শাকিল রিয়াজের কুড়ি কবিতা
|| কাজী জহিরুল ইসলাম ||
শাকিল রিয়াজের কুড়িটি কবিতা এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলি। তার কবিতার সঙ্গে আমার পরিচয় দুই দশকের অধিক সময় ধরে। শাকিল রোমান্টিক ধারার কবি। নারীদেহের রহস্যময় ভাঁজে হীরক খন্ডের মতো দ্যুতি ছড়ায় তার শব্দেরা। তবে নারী দেহই তার লক্ষ্য নয়, এটি কেবল উপজীব্য। বেড়ে ওঠার অবলম্বন। মূল লক্ষ্যটি হচ্ছে জীবন, বহু বিচিত্র অভিজ্ঞতার অভিঘাতে পূর্ণ যে জীবন সেই জীবনের ছবি আঁকাই এই কবির লক্ষ্য।
মান ম্লান হয়ে যায় চটুল বিজ্ঞাপনে, মেধাহীন মানুষ প্রাধান্য পেয়ে যায় প্রচারকৌশলে, এটি আধুনিক জীবনের একটি যন্ত্রণা, এই যন্ত্রণা চিত্রিত হয় শাকিলের তুলিতে, “মেধার বালাই নেই, তবু শুনি তোমার সুগোল/ স্তনের প্রতিভা নিয়ে তুমি আজ বিখ্যাত হয়েছো”।
রোমান্টিকতার অনুষঙ্গে কবি শাকিল রিয়াজ নির্মাণ করেছেন অসাধারণ সব চিত্রকল্প। কবিতা তো ইমেজেরই কাজ, একেকটি শব্দ, একেকটি পঙক্তি, পাঠকের জন্যে খুলে দেবে অপার আনন্দে অবগাহনের দরোজা, এটাই তো কবির কাজ। সেই কাজ শাকিল নিষ্ঠার সঙ্গে করে গেছেন। চিত্রকল্প নির্মাণের এই দক্ষতা তার সহজাত, এই মেধা তার জন্মগত, অনুশীলনে তা অর্জন করা যায় না।
“আপনি বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলেন শাড়ি উপরে টেনে ধরে
বৃষ্টির ছাঁট শাড়ি ছুঁতে পারে না
কিন্তু আপনার ফর্সা জঙ্ঘা ছুঁয়ে যায় আলো
ছুঁয়ে যায় চোখ আর মেঘ
আটপৌরে জীবনে নিজেকে সঁপে দিয়ে এখন
জঙ্ঘার চেয়ে শাড়ির পাড়কে দামী ভাবেন
আপনার বিহ্বল জঙ্ঘা তাই মিটিমিটি আমাতে হাসে
বৃষ্টি থেমে গেছে কবে, বৃষ্টির গান থামেনি
আপনি ফিরে গেছেন, জঙ্ঘা ফেরে নাই ঘরে
কেবলই পড়ে আছে মনে
এই হাওয়া দেখেছে, এই গান জানে
জ্বলেছি নীরবে, তবু তাতে মৈথুন রাখিনি কোনক্রমে।”
(কবিতাঃ জ্বলেছি নীরবে)
“এই ঘন তুষারপাতে কে এমন কবিতা লিখে গেলো পথে?
আমি তার দৈর্ঘ্য প্রস্থ আন্দাজ করে ফেলি। আমি তার প্রেমে পড়ি।
আমি দেখি, তুমি বাসায় ফিরেছো। একটি একাকী বাসায়।
শীত সেলাই করছে তোমার দাঁতগুলো। দেখি,
একটি চিরুনি তোমার চুল ছুঁতে কীভাবে থুতনি ঠেকিয়ে তাকিয়ে আছে তোমাতে
আমি ওই হতভাগ্য চিরুনি হয়ে আঁচড়ে আঁচড়ে
তোমার পিঠ বেয়ে নামাবো অন্ধকার।
অন্ধকারে মাথা রেখে ঘুমাই।
তুষারপাত থেকে কিছু আলো ছিনিয়ে নিয়ে
কে ছুঁড়ে মারলো ঘুমে?
কেউ নেই। কিছু স্বপ্ন পড়ে আছে কাঁধে।
রঙহীন, অবয়বহীন, মৃতের মত শাদা।
তুমি বললে, শাদা তো মিছরির রঙ! ভারী মিষ্টি।
তুমি বললে, তাই স্বপ্নকে জিহ্বায় টেনে এনে স্বাদ চেখে দেখি।
কিছু না, তোমার ঠোঁটের চারধারে হাসি সামলানো
টোলগুলো জিহ্বায় টের পাই”।
(কবিতাঃ একটি শাদা প্রেম)
“স্ক্রুর মত ঘুরে ঘুরে তোমার অবাধ্য চোখ আলগা হয়ে গেলো
মৃত্যু পষ্ট হয় এই মতে।
মৃত্যুর সামনে এসে জীবনটা বেঁকে বসে আছে।
দোয়ার ভঙ্গিমায় আমি তাই
দুহাতে এনেছি বয়ে দশটি আঙ্গুল
তুমি ধার নেবে দুটি মুঠ এই ভরসায়।
দুটি মুঠ! তুমি ধার নেবে এই ক্ষুধা?
অনাহারী এক প্লেটে পড়ে আছি সামান্য খাবার
কীভাবে ঠেকাবে?”
(কবিতাঃ দুটি মুঠ)
জ্যেষ্ঠ নারীর দেহবল্লরীর আগুনে কোন কিশোর পোড়েনি? সেই পোড়াদাগ মধ্য যৌবনে জ্বলজ্বলে অলঙ্কার হয়ে ওঠে কবি শাকিল রিয়াজের কবিতায় কী অবলীলায়। তিনি যখন বলেন “আমি ওই হতভাগ্য চিরুনি হয়ে আঁচড়ে আঁচড়ে/ তোমার পিঠ বেয়ে নামাবো অন্ধকার” তখন আমাদের চোখের সামনে নারী ও প্রকৃতি এক হয়ে যায়। নারীর দীঘল চুল হয়ে যায় উত্তর মেরুর দীর্ঘ রাত, যার অন্ধকারে রয়েছে অন্য এক আগুন, অন্য এক উষ্ণতা। তখন কবি বলতেই পারেন, “অন্ধকারে মাথা রেখে ঘুমাই।/ তুষারপাত থেকে কিছু আলো ছিনিয়ে নিয়ে/ কে ছুঁড়ে মারলো ঘুমে?” কী অসাধারণ চিত্রকল্প “স্ক্রুর মত ঘুরে ঘুরে তোমার অবাধ্য চোখ আলগা হয়ে গেলো।” কবি শাকিল রিয়াজ রোমান্টিকতায় এতোটায় নিমজ্জিত যে মৃত্যুর মত ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতাকেও দেখেন আনন্দের ঘটনা হিশেবে।
“জ্যোছনায় কি ধুয়ে যায় এতসব সাধ?
কিছুটা আর্দ্রতা কিছু তবে ক্রন্দন আকাঙ্ক্ষা হবে মৃত্যুর গুঞ্জনে
চলো, এসেছে কর্কশ ছায়া আমাদের নিতে
কবরের নিস্তব্ধতা উপভোগ করে আসি, চলো”।
(কবিতাঃ কবরের নিস্তব্ধতা)
কবিরা কবিতায় নানান রকম পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন, অনেকেই ছন্দ পরিত্যাগ করে শেষ পর্যন্ত হতাশ হয়ে কবিতাকেও পরিত্যাগ করেছেন। বুদ্ধিমান কবিরা আগে-ভাগেই ছন্দটা ভালো করে শিখে নিয়ে লিখতে শুরু করেছেন কেননা তারা বুঝতে পেরেছিলেন শেষ পর্যন্ত ছন্দের কাছেই ফিরে আসতে হবে। শাকিল রিয়াজ ছন্দ সচেতন কবি। বেশিরভাগ কবিতাই তিনি অক্ষরবৃত্তে লিখেছেন। তবে বেশ কিছু মাত্রাবৃত্তের কবিতাও তিনি লিখেছেন যা খুবই সুখপাঠ্য। তিনি আঠার মাত্রার একটি ব্যতিক্রমী কবিতা আঠার পঙক্তিতে লিখেছেন (“লোকটা প্রেমিক ছিল কাল সারারাত”)। সাধারণত আধুনিক সনেট অর্থাৎ ১৪ পঙক্তির কবিতাগুলো আঠার মাত্রায় লেখা হয়, কেউ কেউ ২২ মাত্রায়ও লিখেছেন, তবে ১৮ মাত্রাই সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং সর্বাধিক রচিত হয়েছে। “বীজতন্ত্র” কবিতাটি স্বরবৃত্তে লিখলেও এই কবিতার পর্বগুলোকে মাত্রাবৃত্তেও ফেলা যায়। সব গুলো পর্বই পাঁচ এবং ছয় মাত্রায় বিভাজিত। মাত্রাবৃত্তের পাঁচ মাত্রা স্বরবৃত্ত ছন্দের চার মাত্রার তালেই চলে। একই কবিতায় মাত্রাবৃত্তের কিছু পর্ব পাঁচ এবং কিছু পর্ব ছয় মাত্রায় দেখতে পেলে তখন মিলিয়ে দেখতে হবে যে পর্বগুলো স্বরবৃত্তের চার মাত্রার তালে পড়ে কি-না। এ জাতীয় কবিতাকে স্বরমাত্রিক ছন্দের কবিতাও বলা হয়। এগুলোকে শুদ্ধ ধ্রুপদী স্বরবৃত্ত ছন্দের কবিতা বলা যাবে না এজন্য যে ছন্দ বিশেষজ্ঞরা স্বরবৃত্ত ছন্দে ভাঙা পর্ব বা অতিপর্ব রাখার সুযোগ নেই বলেছেন। কিন্তু “বীজতন্ত্র” কবিতাটিতে প্রতি তিন পর্ব পরে একটি দুই মাত্রার ভাঙা পর্ব আছে।
কার শরীরের/ কোন গোপনে/ রেখেছিলাম/ বীজ
গোপনতার/ মধ্যে বিষাদ/ করছিল গিজ/গিজ
বিষাদ কেন?/ বিষাদ কেন?/ উর্বরা হিম/-নারী
শীতবস্ত্রের/ নিচে তখন/ সূর্যটা বা/হারি।
প্রথম পঙক্তির প্রথম পর্বে, দ্বিতীয় পঙক্তির দ্বিতীয় এবং তৃতীয় পর্বে, তৃতীয় পঙক্তির তৃতীয় পর্বে এবং চতুর্থ পঙক্তির প্রথম এবং তৃতীয় পর্বে ছয় মাত্রা রয়েছে। বাকী সব পাঁচ মাত্রার পর্ব। কিন্তু প্রতিটি পঙক্তির শেষের দুই মাত্রার ভাঙা পর্ব ছাড়া সকল পর্বই স্বরবৃত্ত ছন্দে চার মাত্রার পর্ব (এক্ষেত্রে শীতবস্ত্র শব্দটিকে শীতোবস্ত্র পড়তে হবে)। এজন্যই এটি স্বরমাত্রিক ছন্দেরও কবিতা।
একজন কবি যে বিষয় নিয়েই লিখুন না কেন তাকে শেষ পর্যন্ত মানবিক হতে হয়। মানবিকতার দাবী তাকে মেটাতেই হয়। কবি শাকিল রিয়াজ সে দাবীও মিটিয়েছেন।
“তাকে আমি চাইনি, কেননা খুব কালো ছিলো ওর শরীরের রং
চাইনি কেননা, ও তো প্রেম শব্দটা গুছিয়ে বলতে পারেনি
তাছাড়া ও কথা বলতো দূষিত বাংলায়,
স্বাস্থ্যবতী ছিল আর বসতে গেলে পা ছড়িয়ে বসতো।
একে ভালবাসা যায়!
আমি তাই ফিরিয়ে দিয়েছিলাম।
.....................................
রেহনুমা হাসিমুখে বলতে পেরেছিল তার বেঁচে থাকা অর্থহীন
এই হাসির নামই ছিল মৃত্যু, এবং ভালবাসা।
এবং পৃথিবীর সবকিছুকে অর্থহীন বলতে পেরেছিল
নিজের প্রেমকে অর্থময় মনে করার লোভে”।
রাহনূমা নামের এই মোটাসোটা, অশিক্ষিত মেয়েটি তার প্রেমকে সব কিছুর ওপরে স্থান দিতেই বেছে নিয়েছিলেন আত্মহননের পথ। বহুদিন পর গ্রামে ফিরে গেলে সেইসব কথা মনে পড়ে কবির, তিনি অনুশোচনায় ভোগেন। এই আত্মোপলব্ধিই কবিকে বাঁচিয়ে দেয়, একজন মানুষকে শেষ পর্যন্ত মানবিক করে তোলে, মানুষ করে তোলে। আজকের পৃথিবীতে না চাইলেও আমাদের রাজনীতি সচেতন হতে হয় কেননা রাজনীতি আমাদের কলমকে স্পর্শ করে, আঘাত করে, ভেঙে দেয়। কবি শাকিল রিয়াজ কম হলেও কিছু রাজনৈতিক কবিতা লিখে নিজের সচেতনতার জানান দিয়েছেন।
“ভাতের দাবিতে ওরা আমরণ অনশনে আজ।
প্রিয় দেশবাসী,
চলো যাই।
ওদের প্যান্টের বেল্টে
আরও দুই বাড়তি ফুটো করে দিয়ে আসি।”
(কবিতাঃ রাজনীতি)
এটিই তৃতীয় বিশ্বের অনৈতিক রাজনীতির প্রকৃত চিত্র যা খুব অল্প কথায় তুলে এনেছেন তিনি। রোমান্টিকতাই শাকিল রিয়াজের কবিতার মূল পাথেয় তবে লক্ষ্য জীবন, জীবনের ঘাত-সংঘাত, অভিঘাত। চিত্রকল্প নির্মাণে তার মুন্সিয়ানা বিস্ময়কর, এই শক্তিই তাকে একজন গুরুত্বপূর্ণ কবি করে তুলেছে। দীর্ঘদিন প্রবাসে অবস্থান করার ফলে লেখালেখির গতি কমে যাওয়া স্বাভাবিক এবং প্রকাশে অনীহা তৈরী হওয়াও বিচিত্র কিছু নয়। ফলে আজকের পাঠকেরা অনেকেই হয়ত শাকিল রিয়াজের কবিতার সাথে পরিচিত নন, এই গ্রন্থের কুড়িটি কবিতা পাঠেই পাঠক জেনে যাবেন কি সুদৃঢ় কাব্যভীত তিনি ইতোমধ্যেই নির্মাণ করে রেখেছেন।
Comments
Post a Comment