নরেন্দ্র মোদির দূরভিসন্ধি
|| কাজী জহিরুল ইসলাম ||
সংবিধানের ৩৭০ ধারা তুলে দিয়ে কাশ্মীরকে অশান্ত করে তোলে মোদি সরকার। ৩৭০ ধারা নিশ্চিত করেছিল কাশ্মীরের স্বায়ত্বশাসন এবং নিষিদ্ধ করেছিল বহিরাগতদের অনুপ্রবেশ। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহেরলাল নেহেরু কাশ্মীর প্রসঙ্গে বলেছিলেন, কাশ্মীর কাশ্মীরীদেরই থাকবে, কাশ্মীরের জনগণই সিদ্ধান্ত নেবে তাদের ভবিষ্যৎ কি হবে। কিন্তু মোদি সরকার এই ধারা তুলে দিয়ে কাশ্মীরকে ভারতের অন্যান্য অঙ্গরাজ্যের মত একটি সাধারণ অঙ্গরাজ্যে পরিণত করেছে। বিজেপির প্রধান অমিত শাহ কাশ্মীর প্রসঙ্গে নেহেরুকে দায়ী করেন। তিনি বলেন, নেহেরুর জন্যই কাশ্মীরের একটি বড় অংশ ভারতের হাতছাড়া হয়ে যায়। ৩৭০ ধারা তুলে দেবার ফলে এখন যে কেউ কাশ্মীরে জায়গা-জমি কিনে বাড়িঘর বানাতে পারবে, মিল কারখানা গড়ে তুলতে পারবে। এর প্রতিবাদে ফেটে পড়ে কাশ্মীরের জনগণ। সেই আন্দোলনে ইন্ধন জুগিয়েছে পাকিস্তান। এবং তা কঠোর হস্তে দমন করতে নেমে পড়েছে ভারতীয় সেনাবাহিনী। বিদ্যুৎ বন্ধ করে দিয়ে, ইন্টারনেট, টেলিফোন লাইন কেটে দিয়ে রাতের অন্ধকারে কাশ্মীরে গুম এবং হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে ভারতীয় সেনাবাহিনী। এ প্রসঙ্গে আমি বেশ ক’জন ভারতীয় বন্ধুর সঙ্গে কথা বলেছি। তারা তোতা পাখির শেখানো বুলির মত বলেছে, কিছুদিন পরেই সব ঠিক হয়ে যাবে। যখন কাশ্মীরের লোকেরা দেখবে, মিল কারখানা হচ্ছে, চাকরি-বাকরির ক্ষেত্রে তৈরী হচ্ছে, ভালো স্কুল-কলেজ হচ্ছে তখন সবাই বুঝে যাবে সরকার ঠিক কাজ করেছে। শিক্ষা-দীক্ষা এবং অর্থনৈতিক উন্নতিই আসল কথা, স্বাধীনতা কিছু না। কথাটা মোটেও নিতে পারিনি। আমি বলি, এক কাজ করো না, তোমরা ভারতকে আমেরিকার কাছে দিয়ে দাও। সবাই আমেরিকার পাসপোর্ট পাবে, আমেরিকার ফ্লাগ পাবে, এক লাফে উন্নত দেশের নাগরিক হয়ে যাবে ১২০ কোটি ভারতীয়, যাদের অধিকাংশই (ইউনিসেফের তথ্য মতে ৬২ কোটি) এখনো খোলা আকাশের নিচে হাগে। ওরা দুজন মুখ কালো করে উল্টো দিকে হাঁটতে শুরু করে।
এই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই মোদি সরকার নাগরিকত্ব আইন সংশোধনের বিল উত্থাপন করেছে এবং তা পাশ হয়ে গেছে। ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করে নতুন সংশোধনীতে যোগ করা হয়েছে, ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের আগে যেসব অবৈধ হিন্দু, বৌদ্ধ, ক্রিস্টান, শিখ, জৈন, পারসিক ধর্মাবলম্বী মানুষ পাকিস্তান,আফগানিস্তান এবং বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে ভারতে ঢুকেছে তাদেরকে প্রমাণ উপস্থাপন সাপেক্ষে নাগরিকত্ব প্রদান করা হবে। জন্মসনদ, ইমিগ্রেশন সীল ইত্যাদি প্রমাণ হিসাবে উপস্থাপন করা যাবে। এই সংশোধনীর দুটি মন্দ দিক আছে। প্রথমত সুনির্দিষ্ট কিছু ধর্মের মানুষের জন্য নাগরিকত্ব আইন সংশোধণ করা হয়েছে এবং নির্দিষ্ট করে মুসলমানদের বাদ দেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয়ত দালিলিক প্রমাণ সাপেক্ষে নাগরিকত্বের আবেদন করার বিষয়টি উন্নত বিশ্বের কাছে গ্রহনযোগ্য মনে হলেও উপমহাদেশে উপর্যুপরি দাঙ্গা এবং রায়টের ফলে পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বাধ্যতামূলক অভিবাসন ঘটেছে। এই অভিবাসন ছিল বড়ই বেদনাদায়ক এবং হৃদয়বিদারক। প্রাণ নিয়ে পালিয়ে বাঁচার অভিবাসন। এই প্রক্রিয়ায় এপার-ওপার হওয়া মানুষের কারোরই জন্মসনদ থাকার কথা নয়, পাসপোর্ট তো সুদূর পরাহত। আর ইমিগ্রেশন সীল! হাসবো না কাঁদবো? যারা দাঙ্গা বা রায়টের কারণে এক দেশ থেকে অন্য দেশে গেছে তাদের কারোরই কোনো দলিল দস্তাবেজ নেই যা তারা নাগরিকত্বের জন্য উপস্থাপন করতে পারে। এ প্রসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের সাংসদ ঋতাব্রত বন্দোপাধ্যায় সংসদে এক আবেগময় ভাষণে বিষয়টি উপস্থাপন করেন। পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়সহ রাজ্যের প্রায় সকল মানুষই এই সংশোধনের বিরোধিতা করে আন্দোলনে নেমেছে। থেমে নেই দেশের বাইরে থাকা উপমহাদেশের অভিবাসীরাও।
শুক্রবার, ১৭ জানুয়ারি ২০২০। দুপুর দেড়টা। তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচে। মেঘ আর রোদের লুকোচুরি খেলা চলছে। ফোর্টি সেভেন স্ট্রিটে ধীরে লোক জড়ো হচ্ছে। এক পা দুপা করে আমিও এগিয়ে যাই। আমার চোখে নিশ্চয়ই এমন কোনো ভাষা ছিল যা জড়ো হতে থাকা মানুষগুলো পড়তে পারছিল এবং সেই ভাষা তাদেরকে আমার প্রতি আগ্রহী করে তুলছিল। একজন বাংলাদেশি তরুণ এগিয়ে আসেন, তাঁর নাম আল আমীন। তিনি আমেরিকার সেনাবাহিনীতে কাজ করেন। গায়ে জলপাই রঙের জ্যাকেট, মাথায় ক্যাপ, গলায় ধুসর মাফলার, কাঁধে ব্যাগ, ব্যাগের হলুদ স্ট্র্যাপ বুকের ওপর আঁড়াআঁড়ি সেটে আছে। যুবকের হাতে প্লাকার্ড, তাতে লেখা, ‘স্টপ মোদি ফ্রম ডুয়িং হোয়াট হিটলার ডিড’। আমি বলি, এ-কথার অর্থ কি? এরই মধ্যে আরো চার-পাঁচজন লোক আমাকে ঘিরে ধরেছে। আল আমীন বয়সে তরুণ হলেও বেশ ঠান্ডা মাথার মানুষ। আমাকে সে ধীরে বলে, ৩৭০ ধারা বাতিল, নাগরিকত্ব আইন সংশোধন, এসবের মধ্য দিয়ে মোদি গ্রাউন্ড তৈরী করছে ভারতকে একটি হিন্দু রাষ্ট্র বানাবার জন্য। ওরা একসময় মুসলমানদের নিশ্চিহ্ন করতে শুরু করবে। গুজরাটে রায়টের জন্ম দেবার পরেও যে দেশের মানুষ মোদিকে ম্যান্ডেড দেয় সেই দেশের মানুষ এটাই চায়। সারা পৃথিবীর মানুষের এগিয়ে আসা উচিত এই কসাইয়ের হাত থেকে ভারতের মুসলমানদের বাঁচাতে। বিশ্ববিবেক জেগে না উঠলে মোদি বড় ধরণের গণহত্যা ঘটাবে। ক্রমশ সে হিটলার হইয়ে উঠছে। এরই মধ্যে অন্য একজন কর্মী যিনি মাইক্রোফোনের সংযোগ ঠিক করছিলেন, কাজ করতে করতেই আল আমীনকে ইংরেজিতে প্রশ্ন করেন, আপনার অসুবিধা হবে না, এই যে মিলিটেরিতে চাকরি করে আন্দোলনে নেমেছেন? আল আমীন পালটা প্রশ্ন করেন, কি অসুবিধা হবে? ভয় পেলেই ভয়। আমি তো কোনো অন্যায় করছি না। হত্যার প্রতিবাদ করতে এসেছি, মানবতার কথা বলতে এসেছি।
জুম্মার নামাজ শেষ হয়ে গেছে, ধীরে লোকজন বাড়ছে। প্রথমে ভেবেছিলাম বুঝি বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানের মুসলমানেরাই এই আন্দোলনের আয়োজন করেছে কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখতে পাই, মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমানেরাও যোগ দিয়েছে। ওরা ইংরেজিতে স্লোগান দিচ্ছে, জাতিসংঘ ভবনের দিকে মুষ্ঠি ছুঁড়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছে। মোদির মুসলিম নিধন ও তার হিন্দু রাষ্ট্র কায়েমের দুরভিসন্ধির কথা বক্তৃতায় তুলে ধরছে। কাশ্মীরের মানুষের অবর্ণনীয় কষ্টের কথা, নির্যাতনের কথা, খুন, গুমের কথাও তুলে ধরছে। পথচারীরা হয়ত যার গন্তব্যের দিকে ছুটে যেতে ভাবছে, এই হাড় কাঁপানো শীতের মধ্যে যেখানে মানুষ প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বেরুতে চায় না, এই লোকগুলো রাস্তায় দাঁড়িয়ে কী করছে? ওরা কী পাগল!
হ্যাঁ ওরা পাগলই। এমন পাগল পৃথিবীতে আছে বলেই এখনো টিকে আছে মানবতা।
নিউইয়র্ক। ১৭ জানুয়ারি ২০২০।

খাঁকি-গেরুয়া-চাড্ডির ত্রিফলায় জর্জরিত দেশ।
ReplyDelete