Skip to main content

আঞ্চলিকতা আর আন্তরিকতা

 এক তিতাস ভালোবাসা

|| কাজী জহিরুল ইসলাম ||  


 

আঞ্চলিকতা একটি গাছ। সেই গাছে লতার মতো জড়িয়ে আছে আন্তরিকতা। এ কারণেই আমি আঞ্চলিক সংগঠনগুলো পছন্দ করি। আমার অনেক কবিলেখকশিল্পী বন্ধুউচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বন্ধুতা পছন্দ করেন না। না করার কারণ হচ্ছে তারা মনে করেন তাদের রুচিবোধ অনেক উন্নতআঞ্চলিক সংগঠন যারা করেন তাদের সাথে ফ্রিকোয়েন্সিতে মেলে না। আমরা নানান রকম যোগ্যতার পোশাক পরে ঘুরে বেড়াই এবং তা নানান কারণেই করতে হয়। মাঝে মাঝে আমি সকল পোশাক খুলে নগ্ন হয়ে যেতে পছন্দ করিতখন যে কোনো সমাজে মিশবার মতো একটি পোশাক খুব সহজেই পরে নেয়া যায়।

আমার বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া। এই শহরে অন্যান্য জেলার মতো ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মানুষদেরও সমিতি আছে। তারা বাংলাদেশের জাতীয় দিবসগুলো উদযাপন করেনব্রাহ্মণবাড়িয়ার কৃতি সন্তানদের জন্ম-মৃত্যু দিবস পালন করেনদেশ থেকে গুণী মানুষেরা এলে তাদের নিয়ে আড্ডার আয়োজন করেনবার্ষিক বনভোজন করেন। আমি তাদের কাছাকাছি যেতে চাইতাদের মাঝে কিছুটা সময় কাটাতে চাই। আমি যেহেতু লেখালেখি করিকবি লেখকদের সাথেই আড্ডা দিতে বেশি পছন্দ করি কিন্তু যখন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মানুষদের মধ্যে অবস্থান করি তখন অন্যরকম একটা আনন্দে আমার মন ভরে থাকে। যখন খাঁটি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ভাষায় কেউ কথা বলেন আমার বুকের ভেতরটা হু হু করে ওঠে। আমি মুহূর্তের মধ্যেই পৌঁছে যাই তিতাসের পাড়েগোমতীর পাড়েমেঘনার পাড়ে। আমি পৌঁছে যাই আমার শৈশবের খাগাতুয়ারতনপুর গ্রামেমানিকনগর ঘাটেগোকর্ণ ঘাটে। আজ জীবনের অর্ধশতক পাড় করে এখন আমি একই আনন্দ অনুভব করতে পারি বাংলাদেশের অন্য যে কোনো অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষা ও মানুষের সান্নিধ্যেও। এখন মনে হয় প্রতিটি গ্রামই আমার গ্রামপ্রতিটি নদীই আমার নদী। যারা আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলেন তাদের মধ্যে যে শুদ্ধতা আছে আমি সেই শুদ্ধতায় অবগাহন করতে চাইনিজের গায়ে লেগে থাকা কৃত্রিমতার আবর্জনা ধুয়ে ফেলতে চাই। কিন্তু প্রায়শই যে বিষয়টি আমাকে পীড়া দেয় তা হচ্ছে বিভাজন। আঞ্চলিকতার মধ্যে যে শুদ্ধতা আছেযে শক্তি আছে এই শক্তি বিভক্ত হচ্ছেরক্তাক্ত হচ্ছেআমি তা দেখতে চাই না। 

আমি এখন যে শহরে বাস করি এই নিউইয়র্ক শহরে বাংলাদেশের সকল জেলার একাধিক সমিতি আছে। তারা পরস্পরের প্রতি কাদা ছোড়াছুড়ি করেন। একে অন্যকে নানান কৌশলে রক্তাক্ত করেন। এতে আমি নিজেও রক্তাক্ত হই। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলারও বেশ কিছু সমিতি আছে। তারা নিজেদের মধ্যে এতোটাই বিভক্ত যে আমি যদি এক পক্ষের সাথে যোগাযোগ রাখি তাহলে অন্য পক্ষ অসন্তুষ্ট হন। কিন্তু আমি তো চাই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রতিটি মানুষকে বুকে জড়িয়ে ধরতে। বিভাজনের রেখা মুছে দিয়ে সবাইকে একটি বৃত্তের ভেতর হাস্যোজ্জ্বল দেখতে আমি আকুল হয়ে তাকিয়ে থাকি।

কেন এই বিভাজনএর মূল কারণ হচ্ছে নেতৃত্ব। কিন্তু আপনারা কেন একথা বুঝতে পারেন না প্রকৃত নেতা কখনোই নিজের অস্তিত্বকে খণ্ডিত করেন না। প্রকৃত নেতা তো তিনিই যিনি নেতৃত্ব থেকে সরে গিয়ে অখণ্ডতা রক্ষা করেন। নেতা তো তিনিই যিনি তার জনগোষ্ঠীর প্রতিটি মানুষের কল্যান নিশ্চিত করতে চান। 

গত সপ্তাহে আমি জ্যামাইকার একটি রেস্টুরেন্টে ঢুকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কোনো একটি সমিতির চারজনকে একসাথে পেয়ে যাই। কিন্তু আমি লক্ষ করি তারা আগের মতো যথেষ্ট উষ্ণ নন। আমি জানি এর কারণ হচ্ছে অন্য একটি অংশের অনুষ্ঠানে আমি অংশ নিয়েছি এতে তারা হয়ত অসন্তুষ্ঠ হয়ে থাকবেন। কিছুদিন আগে পর্যন্ত আমি এই বিভাজনগুলো জানতাম না। এখন আমি জানিএর তীব্রতাও ক্রমশ টের পাচ্ছিযতো টের পাচ্ছি ততই আমি রক্তাক্ত হচ্ছি। আমি তো মনে করি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রতিটি নারী-পুরুষ আমার আপনজন। এই অপ্রয়োজনীয় বিভাজনের কারণে কেউ একজন যদি আমাকে দূরে ঠেলে দেয় কষ্টে আমার বুক ভেঙে যায়।

আমি একজন সামান্য লেখক। তারা যদি আমার কষ্টকে গুরুত্ব দেন। সব বিভেদের রেখা মুছে দিয়ে একটি বৃত্তের ভেতর এসে দাঁড়ান আমি খুব খুশি হবো। তাদের সকলের জন্য আমার হৃদয়ের অতল গহন থেকে জানাই এক তিতাস ভালোবাসা। 

হলিসউডনিউইয়র্ক। ২৭ নভেম্বর ২০১৯

 

Comments

Popular posts from this blog

শিল্পী কাজী রকিবের সাক্ষাৎকার

নন-একাডেমিক শিল্পীরাই নতুন কিছু দেয় -    কাজী রকিব  [কাজী রকিব বাংলাদেশের একজন গুণী শিল্পী। রাজশাহী আর্ট কলেজের একজন প্রতিষ্ঠাতা-শিক্ষক। কলেজের প্রথম ক্লাসটি নেবার কৃতিত্বও তাঁর। নিরন্তর ছবি আঁকেন। নানান মাধ্যমে ,  নানান ভাবনার ছবি। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে সস্ত্রীক বসবাস। তার স্ত্রী মাসুদা কাজীও একজন গুণী শিল্পী। বৈচিত্রপ্রিয় এই শিল্পীর একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন কবি কাজী জহিরুল ইসলাম। ধারাবাহিকভাবে তা এখানে প্রকাশ করা হবে। আজ উপস্থাপন করা হলো প্রথম পর্ব।]   জহিরুলঃ  বেশিরভাগ শিল্পীই নিজের একটা স্টাইল তৈরি করেন ,  নিজস্বতা যাকে আমরা বলি। আবার কেউ কেউ একই ধরণের ছবি বারবার আঁকেন। আপনার কাজে বৈচিত্র খুব বেশি ,  এতে করে "টাইপড" অপবাদ থেকে আপনি মুক্ত কিন্তু নিজের একটি স্টাইল তৈরি করতে না পারা বা তৈরি হয়নি বলে কি আক্ষেপ হয় ,  নাকি এই যে ভার্সেটিলিটি এটাই আপনি বেশি উপভোগ করেন ?    রকিবঃ   আমি আসলে আলাদা করে ভাবিনি এই স্টাইল বিষয়ে। কারো মতো আঁকারও চেষ্টা করিনি তেমন ভাবে। অল্প বয়সে ,  আমার ১৯ / ২০ বছর বয়সে ,  সালভাদর দালির মতো আঁকতে চেষ্টা করেছিলাম কিছুদিন ।

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জুর সাক্ষাৎকার || পর্ব ৭

মতিউর রহমান চৌধুরীকে  র‍্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কারের জন্য নমিনেট করেছিলেন  আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু       [লেখক, সাংবাদিক, অনুবাদক আনোয়ার হোসেইন মঞ্জুর সাক্ষাৎকারের সপ্তম  পর্ব আজ প্রকাশ করা হলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কবি কাজী জহিরুল ইসলাম।]          জহিরুলঃ  আপনার সাংবাদিকতা জীবনের প্রায় পুরোটাই ব্যয় করেছেন জাতীয় সংসদ কভার করে। এই সংসদে আমাদের সংবিধানের অনেকগুলো সংশোধনী পাশ হয়েছে। আমাদের নেতারা সব সময় বলেন, ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড় কিন্তু প্রকৃত চিত্র হচ্ছে দেশের চেয়ে দলের স্বার্থ বড় হয়ে ওঠে এবং দলের চেয়ে ব্যক্তির/পরিবারের স্বার্থই বেশি গুরুত্ব পায়। প্রধান প্রধান সংশোধনীগুলোর আলোকে যদি বিশ্লেষণ করেন কতোটা জাতীয় স্বার্থে আর কতটা ব্যক্তি বা পরিবারের স্বার্থে এইসব সংশোধনীগুলো করা হয়েছে।    মঞ্জুঃ   আপনি ঠিকই বলেছেন, এযাবত বাংলাদেশে ১১টি জাতীয় সংসদ গঠিত হয়েছে এবং এর মধ্যে দ্বিতীয় সংসদ থেকে নবম সংসদ পর্যন্ত মোট আটটি সংসদের অধিবেশন কভার করা সুযোগ হয়েছে আমার। আমার সংসদ কভারের সময়ে আমাদের সংবিধানের ১০টি সংশোধনী অনুমোদিত হয়েছে এবং সংশোধনী প্রক্রিয়া কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। এখন পর্যন্ত স

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জুর সাক্ষাৎকার - তৃতীয় পর্ব

মঞ্জু আমার ওপর রাগ করেছে                                                           - আল মাহমুদ [লেখক, সাংবাদিক, অনুবাদক আনোয়ার হোসেইন মঞ্জুর সাক্ষাৎকারের  তৃতীয় পর্ব আজ প্রকাশ করা হলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কবি কাজী জহিরুল ইসলাম।]  সাক্ষাৎকার নেবার এক পর্যায়ে আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু  ও কাজী জহিরুল ইসলাম। ওয়ান্টাগ পার্ক, নিউ ইয়র্ক।  ছবি তুলেছেন ড. মাহবুব হাসান।   জহিরুলঃ  খুশবন্ত সিং তার সকল বই অনুবাদ করার লিখিত অনুমতি দিলেন আপনাকে এবং সেই অনুমতিপত্রটি তিনি নিজ হাতে আপনার সামনেই বাংলায় লিখে দিলেন। তিনি কিভাবে বাংলা শিখলেন তা কি জানতে পেরেছিলেন ?  মঞ্জুঃ    জ্বি ,  ঘটনাটি  ঘটে  ১৯৯২ সালের ডিসেম্বর মাসে ,  এ সম্পর্কে আমি আগের এক প্রশ্নে বলেছি। তারিখটি আমার স্মরণে নেই। তবে বাবরি মসজিদ ধ্বংস করার পর ,  ডিসেম্বরের শেষ দিকে। না ,  বাংলায় নয় ,  উনি ইংরেজিতে লিখেছেন। আমার কফি পানের সময়ের মধ্যেই লিখে দিয়েছেন। ১৯৮৪ থেকে মাঝে দীর্ঘ বিরতি দিয়ে আমাকে তিনটি বা চারটি চিঠি লিখেছেন। লিখেছেন বলতে আমার চিঠির উত্তর দিয়েছেন। প্রতিটি চিঠি ইংরেজিতেই লিখেছেন। প্রতিটি চিঠিতে আমাকে সম্বোধন করেছেন  “ আনোয়ার ভাই ,”  বলে।