Skip to main content

আদি নারী কবি কাই লেখেন বিষাদ ও ক্রোধের কবিতা

পৃথিবীর আদি নারী কবিদের কথা 

|| কাজী জহিরুল ইসলাম || 



গদ্য সাহিত্যের জন্ম এইতো সেদিন। কবিতাই আদি সাহিত্য। দাউদ নবী ছিলেন কিছুটা পাগলা কিসিমের। তিনি দিনরাত গীত রচনা করতেন আর গাইতেন। সেগুলো ছিল খোদার প্রশংসা এবং মন্দ লোকদের বিরুদ্ধে বিদ্রূপ এবং তাদের ধ্বংস কামনায় পূর্ণ। এরপর মূসা এলেন, ঈসা এলেন, মুহাম্মদ এলেন। তাদের মাধ্যমে খোদার কাছ থেকে অবতীর্ণ হলো তওরাত, ইঞ্জিল এবং কোরান। শ্রেষ্ঠ তিনটি ধর্মগ্রন্থ। এই ধর্ম গ্রন্থগুলোর সবই কিন্তু কবিতা, অর্থাৎ কাব্যিক ফর্মেই এগুলো এসেছে। সুতরাং খোদার অনেক গুণাবলীর একটি হচ্ছে তিনি কবি।
 

এদিকে ভারত উপমহাদেশে কালক্রমে গড়ে উঠেছে যে সনাতন ধর্ম সেই ধর্মের গ্রন্থাবলীও কবিতায়ই রচিত। নানান দেশের পুরাণকাহিনী, এপিক সাহিত্য সবই কবিতা। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার হলো এর প্রায় সবগুলোই রচিত হয়েছে পুরুষ কবির দ্বারা। আর ধর্মগ্রন্থগুলোও অবতীর্ণ হয়েছে পুরুষদের ওপরই। প্রাচীনকালে কি কোনো নারী কবি ছিলেন না? যীশুর জন্মের ২২৮৫ বছর আগে মধ্যপ্রাচ্যের উর শহরে জন্মগ্রহণ করেন এনহেদুয়ানা নামের এক দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নারী, যিনি মাত্র ৩৫ বছর বেঁচে ছিলেন। অথচ এই অল্প সময়েই তিনি প্রচুর প্রার্থনা সঙ্গীত এবং প্রার্থনা বচন রচনা করেছিলেন। তিনি ছিলেন আক্কাডিয়ান সম্রাট সার্গনের কণ্যা। এ যাবত উদঘাটিত তথ্যের ভিত্তিতে যতদূর জানা যায় এনহেদুয়ানাই পৃথিবীর প্রথম নারী কবি।

যীশুর জন্মের আগে বেশ কিছু গ্রীক নারী কবির জন্ম হয়েছিল, তাদের মধ্যে সাপফো, কোরিনা, ক্লিওবুলিনা, এলেফন্টিস, মাইরো, নোসিস, প্রাক্সিলা, তেলেসিলা, আনিতে প্রমূখের নাম পাওয়া যায়। এরা সবাই খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ থেকে প্রথম শতকে জন্মেছিলেন। একজন রোমান এবং দু’জন চীনা মহিলা কবির নামও পাওয়া যায়, তারা হচ্ছেন যথাক্রমে কর্নিফিশিয়া এবং কনসোর্ট বান ও ঝুও ওয়েঞ্জুন। 

যীশুর জন্মের পরে যেসব নারী কবিদের জন্ম হয় তাদের মধ্যে চীনের কাই ইয়ানই  প্রথম নারী কবি। তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৫৭ সালে। চীন একটি বিশাল দেশ। বিভিন্ন সময়ে এই দেশটিকে বিভিন্ন রাজবংশ শাসন করে। আবার কখনো ছোট ছোট একেকটি অঞ্চল শাসন করে একেকটি রাজবংশ। তেমনি এক বিখ্যাত রাজবংশের নাম হ্যান রাজবংশ। এই বংশের এক পণ্ডিত ব্যক্তি কাই ইয়ং। কাই ইয়ংয়ের কন্যাই কাই ইয়ান। এই রচনায় কাই ইয়ানকে নিয়েই আলোচনা করবো।

চি প্রদেশের পাহাড়ে উপত্যকায় বেড়ে ওঠে কাইয়ের শৈশব – কৈশোর। তুষারাচ্ছাদিত পাহাড় চূড়া, কুয়াশাচ্ছন্ন দিবস কাইয়ের মনে এক প্রগাঢ় ছায়া ফেলে। সেই ছায়ার আড়ালে ঢাকা পড়ে জাগতিক চিন্তা। আর দশটি মেয়ের মতো কাই বিয়ে করে সংসারী হওয়া কিংবা মা হয়ে সন্তানের লালন পালনে মনোযোগী হননি। বরং তার মন বলতো অন্য কথা। বৈরী প্রকৃতি সম্প্রদায়ের মানুষের ওপর যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে প্রতি বছর এক প্রলম্বিতকাল জুড়ে তা কাইয়ের মনকে বিষণ্ণ করে তোলে। ভাবতে ভাবতে কাই লিখতে শুরু করেন। পিতার সংগ্রহে থাকা চার হাজার গ্রন্থ তাকে কবি হয়ে উঠতে সাহায্য করে সবচেয়ে বেশি। অবশেষে ৩৫ বছর বয়সে কাই বিয়ে করেন ওয়ে জংদাওকে। কিন্তু অল্প দিনের মধ্যেই তার স্বামী মারা যান। এ সময়ে হ্যান রাজবংশের প্রতিপক্ষ শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং যুদ্ধে হ্যান বংশকে পরাজিত করে রাজ্য দখল করে নেয় জিয়ংদু কনফেডারেশন। জিয়ংদু যোদ্ধারা কবি এবং সুন্দরী রাজকন্যা কাইকে তুলে নিয়ে যান। বন্দী থাকাকালীন সময়ে কাই বাধ্য হন জিয়ংদু প্রধান লিও বাওকে বিয়ে করতে। প্রথম স্বামীর ঘরে কোনো সন্তান জন্ম না নিলেও লিও বাওয়ের ঘরে কাই দুই সন্তানের জন্ম দেন। বারো বছর পর হ্যান বংশের প্রধান কাও কাও বড় অংকের মুক্তিপণ দিয়ে কাইকে ছাড়িয়ে আনেন। কাই তার মাতৃভূমিতে একাই ফিরে আসেন, সন্তানদের ফেলে আসেন জিয়ংদুর প্রাসাদে। মাতৃভূমিতে ফিরে এসে তিনি আবারো বিয়ে করেন। তার তৃতীয় স্বামী ডং সি ছিলেন একজন সরকারী কর্মচারী। বড় ধরণের দুর্নীতি করার কারণে ডং সির সাজা হয়। কাই স্বামীর মুক্তি চেয়ে কাও কাওয়ের কাছে আবেদন করেন। কাইয়ের বিষণ্ণতা সম্রাট কাও কাওকে পিড়ীত করে এবং তিনি ডং সি কে মুক্ত করে দেন। জীবনের এই উত্থান-পতন কবি হিশেবে কাইকে আরো সমৃদ্ধ করে। শত্রুর ঘরে দুই সন্তান, প্রথম স্বামীর মৃত্যু, তৃতীয় স্বামীর দুর্নীতি, এর প্রতিটি ঘটনাই কাইয়ের মনকে দুমড়ে মুচড়ে দেয়। কাইয়ের কবিতায় তাই বিষাদের স্বাদই বেশি। তার বিখ্যাত গ্রন্থটির নামও “বিষাদ ও ক্রোধের কবিতা”। 

কবি হিশেবে তিনি কাই ওয়েংজি নামে পরিচিতি লাভ করেন। তিনি তার পিতার মতোই একজন ভাল ক্যালিগ্রাফারও ছিলেন। কাই উপাখ্যান মূলত দুঃখ ও বিষাদের উপাখ্যান হলেও হ্যান রাজ্যে তার প্রত্যাবর্তনের ওপর প্রচুর শিল্পকর্ম তৈরী হয়েছে। তার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ওপর অঙ্কিত চিত্রকর্ম আজো আধুনিক বেইজিং অপেরায় শোভা পায়। কাই ওয়েংজির জীবনী নির্ভর প্রচুর নাটক তৈরি হয়েছে চীনে। সিচুয়ানের বিখ্যাত লেখক, কবি গুয়ে মোরু ১৯৫৯ সালে কাই ওয়েংজির জীবননির্ভর একটি নাটক লিখেন যেটি ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। 

কাই ওয়েংজির “বিষাদ ও ক্রোধের কবিতা” গ্রন্থ থেকে একটি কবিতার বাংলা অনুবাদ পাঠকদের জন্য এখানে উপস্থাপন করা হলো। এই কবিতাটি কাই ওয়েংজির কাব্যশক্তি সম্পর্কে আমাদের একটি সুস্পষ্ট ধারণা দেবে বলে আমি মনে করি। 

 

আমার আবাস প্রায় সব সময়ই কুয়াশা ও তুষারাচ্ছাদিত

ভিনদেশি বাতাশ পুনরায় বসন্ত এবং গ্রীস্ম এনেছিল যদিও

শীতল হাওয়া তবু ধীরে ধীরে আমার জামার ভেতরে ঢুকে পড়ে

আমি ওদের উগ্র শীৎকার শুনতে পাই

আবেগ আড়মোড়া ভাঙে, আমি শুনতে পাই পিতার কন্ঠ

শুনি মায়ের আদরের ডাক

এবং আমার ভেতর থেকে একটি শূন্য দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে যায়

যখন দূরাগত অতিথি আসে

তাদের আগমন সংবাদ আমাকে আনন্দ দেয়।

আমি ব্যাকুল হয়ে জানতে চাই

অতিথিরা আমার মাতৃভূমি থেকে আসছে কি-না।

 

সুপ্রাচীনকালে এশিয়া এবং দক্ষিণ ইউরোপে প্রচুর প্রতিভাবান নারী কবির জন্ম হয়েছিল। কিন্তু তাদের কোনো কর্মই সেইভাবে সমাদৃত হয়নি। কারণ পৃথিবীর কোনো সমাজই এটা সহজভাবে নেয়নি যে নারীর রচিত কবিতা পুরুষেরা পাঠ করুক এবং তার বাণী অনুযায়ী সমাজ বা ধর্মকর্ম প্রভাবিত হোক।  

হলিসউড, নিউ ইয়র্ক। ২২ জুন ২০১৬

Comments

Popular posts from this blog

শিল্পী কাজী রকিবের সাক্ষাৎকার

নন-একাডেমিক শিল্পীরাই নতুন কিছু দেয় -    কাজী রকিব  [কাজী রকিব বাংলাদেশের একজন গুণী শিল্পী। রাজশাহী আর্ট কলেজের একজন প্রতিষ্ঠাতা-শিক্ষক। কলেজের প্রথম ক্লাসটি নেবার কৃতিত্বও তাঁর। নিরন্তর ছবি আঁকেন। নানান মাধ্যমে ,  নানান ভাবনার ছবি। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে সস্ত্রীক বসবাস। তার স্ত্রী মাসুদা কাজীও একজন গুণী শিল্পী। বৈচিত্রপ্রিয় এই শিল্পীর একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন কবি কাজী জহিরুল ইসলাম। ধারাবাহিকভাবে তা এখানে প্রকাশ করা হবে। আজ উপস্থাপন করা হলো প্রথম পর্ব।]   জহিরুলঃ  বেশিরভাগ শিল্পীই নিজের একটা স্টাইল তৈরি করেন ,  নিজস্বতা যাকে আমরা বলি। আবার কেউ কেউ একই ধরণের ছবি বারবার আঁকেন। আপনার কাজে বৈচিত্র খুব বেশি ,  এতে করে "টাইপড" অপবাদ থেকে আপনি মুক্ত কিন্তু নিজের একটি স্টাইল তৈরি করতে না পারা বা তৈরি হয়নি বলে কি আক্ষেপ হয় ,  নাকি এই যে ভার্সেটিলিটি এটাই আপনি বেশি উপভোগ করেন ?    রকিবঃ   আমি আসলে আলাদা করে ভাবিনি এই স্টাইল বিষয়ে। কারো মতো আঁকারও চেষ্টা করিনি তেমন ভাবে। অল্প বয়সে ,  আমার ১৯ / ২০ বছর বয়সে ,  সালভাদর দালির মতো আঁকতে চেষ্টা করেছিলাম কিছুদিন ।

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জুর সাক্ষাৎকার || পর্ব ৭

মতিউর রহমান চৌধুরীকে  র‍্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কারের জন্য নমিনেট করেছিলেন  আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু       [লেখক, সাংবাদিক, অনুবাদক আনোয়ার হোসেইন মঞ্জুর সাক্ষাৎকারের সপ্তম  পর্ব আজ প্রকাশ করা হলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কবি কাজী জহিরুল ইসলাম।]          জহিরুলঃ  আপনার সাংবাদিকতা জীবনের প্রায় পুরোটাই ব্যয় করেছেন জাতীয় সংসদ কভার করে। এই সংসদে আমাদের সংবিধানের অনেকগুলো সংশোধনী পাশ হয়েছে। আমাদের নেতারা সব সময় বলেন, ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড় কিন্তু প্রকৃত চিত্র হচ্ছে দেশের চেয়ে দলের স্বার্থ বড় হয়ে ওঠে এবং দলের চেয়ে ব্যক্তির/পরিবারের স্বার্থই বেশি গুরুত্ব পায়। প্রধান প্রধান সংশোধনীগুলোর আলোকে যদি বিশ্লেষণ করেন কতোটা জাতীয় স্বার্থে আর কতটা ব্যক্তি বা পরিবারের স্বার্থে এইসব সংশোধনীগুলো করা হয়েছে।    মঞ্জুঃ   আপনি ঠিকই বলেছেন, এযাবত বাংলাদেশে ১১টি জাতীয় সংসদ গঠিত হয়েছে এবং এর মধ্যে দ্বিতীয় সংসদ থেকে নবম সংসদ পর্যন্ত মোট আটটি সংসদের অধিবেশন কভার করা সুযোগ হয়েছে আমার। আমার সংসদ কভারের সময়ে আমাদের সংবিধানের ১০টি সংশোধনী অনুমোদিত হয়েছে এবং সংশোধনী প্রক্রিয়া কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। এখন পর্যন্ত স

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জুর সাক্ষাৎকার - তৃতীয় পর্ব

মঞ্জু আমার ওপর রাগ করেছে                                                           - আল মাহমুদ [লেখক, সাংবাদিক, অনুবাদক আনোয়ার হোসেইন মঞ্জুর সাক্ষাৎকারের  তৃতীয় পর্ব আজ প্রকাশ করা হলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কবি কাজী জহিরুল ইসলাম।]  সাক্ষাৎকার নেবার এক পর্যায়ে আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু  ও কাজী জহিরুল ইসলাম। ওয়ান্টাগ পার্ক, নিউ ইয়র্ক।  ছবি তুলেছেন ড. মাহবুব হাসান।   জহিরুলঃ  খুশবন্ত সিং তার সকল বই অনুবাদ করার লিখিত অনুমতি দিলেন আপনাকে এবং সেই অনুমতিপত্রটি তিনি নিজ হাতে আপনার সামনেই বাংলায় লিখে দিলেন। তিনি কিভাবে বাংলা শিখলেন তা কি জানতে পেরেছিলেন ?  মঞ্জুঃ    জ্বি ,  ঘটনাটি  ঘটে  ১৯৯২ সালের ডিসেম্বর মাসে ,  এ সম্পর্কে আমি আগের এক প্রশ্নে বলেছি। তারিখটি আমার স্মরণে নেই। তবে বাবরি মসজিদ ধ্বংস করার পর ,  ডিসেম্বরের শেষ দিকে। না ,  বাংলায় নয় ,  উনি ইংরেজিতে লিখেছেন। আমার কফি পানের সময়ের মধ্যেই লিখে দিয়েছেন। ১৯৮৪ থেকে মাঝে দীর্ঘ বিরতি দিয়ে আমাকে তিনটি বা চারটি চিঠি লিখেছেন। লিখেছেন বলতে আমার চিঠির উত্তর দিয়েছেন। প্রতিটি চিঠি ইংরেজিতেই লিখেছেন। প্রতিটি চিঠিতে আমাকে সম্বোধন করেছেন  “ আনোয়ার ভাই ,”  বলে।