Skip to main content

সাংবাদিক মনজুর আহমেদের লেখা

আফ্রিকার সেই পান্থজন

কাজী জহিরুল ইসলাম  

|| মনজুর আহমদ || 





 

জহির আমাকে আফ্রিকার অন্তরমহলে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেই আফ্রিকাসেই দুর্গম রহস্যের আফ্রিকা। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়উদভ্রান্ত সেই আদিম  যুগে প্রাচী ধরিত্রীর বুকের থেকে ছিনিয়ে নিয়ে কৃপণ আলোর অন্তঃপুরে বনস্পতির নিবিড় পাহারায় বেঁধে রাখা সেই আফ্রিকা। বিদ্রুপ করছিলে ভীষণকে বিরূপের ছদ্মবেশেশঙ্কাকে চাচ্ছিলে হার মানাতে আপনাকে উগ্র করে বিভীষিকার প্রচন্ড মহিমায় তান্ডবের দুন্দুভিনিনাদে

 

সেই আফ্রিকা। সেই আফ্রিকা আমার কাছে চির দুর্গমই রয়ে গেল। বিশ্বময় নিজেরে ছড়িয়ে দিয়েও আফ্রিকা এখনও আমার দূরতিক্রম্য। নিজের দেশ থেকে বিশ্বের আর এক প্রান্তের দেশ আমেরিকায় এসে বসতি করেছিইউরোপের দেশে দেশে মন ভরে ঘুরেছিকিন্তু রহস্যাবৃত আফ্রিকার সাথে কোন সখ্য গড়ে তোলার সুযোগ আমার হয়ে ওঠেনি।   

 

এই সুযোগটাই পেয়েছেন কাজী জহিরুল ইসলাম। লেখক-কবি কাজী জহিরুল ইসলাম। সুযোগ পেয়েছেন আফ্রিকার দেশে দেশে যাওয়ারদেশে দেশে বেশ লম্বা একটা সময় কাটাবার। জাতিসংঘের চাকরি তাকে নিয়ে গেছে আফ্রিকায়। কিন্তু আফ্রিকায় বসবাসকে তিনি শুধু চাকরির পেছনেই কাটিয়ে দেননি। তিনি একটা প্রশংসনীয় কাজ করেছেনতিনি লিখেছেন। বুঝতেই পারি জহিরুল ইসলামের লেখক মন তাকে তাগিদ দিয়েছে তার আফ্রিকার অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখতে। তিনি লিখেছেন। যেখানে যেখানে গেছেন সেখানকার কথা কালি-কলমে রূপায়িত করেছেন। তিনি তার লেখক সত্ত্বার দায়িত্ব পালন করেছেন।

 

তার লেখা আমাকে আকৃষ্ট করেছে। তার লেখায় অদেখা-অচেনা আফ্রিকাকে কাছ থেকে ঘনিষ্ঠভাবে দেখার প্রয়াস পেয়েছি। বলেছিলেখার মধ্য দিয়ে জহির আমাকে আফ্রিকার অন্তরমহলে নিয়ে গিয়েছেন। আমার মতো  জহিরের লেখা পড়ার আগে আর কেউ কি জানতেন আইভরিকোস্টের কুলিবালির কথা। কিংবা তার লেখায় উঠে আসা সোয়াজিল্যান্ডের বাহাশুলেমাদাগাস্কারের রাজাফিমাহারোবতসোয়ানার চার্সল তালহার কথাকাজী জহির মিলেমিশে একাত্ম হয়ে গেছেন  সিয়েরা লিয়নঘানালাইবেরিয়ানিজারমালিসুদানকেনিয়া,   ইথিওপিয়ার মানুষদের সাথে।

 

ঢাকার পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ পাওয়া তার  লেখাগুলিআমি সাগ্রহে পড়তাম। ভাল লাগত। আফ্রিকাকেসেখানকার মানুষদেরকে আমার সামনে তুলে ধরার জন্য মনে মনে ধন্যবাদ জানাতাম তাকে। কিন্তু আফ্রিকার মত এই লেখকও তখন আমার অনেক দূরের মানুষ। কিছুই জানতাম না তার সম্পর্কে। শুধু জেনেছিলাম তিনি জাতিসংঘের একজন কর্মকর্তাসেই সুবাদেই তার আফ্রিকায় বসবাস।   

 

বড় অভাবিতভাবেই জহিরের সাথে দেখা সাক্ষাত পরিচয় হয়ে গেল এই নিউ ইয়র্কেরই পোকেপসিতে। সেখানে শামীম-রূপার বাসায় আমি কয়েকদিন তাদের আতিথেয়তায় কাটিয়েছি। সেখানেই হঠাৎ একদিন জহির এসে হাজির। আফ্রিকা থেকেই এসেছিলেন জাতিসংঘের কোনো একটা মিটিং-এ যোগ দিতে। শামিম আমাকে আগেই বলেছিলেন জহিরের আসার কথাকিন্তু বুঝতে পারিনি এই সেই কাজী জহিরুল ইসলাম যিনি আফ্রিকা থেকে লেখেন। আফ্রিকার পান্থজন হিসাবে যিনি আমার অনেক দিনের পরিচিত। শামীম সকালে তৈরি হচ্ছিলেন পোকেপসি রেল স্টেশন থেকে জহিরকে আনার জন্য। জহির স্টেশনে নেমে ফোন করবেন এমনটিই কথা ছিল। কিন্তু ফোন আর আসে নাজহির আদৌ এলেন কিনা তা নিয়ে সংশয়ে পড়লেন শামীম। খানিক পরেই দেখা গেল জহির এসে হাজির। স্টেশন থেকে দীর্ঘ পথ হেঁটেই চলে এসেছেন। বললেনভালই তো লাগল হেঁটে আসতে।

 

সেই প্রথম পরিচয়। প্রথম পরিচয়েই তার আফ্রিকার লেখাগুলির প্রসঙ্গ তুলে আমার ভাল লাগার কথা তাকে জানালাম। কদিন পরে জহিরের স্ত্রী এবং ছেলেও এসেছিল বাংলাদেশ থেকে। মনে আছেজহিরের সেবার নিউইয়র্ক আসা নিয়ে একটা বড় মজার কিন্তু বড় বিড়ম্বনার ঘটনা ঘটেছিল নিউ ইয়র্কের জাতিসংঘ পাড়ায়। ঘটনাটি ২০০৪ সালের আগস্ট মাসের। 

 

জে এফ কে-তে নেমে জহির তার লাগেজ মানে স্যুটকেস দুটি পাননি। রীতি অনুযায়ী সেগুলি বিমান সংস্থার কাছে হাওলা করে দিয়ে জহির চলে এসেছিলেন। পরদিন তিনি যখন জাতিসংঘ ভবনের কাছে অন্য একটি অফিসে মিটিং-এ ব্যস্ত তখনই ঘটল এক অঘটন। বিমান সংস্থার কাছে  তার ঠিকানা দেয়া ছিল জাতিসংঘে তার অফিসের এবং টেলিফোন নম্বর দেয়া ছিল তার এক সহকর্মীর।  তার লাগেজ খুঁজে পেয়ে বিমান সংস্থার কর্তারা তাদের লোক মারফৎ তা পাঠিয়ে দেয় সেই ঠিকানায়। ফোন করে তার সহকর্মীকে। কিন্তু তাকে ফোনে না পেয়ে মেসেজে জানিয়ে দেয় স্যুটকেস দুটি অফিসের লবিতে রেখে আসার কথা। সেখানে বেওয়ারিশ পড়ে থাকা স্যুটকেস দুটি মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং মুহূর্তেই খবর চলে যায় পুলিশের কাছে। পুলিশ দ্রুত ছুটে এসে পুরো এলাকা কর্ডন করে দেয়। বন্ধ করে দেয় যানবাহন-পথচারী চলাচল। বেশ কিছুক্ষণ ধরে চলে এই অবস্থা। এক পর্যায়ে বোমা বিশারদ এসে স্যুটকেস দুটি পরীক্ষা করে। ক্ষতিকর কিছু না পেয়ে পুলিশ স্যুটকেস দুটি নিজেদের জিম্মায় নিয়ে যায়। মিটিং থেকে বেরিয়ে নিচে নেমে জহির পুরো বিষয়টি জানতে পারেন এবং পরদিন জাতিসংঘ কর্মকর্তাদের সাথে নিয়ে পুলিশ দফতরে গিয়ে স্যূটকেস দুটি উদ্ধার করেন।

 

এই ঘটনা নিয়ে আমি তখন ঢাকার দৈনিক আমার দেশ-এ লিখেছিলাম।

 

কবি-লেখক কাজী জহিরুল ইসলামকে আমি আমার এই লেখায় আনিনি। যা লিখলাম তা সবই তার সাথে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক নিয়ে। অনেক লিখছেন জহির। কবিতায় নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছেন এবং সুধীমহলে প্রশংসিত হচ্ছেন।  

Comments

  1. অনেক ধন্যবাদ মনজুর ভাই।

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

অসাধারণ এই শিল্পীর জীবনের গল্প বড় করুণ

  [এই সময়ের অত্যন্ত প্রতিভাবান শিল্পী সারফুদ্দিন আহমেদ। বাড়ি পশ্চিমবঙ্গে। আর্ট কলেজে খণ্ডকালীন শিক্ষকতা করেন ,  আর শুধু ছবি আঁকেন। নানান মাধ্যমে ,  নানান বিষয়ের ছবি। সারফুদ্দিন আহমেদের ছবি থেকে চোখ ফেরানো যায় না ,  আপনাতেই ওঁর নান্দনিক সৃষ্টিকর্মে দৃষ্টি আটকে যায় ,  কী জল রঙ ,  কী অ্যাক্রিলিক ,  কিংবা স্রেফ পেন্সিলের ড্রয়িং। এই গুণী শিল্পীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কবি কাজী জহিরুল ইসলাম। সাক্ষাৎকারটি এখানে উপস্থাপন করা হলো।]       ভারত আমাকে চোখ দিয়েছে ,  বাংলাদেশ দিয়েছে দৃষ্টি -     সারফুদ্দিন আহমেদ     কাজী জহিরুল ইসলামঃ  ব্যাক গ্রাউন্ডে তবলা বাজছে আপনি ছবি আঁকছেন কাচের ওপর।    এই যে বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে ছবি আঁকা, এই ছন্দটা ছবিতে কিভাবে ধরেন? আর কোনো শিল্পী ছবি  আঁ কার সময় যন্ত্রানুসঙ্গ ব্যবহার করেছেন?   সারফুদ্দিন আহমেদঃ   কাঁচ নয়,   এটি এক বিশেষ ধরনের কাপড়-নেট। এই নেটের উপরে বর্তমানে আমার এক্সপেরিমেন্ট চলছে।    জহিরুলঃ ও ,  ফেইসবুকে যখন ছবিটি দেখি কাচের মতো ...

কাজী জহিরুল ইসলামের কবিতা || আবুল কাইয়ুম

কাজী জহিরুল ইসলামের কবিতা: জাতীয়-বৈশ্বিক মেলবন্ধন   || আবুল কাইয়ুম ||    কবি যদি হন বিশ্বপরিব্রাজক ,  তবে তিনি তো কবিতায় আঁকবেন তাঁর দেখা দুনিয়ার ছবি। বৃহত্ত্বকে আশ্লেষ করার পরিণামে স্বাভাবিকভাবে তাঁর মধ্যে জন্ম নেবে মানবিক মহত্ত্ববোধ ,  তা যে কাব্যাদর্শের লাঠিতে ভর করেই হোক। আশির দশক থেকে ক্রমবিকশিত কবি কাজী জহিরুল ইসলামের ক্ষেত্রেও একথা সত্যি । পর্যাপ্ত বিশ্বভ্রমণের অভিজ্ঞতায় আলোকিত হয়েছেন বলেই তিনি যে কোনো সঙ্কীর্ণতার উর্ধ্বে থেকে নিজেকে উদারনৈতিক মানবিক চৈতন্যে সংগঠিত করতে পেরেছেন ,  বিশ্বমানবতা ও বিশ্বশান্তির মন্ত্রে উজ্জীবিত রেখেছেন। তাঁর ব্যক্তিত্বে জড়ো হয়েছে বৃহত্তর সমষ্টিচেতনা ,  তাঁর প্রেম ও প্রার্থনা মানব কল্যাণের আশ্রয়ে গড়ে উঠেছে। তার লেখনীতে নানা দেশের মানুষের জীবন ,  সংস্কৃতি ,  প্রেম ,  ত্যাগ ও সংগ্রামের চালচিত্র কীভাবে উঠে এসেছে তা তাঁর কবিতার সংস্পর্শে না এলে বোঝা যাবে না। তাঁর  ‘ এল সালভাদর ’  শীর্ষক কবিতার কথাই ধরা যাক। এই অত্যুজ্জ্বল কবিতার মাত্র কয়টি বিস্ময়কর পংক্তিই শুধু এখানে তুলে ধরছি-    হণ্ডু...

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জুর সাক্ষাৎকার || পর্ব ৭

মতিউর রহমান চৌধুরীকে  র‍্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কারের জন্য নমিনেট করেছিলেন  আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু       [লেখক, সাংবাদিক, অনুবাদক আনোয়ার হোসেইন মঞ্জুর সাক্ষাৎকারের সপ্তম  পর্ব আজ প্রকাশ করা হলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কবি কাজী জহিরুল ইসলাম।]          জহিরুলঃ  আপনার সাংবাদিকতা জীবনের প্রায় পুরোটাই ব্যয় করেছেন জাতীয় সংসদ কভার করে। এই সংসদে আমাদের সংবিধানের অনেকগুলো সংশোধনী পাশ হয়েছে। আমাদের নেতারা সব সময় বলেন, ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড় কিন্তু প্রকৃত চিত্র হচ্ছে দেশের চেয়ে দলের স্বার্থ বড় হয়ে ওঠে এবং দলের চেয়ে ব্যক্তির/পরিবারের স্বার্থই বেশি গুরুত্ব পায়। প্রধান প্রধান সংশোধনীগুলোর আলোকে যদি বিশ্লেষণ করেন কতোটা জাতীয় স্বার্থে আর কতটা ব্যক্তি বা পরিবারের স্বার্থে এইসব সংশোধনীগুলো করা হয়েছে।    মঞ্জুঃ   আপনি ঠিকই বলেছেন, এযাবত বাংলাদেশে ১১টি জাতীয় সংসদ গঠিত হয়েছে এবং এর মধ্যে দ্বিতীয় সংসদ থেকে নবম সংসদ পর্যন্ত মোট আটটি সংসদের অধিবেশন কভার করা সুযোগ হয়েছে আমার। আমার সংসদ কভারের সময়ে আমাদের সংবিধানের ১০টি সংশোধনী অনুমো...