Skip to main content

জীবনের চেয়ে সম্পদের প্রতি প্রেম বেশি

ঢাকার দালানকোঠা 

 || কাজী জহিরুল ইসলাম ||


কাশফুলশুভ্র ফ্রেঞ্চকাট দাড়িএক মোটাসোটা বুড়োহুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে পড়লো। নভো চিৎকার করছেবাবাবাবাদেখো কে যেন এসেছে। আমি ওপরেব্যাগ গোছাচ্ছিসকালে ফ্লাইট। নভোর চিৎকারে ছুটতে ছুটতে ওককাঠের সিঁড়িতে ঝড় তুলে নিচে নামি। দুই মেয়ে নিচেঅচেনা কেউ ঘরে ঢুকে পড়েছেকী সাংঘাতিক কথা। দরোজায় লক না থাকলেও চাইম অন করা ছিলনারীকন্ঠ বেজে উঠে জানিয়েছিলসদর দরোজা খোলা হয়েছে। নিচে নেমে দেখিজ্যাকবআমার প্রতিবেশীজুইশ বুড়ো। শেষবার ও এসেছিল বছর পাঁচেক আগে। তখন ওর দাঁড়ি ছিল না। জ্যাকব দুই হাত জোড় করে এভাবে ঢুকে পড়ার জন্য ক্ষমা চাইল। এরপর আমাকে টেনে ওর মুখের কাছে নিয়ে বেশ নাটকীয় ভঙ্গিতে বললোআমি খুব বিপদে পড়েছি। হানা আমাকে কিছুতেই ব্যাকইয়ার্ডে যেতে দিচ্ছে না। 




আমার ব্যকইয়ার্ডে একটি ডালপালায় বিস্তৃত সুবিশাল শতবর্ষী ওক গাছ আছে। ওর কিছু ডাল প্রতিবেশীদের বাড়িতেও ছায়া দেয়। দুদিন আগে নাকি সেই বৃক্ষের একটি মরা ডাল জ্যাকবের উঠোনে ভেঙে পড়েছে। আবার যদি পড়েএই ভয়ে ওর স্ত্রী নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ও যেন আর ব্যাকইয়ার্ডে না যায়। ওর উৎকন্ঠিত বক্তব্য শুনে আমি কথা দিইছুটি থেকে ফিরে এসে মরা ডালগুলো ছাটাবার ব্যবস্থা করবো। হয়ত আমার হাজার খানেক ডলার খসবেকিন্তু মানুষের জানের নিরাপত্তা তো সবার আগে। জ্যাকব যখন কথাগুলো বলছিল আমি তখন মিটমিট করে হাসছিলাম। ও আমাকে জিজ্ঞেস করেহাসছো কেনআমি কী হাসির কিছু বললামআমি বলি নাতোমার প্রতি হানার এই প্রেম আমাকে আনন্দ দিয়েছেতাই হাসছি। ও তখন ঘর কাঁপিয়ে হো হো করে হাসে এবং আমাকে বলে হাসতে হলে এভাবে হাসবে। আসলে আমি হাসছিলামআবার যদি ওক বৃক্ষ থেকে একটি মরা ডাল পরেএবং সে-সময়ে যদি জ্যাকব বাইরে থাকে এবং তা যদি জ্যাকবের মাথায় পরেএতোগুলো যদির ভেতর থেকে বের করে আনা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ওরা চিন্তিতএই ভেবে। মনে মনে ভাবছিলাম, তুমি যদি একবার বাংলাদেশে গিয়ে দেখতে কীভাবে আমরা রাস্তা পার হই, কীভাবে আমরা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে গাছ কাটার দৃশ্য দেখি তাহলে বুঝতে ঝুঁকি কাকে বলে। আমি তো সেই বাঙালি, আমার কাছে তুমি যদি ডাল ভেঙে পড়ে টাইপের ঝুঁকি নিয়ে এসেছো! 

জ্যাকবকে এই বলে আস্বস্ত করি যে আমি আগামীকাল বাংলাদেশে যাচ্ছি, ছুটিতে, দুসপ্তাহ পরে ফিরে আসবো। ফিরে এসে তোমার এই সমস্যার সমাধান করে দেব। 

 

ঢাকায় গিয়ে উঠি আমার ছোটোভাই বিটনের নতুন ফ্লাটে। বনশ্রীতে খুব সুন্দর একটি এপার্টমেন্ট কিনেছে। দেয়ালের রঙআসবাবপত্রসব নতুনঝকঝকে এবং শিল্পসম্মত। ঘরে ঢুকলেই মন ভরে যায়। বাড়িটি সাততলা। নিচতলায় গাড়ির গ্যারেজওপরের ছয়তলায় ছয়টি পরিবার। সাজানো-গোছানোছবির মতো। প্রতি ফ্লোরে একটি স্প্লিট লেভেল বারান্দা আছে। ওখানে ছোটোখাটো একটি বাগান। সেই বাগানের পাশেই আমার ঘর। নানান রকম ফুল ও অর্কিডের পাশে একটি তুলসীগাছও আছে। এসব দেখে আমার খুব আনন্দিত হবার কথা। কিন্তু আমার মনের মধ্যে নিরাপত্তা ঝুঁকি খচখচ করছে। বারবার জ্যাকবের কথা মনে পড়ছে। এই পুরো বাড়ির একটি মাত্র আগমন এবং বহির্গমন পথ। যেটিকে সাড়ে তিনফুট বাই ছয় ফুটের একটি ফুটোও বলা যেতে পারে। যদি দৈবাৎ আগুন লাগে। বের হবার উপায় কী? 

আমেরিকার সাথে ঢাকার দিন-রাত্রির তারতম্যের কারণে ভোর ছয়টায় ঘুম ভেঙে যায়। উঠেই হাঁটতে বের হই। পথের দুপাশে সারি সারি দালান। আবাসিক এপার্টমেন্ট বিল্ডিং। ভালো করে লক্ষ করিসাত/আটতলা এই দালানগুলোর একটিরও ফায়ার এক্সিট নেই। বিষয়টি যে কত গুরুত্বপূর্ণ একটি সমস্যা তা নিয়ে কারো কোনো মাথাব্যাথা আছে বলেও মনে হয় না। প্রতিটি সুবিশাল দালানের একটি মাত্র ফুটো। 

কেন এ-বিষয়ে কারো কোনো মাথাব্যাথা নেইনেই এ-কারণে যে মানুষের জীবন যে সব কিছুর উপরে এই বোধ আমাদের তৈরী হয়নি। সম্পদের নিরাপত্তায় আমরা যতটা যত্নবান জীবনের নিরাপত্তায় ততটা নইআর তা যদি হয় অন্যের জীবন তাহলে তো আর কথাই নেই।

রামপুরা, ঢাকা। ৭ অক্টবর ২০১৯

Comments

Popular posts from this blog

শিল্পী কাজী রকিবের সাক্ষাৎকার

নন-একাডেমিক শিল্পীরাই নতুন কিছু দেয় -    কাজী রকিব  [কাজী রকিব বাংলাদেশের একজন গুণী শিল্পী। রাজশাহী আর্ট কলেজের একজন প্রতিষ্ঠাতা-শিক্ষক। কলেজের প্রথম ক্লাসটি নেবার কৃতিত্বও তাঁর। নিরন্তর ছবি আঁকেন। নানান মাধ্যমে ,  নানান ভাবনার ছবি। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে সস্ত্রীক বসবাস। তার স্ত্রী মাসুদা কাজীও একজন গুণী শিল্পী। বৈচিত্রপ্রিয় এই শিল্পীর একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন কবি কাজী জহিরুল ইসলাম। ধারাবাহিকভাবে তা এখানে প্রকাশ করা হবে। আজ উপস্থাপন করা হলো প্রথম পর্ব।]   জহিরুলঃ  বেশিরভাগ শিল্পীই নিজের একটা স্টাইল তৈরি করেন ,  নিজস্বতা যাকে আমরা বলি। আবার কেউ কেউ একই ধরণের ছবি বারবার আঁকেন। আপনার কাজে বৈচিত্র খুব বেশি ,  এতে করে "টাইপড" অপবাদ থেকে আপনি মুক্ত কিন্তু নিজের একটি স্টাইল তৈরি করতে না পারা বা তৈরি হয়নি বলে কি আক্ষেপ হয় ,  নাকি এই যে ভার্সেটিলিটি এটাই আপনি বেশি উপভোগ করেন ?    রকিবঃ   আমি আসলে আলাদা করে ভাবিনি এই স্টাইল বিষয়ে। কারো মতো আঁকারও চেষ্টা করিনি তেমন ভাবে। অল্প বয়সে ,  আমার ১৯ / ২০ বছর বয়সে ,  সালভাদর দালির মতো আঁকতে চেষ্টা করেছিলাম কিছুদিন ।

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জুর সাক্ষাৎকার || পর্ব ৭

মতিউর রহমান চৌধুরীকে  র‍্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কারের জন্য নমিনেট করেছিলেন  আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু       [লেখক, সাংবাদিক, অনুবাদক আনোয়ার হোসেইন মঞ্জুর সাক্ষাৎকারের সপ্তম  পর্ব আজ প্রকাশ করা হলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কবি কাজী জহিরুল ইসলাম।]          জহিরুলঃ  আপনার সাংবাদিকতা জীবনের প্রায় পুরোটাই ব্যয় করেছেন জাতীয় সংসদ কভার করে। এই সংসদে আমাদের সংবিধানের অনেকগুলো সংশোধনী পাশ হয়েছে। আমাদের নেতারা সব সময় বলেন, ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড় কিন্তু প্রকৃত চিত্র হচ্ছে দেশের চেয়ে দলের স্বার্থ বড় হয়ে ওঠে এবং দলের চেয়ে ব্যক্তির/পরিবারের স্বার্থই বেশি গুরুত্ব পায়। প্রধান প্রধান সংশোধনীগুলোর আলোকে যদি বিশ্লেষণ করেন কতোটা জাতীয় স্বার্থে আর কতটা ব্যক্তি বা পরিবারের স্বার্থে এইসব সংশোধনীগুলো করা হয়েছে।    মঞ্জুঃ   আপনি ঠিকই বলেছেন, এযাবত বাংলাদেশে ১১টি জাতীয় সংসদ গঠিত হয়েছে এবং এর মধ্যে দ্বিতীয় সংসদ থেকে নবম সংসদ পর্যন্ত মোট আটটি সংসদের অধিবেশন কভার করা সুযোগ হয়েছে আমার। আমার সংসদ কভারের সময়ে আমাদের সংবিধানের ১০টি সংশোধনী অনুমোদিত হয়েছে এবং সংশোধনী প্রক্রিয়া কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। এখন পর্যন্ত স

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জুর সাক্ষাৎকার - তৃতীয় পর্ব

মঞ্জু আমার ওপর রাগ করেছে                                                           - আল মাহমুদ [লেখক, সাংবাদিক, অনুবাদক আনোয়ার হোসেইন মঞ্জুর সাক্ষাৎকারের  তৃতীয় পর্ব আজ প্রকাশ করা হলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কবি কাজী জহিরুল ইসলাম।]  সাক্ষাৎকার নেবার এক পর্যায়ে আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু  ও কাজী জহিরুল ইসলাম। ওয়ান্টাগ পার্ক, নিউ ইয়র্ক।  ছবি তুলেছেন ড. মাহবুব হাসান।   জহিরুলঃ  খুশবন্ত সিং তার সকল বই অনুবাদ করার লিখিত অনুমতি দিলেন আপনাকে এবং সেই অনুমতিপত্রটি তিনি নিজ হাতে আপনার সামনেই বাংলায় লিখে দিলেন। তিনি কিভাবে বাংলা শিখলেন তা কি জানতে পেরেছিলেন ?  মঞ্জুঃ    জ্বি ,  ঘটনাটি  ঘটে  ১৯৯২ সালের ডিসেম্বর মাসে ,  এ সম্পর্কে আমি আগের এক প্রশ্নে বলেছি। তারিখটি আমার স্মরণে নেই। তবে বাবরি মসজিদ ধ্বংস করার পর ,  ডিসেম্বরের শেষ দিকে। না ,  বাংলায় নয় ,  উনি ইংরেজিতে লিখেছেন। আমার কফি পানের সময়ের মধ্যেই লিখে দিয়েছেন। ১৯৮৪ থেকে মাঝে দীর্ঘ বিরতি দিয়ে আমাকে তিনটি বা চারটি চিঠি লিখেছেন। লিখেছেন বলতে আমার চিঠির উত্তর দিয়েছেন। প্রতিটি চিঠি ইংরেজিতেই লিখেছেন। প্রতিটি চিঠিতে আমাকে সম্বোধন করেছেন  “ আনোয়ার ভাই ,”  বলে।