কাজী জহিরুল ইসলামের
আত্মপ্রতিকৃতি
১
কখনো ফ্রেঞ্চকাট কখনো মুখ ভরা দাড়ি
কখনো একা একা কখনো সাথে এক নারী
শীতে সে জবুথুবু গ্রীষ্মে থাকে ফুরফুরে
রোদেলা পথ পেলে হেঁটে সে যায় বহু দূরে।
পথে পথে থামে আর দেখে এটা-সেটা
হোমলেস গোবেচারী, কেউ কেউ আছে কেউকেটা
প্রতিবাদ সভা যদি কখনো দাঁড়ায় চত্বরে
লোকটির কালো চোখ জ্বলে ওঠে চকচক করে
নেইম কার্ড, লিফলেট, এটা-সেটা যা কিছু পায়
সাগ্রহে জ্যাকেটের দুইখানা পকেটে ঢোকায়
হাজারো কাগজে তার পকেটেরা বাবুইয়ের বাসা
কিছু কিছু ফাঁকা আর কিছু কালো অক্ষরে ঠাসা
মাঝে মাঝে থেমে গিয়ে দাঁড়ায় সে রাস্তার বাঁকে
সেলফোন বের করে কী কী যেন নোট করে রাখে
কখনো কাগজে লেখে, খুলে রাখে স্মার্ট সেলফোনও
সঙ্গে যে নারী হাঁটে একদিন হেসে বলে, শোনো
বেলা যে ফুরিয়ে গেলো সেই কথা কখনো কী ভাবো?
লোকটি অবাক হয়, আমি কী কোথাও আজ যাবো?
হেঁটে হেঁটে মাঝপথে, কোথাও হয়েছে বুঝি ভুল?
স্যুট-টাই পরে হাঁটে
নগরীর তল্লাটে
এই বোকা লোকটির নাম হলো কাজী জহিরুল।
নিউইয়র্ক। ২৯ জানুয়ারি, ২০২০।
২
আজকাল লোকটির নেশা খুব পানে
তাম্বুলরস নাকি খুব তাকে টানে
মুখে পান ঠোঁটে তোলে তৃপ্তির শিস
প্রথম পানের পিক পুরোটাই বিষ
বিষ ফেলে দিয়ে মুখ রসে টলোমল
দ্বিতীয় পানের পিক হলো অম্বল
ওটাকেও ফেলে দিয়ে হাসে সে স্মিত
এরপর পান হলো পুরো অমৃত।
মাঝে মাঝে কিউবান চুরুটে আগুন
সুখ টান দিয়ে গান করে গুনগুন
হুক্কাও আছে ঘরে লোকে বলে শিশা
খুব বেশি টানে যদি হয় বিবমিষা
মাথা ঘোরে, কাশি হয়, তবু দেয় টান
সপ্তাহে শিশা রোজ এক খিলি পান
মাঝে মাঝে ছবি আঁকে গাছ, পাখি, ফুল
লোকটি পাগল, নাকি কাজী জহিরুল?
হলিসউড, নিউইয়র্ক। ২৯ জানুয়ারি ২০২০।
৩
বুদ্ধিটা কম বলে কত কিছু বোঝে না
এই লোক অন্যের দোষ-ত্রুটি খোঁজে না
ঘুম থেকে উঠে বলে সকাল কী সুন্দর
পাখিদের ডেকে বলে গান গুনগুন ধর।
চুমু দিয়ে মেয়েদের রোজ ঘুম থেকে তোলে
সকালে আনন্দের দরোজা তো সে-ই খোলে
নাশতার টেবিলে দুই রাজকন্যা
ভোর বেলা এই ঘরে আনন্দ-বন্যা
সিঁড়ি দিয়ে চুপচাপ নিচে নামে অগ্নি
নিচ থেকে বিষ্ময়ে দেখে দুই ভগ্নি।
ছোটো মেয়ে নভোকে সে ইশকুলে নিয়ে যায়
স্কুল-বাস নিতে এলে জল হাসে দরোজায়
এভাবেই দিন শুরু হাঙ্গামা নেই কোনো
মাঝে মাঝে ফেইসবুক, অন করে সেলফোনও
কেউ বলে বোকা লোক, কেউ বলে কী জটিল!
কখনো তো কারো ঘরে ছোঁড়ে না সে কোনো ঢিল
হয়ত সে বোকা লোকই, হয়ত সে অসফল
কেউ কেউ বলে তাকে লোক খুবই দূর্বল
বোকা বলে অন্যের দোষ-ত্রুটি পায় না
কষ্টেরা তার কাছে তাই খুব যায় না।
নিউ ইয়র্ক। ৩০ জানুয়ারি ২০২০।
৪
হাঁটতে তো তার ভালোই লাগে হাঁটছে এ-লোক সবখানে
শুধুই কী সে হাঁটে, নাকি থাকে কিছুর সন্ধানে?
মাঝে মাঝে পথের ওপর দাঁড়িয়ে কী সব নোট করে
নোটের ফাঁকে ফাঁকে আবার উক্তি কিছু কোট করে।
আগে তো সব থাকতো মনে এখন কিছুই থাকে না
বুড়ো হওয়ার কী যন্ত্রণা ভোগাচ্ছে সে কাকে না!
শীতের ভোরে হাঁটতে গেলেই হাড়ে ধরে কাঁপন যে
তবু এ-লোক বেরিয়ে পড়ে, আকাশটা খুব আপন যে।
হাঁটতে গিয়ে বৃক্ষ দেখে শীতের মরা ডালগুলো
কবে আবার দেখতে পাবে চেরীফুলের লালগুলো
না হেঁটে তো উপায়ও নেই রক্তে প্রচুর শর্করা
স্বাস্থ্য ছাড়া কী আর হবে ডলার দিয়ে কড়কড়া?
মাথার চুলে পাক ধরেছে চশমা ছাড়া দৃষ্টি নেই
ক'দিন পরে এমন হবে, ভালোবাসার বৃষ্টি নেই
রাতের পরে সকাল আসে শীত পেরুলেই গ্রীষ্ম পাই
বুড়োকালের নেই কোনো পর লোক হয়ে যায় নিঃস্ব ভাই।
এ-চিন্তাটা দূরেই রাখে, চিন্তা তবু নেয় পিছু
খাঁচার পাখি উড়ে গেলে পালক পড়ে রয় কিছু।
হলিসউড, নিউইয়র্ক। ৩০ জানুয়ারি ২০২০।
৫
একদিন লোকে বলবে আঙুল তুলে
এসেছিল কেউ এইখানে পথ ভুলে
এখানে-ওখানে শুধু শব্দের ছবি
লোকটি বোধ হয় অভ্যাসে ছিল কবি।
লম্বা নাকি বেঁটে-খাটো ছিলো লোক?
তারও কি ছিল সাধারণ দুটি চোখ?
কালো ছিল চোখ, নাকি ছিল কিছু নীলও
মাথায় কি তার কাচা-পাকা চুল ছিল?
গোঁফ ছিল নাকি? চিবুকে লম্বা দাড়ি?
সারাদিন সে কি হাঁটতো পথেই,
পথই ছিল ঘর-বাড়ি?
থাকতো কি বসে সারাদিন চুপ করে?
খুঁজতো সে নীল অনন্ত অম্বরে?
এই যে কাঠের ছোট্ট টেবিলখানি
কত চিহ্নের করতল ঘষটানি
শবর্ষের পুরনো কাঠের তাক
কালশিটে কিছু গজিয়েছে ছত্রাক
ফাঁকে ফাঁকে বই, পঙক্তিরা ওঠে হেসে
অতীতের কবি লিখেছেন ভালোবেসে।
কেউ নেবে খোঁজ দূর অতীতের
ইতিহাস ঘেঁটে ঘেঁটে
কী করে এ-লোক পাড়ি দিত পথ
দূর্গম হেঁটে হেঁটে?
নিউ ইয়র্ক। ৩১ জানুয়ারি, ২০২০।
৬
আর কিছু নয় কবিতা লিখেই ক্যারিয়ার বর্বাদ
সারাদিন শুধু অক্ষর বোনে ছন্দের চাষাবাদ।
পড়াশোনাটাও হলো না তেমন ডিগ্রি মেলেনি বড়
দূর শৈশবে খাদ্য-কষ্ট ভাঙাচুরা ছিল ঘরও।
না হয় মেলেনি মাথার ওপর ইট-পাথরের ছাদ
সারা গায়ে তার চুম্বন ছিল কবিতার আহ্লাদ।
রোগা টিঙটিঙে দেহের ওপর উজ্জ্বল দুটি চোখ
সেই দুটি চোখে খুঁজে পেতো কি-যে রাজ্যের সব লোক।
এখানে-ওখানে তাকে ঘিরে কতো কথাদের আয়োজন
কিছু ভালো কথা আলোকোজ্জ্বল কিছু ছিলো গুঞ্জন।
কেউ বলে ছেলে একদিন খুব নামী দামী কেউ হবে
তাকে ঘিরে লোক মেতে উঠবেই মানবিক উৎসবে
কেউ বলে ধ্যাৎ গরীবের ছেলে লিখেছে না হয় কাব্য
তাই বলে রোজ পাড়া-পড়শিরা তাকে নিয়ে শুধু ভাববো?
যত্ন না পেলে ঝরে পড়ে ফুল এ-তো হামেশাই ঘটে
তাকে নিয়ে কত কথাদের কথা, আজও কত কথা রটে
সেই ছেলে আজ ছেলেদের পিতা কাঁচা-পাকা চুল-দাড়ি
সারাদিন ছোটে, হাঁটে আর খোঁজে কবিতার ঘর-বাড়ি।
হলিসউড, নিউইয়র্ক। ৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০
৭
ফুলের সাথে ভাব ছিল তার পাখির সাথে সখ্য
পাখির মতো উড়বে শুধু এটাই ছিল লক্ষ্য
ঝিঁ ঝিঁ পোকার গান শুনে তার কান হয়েছে বৃদ্ধ
পাখির কাছে ছন্দ শেখার অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ
তরঙ্গহীন দীঘির জলে হিজল ফুলের কার্পেট
রাজহংস ঝাড়ছে ডানা ছন্দে দোলে তার পেট
হাওয়ার তোড়ে বাঁশপাতারা বাজায় করতালি
রঙের জাদু শেখায় তাকে শুভ্র জুঁই শেফালি।
কেমন করে কাব্য লেখে ছন্দে এতো দক্ষ?
ফুল-পাখিদের শিক্ষা নিয়ে লোকটি পরিপক্ক
প্রকৃতি যার শিক্ষাগুরু পাঠশালা কী দরকার
সত্যের ওপর ঠাঁয় দাঁড়িয়ে নিজেই নিজের সরকার।
হলিসউড, নিউইয়র্ক। ৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০।
৮
প্রশংসা কপালের তিলক নিন্দা পুষ্পহার
ভালোবেসে নিন্দা কুড়ায় সাজায় সে সম্ভার
নিন্দা থেকে নিন্দাকারীর নামটি মুছে দেয়
স্বর্ণমুদ্রা করে তাকে বুক পকেটে নেয়
এ-মুদ্রাতেই সওদা করে বিশ্বলয়ের হাটে
সবাই ভাবে লোকটি বোকা এই ভব তল্লাটে।
হলিসউড, নিউইয়র্ক। ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২০।
৯
লোকটি যখন কিশোর ছিল বন বাদাড়ে ঘুরত
স্বপ্নের আগুন দিয়ে নিজের দুঃখগুলো পুড়ত
দুঃখপোড়া ছাই ছিটিয়ে করত জমি উর্বরা
পাখির সাথে সখ্য ছিল কন্ঠে সুখের সুর ভরা
গোল্লাছুট আর দাঁড়িয়াবাঁধা সঙ্গী ছিল নিত্য
কচুরিপানার নীল ফুলে তার উঠত নেচে চিত্ত।
ডাংগুলি আর নৈ খেলাতে তার ছিল না ক্লান্তি
জন্মগ্রামের জলকাদা-প্রেম হয় কি রে বিভ্রান্তি?
মাছশিকারে দারুণ নেশা ছুটত ডোবা-চাতালে
মদের নেশায় চুর হয়েছে কবে এমন মাতালে?
গোলাপ, বেলি, জুঁই, চামেলি এসব তো খুব তুচ্ছ
সর্ষে ফুলের হলুদ মেখে নাচত নেড়ে পুচ্ছ।
লোকটি যখন কিশোর ছিল বন বাদাড়ে ঘুরত
উড়াল শেখার আগেই এ-লোক ঘুড়ির সাথে উড়ত।
হলিসউড, নিউ ইয়র্ক। ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০।
১০
কিছুই থাকে না মনে ভুলে যায় সব
নিজেই নিজেকে সে
রেগে গিয়ে অবশেষে বলে গর্দভ।
গাধার আদলে গড়া মজবুত কাঁধ
দিন-রাত বোঝা টানে
হাসিমুখে সজ্ঞানে সইছে আঘাত।
কেউ কেউ আহা উঁহু, দেখায় দরদ
মুখ টিপে কেউ হাসে
তবুও তো বোঝে না সে লোকগুলো বদ।
ছোঁয় না ব্যাথারা তার আধপাকা চুল
লেগে আছে হাসি ঠোঁটে
গোপন আঁধারে ফোটে কষ্টের ফুল।
এই বোকা লোকটির নাম জহিরুল।

নিজেকে নিয়ে লেখাগুলো খুবই সুন্দর।
ReplyDelete