বেশি আয়ের দেশ লুক্সেমম্বার্গ, যার নাগরিকদের মাথাপিছু গড় আয় ১ লক্ষ সাড়ে ১২ হাজার ডলার। পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম মাথাপিছু গড় আয় ইটালির, ৪১ হাজার ডলার। পুরো ইউরোপের সবচেয়ে দরিদ্র দেশ মলদোভা, সে দেশের মাথাপিছু গড় আয় সাড়ে সাত হাজার ডলার, যা এশিয়া এবং আফ্রিকার অনেক দেশের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। এখানে উল্লেখ করা দরকার যে বাংলাদেশের মাথাপিছু গড় আয় মাত্র ১,৩১৬ ডলার। পৃথিবীতে কি এমন কোনো দেশ আছে যে দেশে জেলখানা নেই? উত্তর হচ্ছে, হ্যাঁ আছে, সেই দেশের নাম নেদারল্যান্ড। সেটি পশ্চিম ইওরোপে অবস্থিত। কেন সে দেশে জেলখানা নেই? কারণ, জেলে বন্দী করার মতো অপরাধী সে দেশে নেই। পৃথিবীর সবচেয়ে বাসযোগ্য শহর কোনটি? উত্তর হচ্ছে, অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনা, যেটি পশ্চিম ইউরোপে অবস্থিত। দেখা যাচ্ছে যারা মেধাকে সবচেয়ে বেশি মূল্য দেয় তারাই সবদিক থেকে এগিয়ে আছে।  

যে জাতি মেধাকে, মেধাবীকে সম্মান করে না সেই জাতির উন্নয়নের গতি যে শ্লথ একটু চোখ খুলে পৃথিবীর মানচিত্রের দিকে তাকালেই তা পরিস্কার হয়ে যায়। এখন আমরা কি করবো? আমি ব্যক্তিগতভাবে বয়োজ্যাষ্ঠদের সম্মান করার পক্ষে। তবে কখনো যদি তা মেধার সাথে সাংঘর্ষিক হয় তাহলে আমি মেধাকেই প্রাধান্য দেব। পদমর্যাকে অধস্তনরা যৌক্তিকভাবে মেনে চলবে কিন্তু অনুগত দাসের আচরণ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে এবং কোনোভাবেই কোনো প্রতিষ্ঠানের, রাজনৈতিক-সামাজিক সংগঠনের বড় পদাধিকার হবার কারণে সমাজে তাকে বাড়তি সম্মানের আসন দেয়া যাবে না যদি না মানুষটি তার মেধা ও ভালোবাসা দিয়ে তা অর্জন করে নেয়। মেধার মর্যাদাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে পারলে বড় পদে মেধাবীরাই যাবেন তখন আর বড় পদের লোকটি অধিক মেধাবী কি-না এই দ্বিধা থাকবে না। বিত্তের মর্যাদাকে ঝেঁটিয়ে বিদেয় করতে না পারলে বিত্ত অর্জনের মোহে মানুষের অনৈতিক পথে পা বাড়ানো বন্ধ করা যাবে না। পশ্চাদপদ সমাজের একটি বড় ক্ষত হচ্ছে বিত্তের তোষামোদ। বংশমর্যাদাকে বাড়তি সম্মান দেখানোর যে প্রথা, তা আপাতদৃষ্টিতে কমে এসেছে মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে আমাদের অঞ্চলে কিছু দানবীয় বংশ তৈরী হয়েছে। এটি বেশ বড়সড় টিউমারের আকার ধারণ করেছে। এই টিউমার অপসারণ করতে না পারলে সুশাসন নামক দেহের মৃত্যু ঘটবে।

মূল কথায় ফিরে আসি। সম্মান প্রদর্শনের ভিত্তি তাহলে কি হলে ভালো হয়? পৃথিবীর দিকে চোখ বুলিয়ে তো এ কথাই বলতে হয় মেধাই সম্মান দেখানোর প্রধান ভিত্তি হওয়া উচিত তবে এর সঙ্গে আমি জ্যেষ্ঠতার মিশেলটা রাখতে চাই। বিশেষ করে নিজ পরিবারের জ্যেষ্ঠ সদস্যদের সম্মান করার বিষয়ে আমি বিশেষ তাগিদ অনুভব করি।  সামগ্রিকভাবে সমাজের মেধাবীদের সম্মান করতে হবে, মূল্যায়ন করতে হবে। সমাজ ও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্ব পাবার ক্ষেত্রে মেধা এবং প্রজ্ঞাই (যা মেধার সাথে অভিজ্ঞতার মিশেলে তৈরী হয়) প্রাধান্য পাবে আর কিছু নয়। এই অবস্থানটি তৈরী করতে হলে আমাদের প্রত্যেকের চিন্তায় মেধাকে সর্বোচ্চ অবস্থানে বসাতে হবে। অন্য কোনো বিবেচনাকে গুরুত্ব দেয়া যাবে না, যদি গুরুত্ব পায় তার নিন্দা জানাতে হবে, মৃদু হলেও প্রতিবাদ জানাতে হবে। এভাবেই আমরা একটি মেধাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে পারব। 

আসুন মেধাকে সম্মান জানাই। 

Comments

  1. খুব খাঁটি কথা । সমৃদ্ধ হলাম

    ReplyDelete
  2. অনেক ধন্যবাদ ভাই। শুভ কামনা রইল।

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

অসাধারণ এই শিল্পীর জীবনের গল্প বড় করুণ

  [এই সময়ের অত্যন্ত প্রতিভাবান শিল্পী সারফুদ্দিন আহমেদ। বাড়ি পশ্চিমবঙ্গে। আর্ট কলেজে খণ্ডকালীন শিক্ষকতা করেন ,  আর শুধু ছবি আঁকেন। নানান মাধ্যমে ,  নানান বিষয়ের ছবি। সারফুদ্দিন আহমেদের ছবি থেকে চোখ ফেরানো যায় না ,  আপনাতেই ওঁর নান্দনিক সৃষ্টিকর্মে দৃষ্টি আটকে যায় ,  কী জল রঙ ,  কী অ্যাক্রিলিক ,  কিংবা স্রেফ পেন্সিলের ড্রয়িং। এই গুণী শিল্পীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কবি কাজী জহিরুল ইসলাম। সাক্ষাৎকারটি এখানে উপস্থাপন করা হলো।]       ভারত আমাকে চোখ দিয়েছে ,  বাংলাদেশ দিয়েছে দৃষ্টি -     সারফুদ্দিন আহমেদ     কাজী জহিরুল ইসলামঃ  ব্যাক গ্রাউন্ডে তবলা বাজছে আপনি ছবি আঁকছেন কাচের ওপর।    এই যে বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে ছবি আঁকা, এই ছন্দটা ছবিতে কিভাবে ধরেন? আর কোনো শিল্পী ছবি  আঁ কার সময় যন্ত্রানুসঙ্গ ব্যবহার করেছেন?   সারফুদ্দিন আহমেদঃ   কাঁচ নয়,   এটি এক বিশেষ ধরনের কাপড়-নেট। এই নেটের উপরে বর্তমানে আমার এক্সপেরিমেন্ট চলছে।    জহিরুলঃ ও ,  ফেইসবুকে যখন ছবিটি দেখি কাচের মতো ...

কাজী জহিরুল ইসলামের কবিতা || আবুল কাইয়ুম

কাজী জহিরুল ইসলামের কবিতা: জাতীয়-বৈশ্বিক মেলবন্ধন   || আবুল কাইয়ুম ||    কবি যদি হন বিশ্বপরিব্রাজক ,  তবে তিনি তো কবিতায় আঁকবেন তাঁর দেখা দুনিয়ার ছবি। বৃহত্ত্বকে আশ্লেষ করার পরিণামে স্বাভাবিকভাবে তাঁর মধ্যে জন্ম নেবে মানবিক মহত্ত্ববোধ ,  তা যে কাব্যাদর্শের লাঠিতে ভর করেই হোক। আশির দশক থেকে ক্রমবিকশিত কবি কাজী জহিরুল ইসলামের ক্ষেত্রেও একথা সত্যি । পর্যাপ্ত বিশ্বভ্রমণের অভিজ্ঞতায় আলোকিত হয়েছেন বলেই তিনি যে কোনো সঙ্কীর্ণতার উর্ধ্বে থেকে নিজেকে উদারনৈতিক মানবিক চৈতন্যে সংগঠিত করতে পেরেছেন ,  বিশ্বমানবতা ও বিশ্বশান্তির মন্ত্রে উজ্জীবিত রেখেছেন। তাঁর ব্যক্তিত্বে জড়ো হয়েছে বৃহত্তর সমষ্টিচেতনা ,  তাঁর প্রেম ও প্রার্থনা মানব কল্যাণের আশ্রয়ে গড়ে উঠেছে। তার লেখনীতে নানা দেশের মানুষের জীবন ,  সংস্কৃতি ,  প্রেম ,  ত্যাগ ও সংগ্রামের চালচিত্র কীভাবে উঠে এসেছে তা তাঁর কবিতার সংস্পর্শে না এলে বোঝা যাবে না। তাঁর  ‘ এল সালভাদর ’  শীর্ষক কবিতার কথাই ধরা যাক। এই অত্যুজ্জ্বল কবিতার মাত্র কয়টি বিস্ময়কর পংক্তিই শুধু এখানে তুলে ধরছি-    হণ্ডু...

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জুর সাক্ষাৎকার || পর্ব ৭

মতিউর রহমান চৌধুরীকে  র‍্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কারের জন্য নমিনেট করেছিলেন  আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু       [লেখক, সাংবাদিক, অনুবাদক আনোয়ার হোসেইন মঞ্জুর সাক্ষাৎকারের সপ্তম  পর্ব আজ প্রকাশ করা হলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কবি কাজী জহিরুল ইসলাম।]          জহিরুলঃ  আপনার সাংবাদিকতা জীবনের প্রায় পুরোটাই ব্যয় করেছেন জাতীয় সংসদ কভার করে। এই সংসদে আমাদের সংবিধানের অনেকগুলো সংশোধনী পাশ হয়েছে। আমাদের নেতারা সব সময় বলেন, ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড় কিন্তু প্রকৃত চিত্র হচ্ছে দেশের চেয়ে দলের স্বার্থ বড় হয়ে ওঠে এবং দলের চেয়ে ব্যক্তির/পরিবারের স্বার্থই বেশি গুরুত্ব পায়। প্রধান প্রধান সংশোধনীগুলোর আলোকে যদি বিশ্লেষণ করেন কতোটা জাতীয় স্বার্থে আর কতটা ব্যক্তি বা পরিবারের স্বার্থে এইসব সংশোধনীগুলো করা হয়েছে।    মঞ্জুঃ   আপনি ঠিকই বলেছেন, এযাবত বাংলাদেশে ১১টি জাতীয় সংসদ গঠিত হয়েছে এবং এর মধ্যে দ্বিতীয় সংসদ থেকে নবম সংসদ পর্যন্ত মোট আটটি সংসদের অধিবেশন কভার করা সুযোগ হয়েছে আমার। আমার সংসদ কভারের সময়ে আমাদের সংবিধানের ১০টি সংশোধনী অনুমো...