একুশের দিন জাতিসংঘে বইমেলা
|| কাজী জহিরুল ইসলাম ||
আজ একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রেজেন্টেশন ছিল। দাপ্তরিক কাজ। ওটা সেরে জাতিসংঘ সদর দফতরের জেনারেল এসেম্বলি হল থেকে বের হই। হাঁটতে হাঁটতে চলে আসি ভিজিটরস লবিতে। তখন দুপুর বারোটা। কী আশ্চর্য, এতো মানুষ কেন এখানে? টেবিল পেতে সাজানো হয়েছে বইয়ের পশরা। নানান দেশের, নানান বর্ণের মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়েছে টেবিলগুলোর ওপর। আমি এগিয়ে যাই। এক তরুণীকে জিজ্ঞেস করি, কি হচ্ছে এখানে? তরুণী জানায়, বইমেলা। তা তো আমি দেখতেই পাচ্ছি, আজ একুশে ফেব্রুয়ারি, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, তোমরা কি এই উপলক্ষেই বইমেলার আয়োজন করেছ। তরুণী বলে, হ্যাঁ। আমি ওকে জিজ্ঞেস করি, বলো তো এই দিনটি কীভাবে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হল? মেয়েটির শূন্য দৃষ্টি আমার চোখে। আমি বুঝতে পারি, ও জানে না। মেয়েটি তার বসকে ডেকে আনে। বসের নাম ডাফি, ষাট ছুঁই ছুঁই ছোটো খাটো এক নারী, গালে অসংখ্য রিংকলস, অভিজ্ঞতার প্রগাঢ় ছাপ। ডাফি একটি হালকা পাতলা ধারণা দেয়। অগুরুত্বপূর্ণ ভাষার অস্তিত্বরক্ষার প্রতিকী দিবস, এইসব বলে। আমি ওকে খুলে বলি কি হয়েছিল এই দিনে। কীভাবে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, সফিউর, আউয়াল, কিশোর অহিউল্লাহ মাতৃভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছিল। কীভাবে ঢাকার রাজপথ রক্তে লাল হয়ে উঠেছিল। ওদের চোখ অশ্রুসজল হয়। এবার আমি বলি যে ভাষার জন্য আজকের এই দিবস, সেই ভাষার কোনো বই দেখছি না কেন? ওরা আমতা আমতা করে। আমি নিজের পরিচয় দিই, বলি, আমি সেই বাংলা ভাষার মানুষ। বাংলা ভাষার একজন লেখক। ওরা আমাকে আঁকড়ে ধরে, আপনার লেখা বই আছে? দেবেন আমাদের? আমি বলি, হ্যাঁ দেব। অফিসে ২/৩টা বই আছে, অপেক্ষা কর, আমি নিয়ে আসছি।
ঘণ্টা খানেক পরে আমি ৩টি বই নিয়ে ফিরে যাই। হাতের কাছে ‘শেকড়ের খোঁজ’ ‘উটপাখিদের গ্রামে উড়ালসভা’ এবং ‘অসীম শূন্যতে তিষ্ঠ’ এই তিনটি বইই ছিল। সবগুলোই গতবছরের বই। সম্ভবত ওরা এর আগে আর কখনো বাংলা বর্ণমালা দেখেনি, ডাফি এবং ওর সহকর্মীরা বইগুলোর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। অক্ষরগুলো এমন মমতায় এবং শ্রদ্ধায় ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখে যেন রফিক, সালাম বরকতের পবিত্র রক্ত লেগে আছে অক্ষরগুলোর গায়ে। ডান থেকে বামে, নাকি বাম থেকে ডানে? কোন ভাষা পরিবারের সদস্য বাংলা? ইত্যাদি নানান প্রশ্ন ওদের। আমি একে একে ওদের প্রশ্নের উত্তর দেই। তখন আমাকে ঘিরে ছোটো খাটো একটি জটলা। যে মেয়েটির বাড়ি কাজাখস্তান, তাঁর আগ্রহের শেষ নেই। বইগুলোর নাম আমি যেন সঠিক বাংলায় উচ্চারণ করে ওকে শোনাই। এরপর অনুবাদ, এরপর একটি কবিতা পড়ুন, ইংরেজী করুন, কত কি? আমি কি বিরক্ত হচ্ছি? মোটেও না। ক’জন ভিনদেশি বাংলা বর্ণমালার প্রতি আগ্রহ দেখাচ্ছে, এর ইতিহাস, জন্ম, পরিবারের খোঁজ নিচ্ছে, আমার কবিতা বাংলায় শুনতে চাইছে, ইংরেজি তর্জমা জানতে চাইছে, এবং এর সবই ঘটছে একুশে ফেব্রুয়ারির দিন, এর চেয়ে আনন্দের ঘটনা আর কি আছে। এই বিদেশ বিভূঁইয়ে একুশে ফেব্রুয়ারির দিন অন্যান্য দিনের মতো কাজে এসেছি, অথচ মন পড়ে আছে ঢাকায়, শহিদ মিনারে, বইমেলায়। কিন্তু এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে এই পরবাস অর্থহীন নয়। বাংলা বর্ণমালাকে আমি ছড়িয়ে দিচ্ছি হাজারো বর্ণমালার ভেতর, শাদা, কালো, লাল, হলুদ মানুষের ভেতর।
বিদেশি পাঠকেরা হুমড়ি খেয়ে পড়েছে বাংলা বইয়ের ওপর
ডাফি অতি বিনয়ের সাথে বলে, অনুগ্রহ করে বইগুলো কি স্বাক্ষর করে দেবেন, আমরা লেখকের স্বাক্ষর সম্বলিত বই হিসেবে এগুলো বিশেষ মর্যাদায় ডিসপ্লে করবো। তখন মনে হয়, কিছু ছবি তুলে রাখা দরকার। ওদের এক সহকর্মীর হাতে সেল ফোনটা বাড়িয়ে দিতেই বেশ কিছু ছবি তুলে দিল, যখন আমি স্বাক্ষর করছি সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি বইমেলার জন্য আমার বইগুলোতে। বহু মেলায় বহু জায়গায় পাঠকের জন্য বইয়ে স্বাক্ষর করেছি কিন্তু আজকের এই অনুভুতিটি ছিল অন্য রকম, এক অসাধারণ ভালোলাগায় ডুবে ছিলাম আজ, ২০১৮-র একুশে ফেব্রুয়ারির দুপুরে।
দুজন ভিনদেশি পাঠকের সাথে লেখক
প্রতিষ্ঠানটির নাম ‘ইউনাইটেড নেশনস স্টাফ ওয়ান পারসেন্ট ফান্ড ফর ডেভেলপিং কান্ট্রি’। ডাফি জানালো ওরা প্রতি বছরই এই বইমেলাটির আয়োজন করে, তবে তারিখের কোনো ঠিক নেই। এ থেকে যা আয় হয় তা উন্নয়নশীল দেশের কোনো উন্নয়নমূলক কাজের জন্য পাঠিয়ে দেয়। আমি বলি, এখন থেকে তোমরা আয়োজনটি প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারিতেই করো। আমি তোমাদের বাংলা বই পেতে এবং বাঙালি দর্শক/ ক্রেতা পেতে সাহায্য করবো।
ম্যানহাটন, নিউ ইয়র্ক। ২১ ফেব্রুয়ারী ২০১৮।
Comments
Post a Comment