|| ড. মাহবুব হাসান ||
আমি কাজী জহিরুল ইসলামের কবিতা পড়েছি। খুব বেশিদিন হয়নি আমি তার কবিতা পড়ি। কিন্তু তারপরও আমি নিবিড়ভাবেই তাকে পাঠ করেছি বলে মনে হয়। তিনি অত্যন্ত স্পনটেনুয়াস। সময়কে তিনি গেঁথে তোলেন তার ভাষার সুঁই আর সুতো দিয়ে। ফলে সেই ফোঁড়গুলো সাম্যময় মাত্রিকতায় এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে দ্রুত চলে যায়। আবার মাকুর মতোই গেঁথে তোলেন সেই কবিতা-কাঁথাটি, যা আমাদের বোধ ও বুদ্ধির খোল-নলচেতে বেশ আনন্দ ও আরাম দেয়। আরাম দেয় এ-কারণে যে তা আমাদের সাংস্কৃতিক যাত্রায় সামিল এবং কালচারাল কন্টিন্যুআমের মধ্যে নিবিড় যোগসূত্র নির্মাণ করে। আমাদের লোকজ অভ্যাসে আছে, হাঁড়ির একটি ভাত টিপে দেখলেই বোঝা যায় সব ভাত ফুটেছে কি না। কবিতা রাঁধতে তিনি পেঁকে গেছেন এটা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
ফেসবুকে আমি তার কবিতা যাত্রায় সামিল ছিলাম। তখন আমি লস এঞ্জেলেসের পোমোনা সিটির বাসিন্দা। প্রায়ই আমরা কথা বলতাম ফোনে। তারপর ফেসবুকে তার কবিতা পড়ে বুঝেছি। এখন যখন নিউ ইয়র্কে আছি, রোজ না হোক সপ্তাহে একবার দেখা হয়। কথা হয় কবিতা নিয়ে। এর বাইরে আমাদের সামাজিক সম্পর্ক নেই বললেই চলে। তারপরও আমরা সমাজে বাস করি, কবিতায়ও সেই সমাজকে আমরা ফোকাস করি, নিজের চিন্তা আর স্বপ্নকে মেলে ধরি। বলবার চেষ্টা করি কোথায় কি হচ্ছে, কি হওয়া উচিৎ নয়।
কবিদের কথা সহজে বোঝা যায় না, আভাসে-ইঙ্গিতে বুঝে নিতে হয়। কখনো কখনো কবি আশ্রয় নেন উপমার, কখনো প্রতীকের হাত ধরে তিনি চলে যান কোনো এক অতীত কালের সাম্রাজ্যে। আবার অ্যালেগরি বা রুপকে যখন তিনি ফেরেন, সেই রূপকের রহস্যভেদ করা অনেকটাই দুরূহ। তবে কোনো কিছুই অগম্য নয়, যদি আমি সেই যাত্রায় মানসিকভাবে যুক্ত থাকি। যদি চিত্র আর চিত্রকল্পের মধ্যেকার পার্থক্য না বুঝি, যদি রূপক, উপমা, উৎপ্রেক্ষা, সমাসোক্তি ও শব্দালংকার কি সে-সম্পর্কে সম্যক আমার জানা না থাকে, যদি প্রচলিত ও অপ্রচলিত মিথিক স্টোরিগুলোর নাম-চরিত্র এবং অন্যান্য পরিপ্রেক্ষিত জানা না থাকে, তাহলে কবিতা পাঠের আনন্দ ব্যর্থ হতে বাধ্য। আর জানা থাকলে সেই পাঠ অনির্বচনীয় হবেই। এ-কারণে আমি কবিতার পাঠককে যোগ্য হয়ে উঠতে অনুরোধ করি। কবি নিজেও আসলে পাঠক। আমি সেই সব পাঠকের আশা করি যারা কবির চেয়েও বেশি চিন্তক এক নতুন চিন্তার খোরাক তৈরি করেত পারেন।
মূলত কাজী জহিরুল ইসলামের ‘ক্রিয়াপদহীন কবিতা’ই তার কবিতার প্রথম পাঠ আমার। এর আগে তার কবিতা আমি পড়িনি। বলা যেতে পারে আমার সেই সুযোগ হয়নি। তো, প্রথম পাঠেই আমি চিনেছি যে জহিরের ভেতরে স্বপ্ন আর কল্পনার জাল বুননের কায়দা-কানুন বেশ আছে। আর আছে চিন্তা করার অপার ক্ষমতা। কবিতায় যদি চিন্তার রেশ না থকে, তাহলে তা চর্বিত চর্বন হয়ে ওঠে। অর্থাৎ যদি আগে লেখা হয়েছে, সেই কবিতাই অন্য একজন তার নিজের ভাষায় লিখছেন,তাহলে তা অনুকারিতায় পরিণত হয়। রবীন্দ্রনাথের সময়-কালে দেখা গিয়েছিলো কিছু অনুকারী কবিকে। আমাদের কালে সে রকম চেষ্টা না হলেও প্রকৃত কবি হওয়ার যে শ্রম সেটা খুব একটা পাওয়া যায় না। আজকের সমাজ-বাস্তবতা এতোটাই চোরাস্রোত আর কন্টকিত পরিবেশ পরিস্থিতিতে আকীর্ণ যে, কবিকে নির্লিপ্তি পরিত্যাগ করতে হয়। তাই কবির মানস জটিল-জঙ্গমের অনুবর্তী হয়ে পড়ে। তখন কবি আশ্রয় নেন নানা মাত্রিক প্রতীক বা রূপকের। আমি কাজী জহিরুল ইসলামের কবিতায় সেই মানসিক ও মানবিক ক্রিয়ার জঙ্গম লক্ষ্য করেছি। তার ক্রিয়াপদহীন কবিতা পাঠ করতে করতে সেই অনুভবই আমার হয়েছিলো। এই যে কুড়িটি কবিতা এখানে পড়বো/পড়ছি সেগুলো কেমন, সেই স্বাদ নেয়া যাক একটু।
“জেনেভা, হে অনিন্দ্য সুন্দরী, বেরিয়ে এসো আমার পকেট থেকে
দেখো এক পৃথিবী ফেইস তোমার দিকে বাড়িয়ে দিয়েছে তৃঞ্চার্ত বুক।”
[পকেটে জেনেভা নিয়ে হাঁটছি]
এই পঙতি দুটিকে খুব সহজ বা সরল মনে হয়? যে সব কথা তিনি লিখেছেন, তার সব শব্দের অর্থই তো জানি, বুঝি আমরা। পাঠকেরও জানা আছে। তারপরও কেমন যেনো অচেনা লাগে। কারণ জেনেভা নামক শহরটিকে পকেটে নিয়ে হাঁটছেন কবি এটা বলার মানে কি? শহরটিকে কি পকেটে পোরা যায়? না যায় না, তাহলে এর মানে কি এটা নয় যে জহির যা লিখেছেন তা উদ্ভট আর অবাস্তব? অবশ্যই উদ্ভট এবং অবাস্তবও। তাহলে কি ধরে নেবো কবিরা অবাস্তব আর উদ্ভটেরই চড়নদার? এখানে এসেই আমি প্রিয় পাঠককে বলবো চিন্তা করে দেখেন জেনেভা কেন বিখ্যাত। সুইস এই শহরটিকে বলা হয় শান্তি আর মানবতার এক নিখিল শহর। কাজী জহিরুল ইসলাম সেই শান্তির দ্যূতিকে বলছেন বেরিয়ে এসো আমার পকেট থেকে, দেখো বাকি পৃথিবীর মুখ। তার তৃঞ্চা। কিসের জন্য তৃঞ্চার্ত আজকের পৃথিবী? সে কি জলপিপাসা-কাতরতায়? না। হ্যা, এ-কাতরতা জল পিপাসার নয়। এ-তৃঞ্চা মানবতার। মানুষের ভেতরের বোধ অমানবিকতার ক্ষারে দুষ্ট, তাই কবি আবাহন করছেন জেনেভাকে। তার ভেতরে রয়েছে সেই প্রতীকী শান্তির সুষমা যা আমাদের এই অমানবিক পৃথিবীর জন্য খুবই প্রয়োজন আজ।
“মিতু এবং নোবেলের সাথে বারবিকিউর
আগুন জ্বালাবে মাওরি বারান্দায়, হলো না।
ড্যানিয়েল বারসাতের ভাঙা চেয়ারে চড়ে
অক্সফোর্ড স্ট্রিট থেকে ট্রাফেলগার স্কয়ার অবধি
মানবিক ভ্রমণটা আর হলোই না রেহনূমা নূরের,
তোমার ওয়াটার জেট দিয়ে ভেজাতে চেয়েছিলে
আফগান মরু মঈনুস সুলতান, কিছুই হলো না।”
এই কবিতায় মানুষের ব্যর্থতার ছবি তুলে ধরেছেন কাজী জহির। ব্যক্তি নামগুলো প্রতীকী এটা বোঝা যায়। মানুষের ব্যর্থতা হচ্ছে আশার বিপরীত শব্দ। কিন্তু সেটা নতুন করে সংগ্রামেরই আহ্বান বলে মনে হয়। কারণ ব্যর্থতা ছাড়া সাফল্য আসে না। আমি লক্ষ্য করেছি কাজী জহিরুল ইসলাম খুব ছন্দপ্রিয় কবি। তিনি চান নিপাট ছন্দে সাজাতে তার বোধ ও বুদ্ধির কারুকাজ। বাংলা কবিতার তিনটি মূল ছন্দ, অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত আর স্বরবৃত্ত। এই তিনটি মূল ছন্দের মধ্যে মাত্রাবৃত্ত ছন্দে কবিতা রচনা একটু দুরূহ। শব্দের খেলা এই ছন্দে বেশ আনন্দের। তবে এই মাত্রাবৃত্তের আরো একটা নাম জানি, সেটাকে ৭ মাত্রা পর্বের মাত্রাবৃত্ত নামে কেউ কেউ ডাকেন। যে নামেই ডাকা হোক না কেনো, এর প্রবহমানতা কবির শক্তিমত্তাকে চিত্রিত ও চিহ্নিত করে। কবিতা শিল্পের কারিগররা জানেন যে ছন্দ হচ্ছে সেই শক্তি যার ডাক নাম আমরা দিতে পারি শিরদাঁড়া বা ইংরেজিতে স্পাইনাল কর্ড। মানুষের শারীরিক স্টাকচারটিকে খাড়া করে রাখে শিরদাঁড়া। আমি কবিতার শিরদাঁড়া হিসেবে চিহিৃত করতে চাই এই ছন্দকে। ছন্দ কবিতার শিরদাঁড়া হিসেবে কাজ করে। তাকে চরম প্রাপ্তির দিকে ঠেলে নিয়ে যেতে উদ্বুদ্ধ করে। কবির চেতনাকে শাসন করে, শব্দ-সহযোগকে যথার্থ করার প্ররোচনা দেয়। বাহুল্যকে পরিত্যাগ করতে সাহায্য করে। এ-সব কারণেই ছন্দ আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। আমি এ-সবই লক্ষ্য করেছি জহিরের কবিতায়। তিনি ছন্দের ব্যাপারে সজাগ এবং চান এমন কিছু সৃজন করতে যা তাকে নতুন ব্যঞ্জনায় পৌছে দিতে সাহায্য করবে। এবার দেখা যাক তার মাত্রাবৃত্তের কাজ।
“পাথর-খন্ড রক্তবৃষ্টিপাত
দরোজা খুলেছে এ-কোন সভ্য রাত
রাত নাকি দিন, আলো না আগুন জ্বলে
বোধের প্রান্ত নির্বোধ ঘুমে বোবা
ঝুলে আছে দূরে বহুরঙা নেকলেস
শিশুরা লাফায় প্রলুব্ধ আহ্লাদে
নিচে নেমে যায় বৃষ্টি-প্রহর দ্রুত”
[হাওয়ার নেকলেস]
সেই নমুনাই তুলে আনা হলো যেখানে কাজী জহিরের চিন্তাবৃত্ত নতুন করে দেখতে শিখেছে। এই কবিতাংশ কি কিছুটা জটিল-জঙ্গম মনে হয়? তা হতেই পারে। আবার তা পাঠককে নতুন চিন্তার দরোজাও মেলে দিতে পারে। একবার ভাবুন যে মানুষ কতোটা সাদাসিধে বা কতোটা জটিল। মানুষের মন কি পড়া যায়? যে পর্যন্ত আপনি মানুষের সাইকোলজিটা ধরতে না পারবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত কবিতার সাইকিটা আপনার হৃদয়ঙ্গম হবে না। ধরা যাক,‘হাওয়ার নেকলেস’ কবিতার দুটি পঙক্তি- ‘কালো দম্পতি খুঁজে পায় যদি ঘর/ না পেয়ে শিকার শাদা নেকড়ে কি ফেরে?’ এই কথাগুলোর মানে কি? আমরা যদি সিমবলিক কায়দায় শাদা-কালোর সামাজিক ও রাজনৈতিক চরিত্রকে ধরি, তাহলে গোটা পৃথিবীব্যাপি যে বর্ণবাদিতা চলছে তারই এক নগ্ন পরোক্ষ রুপ কি আমরা পাই না? এ-দুটি পঙক্তিতে কাজী জহিরুল ইসলাম কালো আর শাদার মধ্যেকার যে বিভেদের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও বর্ণবাদিতার রূপকে মেলেছেন, সেখানে মানবতা হার মেনে যায়। দুঃখজনক হলেও সত্য আজকে মানবতা নয় বর্ণবাদিতাই যেন মাথাচারা দিয়ে উঠছে পৃথিবীব্যাপী।
“মাটি সরে যায় ঘন-বর্ষণ স্রোতে
পুরনো বৃক্ষ ভেঙ্গে পড়ে একে একে
লেক-নদী ছেড়ে উঠে আসে জল মাঠে
জলহীন নদী, হাঙর দু’পায়ে হাঁটে
অভিবাসীগণ ছুটে যায় আরও দূরে
হাওয়ায় ভাসে বহুরঙা নেকলেস।”
আমাদের প্রবাস জীবনের প্রকৃত অবস্থার একটি রূঢ় ছবি এখানে উঠে এসেছে। ‘জলহীন নদী, হাঙর দু’পায়ে হাঁটে/ অভিবাসীগণ ছুটে যায় আরও দূরে’। হাঙরের কি দু’পা আছে? না নেই। তাহলে এই হাঙর যে মানুষ এবং সেই মানুষ শাদা রঙের এবং বর্ণবাদি সেই সত্যই কি উঠে আসেনি? আজকে আমেরিকান অভিবাসীরা ভীত সন্ত্রস্ত, সেই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে এই কবিতাকে বর্ণবাদিতার বিরুদ্ধে এক দলিল বলা যেতে পারে।
ষড়ঋতুর বোন, দিন-রাত্রির গল্প, অন্ধকার-২, দেহকাব্য-১১, ঘামসূত্র, অচেনা শহর, আঁড়ি, মধ্যবর্তী, বাড়ি আছো?--- এরকম আরও অসংখ্য কবিতা কাজী জহিরুল ইসলামকে মেলে ধরে তার মনোবাস্তবিক, সাংস্কৃতিক কন্টিনুআমসহ। তিনি তার বৃহত্তর লোকসংস্কৃতির আঙিনা থেকে সংগ্রহ করেন, সেই সব চিত্রকল্প যা আমাদের ট্রাডিশনের অন্তর্গত। বাংলা ভাষার একজন কবিকে চিনতে হলে তার কালচারাল কন্টিনুআমকে লক্ষ্য করবেন, কারণ সেখানেই লুকিয়ে আছে বাংলা ভাষা-সাহিত্যের উপাদান উপকরণ। কাজী জহিরুল ইসলামের কবিতায় সেই সৌন্দর্যই পাওয়া যায় যেখানে বৃহত্তর গণজীবনের মৌলিক উপকরণ ও উপাদানের ব্যবহার রয়েছে। আমরা আল মাহমুদকে কেন উঁচু স্তরের কবি বলে বিবেচনা করি? কারণ তার কবিতায় বাংলার লোকায়ত সংস্কৃতির অভিজ্ঞান পাই। আমাদের লোক ঐতিহ্যের সুদীর্ঘ যাত্রার প্রতিফলন আল মাহমুদে যেমন পাই তেমনি পাই কাজী জহিরুলের কবিতায়ও। সেই বিবেচনা অবশ্যই আমাদের মনে রাখতে হবে।
জ্যামাইকা, নিউ ইয়র্ক। নভেম্বর ২০১৬।


প্রিয় কবি কাজী জহিরুল ইসলামের অনবদ্য কবিতার চমৎকার পোষ্টমর্টেম করেছেন শ্রদ্ধেয় কবি ড: মাহবুব হাসান। দুজনের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
ReplyDelete