জিন্নাহ সেক্যুলার পাকিস্তান চেয়েছিলেন
- মঞ্জু
[লেখক, সাংবাদিক, অনুবাদক আনোয়ার হোসেইন মঞ্জুর সাক্ষাৎকারের চতুর্থ পর্ব আজ প্রকাশ করা হলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কবি কাজী জহিরুল ইসলাম।]
জহিরুলঃ নিজে ধর্মচর্চা না করেও ধর্মভিত্তিক একটি রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়ে জাতির পিতার মর্যাদায় ভূষিত হয়েছেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, নিজে শ্রমিক না হয়ে শ্রমিকদের নিয়ে গঠিত রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব দিতে দেখা যায় অনেক নেতাকে, কট্টর কম্যুনিস্টকে দেখি আমেরিকার কঠোর সমালোচক হয়েও আমেরিকাতেই অভিবাস গ্রহন করেন। আপনার মধ্যে মুসলিম সংস্কৃতি ও জীবনাচারের প্রতি পক্ষপাত লক্ষ্য করেছি, ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণে জানি আপনি ধর্মের রীতিনীতি ও রিচুয়ালসের চর্চা তেমন করেন না। নবী মোহাম্মদ (স) যে নিজে মিষ্টি খাওয়া বন্ধ করে অন্যকে না খেতে উপদেশ দিয়েছেন সেই আলোকে এই বিষয়গুলো আপনি কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
মঞ্জুঃ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে আপনাকে বলতে পারি যে, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ’র ব্যক্তিগত ধর্ম চর্চা করা না করার সাথে পাকিস্তান নামে মুসলমানদের একটি পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কোনো সম্পর্ক ছিল না। তিনি ধর্মীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করেননি এবং ধর্মীয় রাষ্ট্রের জাতির পিতাও হননি। তাঁর আন্দোলন ছিল মুসলমানদের পৃথক আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার আন্দোলন, কারণ এ-ছাড়া বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতে মুসলমানদের মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প ছিল না। জিন্নাহ কখনোই বলেননি যে তিনি পাকিস্তানকে একটি ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করতে যাচ্ছেন। এমনকি ১৯৪৭ সালের ১১ আগস্ট তিনি গণপরিষদে যে ভাষণ দেন, তাতে তিনি যে কথাগুলো বলেছেন তা হচ্ছে, আমাদের সামনে যে আদর্শ থাকবে তাতে সবাই দেখবেন যে ধর্মবোধ থেকে এক সময়ে হিন্দুরা আর নিজেদেরকে হিন্দু ভাববে না, মুসলমানেরা নিজেদেরকে আর মুসলমান বলে ভাববে না, কারণ ধর্ম প্রত্যেকের ব্যক্তিগত বিশ্বাসের ব্যাপার, কিন্তু রাজনৈতিক চিন্তাবোধ থেকে প্রত্যেকে নিজেকে রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে ভাববে। জিন্নাহ পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়ন পর্যন্ত জীবিত ছিলেন না। ১৯৪৮ সালেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। সংবিধান প্রণয়ন পর্যন্ত তিনি জীবিত থাকলে গণপরিষদে জিন্নাহর দেবক্তব্যই পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হতো বলে এক পক্ষ দাবী করেন এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানিদের অধিকাংশের যুক্তিও সেটি।
কিন্তু গণপরিষদের এক পক্ষ, যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল, জিন্নাহ’র বিভিন্ন সময়ের ইসলাম বিষয়ক বক্তব্যের জের টেনে পাকিস্তানকে ইসলামী প্রজাতন্ত্রে পরিণত করার জন্য উঠে পড়ে লাগে। সেই সব বক্তব্যে জিন্নাহ বলেছিলেন, ইসলাম শুধু আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গি, বিধিবিধান, রীতিনীতি, উৎসব আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, সমগ্র মুসলিম সমাজ, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রকে যৌথভাবে ও এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করার পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। “অবজেকটিভ রেজ্যুলিউশন” নিয়ে গণপরিষদের বিতর্কে তারা যুক্তি দেন যে, জিন্নাহ সংখ্যালঘুদের যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, মুসলমানদের যেসব দিয়েছেন ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা সেই প্রতিশ্রুতির অন্যতম। এই বিতর্কের শেষ হয়নি, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার নয় বছর পর ১৯৫৬ সালের সংবিধানে পাকিস্তানকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু জিন্নাহর ১১ আগষ্টের ভাষণ ছিল সুস্পষ্টভাবে পাকিস্তানের সেক্যুলার মেনিফেস্টো। এর পক্ষে আরেকটি দৃষ্টান্ত দেয়া হয়, জিন্নাহ পাকিস্তানের উদ্দেশে দিল্লি ত্যাগ করার সময় ইস্কান্দার মির্জা তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলেন যে, আমরা তো সবাই পাকিস্তানে যেতে প্রস্তুত, কিন্তু পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিচয় কী হবে? আপনি কী পাকিস্তানকে ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে যাচ্ছেন?’ জিন্নাহর উত্তর ছিল, ‘ননসেন্স, আমি একটি আধুনিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে যাচ্ছি।’ দীর্ঘদিন আগে আমি জিন্নাহর ওপর একটি বই পড়তে গিয়েও দেখেছি যে, পাকিস্তানে নিযুক্ত ভারতের প্রথম হাইকমিশনার শ্রী প্রকাশের সাথে একাধিক সাক্ষাতে পাকিস্তানকে তিনি সেক্যুলার রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার ইচ্ছার কথা বলেছেন। তাছাড়া পাকিস্তানের গণপরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন যোগেন্দ্র নাথ মণ্ডল নামে একজন হিন্দু। পাকিস্তানকে যদি ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করার ইচ্ছা জিন্নাহ’র থাকতো, তাহলে পাকিস্তান গণপরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে অন্তত একজন হিন্দুকে নির্বাচিত করা হতো না। অতএব, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে একটি মুসলিম নেশন স্টেট এর জাতির পিতা বলা যায়, ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের জাতির পিতা নয়।
বৈপরীত্য মানুষের বৈশিষ্ট। প্রতিটি ধর্মগ্রন্থে এজন্য সতর্ক করা হয়েছে। কোরআনে বলা হয়েছে, “লেমা তা কুলুনা মা’লা তাফালুন,” – তোমরা যা করো না তা বলো কেন। কিন্তু চোরা না শুনে ধর্মের কাহিনি। আমাদের দেশে প্রাইমারী স্কুল শিক্ষকদের নেতা ছিলেন একজনবিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। শ্রমিক না হয়েও শ্রমিকদের নেতা হিসেবে খ্যাত ছিলেন কাজী জাফর আহমেদ। শেষ পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর পদও অলঙ্কৃত করেছিলেন। এমন অনেক আছে। আমাদের দেশের কমিউনিস্ট নেতা বা প্রবক্তাদের পুঁজিবাদী দেশে আশ্রয় নেয়ার ঘটনা তো আমরা কমই দেখি। আমি একটা পরিসংখ্যানের কথা স্মরণ করতে পারি। চীনের পলিটব্যুরোর নয় জন নেতার মধ্যে সাত জনের সন্তান পড়াশোনা করতেন যুক্তরাষ্ট্রে। তাদের অনেকে আর চীনে ফেরত যাননি। নবী মোহাম্মদের নিজে মিষ্টি খাওয়ার অভ্যাস পরিত্যাগ করে একটি শিশুকে মিষ্টি না খাওয়ার উপদেশ দেয়ার ঘটনার সত্যতা নিয়ে কথা আছে। কিন্তু কোনো বিষয়ে কাউকে উপদেশ দিতে হলে আগে নিজেকে সে বিষয়ে অনুশীলন করতে হবে। আমরা সচরাচর বলে থাকি, “আপনি আচরি ধর্ম পরকে শিখাবে।” কথাটি আমরা অহরহ বলি, কিন্তু নিজের ক্ষেত্রে পালন বা চর্চা করি না।
জহিরুলঃ সুফি দর্শনের প্রতি আপনার গভীর আগ্রহ আছে, রুমি কিংবা তাবরেজির জীবন দর্শন দ্বারা আপনি অনুপ্রাণিত, তাদের কাজ বাংলায় অনুবাদ করেছেন। সুফি দর্শন আসলে কি? আপনি নিজে কি একজন সুফিবাদের অনুসারী, যদি হন, কিভাবে আপনি সুফি চর্চা করেন?
মঞ্জুঃ আপনি ঠিকই বলেছেন যে সূফি দর্শনের প্রতি আমার বেশ আগ্রহ আছে। মাওলানা জালালুদ্দীন রুমির জীবন দর্শন আমাকে সূফিবাদ সম্পর্কে জানতে আগ্রহী করেছে। শামস-ই-তাবরিজী সম্পর্কে জানতে পারি অনেক পরে। আপনি তো জানেন, ব্রিটিশ রাজশক্তি উপমহাদেশে তাদের শাসন প্রতিষ্ঠার আগে সমগ্র ভারতবর্ষ প্রায় সাতশ’ বছর মুসলিম শাসনাধীনে ছিল, যার মধ্যে তিনশ বছর ছিল মোগলদের অধীনে। এই দীর্ঘ সময়ে ভারতের অফিস আদালতে ফারসি ভাষা ব্যবহৃত হতো। শিক্ষার মাধ্যমও ছিল ফারসি। ফারসি ভাষার প্রভাব ছিল ব্যাপক। ইংরেজরা যেহেতু মুসলিম শাসকদের হটিয়ে শাসনক্ষমতার অধিকারী হয়েছিল, সেজন্য ক্ষমতায় এসে মুসলমানদের কোনঠাসা করার জন্য যা যা করার তা করেছে। কিন্তু তা সত্বেও তাদের দুশ’ বছরের শাসনামলে ইংরেজি ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেও ফারসিকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করতে পারেনি। ইংরেজির মধ্যে বহু শব্দকে তারা গ্রহণ করেছিল, যাতে জমিজমা, প্রশাসন, ব্যবসা, আদালতের কাজে বহু ফারসি শব্দ, যা সাধারণ মানুষ সহজে বুঝতো সেগুলো বাদ দিতে পারেনি। দৈনন্দিন জীবনে আমরা কথা বলার সময় এখনো বহু ফারসি শব্দ ব্যবহার করি, যে শব্দগুলো বাংলাভাষার শব্দ ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে। ঢাকাস্থ ইরানি দূতাবাসের তত্বাবধানে পরিচালিত ইরানি সংস্কৃতি কেন্দ্র একবার ফারসি ভাষার প্রভাবের ওপর একটি জরিপ চালিয়ে বাংলাদেশে আট হাজারের অধিক ফারসি শব্দের অস্তিত্ব পেয়েছে। পাকিস্তানি শাসনামল পর্যন্ত বাংলাদেশের আলিয়া মাদ্রাসাগুলোতে ফারসি ও উর্দু ভাষা চালু ছিল এবং মাদ্রাসা শিক্ষিতরা আরবির পাশাপাশি ফারসি ও উর্দু সাহিত্যের চর্চা করতো। খারেজি ও কওমি মাদ্রাসাগুলোতে ফারসি ও উর্দু চর্চা আরো বেশি হতো। এখন সীমিত আকারে চালু আছে বলে জানি। কারণ বাংলাদেশে ফারসি ও উর্দু শেখানোর শিক্ষক এখন বলতে গেলে পাওয়াই যায় না।
আপনি তো জানেন, বাংলাদেশে প্রতিবছর শীত মওসুমে গ্রাম এলাকায় ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন করা হতো। সেসব মাহফিলে খ্যাতিমান মাওলানা ও ওয়ায়েজিনরা আসতেন। ছোট সময় দাদার হাত ধরে অনেক ওয়াজ মাহফিলে গেছি। পরবর্তী সময়েও বন্ধুবান্ধবের সাথে গেছি। ওয়াজের প্রতি তেমন মনোযোগী হতে না পারলেও মাওলানা সাহেবদের মুখে গানের সুরে উচ্চারণ করা দুর্বোধ্য ফারসি বয়েত শুনতে ভালো লাগতো। তারা যেসব ব্যক্তির বয়েত গাইতেন, তাদের মধ্যে মাওলানা জালালুদ্দীন রুমি, শেখ সা’দী, হাফিজ, ইমাম গাজ্জালীর নাম বেশি শুনেছি। নামগুলো মনে গেঁথে গিয়েছিল। স্কুলের ওপরের ক্লাসে ওঠে কাজী নজরুল ইসলামের অনুবাদে ‘দিওয়ান-ই-হাফিজ’ পড়েছি, শেখ সা’দীর ‘গুলিস্তান’ পড়েছি। কিশোর বয়সেই ‘গুলিস্তান’ একাধিকবার পড়েছি। উপদেশমূলক বাণীর সাথে প্রেমমূলক বাণীও আছে এই কাব্যগ্রন্থে, অশ্লীলতাও আছে। কিন্তু যেহেতু শেখ সা’দীর কবিতা অতএব তাঁর অশ্লীল কবিতাগুলোকে কেউ অশ্লীল বিবেচনা করতো না। বিশেষ করে শেখ সা’দী রচিত “বালাগাল উলাবি জামালিহি, কাশাফাদ দোজাবি জামালিহি, হাসুনাত জামিউ খিসালিহী, সাল্লু আলাইহি ওয়ালিহী” তিলাওয়াত ছাড়া বাংলাদেশে মিলাদ মাহফিল কল্পনাই করা যেতো না, এখনো এই ফারসি বয়েত ছাড়া মিলাদ অনুষ্ঠান অকল্পনীয়। অতএব শেখ সা’দী তাঁর কবিতায় উপমা হিসেবে নারী-পুরুষের স্পর্শকাতর অঙ্গ হাতাহাতি করলেও তাঁর মর্যাদা ও সাবর্জনীন গ্রহণযোগ্যতার কারণে তাঁর কবিতা চর্চাকে বরং পূণ্যের কাজ ভাবতো। কারণ গ্রন্থটির ভূমিকা অনুযায়ী এতে কোরআন ও সুন্নাহর মর্মানুযায়ী কিসসা-কাহিনি ও উপদেশাবলী সন্নিবেশিত হয়েছে। যেহেতু আজকাল বাংলাদেশে আধুনিক মানুষ খুব সা’দী বা হাফিজ চর্চা করেন না, তারা সা’দী সম্পর্কে আমার বক্তব্যকে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ বলে ভাবতে পারেন। সেজন্য আমি আমার মুখস্থ করা শেখ সা’দীর কয়েকটি বয়েত আপনার মাধ্যমে পাঠকদের জানাতে চাই। আরেকটি হচ্ছে: “পীরে হাফতাদ সালাহ জানে মফুনা/কোরে মোকারি বখার নয় চশ রোশ/জোরে বাইয়াদ না জর কে বা জানুরা/গাজরে ছাখত বেহকে দাহমন গোশ” (সত্তরের বৃদ্ধ কখনো যুবকের মতো হতে পারে না/জন্মান্ধ যেমন স্বপ্নেও দৃষ্টি ফিরে পায় না/নারীর জন্য প্রয়োজন পুরুষের শক্তি, বিপুল বিত্ত নয় /পুরুষাঙ্গ তার কাছে দশ মণ মাংসের চেয়ে উত্তম।” এমন অনেক বয়েত আছে, আমি আর একটি উল্লেখ করেই এ প্রসঙ্গ শেষ করবো: “রুয়ে জীবা জামায়ে দীবা/সিনদুল ওউদ ওরঙ্গ ও বুয়ে ও হাউছ/ই’হামা জিনাতে জেনানে বাশাদ/মরদেরা কির ও খাইয়া জিনাত বছ” (আকর্ষণীয় চেহারা ও দামী পোশাক/সিঁদুর চন্দন রঙ ও সুগন্ধি/ এসব মিলেই নারীর সৌন্দর্য, আর/পুরুষের আসল সৌন্দর্য হলো তার লিঙ্গ ও অণ্ডকোষ)। শৈশবে আমরা অনেকে পাঠ্যবইয়ে শেখ সা’দীর একটি কবিতার বঙ্গানুরূপ পড়েছি। কে সেই কবিতাটি বাংলায় কাব্যানুবাদ করেছেন এ মুহূর্তে আমার মনে নেই। অসাধারণ লাগতো। কবিতাটির মর্মকথা ছিল, ‘একদিন প্রিয়ার হাত থেকে সুগন্ধিযুক্ত এক টুকরা মাটি আমার হাতে এলো। সুগন্ধিতে মুগ্ধ হয়ে মাটিকে বললাম, তুমি কী মেশক, না কি আম্বর। মাটি বললো, আমি নিকৃষ্ট মাটি ছিলাম, কিছু সময়ের জন্য সুগন্ধিপূর্ণ গোলাপের সংস্পর্শে আসি, সেই সাহচর্য আমাকে সুগন্ধি দিয়েছে; তা না হলে আমার মাঝে তো শুধু মাটির গুণই বিদ্যমান ছিল। বড় হয়ে সেই অসাধারণ ফারসি বয়েত পড়ার সুযোগ হয়েছে: “গুলে খুশবু ইয়েদর হাম্মামে রোযজ/রছিদ আজ দস্তে মেহবুবে বদস্তম/বদু গুফতাম কে মেশকি ইয়া আবেরি/কে আজ বুয়ে দেলাবিজে তুমস্তম/বগুফ্তা মান গুলে না-চিজে বুদাম/ওয়ালেকিন মুদ্দতে বা-গুল নেশাস্তম/জামালে হামনশি দরমান আছর করদ/ওয়াগার না মান হুমা খাকম কে হাস্তম।” আমাদের শৈশব-কৈশোরে সামান্য অশ্লীল শব্দমালা সমৃদ্ধ বাংলা বইগুলোর ওপরে লেখা থাকতো “কেবলমাত্র প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য”, কিন্তু ‘গুলিস্তান’ বা এ ধরনের বইয়ে কোনো নিষেধাজ্ঞা ছিল না। কভারগুলো ছিল ইসলামী বইয়ের কভারে এখন যেমন ইসলামী শিল্পকলার বৈশিষ্ট থাকে সেইরকম এবং সম্মানের সাথে সংরক্ষণ করা থাকতো। এগুলো সহজলভ্যও ছিল। স্কুলের কোনো প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের পুরস্কার হিসেবে এই বইগুলো দেয়া হতো। কিন্তু জালালুদ্দীন রুমির কোনে বই তখনো আমার হাতে পড়েনি বা পড়ার সুযোগ পাইনি। জালালুদ্দীন রুমির কবিতার সাথে আমার পরিচয় ঘটে অনেক পরে ২০০০ সালের পর। বলতে পারেন পরিণত বয়সে। তাঁর প্রেমের কবিতা, মসনবীর অংশবিশেষের সঙ্গে পরিচয় ঘটে। কবিতা যেহেতু ভালো লাগতো, রুমির কবিতাও ভালো লাগে এবং রুমির কবিতার মধ্য দিয়ে আরো অনেক সূফি কবির কবিতা পড়তে থাকি। রুমির সূত্র ধরে পরিচয় ঘটে তাঁর উস্তাদ খ্যাত শামস-ই-তাবরিজীর সাথে। রুমির জীবনে শামস এর রহস্যময় আবির্ভাব ও অন্তর্ধান তাঁর সম্পর্কে জানতে আমাকে আগ্রহী করে তোলে। এভাবে সূফি ব্যক্তিত্ব, সূফি সাহিত্য, সঙ্গীত ও ঘূর্ণায়মান নৃত্য সম্পর্কে আমি আরো বেশি জানার চেষ্টা করি। আমি নিজেকে সূফিবাদের অনুসারী বলে মনে করি না। আমি সূফিবাদ চর্চা করি না। আমার কৌতুহল ও আগ্রহের স্থান হলো সূফি সাহিত্য, যা আমি অনেকের মতো সূফি সাহিত্যের প্রতি অনুরাগী বাংলাভাষী পাঠকদের কাছে আধুনিক বাংলায় তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আমার এ চেষ্টার অংশ হিসেবে আমি অনুবাদ করেছি কোলম্যান বার্কস এর ইংরেজি কবিতা সংকলন “দ্য সোল অফ রুমী,” “রুমীর সংলাপ,” “এ ইয়ার উইথ রুমী,” “ফরবিডেন রুমী,” এবং শামস-ই-তাবরিজীর আত্মকথন ‘মাকালাত’ এর, যার বাংলা নাম “আমি এবং রুমী”। ইংরেজিতে এ বইটির অনুবাদ করেছেন আমেরিকান সূফি গবেষক উইলিয়াম চিতিক। সূফিবাদের ওপর এখনো প্রচুর পড়াশোনা করছি এবং সম্ভব হলে সূফিবাদের সাহিত্যের ওপর আরো কিছু কাজ করবো।
আমি সূফি দর্শন ব্যাখ্যা করার উপযুক্ত লোক নই। এ সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেয়ার মতো যোগ্যতা আমার নেই। সূফিবাদ সম্পর্কে সীমিত পাঠ ও চেষ্টায় আমি যতোটুকু বুঝেছি, তাতে বলতে পারি, আল্লাহর সাথে সরাসরি ব্যক্তিগত সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে ঐশ্বরিক প্রেম ও অভিজ্ঞতা অর্জনের আধ্যাত্মিক প্রচেষ্টাই সূফি দর্শনের মূলমন্ত্র। এই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে সূফিরা সবসময় ‘মুরাকাবা’ বা ধ্যান করেন এবং এই ধ্যানের মধ্য দিয়ে নিজের মাঝে সৃষ্টিকর্তার উপস্থিতির অভিজ্ঞতা লাভ করেন। নির্জনে এই ধ্যানের মধ্যে তারা কোরআনের আয়াত উচ্চারণ করেন অব্যাহতভাবে, অভুক্ত থাকেন, মোহমুক্ত হওয়ার সাধনা করেন।
জহিরুলঃ সুফি চর্চার সাথে শারিয়া চর্চা সাংঘর্ষিক, এ নিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় বিবাদ তৈরি হয়েছে। এ বিষয়ে আপনার ব্যাপক পড়াশোনা আছে, যদি বিষয়গুলো একটু ব্যাখ্যা করেন, সংঘর্ষের মূল জায়গাটা কোথায়, এটা এড়ানোর কোনো উপায় আছে কি-না।
মঞ্জুঃ এ কথা সত্য যে সূফিবাদকে ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক বিবেচনা করা হয়। বহু মুসলিম দেশে সূফিবাদী ও কট্টরপন্থী মুসলমানদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে এবং অনেক মুসলিম দেশে সূফিদের ঘূর্ণায়মান নৃত্য এবং বাদ্যযন্ত্র সহযোগে সূফি সঙ্গীত নিষিদ্ধ করা হয়েছে। মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের সময় সূফি দরবেশ সারমাদকে নগ্ন থাকার অভিযোগে হত্যা করা হয়। তাঁর অনুসারীদের বিতাড়ন করা হয়েছে। ইসলাম ও সূফিবাদের মধ্যে যে বিরোধ আমি নিগূঢ় ধর্মতাত্ত্বিক দিক থেকে এর ব্যাখ্যা দিতে পারবো না। তবে ব্যক্তিগতভাবে সূফিবাদকে ইসলামে একেবারেই অপ্রয়োজনীয় বা অপ্রাসঙ্গিক বলে মনে করি না। সূফিবাদী উদারতা না থাকলে বাংলাদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলামের বিস্তার বা বিকাশ বিলম্বিত হতো। সূফিরাই বাংলাদেশে ইসলামের বিস্তার ঘটিয়েছেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বিতর্কে গিয়ে আমার লাভ কী? ইসলামে এবং সকল ধর্মে পরস্পর বিরোধী মত, পথ, ফেরকা আছে। ইসলামে শিয়া-সুন্নী মতবাদ আছে। এসবের মধ্যেও আবার নানা মাজহাব, নানা ফেরকা আছে। একজন আরেকজনের কল্লা কাটে। একদল জিহাদকে উৎসাহিত করে, আরেক পক্ষ জিহাদের ঘোর বিরোধী। সূফি দার্শনিকরা দাবী করেন সূফিবাদ হচ্ছে, ইসলামের নির্যাস অর্থ্যাৎ নশ্বরত্ব, আত্মনিয়ন্ত্রণ, আত্ম-পরিশুদ্ধি – যা ছাড়া যতো ইবাদত বা প্রার্থনা করা হোক না কেন তা কোনো ব্যক্তির কাজে আসবে না। সূফিবাদের বক্তব্য হচ্ছে মানুষের আপন সত্তা বা ‘নফস’কে নিয়ন্ত্রণ করা বা শৃঙ্খলার মধ্যে আনার কথা কোরআন ও হাদিসেই নিহিত এবং ইবাদত বা আল্লাহকে স্মরণ করার মধ্য দিয়ে সূফিরা পরিশুদ্ধির পর্যায়ে পৌঁছার চেষ্টা চালায়। এটা যদি কোরআন সুন্নাহ বিরোধী হয়, তাহলে তা সূফিবাদ হতে পারে না। কট্টরপন্থী মুসলমান, যারা জিহাদ ছাড়া কিছু বুঝতে চান না, তাদের উদ্দেশে ইমাম গাজ্জালী বলেছেন, ‘তেরোটি দুশমনের বিরুদ্ধে তুমি জিহাদ ঘোষণা করো, যার মধ্যে বারোটি দুশমনকে তুমি দেখতে পাও না। সেগুলো হচ্ছে: অহঙ্কার, ঔদ্ধত্য, দাম্ভিকতা, স্বার্থপরতা, লোভ, কাম, ক্রোধ, অসহিষ্ণুতা, মিথ্যাচার, প্রতারণা, গুজব রটনা ও পরচর্চা। এগুলোর ওপর যদি তুমি বিজয়ী হতে বা ধ্বংস করতে পারো, শুধু তখনই তুমি সেই দুশমনের বিরুদ্ধে জিহাদের প্রস্তুতি নিতে পারো, যে দুশমনকে তুমি দেখতে পাও।’ আমরা এই দুশমনদের ধ্বংস করতে পারি না, কিন্তু পরস্পরকে হত্যা করতে ঝাঁপিয়ে পড়ি। সুফিবাদ এর বিপরীতে, শৃঙ্খলা ও সহনশীলতার চর্চা করতে উদ্বুদ্ধ করে। জালালুদ্দীন রুমি বলেছেন, ‘ওহে মুসলমানরা, আমি কী বলবো; আমি তো নিজেকেই জানি না; আমি খ্রিষ্টান নই, ইহুদি বা জরোস্ট্রিয় নই, এমনকি আমি মুসলিমও নই।’
কেউ যদি ভ্রান্তভাবে সূফিবাদের চর্চা করে, অথবা বিশ্বাসের সাথেই সূফি পথ অনুসরণ করার উদ্যোগ নিয়ে ভুল করে, তাহলে সেই ব্যক্তি ইসলামের বিরোধিতা করে। পরিশুদ্ধির উপায় ভুলকে শুধরে নেয়া ও সঠিক পথ ধরে অগ্রসর হওয়া। তা না হলে ব্যক্তির ভুল সূফিবাদের ওপর কলঙ্কারোপ করতে পারে এবং অনেক অশিক্ষিত লোক সূফিবাদকে সোজা নাকচ করে দিতে পারে। একজন সূফি হওয়ার অর্থ কী? বর্ণ-গোত্রবাদ ও সাম্প্রদায়িক সঙ্কীর্ণ দ্বন্দ্ব ও রেষারেষি এবং ধর্মের নামে ঔদ্ধত্তের উর্ধে ওঠা। সূফিবাদে এ কথা বলার সুযোগ নেই যে, আমরাই সঠিক পথ অনুসরণ করছি, বাদবাকি সবই ভ্রান্ত। কিন্তু রাজনৈতিক ইসলাম ব্যবহৃত হয় ভ্রাতৃত্ব ও সামাজিক সৌহার্দের ধারণাকে নির্মূল করার কাজে। সূফিবাদ বর্ণ-ধর্ম নির্বিশেষে সকলের জন্য উন্মুক্ত। রুমি বলেছেন, ‘এসো এসো। তুমি কে অথবা তুমি এখানে কেন, তা কোনো ব্যাপার নয়।’ ঐশ্বরিক নৈকট্য লাভের চেষ্টায় সকল মানুষ সমান অংশীদার। একজন সূফি সকল ধর্ম, সকল বিশ্বাস ও সকল ধ্যানধারণার প্রতি সহনশীল। সমস্যা সেখানেই সৃষ্টি হয়, যখন কেউ জোর গলায় দাবী করেন যে তিনি শুধু তার ধর্ম জানেন, তাহলে ধরেই নিতে হবে যে তিনি তার নিজের ধর্ম সম্পর্কেও জানেন না। সমাজে অন্যান্য ধর্মবিশ্বাসীরা থাকলে তাদের ধর্ম ও তাদের সম্পর্কেও জানা উচিত। পরস্পরকে ভালোভাবে না জানার কারণে সমাজে ব্যবধান সৃষ্টি হয় এবং সামাজিক ভারসাম্য বিনষ্ট নয়।
রাজনৈতিক ইসলামের বিপরীতে সূফিবাদ নিষ্ঠার সাথে আহবান জানায় মানুষকে রক্ষা ও সংরক্ষণের জন্য। অন্যের জানমাল রক্ষা, একে অপরকে শ্রদ্ধা করা এবং মানুষের কল্যাণের জন্য কাজ করার অর্থ হচ্ছে স্রষ্টাকেই শ্রদ্ধা করা। রাজনৈতিক ইসলামের নামে ধ্বংস, সহিংসতা ও সন্ত্রাসের কারণে যে ঘৃণার বীজ বপন করা হয়েছে এবং সমাজ ও মানুষের মধ্যে বিভাজনের যে সীমারেখা টেনে দেয়া হয়েছে তাতে রাজনৈতিক ইসলামের প্রভাব দূর করতে ইসলামের পরমতসহিষ্ণু ও যৌক্তিক ব্যাখ্যা দিতে সূফিবাদ মুখ্য ভূমিকা পালন করতে পারে। তবে সূফিবাদের নামে ইসলাম বিরোধী যে সব কর্মকাণ্ড চালানো হয়, সেগুলোকেও পরিহার করতে হবে, যাতে সূফিবাদের উদারতাকে ভণ্ড সূফিরা তাদের স্বার্থে ব্যবহার না করতে পারে। এজন্য প্রয়োজন সূফিবাদকে, হয়তো আত্ম-রূপান্তরের মাধ্যমে, আত্ম-মুক্তির আন্দোলনকে নৈতিক মূল্যবোধের সংস্কারের আন্দোলনে রূপান্তর ঘটাতে হবে সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতার সাথে সামঞ্জস্য রেখে, মানবতার প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে। তাহলেই হয়তো বর্তমান সাংঘর্ষিক অবস্থা থেকে উত্তরণ সম্ভব।
জহিরুলঃ আমি ব্যক্তিগতভাবে সেক্যুলারিজম বলতে বুঝি সকল ধর্ম, সকল মতবাদ সহ্য করা, বিরক্ত হয়ে বা কষ্ট করে না, ন্যাচারালি। ধর্মকে প্রত্যাখ্যান করে, ধর্মের বিরুদ্ধাচারণ করে সেক্যুলার হওয়া যায় না। আপনি কি বলেন?
মঞ্জুঃ সেক্যুলারিজম বা ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে আমি বা আমরা সাধারণভাবে যা বুঝি তা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। যারা কট্টরভাবে ধর্মে বিশ্বাস করেন, বা ধর্মের ব্যাপারে রক্ষণশীল, তারা ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে ইশ্বর বা আল্লাহহীন একটি ব্যবস্থা বোঝেন। সোজা কথায় ধর্মের মাঝে ধর্মনিরপেক্ষতা বলে কিছু নেই। ধর্মনিরপেক্ষতা একটি রাজনৈতিক বিশ্বাস – একজন যদি চায় সে তার ধর্ম পালন করবে, অথবা ধর্ম পালন না করার স্বাধীনতাও তার থাকবে। বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে রাষ্ট্রের চার মূলনীতির মধ্যে একটি ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা। এখনো তা আছে, কিন্তু ভিন্নভাবে – ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা। একই সংবিধানে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। সংবিধানের শুরুতে আছে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম।’ এটি বোঝার জন্য সংবিধান বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই যে, সকল পক্ষকে সন্তুষ্ট রাখার জন্য গোঁজামিল দিয়ে সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে। বাংলাদেশে এখন একটি শ্লোগানকে জনপ্রিয় করে তোলার চেষ্টা করা হচ্ছে, ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার।’ এর জন্য কোনো শ্লোগানের প্রয়োজন ছিল না। আমরা শৈশব থেকেই স্কুল কলেজে হিন্দু বন্ধুদের সাথে স্বরস্বতী পূজায় গেছি, প্রসাদ খেয়েছি এবং পূজায় ব্যবহৃত বেলপাতা ও ফুলের পাঁপড়ি বইয়ের মাঝে গুঁজে রেখেছি। দুর্গাপূজায় আমাদের ওখানে প্রতিটি মণ্ডপ ঘুরে ঘুরে প্রতিমা দরশন করেছি, মহিষ-পাঠা বলি করা দেখতে জড়ো হয়েছি, প্রতিদিন সন্ধ্যায় আরতি দেখতে গেছি এবং বিসর্জনের দিন বিসর্জন দেখে হিন্দু বন্ধুদের ‘শুভ বিজয়া’ বলে শুভেচ্ছা জানিয়েছি। একইভাবে হিন্দু ছাত্ররা ১২ই রবিউল আওয়াল উপলক্ষে মিলাদ মাহফিলে এসে বসেছে, রমজানে ইফতারে অংশ নিয়েছে, ঈদের দিন মুসলিম বন্ধুদের বাড়ি বাড়ি গেছে। এক ধর্মের উৎসব তো সনাতন কাল থেকেই অন্য ধর্মাবলম্বীরও উৎসব ছিল। কিন্তু যখন কথাটি নতুন করে শ্লোগান হিসেবে বলা হয় তখন এর পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ আছে বলে কেউ সন্দেহ করতেই পারে। ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাজনৈতিক উদ্দেশে ব্যবহার করলেই ঝামেলা সৃষ্টি হয়। অনেক মুসলিম বংশগতভাবে মুসলিম এবং ধর্ম চর্চা করে না, অনেক হিন্দু বা অন্য কোনো ধর্মের লোকও বংশগতভাবে ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের, তারাও ধর্মের আচার প্রথা মানে না। ধর্ম পালনে কেউ যেমন বাধ্য করতে পারে না, ধর্ম না মানলেও কেউ বাঁধা দিতে পারে না, যদি না সাংবিধানিকভাবে ধর্ম পালনের প্রতি বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়। আমরা আমাদের অভিজ্ঞতা ও সামান্য পড়াশোনা থেকে জানি, যেখানেই কোনো কিছু চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে, সেখানে চাপা ক্ষোভ জমা হতে হতে এক পর্যায়ে বিস্ফোরিত হয়েছে। সমাজে হানাহানি সৃষ্টি হয়েছে, রাষ্ট্রীয় কাঠামো ভেঙে গেছে।
ভারত সাংবিধানিকভাবে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করার পর কোনো ধর্মীয় সংগঠন, প্রতিষ্ঠানের আমন্ত্রণ গ্রহণ করেননি। কোনো মন্দির, মসজিদের দ্বারোদঘাটন করতে যাননি। এখনো সংবিধান অনুযায়ী ভারত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। কিন্তু কারা শাসন ক্ষমতায় থাকে, তাদের ওপর নির্ভর করে সংবিধানের মর্যাদা কীভাবে রক্ষা করবে। অযোধ্যায় রামের জন্মভূমি ইস্যুতে ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংস করা হয়েছে। উচ্চ আদালতে বাবরি মসজিদ ইস্যুতে সব মামলার চূড়ান্ত নিস্পত্তি এখনো হয়নি। তবে একটি রায়ে মসজিদ ও মন্দিরের জমির স্থান ও পরিমাণ নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের অংশীদার দলগুলোর মধ্যে বর্তমান ক্ষমতাসীন দল বিজেপি ছিল। ধ্বংসপ্রাপ্ত মসজিদের স্থানে রামমন্দিরের শিলান্যাস করে এসেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং এর মধ্য দিয়ে তিনি কার্যত সংবিধান লংঘন করেছেন। অতএব বিষয়টি হলো দৃষ্টিভঙ্গির ও যার যার বিশ্বাস ও প্রতিশ্রুতির। এ সম্পর্কে আমি আরেকটি দৃষ্টান্ত দিতে পারি। ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের সময় আমি দিল্লিতে ছিলাম। ভারতের সুপ্রীম কোর্টের প্রধান বিচারপতি, সম্ভবত তাঁর নাম ছিল ভেঙ্কটচালিয়া। তিনি তথাকথিত কর সেবকদের আদেশ দিয়েছিলেন যাতে তাদের সমাবেশ কিছুতেই বেষ্টনি দিয়ে ঘেরা বাবরি মসজিদের ত্রিসীমানায় যেতে না পারে। আদেশ অনুযায়ী প্রশাসন নিরাপত্তা বাহিনীও মোতায়েন করেছিল। কিন্তু মসজিদ গুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। ভারতীয় পার্লামেন্ট ক্যাম্পাসে আমার যেখানে ক্লাস হতো তার পাশেই কন্সটিটিউশন ক্লাব। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পরদিন ৭ ডিসেম্বর বিকেলে সেই ক্লাবে বিজেপি ও রাম জন্মভূমি আন্দোলনের শরীক সংগঠনগুলোর সমাবেশ হয়। সেই সমাবেশে অনেক জাদরেল নেতা বক্তব্য দিচ্ছেন জ্বালাময়ী ভাষায়। উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী কল্যাণ সিংয়ের বক্তব্য শুনে ভালো লেগেছিল যে তিনি একজন খাঁটি হিন্দু হিসেবে বক্তব্য দিয়েছেন। তাঁর কথা ছিল, সুপ্রীম কোর্ট বাবরি মসজিদের আশেপাশে না যাওয়ার আদেশ দিয়েছে ভালো কথা। কিন্তু সুপ্রীম কোর্টের আদেশ ভগবানের আদেশের চেয়ে বড়? সুপ্রীম কোর্টের না মানা যদি কনটেম্পট অফ কোর্ট হয়, তাহলে ভগবানের আদেশ পালন না করা হবে কনটেম্পট অফ ভগবান। অতএব যারা ধর্মনিরপেক্ষতার নামে দেশ চালায়, দিন শেষে তারাও ধার্মিক। একইভাবে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে দেখেছি, টানা দুই যুগ সিপিএম বা কমিউনিষ্ট শাসনের অধীনে ছিল, যাদের ধর্ম নিয়ে কোনো মাথা ব্যথা নেই। সিপিএম’র এক হিন্দু নেতা বিধান সভার নির্বাচনে প্রার্থী। মাথায় গেরুয়া কাপড় বেঁধে, কপালে চন্দন মেখে এক মন্দিরে গেছেন। এক সাংবাদিক জানতে চাইলেন, আপনি কমিউনিষ্ট মানুষ, মন্দিরে ভোট চাইতে এসেছেন কেন? তাঁর উত্তর ছিল, কমিউনিস্ট হলেও তো আমি একজন হিন্দু। যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রেও আপনি নির্বাচনকালে এই দৃশ্য দেখতে পাবেন। কোনো শ্বেতাঙ্গ প্রার্থী মুসলিম এলাকায় টুপি পরে মসজিদে যাচ্ছেন, বিকাল বেলায় গলায় রুদ্রাক্ষের মালা পরে গেরুয়া বস্ত্র ধারণ করে হিন্দু মন্দির ও নেইবারহুডে ঘুরছেন, সন্ধ্যায় পাগড়ি মাথায় দিয়ে শিখ গুরুদুয়ারায় গিয়ে বসছেন। রাজনৈতিকভাবে যিনি ধর্ম মানেন না, দাঙ্গার সময় অন্য ধর্মের মসজিদ, মন্দির, গির্জা ভাঙেন, দোকান লুট করেন, খুন ধর্ষণ করেন। তখন ধর্মনিরপেক্ষরাও ধর্মযোদ্ধা হয়ে যান। ধর্মনিরপেক্ষতা রাষ্ট্রের নীতি হতে পারে, মানুষের পরিচিতির ক্ষেত্রে ধর্মীয় পরিচয়ই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও বড় শক্তি। ২০০২ সালে গুজরাটের দাঙ্গায় কয়েক হাজার মুসলিম নিহত হয়েছিল, অসংখ্য বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছিল, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান লুণ্ঠন ও ধ্বংস করা হয়েছিল। নিহতদের মধ্যে একজন ছিলেন লোকসভার কংগ্রেস দলীয় সাবেক সদস্য ইহসান জাফরি। তাঁর পরিবারের ১৮ জন নারীপুরুষ সেই দাঙ্গায় নিহত হয়। তিনি ধর্মনিরপেক্ষ ছিলেন। কিন্তু নিহত হয়েছেন মুসলিম হওয়ার কারণে। ধর্মনিরপেক্ষতা মানুষের ধর্মীয় পরিচয় মুছে দিতে পারে না।
ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদকে অন্যান্য ধর্ম জায়গা করে দিতে পারলেও আপনি যদি ইসলামে ধর্মনিরপেক্ষতার স্থান আছে কিনা জানতে চান, তাহলে বলবো, ইসলাম ও ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিটি ক্ষেত্রে সাংঘর্ষিক। কেউ ইসলামকে আদর্শ হিসেবে বেছে নিলে তাকে অবশ্যই ধর্মনিরপেক্ষতাকে ত্যাগ করতে হবে। কারণ শারিয়াহ বা ইসলামের মৌলিক বিধিবিধান কোনোভাবে পরিবর্তনযোগ্য নয়। ধর্মনিরপেক্ষতা প্রাপ্তবয়স্ক নারীপুরুষের পারস্পরিক সম্মতিতে যৌনাচারকে বৈধ বিবেচনা করে, যা ইসলামে শাস্তিযোগ্য ব্যভিচার। ধর্মনিরপেক্ষ অর্থনীতিতে সূদ হচ্ছে সকল অর্থনৈতিক লেনদেনের ভিত্তি, ইসলামে সূদ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। ইসলামে মদ তৈরি, বিক্রয়, পান করা নিষিদ্ধ, ধর্মনিরপেক্ষতায় তা অনুমোদিত। ধর্মনিরপেক্ষতা জীবনের সবকিছু থেকে ধর্মকে পৃথক করে, আইন ও বিধিবিধান দ্বারা সবকিছু পরিচালিত হয়, যা আল্লাহর আইন ও নবী মুহাম্মদের বিধান নয়। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ বলে যে, রাজনীতিতে ধর্ম নয় এবং ধর্মে রাজনীতি নয়; অথবা ধর্ম হচ্ছে আল্লাহর জন্য, আর রাষ্ট্র জনগণের জন্য। এর মাধ্যমে ইসলামকে শুধু ব্যক্তির জীবনে ও প্রার্থনার স্থানে সীমাবদ্ধ রাখাই যথেষ্ট বলে ধারণা দেয়ার চেষ্টা করা হয়। জনগণের নামে সবকিছু চালিয়ে দেয়ার যে চেষ্টা তা যারা দেশ শাসন করে তাদের ব্যাখ্যার কাছে সবকিছু অচল। তারা তখন মুফতি, ফকিহ, মুহাদ্দিস ও মুফাসসির হয়ে যান। ইসলামে সার্বভৌমত্ব আল্লাহর, জবাবদিহিতা মানুষের। ধর্মনিরপেক্ষতায় সার্বভৌমত্ব জনগণের এবং জবাবদিহিতা জনগণের প্রতিনিধির। বাংলাদেশের মূল সংবিধানে সার্বভৌমত্ব ছিল জনগণের, তা সংশোধন করে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব স্থাপন করা হয়েছিল, যা পুনরায় সংশোধন করে জনগণের সার্বভৌমত্ব পুন:স্থাপিত হয়েছে। অতএব কারা শাসনক্ষমতায় আছেন তাদের ওপর নির্ভর করে সার্বভৌমত্ব কার হবে। এ বিতর্কের শেষ নেই। |
জহিরুলঃ বাংলা সাহিত্য থেকে 'উপদেশ' প্রায় উঠে গেছে, বলা হয় উপদেশ শিল্পের পরিপন্থি, এটি কি সাহিত্যের উদাসীনতা, দায়িত্বহীনতা বা দিকভ্রান্তি? আপনি কি মনে করেন?
মঞ্জুঃ সাহিত্য বলতে যদি কথা বলা বা প্রকাশ করার অর্থে বোঝানো হয়, তাহলে সাহিত্য থেকে উপদেশ ওঠে গেছে বলার সুযোগ নেই। আপনার আগের এক প্রশ্নের উত্তরে আমি ওরিয়েন্টাল ও ওয়েষ্টার্ন সাহিত্যের ওপর কিছুটা আলোকপাত করার চেষ্টা করেছি। আধুনিক সাহিত্যের উৎসের সন্ধান করতে গেলে আমাদেরকে অনিবার্যভাবেই ধর্মীয় গ্রন্থগুলোর দিকে ফিরে যেতে হবে। সে ধর্মগ্রন্থ, তা হিব্রু বাইবেল, খ্রিস্টান বাইবেল হোক, হিন্দুদের গীতা, মহাভারত, বেদ, মনুসংহিতা হোক, বৌদ্ধদের ত্রিপিটক, কনফুসিয়ান ধর্মের বিবরণী, মুসলমানদের কোরআন বা শিখ ধর্মাবলম্বীদের গ্রন্থ সাহিব হোক না কেন, কোনোটারই সাহিত্য মূল্য অস্বীকার করার উপায় নেই। ধর্মগ্রন্থ মানেই উপদেশের সমাহার। মানুষের করণীয় ও বর্জনীয়, আদেশ ও নিষেধসহ মানুষের জীবনের এমন কোনো বিষয়, এমন কোনো দিক নেই, যে সম্পর্কে উপদশ দেয়া হয়নি। পরবর্তীতেও দার্শনিকরাও ধর্মের আলোকে তাদের উপদেশাবলীকেই গ্রন্থিত করেছেন। আপনি খিস্টপূর্ব ৩০০ সালে কৌটিল্য রচিত ‘অর্থশাস্ত্র’ এর কথা বলুন অথবা ষোড়শ শতাব্দীতে মেকিয়াভেলি রচিত ‘দ্য প্রিন্স’ এর কথা বলুন, দুটি গ্রন্থের রচনাকালের দুস্তর ব্যবধান, একটি গ্রন্থ লেখা হয়েছে প্রাচ্যে, আরেকটি পাশ্চাত্যে। কিন্তু দুটি গ্রন্থের বিষয়বস্তু মোটামুটি একই – রাজ্য শাসন করতে, রাজা, রাজপুত্র ও অমাত্যদের কী করতে হবে, সে সম্পর্কিত নির্দেশনা ও উপদেশ। সক্রেটিস, প্লেটো, অ্যারিষ্টটল যা বলেছেন ও রচনা করেছেন, সেগুলোর বিরাট অংশ জুড়ে রয়েছে উপদেশ এবং সক্রেটিসকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করার কারণও ছিল তাঁর উপদেশ। সাহিত্য শিল্পেরই একটি শাখা, অক্ষর ও শব্দ সহযোগে যার প্রকাশ। এই প্রকাশের মধ্যে যদি মানুষ থাকে, পরিবার ও সমাজ থাকে, রাজনীতি থাকে তাহলে তো উপদেশ থাকবেই। এমনকি হাসি-পরিহাসের মধ্যেও উপদেশ নিহিত থাকে। জনপ্রিয় সাহিত্যের স্থায়ী মূল্য থাকে, মানুষের মাঝে ঠাঁই করে নেয়ার গভীর মর্ম থাকে এবং পাঠকরা এর মধ্য থেকে তাদের প্রয়োজনীয় অংশ বেছে নেয় নিজেদেরকে সমৃদ্ধ করার জন্য। উপদেশকে যারা শিল্পের পরিপন্থী বলেন, তাদের যুক্তি আমি জানি না। তারা কীভাবে উপদেশ বর্জিত শিল্প তৈরি করেছেন তাও আমি দেখিনি, হয়তো আমার সীমাবদ্ধতার কারণে। তবে আমি বলবো তারা যদি এমন বলেন তাহলে তারা তাদের সামাজিক দায়বদ্ধতার কথা ভুলে যান এবং সমাজকে সৃজনশীল কিছু দেয়ার কোনো ইচ্ছাও প্রকাশ করেন না।
জহিরুলঃ ইন্দোনেশিয়া একটি মুসলিম রাষ্ট্র কিন্তু সে দেশের মানুষের জীবনাচারের গভীরে প্রোথিত রামায়ন-মহাভারতের সংস্কৃতি, মানুষের নাম-ধামেও রামায়ন-মহাভারত। একইভাবে দেখি ভারতের হিন্দি অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে মুসলিম সংস্কৃতির চর্চা রয়েছে অথচ পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুদের মধ্যে এবং বাংলাদেশের মুসলমানদের মধ্যে এসব বিষয়ে 'জাত গেল' ধরনের একটি শংকা। মাটি থেকে উদ্ভুত সংস্কৃতির চর্চা কি অধর্মের কাজ? এই বিষয়ে আপনার বক্তব্য কি?
মঞ্জুঃ আমি মনে করি ধর্ম মানুষের সবচেয়ে বড় পরিচয়। ধর্মীয় পরিচয় নিয়েই মানুষ জন্মগ্রহণ করে, বেড়ে ওঠে, জীবন গড়ার প্রাথমিক শিক্ষাও ধর্ম থেকেই আহরণ করে। আপনি ইন্দোনেশিয়ার দৃষ্টান্ত দিয়েছেন, সে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সঙ্গে একসময় রামায়ণ-মহাভারতের যোগসূত্র ছিল এবং দীর্ঘদিন পর্যন্ত ছিল। ইসলাম ধর্মে ব্যাপক ধর্মান্তরের পর তারা ইসলাম চর্চা করছে, কিন্তু যে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য তারা একসময় ধারণ করতো সে সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসেনি। বের করে আনার ব্যাপারে হয়তো জবরদস্তিও ছিল না। এ শুধু ইন্দোনেশিয়ার ক্ষেত্রে নয়, ইসলামের সূতিকাগার মক্কার কাবাঘরকে যে তাওয়াফ করা হয়, সে তাওয়াফ তো ইসলাম পূর্ব সময় থেকেই ছিল। আগে কাবাঘরের ভেতর মূর্তির আরাধনায় তাওয়াফ হতো, ইসলামের আবির্ভাবের পর সেগুলো অপসারিত হয়, তাওয়াফের রীতিতে পরিবর্তন আসে। হাজরে আসওয়াদ বা কালো পাথরটি ইসলামের আগেও পবিত্র ছিল, ইসলামের আগমণের পরও পবিত্র জ্ঞানে চুম্বন করা হয়। সেই পৌত্তলিক সংস্কৃতিকে তো বর্জন করা হয়নি, পরিমার্জন ও ইসলামীকরণ করা হয়েছে। আমি যা প্রত্যক্ষ করেছি, কিছু পড়াশোনার মাধ্যমে যা জেনেছি, সেটুকুই বলার চেষ্টা করলাম। এ সম্পর্কে ইসলামের ব্যাখ্যা কী তা আমার জানা নেই। নামের ক্ষেত্রে হিন্দু ও মুসলামানদের নামে পার্থক্য শুধু শব্দগত, অর্থের দিক থেকে কোনো পার্থক্য নেই। ইন্দোনেশিয়ায় মুসলামানদের নাম রামায়ণ-মহাভারতের চরিত্রের সাথে সামঞ্জস্য রেখে রাখা হলেও তা সংস্কৃতিগত কারণেই রাখা হয়। বাংলাদেশে হিন্দু মুসলিমরা হয়তো বেশি কট্টর এবং এ কারণে সবকিছুর মধ্যে এর প্রকাশ ঘটায়। মুসলিম নাম শামসু হলে, হিন্দু নাম হয় রবি, মুসলিম নাম কামরু হলে হিন্দু নাম হয় চন্দ্র। এমন দৃষ্টান্ত আপনি হাজারটা পাবেন। নাম বলে নয়, সম্বোধনের ক্ষেত্রেও পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরার হিন্দুদের সাথে উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের হিন্দুদের মধ্যে পার্থক্য দেখতে পাবেন।
ব্রিটিশ-পূর্ব ভারতে প্রায় সাতশ’ বছর মুসলিম শাসন চালু ছিল এবং সরকারি দফতরে ও শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হতো ফারসি ভাষা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তুর্কি ভাষারও প্রচলন ছিল। সরকারি চাকুরি পাওয়ার জন্য হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সকলকে ফারসি ভাষা শিখতে হতো। ওই সময়ে ফারসি ভাষায় সাহিত্য চর্চা করে অনেক হিন্দু খ্যাতির অধিকারী হয়েছিলেন। হিন্দুরা মুসলিম সংস্কৃতিকে অনেক ক্ষেত্রে গ্রহণ করেছিল। সেই সংস্কৃতির চর্চা পোশাক-পরিচ্ছদ, খাওয়া-দাওয়া, শিল্প-সঙ্গীতের মধ্যে দৃশ্যমান ছিল।
এ সম্পর্কে আবুল মনসুর আহমদ নির্মোহভাবে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। ১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধের পর থেকে বাংলায় মুসলিম শাসন চাপের মধ্যে পড়ে এবং ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহ দমনের নামে মোগল সাম্রাজ্যের চির অবসানের পর সার্বিকভাবে সমগ্র ভারতে মুসলিমদের ওপর এমনভাবে ব্রিটিশ ও হিন্দুদের নিস্পেষণ নেমে আসে যে তাদের আর কোমর সোজা করে দাঁড়ানোর উপায় ছিল না। লর্ড কর্ণওয়ালিশ ১৭৯৩ সালে বাংলায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের নামে জমিদারদের মাধ্যমে ভূমিকর আদায়ের সীমা নির্ধারণ করে দেয়, অর্থ্যাৎ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি জমিদারদের উপর বার্ষিক যে খাজনা ধার্য করবে তার বিনিময়ে তারা স্থায়ীভাবে জমিদারী ভোগদখল করতে পারবে। মোগল আমলে খাজনার যে হার ছিল তা থেকে খাজনার পরিমাণ বহুগুণ বেড়ে যায়। জমিদাররা কৃষকের উপর চাপ সৃষ্টি করে বর্ধিত খাজনা আদায়ের জন্য। মোগল এবং ব্রিটিশ যুগেও অবিভক্ত বাংলায় পূর্ববঙ্গ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল এবং জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই ছিল কৃষক এবং তারা হিন্দু জমিদারদের প্রজা। হাতে গোনা কয়েকজন মুসলিম জমিদারও ছিল। হিন্দু জমিদাররা পূর্ব বাংলায় জমিদারী করলেও বসবাস করতেন কলকাতায়, তাদের সন্তানরা পড়াশোনা করতো কলকাতায়। আবুল মনসুর আহমদের ভাষায় জমিদারদের কাছে পূর্ববঙ্গ ছিল খামার বাংলা এবং কলকাতা কেন্দ্রিক বাংলা ছিল টাওয়ার বাংলা। জমিদাররা পূর্ব বাংলার উন্নয়নে কিছু না করে কলকাতা কেন্দ্রিক টাওয়ার বাংলাকে সমৃদ্ধ করেছেন। ব্যতিক্রম অবশ্যই ছিল। কিছু কিছু জমিদার পূর্ববঙ্গে কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছেন, তাও ব্রিটিশ প্রভুদের সন্তুষ্ট করতে। আমার নিজ এলাকা শেরপুরের কথাই যদি বলি, দু’জন হিন্দু জমিদার দুটি হাইস্কুল স্থাপন করেছিলেন। একটির নাম ভিক্টোরিয়া একাডেমী, অর্থ্যাৎ রানি ভিক্টোরিয়ার নামে, আরেকটি গোবিন্দ কুমার পিস মেমোরিয়াল ইন্সাটিটিউশন, আমি যে স্কুলের ছাত্র। ১৯১৯ সালে এটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তিতে ব্রিটিশ সরকারকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশে। শিক্ষাদীক্ষা নিয়ন্ত্রিত হতো কলকাতা থেকে এবং স্থানীয় নিয়ন্ত্রণকারীরা ছিলেন হিন্দু জমিদার। শিক্ষার সাথে সংস্কৃতির নিয়ন্ত্রণও তারাই করতেন। সে সংস্কৃতি ছিল বাবু সংস্কৃতি এবং ভারতের অন্য অংশের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন। আপনি যদি শুধু সম্বোধনের ক্ষেত্রে উত্তর ও দক্ষিণ ভারতে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সার্বজনীনভাবে ব্যবহৃত আব্বা, আম্মা, চাচা, ফুফু, খালা, দাদা, দাদি শুনতে পান, তাহলে পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুদের মুখে যথাক্রমে শুনতে পাবেন বাবা, মা, কাকা, পিসী, মাসি, ঠাকুরদা, ঠাকুরমা। সমগ্র ভারতে ব্যবহৃত পানি শব্দটি পশ্চিমবঙ্গে জল। কেউ পানি বললেই বাবুরা নির্ঘাত ধরে নেন শব্দের উচ্চারণকারী একজন মুসলিম। শুধু সম্বোধন নয়, বহু ক্ষেত্রে আপনি এ পার্থক্য দেখতে পাবেন। এসব দিক থেকে পূর্ববঙ্গের মুসলমানরা অনেক উদার। তারা হিন্দু বা মুসলিম সংস্কৃতির দেশে মাটি থেকে উদ্ভুত সংস্কৃতিকেই ধারণ করেছেন এবং পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর এ স্বকীয়তা আরো বিকশিত হয়েছে এবং এর সাথে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই।
জহিরুলঃ নারী নেতৃত্ব নিয়ে ইসলামে নেতিবাচক কথা আছে, এই জায়গাটিতে মানসিকতার এবং ধর্ম বিশ্বাসের সংস্কার প্রয়োজন বলে আধুনিক চিন্তাবিদেরা মনে করেন। এসব বিষয়ে আপনার বক্তব্য কি?
মঞ্জুঃ ইসলামে নারী নেতৃত্ব নিয়ে নেতিবাচক কোনো বক্তব্য নেই। ইসলামে পুরুষ ও নারীকে সমান মর্যাদা দেয়া হয়েছে। কোরআনে নারীর ওপর পুরুষের এবং পুরুষের ওপর নারীর অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। আরো বলা হয়েছে, ‘তোমাদের স্ত্রীরা তোমাদের জন্য বস্ত্র এবং তোমরাও তাদের জন্য বস্ত্র।’ শারিয়াহ’য় পুরুষ ও নারীর মধ্যে কোনো বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়নি। নবী মুহাম্মদ বলেছেন, নারীরা পুরুষের সঙ্গী, প্রতিরূপ। তাঁর একটি হাদিস বহুল আলোচিত যে, এক সাহাবী তাঁর কাছে জানতে চান, পিতা-মাতার মধ্যে সবচেয়ে বেশি মর্যাদার কে, তিনি বলেন, তোমার মা। সাহাবী আবার জানতে চান, এরপর কে? তিনি আবারও বলেন, তোমার মা। এভাবে তিনবার বলার পর চতুর্থ বার নবী বলেন, তোমার বাবা। এ থেকেও কী বোঝা যায় না যে, নারীকে দাবিয়ে রাখার অধিকার পুরুষকে দেয়া হয়নি। শুধু তাই নয়, নারীকে যাতে অবমাননা না করা হয় সেজন্য অন্যায়ভাবে কোনো নারীকে অপবাদ দেয়া হলে কোরআনে অপবাদকারীর জন্য শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। সূরা আন-নূর এর একটি আয়াতে এমনকি একথাও বলা হয়েছে যে, কেউ যদি কোনো সচ্চরিত্র নারী ওপর অপবাদ দেয়, এবং অপবাদ প্রমাণ করতে চারজন সাক্ষী না নিয়ে আসে, তাহলে অপবাদদাতাকে আশিটি বেত্রাঘাত করার জন্য ও তার সাক্ষ্য গ্রহণ না করতে বলা হয়েছে। ইসলামে যদি এভাবে নারীর মর্যাদা ও অধিকারের পক্ষে বলা হয়, সেক্ষেত্রে ইসলামে নারী নেতৃত্বের বিরোধিতা করা হয়েছে বা নেতিবাচক কথা বলা হয়েছে দাবী করা অর্থহীন। আধুনিক চিন্তাবিদরা যদি এমন বলেন এবং ধর্মবিশ্বাসে সংস্কার আনতে বলেন, তাহলে তারা বলে তাদের অজ্ঞতার কারণে এবং ইসলাম বিরোধিতার কারণে। তারা দুনিয়ার সকল ধর্ম ও আদর্শ সম্পর্কে পড়াশোনা করতে রাজি, কিন্তু নিজের ধর্ম সম্পর্কে জানতে অনাগ্রহী। তারা পূজায় অংশগ্রহণ করেন, বড়দিনের অনুষ্ঠানে যান, কিন্তু মিলাদে বা ঈদের জামাতে যান না। আমি বহু মুসলিম বুদ্ধিজীবীকে দেখেছি, তারা খ্যাতিমান কেউ মারা গেলে তাদের জানাজা দেখতে যান, জানাজা নামাজে অংশগ্রহণ করেন না।
ইসলামের ইতিহাসে আপনি অনেক নারী নেতৃত্বের সাক্ষাৎ পাবেন। নবী মুহাম্মদের স্ত্রী আয়িশা পর্যন্ত যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে ভারতে মামলুক বংশের শাসনামলে সুলতানা রাজিয়ার নেতৃত্বের কথা আমরা জানি। ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহে অযোধ্যার হযরত মহল ব্রিটিশের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়ে খ্যাত হয়ে আছেন। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মতো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে নারী নেতৃত্বের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলছে না। শুধু রাজনৈতিক নেতৃত্বের ক্ষেত্রে নয়, রাষ্ট্র ও সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীরা এগিয়ে এসেছেন, নেতৃত্ব দিচ্ছেন এবং ভালো করছেন। নারী যদি যোগ্য হয়, তাহলে প্রতিটি ক্ষেত্রে তারা কর্তৃত্বের অধিকারী হতে পারেন।
জহিরুলঃ আপনি নিজেকে একজন মধ্যপন্থি মানুষ হিসেবে বিবেচনা করেন, শিল্পচর্চার পৃষ্ঠপোষক এবং অনুরাগী। আপনার স্ত্রী একজন চিত্রশিল্পী, তার শিল্পচর্চায় কিভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করেন বা উৎসাহ দেন?
মঞ্জুঃ জি আমি নন্দনতত্ত্ব ও শিল্পের অনুরাগী। যখন থেকে গ্রীক ভাস্কর্য, মেসোপটেমিয়ার কীলকাকৃতির অক্ষর যাকে কিউনিফর্ম বলা হয়, মিশরের পিরামিড ও বিশেষ করে মমি সংরক্ষণ করার কফিনে অঙ্কিত চিত্র, ইলোরা, অজন্তার গুহাচিত্রের সাথে পরিচয় হয়েছে, তখন থেকে আমি এসব শিল্প সম্পর্কে জানতে চেষ্টা করি। এক পর্যায়ে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির মোনালিসার প্রেমে পড়ে যাই। আমার রুমে দীর্ঘদিন পর্যন্ত মোনালিসার বিরাট একটি পোষ্টার সেগুন কাঠের ফ্রেমে বাঁধাই করে টানিয়ে রেখেছিলাম। প্যারিসের ল্যুভ যাদুঘর থেকে মোনালিসা চুরি ও সেটির উদ্ধারের কাহিনি ভিত্তিক চমৎকার একটি বই আছে, আর, এ স্কটের লেখা বইটির নাম “ভ্যানিশড স্মাইল: দ্য মিস্টিরিয়াস থেফট অফ মোনালিসা।” বইটির তথ্য অনুযায়ী মোনালিসাকে যে চুরি করেছিল, সেই চোরের নাম পর্যন্ত আমার মনে আছে, ভিনসেনজো পেরুগিয়া। কাহিনি আপনাকে রহস্যোপন্যাসের মতো টেনে নিয়ে যাবে। আমি বইটির সংক্ষিপ্ত অনুবাদ করেছিলাম এবং সেটি ঢাকা ডাইজেস্টের ‘এ সংখ্যার বই’ হিসেবে কোনো একটি সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল।
বিয়ের পর আমি জানতে পারি আমার স্ত্রী কামরুননাহার মণি চিত্র শিল্পের প্রতি আগ্রহী। আমি পুলকিত হই। তিনি চারুকলা ইন্সটিটিউটের ছাত্রী ছিলেন। কিন্তু পারিবারিক রক্ষণশীলতার কারণে তাকে চারুকলা ছাড়তে হয় এবং পরবর্তীতে ইডেন কলেজে ভর্তি হন। শিল্পের প্রতি তার আগ্রহের কারণে আমি তাকে উৎসাহ দেই বাড়িতে এবং খ্যাতনামা শিল্পীদের কাছে চিত্রকর্ম শিখতে। ক্যানভাস, রঙ, তুলিসহ অন্যান্য উপকরণ কিনে দেই, যাতে পড়াশোনার পাশাপাশি চিত্রকর্ম অঙ্কনের অনুশীলণ চালিয়ে যেতে পারেন। দু’জন শিল্পী রেজাউল করিম ও স্বপন চৌধুরীর কাছে শিক্ষা নেন। বেশ কিছু সংখ্যক চিত্র অঙ্কন করেন। ঢাকায় দুটি চিত্র প্রদর্শনী এবং ২০০৭ সালে নিউইয়র্কের একটি আর্ট গ্যালারিতে চিত্র প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেন। তার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ হচ্ছে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের একটি মিলনায়তনে মঞ্চের ব্যাকগ্রাউণ্ড হিসেবে ২৫ ফুট দীর্ঘ ও তিন ফুট প্রস্থের একটি তৈলচিত্র। আমার উৎসাহে একটি ম্যাগাজিনে ইলাসট্রেশনের কাজও করেছেন কিছুদিন। এখনো তিনি তাঁর চর্চা চালিয়ে যাচ্ছেন, তবে তা অত্যন্ত মন্থর।
জহিরুলঃ গান্ধী কি দেশভাগ এবং ৪৭ সালের রায়ট এড়াতে পারতেন, কিছু কি ছিল করার, যা না করার কারণে তাকে জীবন দিতে হলো?
মঞ্জুঃ পরিস্থিতি এমন এক পর্যায়ে চলে গিয়েছিল যে গান্ধীর একার পক্ষে ভারত বিভাগ এড়ানো সম্ভব ছিল না। জিন্নাহকে যদিও দ্বিজাতি তত্বের জনক বলা হয়, কিন্তু বাস্তবে হিন্দু জাতীয়তাবাদী চেতনায় হিন্দুত্ব দর্শনের ভিত্তিতে ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করার স্বপ্ন ছিল হিন্দু মহাসভার নেতা বীর সাভারকর। তার বক্তব্য ছিল মুসলিম ও খ্রিষ্টানরা হিন্দুদের ধ্বংস করার চক্রান্তে লিপ্ত এবং এর প্রতিকার সম্ভব হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। ভারত যেহেতু হিন্দু প্রধান রাষ্ট্র, অতএব তার এ তত্ত্ব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং হিন্দু-মুসলিম সৌহার্দ্য বিনষ্ট হতে থাকে। এরই এক পর্যায়ে মুসলমানরাও পৃথক আবাসভূমির দাবীতে সোচ্চার হয়, যার পরিণতিতে ভারত বিভক্ত হয় এবং ক্রমে ক্রমে ভারতের মুসলিম, শিখ ও হিন্দু সম্প্রদায় পরস্পরের প্রতি বিদ্বেষী হয়ে ওঠে এবং ১৯৪৬ ও ১৯৪৭ সালে বিপুল সংখ্যক মানুষের রক্তের উপর দিয়ে দুটি দেশ স্বাধীন হয়। গান্ধী যদিও শেষ পর্যন্ত ভারতকে এক রাখার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু কংগ্রেস নেতারা তাকে নানাভাবে বাধাগ্রস্থ করেন। স্বাধীনতার কয়েক মাস পর তাকে হত্যা করা হয় এবং তাকে হত্যার চক্রান্তে জড়িত থাকার পেছনেও সাভারকর ছিলেন বলে অভিযোগ ওঠে এবং তাকে গ্রেফতার করা হয়। অবশ্য পরবর্তীতে তাকে এ অভিযোগ থেকে মুক্ত করা হয়েছিল। গান্ধীকে যখন হত্যা করা হয়, তখন তিনি অনশন করছিলেন মূলত মুসলমানদের হত্যা ও বিতাড়ন, তাদের সম্পত্তি দলের বিরুদ্ধে এবং পাকিস্তানকে তাদের পাওনা পরিশোধ করার দাবীতে। তিনি তখন ভারত বিভাগ মেনে নিয়েই তাঁর দাবী উত্থাপন করেছিলেন। কিন্তু উগ্র হিন্দুরা তাঁর এই দাবীতেও নাখোশ ছিল বলেই তাঁকে হত্যা করেছে।
জহিরুলঃ হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বিবিসি-জরিপের এই ফলাফল জেনে কবি নির্মলেন্দু গুণ কষ্টে কেঁদেছিলেন, কবি সালেম সুলেরী একদিন এক আড্ডায় এই কথা জানান। গুণ দা’র বিচারে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। বিষয়টি খুব স্পর্শকাতর চিন্তা করে পুনরায় নিশ্চিত হওয়ার জন্য সালেম সুলেরীর সাথে যোগাযোগ করি। প্রসঙ্গটি উত্থাপন করলে তার কোনো আপত্তি আছে কি-না জানতে চাই। তিনি লিখিতভাবে জানান, ‘না, আপত্তি নেই, কারণ ঘটনা সত্য। তারিখটি ২০০৪-এর ১৮ আগস্ট। গুণ'দা বলেছিলেন, কবিরা শুদ্ধতাবাদী। রাজনীতিকরা মানুষ হত্যায় জড়িত থাকেন। কবিরা মানুষ হত্যা করে না বিধায় শ্রেষ্ঠত্ব তাদের। কবির পরাজয়ে তিনি তিনদিন স্বস্তিমতো ঘুমাতে পারেননি। কথাগুলো বলেন তোপখানা রোডস্থ সাদাকালো, নিউজব্যাংক অফিসে’। শ্রেষ্ঠ বাঙালি বিষয়ে আপনার বক্তব্য কি? এবং প্রসঙ্গত বঙ্গবন্ধুর অবদান সম্পর্কে আপনার মূল্যায়নও জানতে চাই।
মঞ্জুঃ বিবিসি একটি গণমাধ্যম। একটি গণমাধ্যমের সার্টিফিকেটের আগে শেখ মুজিবুর রহমানকে কেউ হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে চিহ্নিত করেনি। অর্থ্যাৎ বিবিসি যদি তাদের পরিচালিত জরিপ ফলাফলের ভিত্তিতে এই সার্টিফিকেট না দিতো, তাহলে তিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি হতেন না। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যে অবদান রেখেছেন, দেশের প্রতি ভালোবাসার কারণে সপরিবারে জীবন দিয়েছেন, বাংলাদেশের মানুষ তাঁকে তাদের মনে স্থায়ী স্থান দিয়েছে, জাতির পিতার আসন দিয়ে সম্মানের মুকূট পরিয়েছে – এর চেয়ে বড় সম্মান আর কী হতে পারে! তাঁর অবদানকে কেউ অস্বীকার করে না। এখন বিবিসি যদি নতুন করে একই বিষয়ের ওপর আরেকটি জরিপ পরিচালনা করে, অথবা ভয়েস অফ আমেরিকার মতো গণমাধ্যম একটি জরিপ চালায় এবং ফলাফল ভিন্নরকম আসে, তখন কী শেখ মুজিবের শ্রেষ্ঠত্বের স্থান পরিবর্তিত হবে? অতএব কোনো প্রতিষ্ঠানের সার্টিফিকেট চূড়ান্ত নয়। অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বিবিসি শ্রেষ্ঠত্বের আসন না দেয়ার কারণে কবি নির্মলেন্দু গুণ যদি কষ্ট পেয়ে কান্নাকাটি করেন সেটিও যৌক্তিক হতে পারে না। মানুষ সম্মানিত হয় তাঁর কর্ম ও অবদানের কারণে। যারা মানুষের জন্য, দেশ ও সমাজের জন্য অবদান রাখেন তারা কখনো বাড়তি সম্মান পাওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করেন না। তারা কাজ করেন তাদের ভেতরের তাগিদ থেকে। জোর করে, দাবী জানিয়ে সম্মানিত হওয়া যায় না।




ধন্যবাদ কাজী জহিরুল ইসলাম এমন একটি সাক্ষাৎকার নেবার জন্য। আর আনোয়ার হোসেইন মন্জুকে প্রাণঢালা অভিনন্দন তার চিন্তা-ভাবনার সাথে যৌক্তিক বিশ্লেষণের জন্য। প্রতিটি প্রশ্নের উত্তরে তিনি অসাধারণ যুক্তি দিয়েছেন। বিশেষ করে ভারত বিভক্তির জন্য আমি মওলানা আবুল কালাম আজাদের বইটিকেই অথেনটিক বিবেচনা করি। তিনি দুই টার্মে কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন, যখন ভারতের স্বাধীনতা বিষয়ে রাজনৈতিক আলোচনা ও আন্দোলন চলছিলো। তার পক্ষেই অধিক জানা ও বোঝা সম্ভব ছিলো ভারত বিভক্তির মূলে কারা সোচ্চার ছিলেন। মন্জু দেখলাম আজাদের ধার ধারেননি, আরো নতুন নতুন তথ্যে তিনি সাজিয়েছেন তার উত্তর। হিন্দুত্ববাদিরা যে চাইছিলেন হিন্দুরাষ্ট্র কায়েম করতে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। শেষ পর্যন্ত জিন্নাহ অখন্ড ভারতের স্বাধীনতাই মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু গণপরিষণের সিংখ্যাগরিষ্ঠের নেতা হিসেবে যখন জওহর লাল নেহরু সংবাদ সম্মেলন করে বললেন যে তারা পরিষদের অধিবেশনে যে সিদ্ধান্ত নেবেন, সেটাই বাস্তবায়ন করা হবে। তার এই প্রেস কনফারেন্সের পর মুসলিম লিগের নেতারা দেখলেন তারা আবারো হিন্দুত্ববাদিদের রাজনৈতিক শিকারে পরিণত হতে যাচ্ছেন। তারা সম্মেলন করে তাদের অখন্ড ভারতের স্বাধীনতার চেয়ে দুটি রাষ্ট্রের পরিকল্পনায় আবোরো উপনীত হলেন। এটা ঠিক যে জিন্নাহকে ঠেলে দেয়া হয়েছিলো পাকিস্তানের দাবি পুনরায় নেয়ার জন্য। দ্বিজাতিতত্ত্ব তো হিন্দুদের মন ও মনন থেকে জাত হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে বা অন্য কোথাও হিন্দুত্ববাদিদের এই অপকর্মকে হাইলাইট করা হয় না। উল্টো জিন্নাহকে দায়ী ও দোষী সাব্যস্ত করা হয়।
ReplyDeleteতথ্যসমৃদ্ধ পুরো সাক্ষাৎকারটি পড়ে মোহিত ও শিহরিত হলাম। দুয়েক জায়গায় আমার দ্বিমত থাকলেও পুরো সাক্ষাৎকারটি ভালো লেগেছে। দ্বিজাতি তত্ত্বের দায়ভার মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর উপর চাপানোর অপচেষ্টা এখানে খানিকটা হলেও খর্ব হয়েছে এবং প্রকৃত তথ্য অনেকটাই নিখুঁতভাবে উঠে এসেছে। অনেক ধন্যবাদ।
ReplyDelete